Monday, October 26, 2015

মাজালিসে মুশফিক আহমেদ রহঃ (Compilation of Bayanats From: https://mushfiqsir.wordpress.com/)

Video at YouTUBE   
Audio Link


TOPICS



وَالَّذِينَ اسْتَجَابُوا لِرَبِّهِمْ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَأَمْرُهُمْ شُورَى بَيْنَهُمْ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنفِقُونَ
যারা রবের ডাকে সাড়া দিল, নামায কায়েম করল, মাশওয়ারার মাধ্যমে কাজ সমাধা করল আর আল্লাহ তাআলা যা দিয়েছেন তা থেকে দান করল। [সুরা আস শুরা আয়াত ৩৮]
আল্লাহতাআলা মাশওয়ারাকে নামায এবং যাকাতের মাঝখানে বলেছেন আর ঈমানের সাথে জড়িত করেছেন। তো মাশওয়ারা ঐসব আমলের মধ্যে যেগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর ডাকে যে সাড়া দিল তা প্রমাণিত হয়। এর দ্বারা আমলের গুরুত্ব বুঝায়। এটা কত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যে আল্লাহতাআলা ঈমানের সাথে জড়িত করেছেন। যদিও এই কথা বলা হয়নি, যে মাশওয়ারা করেনা সে মু’মিন নয়, কিন্তু ঈমানের সাথে জড়িত করার মাধ্যমে ঐ ধরনের একটা আভাস আছে। যে ঈমান আনল, সে নামায পড়ল। অনেক ফক্বিহর মতে যে নামায পড়ল না, সে ঈমান আনেনি। তো মাশওয়ারাও ঐসমস্ত আমলের মধ্যে যেহেতু নামায আর যাকাতের মাঝখানে।
আবু বকর সিদ্দীক রাঃ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরে যখন অনেকেই যাকাত দিতে অস্বীকার করল, আবু বকর সিদ্দীক রাঃ তাদের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে চাইলেন। কেউ কেউ আপত্তি করলেন যে ইসলাম তো তারা অস্বীকার করেননি। নামায তো পড়ছে। আবুবকর সিদ্দীক রাঃ তার উত্তরে বললেন যে ‘আল্লাহ তাআলা নামায ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করেননি’। তো নামায না পড়লে যেমন তার উপর কিতালের হুকুম হয়, ঐ দলীল থেকেই আবু বকর সিদ্দীক রাঃ যাকাত অস্বীকারকারিদের কিতালের হুকুম দিয়েছেন। কারণ যাকাত এবং নামাযকে একস্তরে রাখা হয়েছে। আর এই আয়াতে আল্লাহ তাআলা মাশওয়ারাকে এই দুটোর মাঝখানে রেখেছেন। এর ভিতরেও এক ধরনের একটা ইঙ্গিত আছে যে, যাকাত, নামায যে স্তরের আমল, মাশওয়ারাও ঐ স্তরের আমল। কয়েকটা কথা যখন একস্তরে বলা হয় যেমনঃ কেউ এই কথা বলবে না জামা-গরু-টুপি, বরং বলবে জামা-কাপড়-টুপি। আর নামায ও যাকাত দুটোই ইবাদত। এই দুটোর মাঝখানে মাশওয়ারাকে উল্লেখ করা হয়েছে।
মাশওয়ারাকে জাহেরিভাবে ইবাদতের মেজাজের মধ্যে অনেকেই দেখে না। কারণ মাশওয়ারা এমন একটা আমল যে যারা আবিদ নয়, যাদের ইবাদতভিত্তিক জীবন নয়, তারাও বিভিন্ন কারণে মাশওয়ারা করে। নামায পড়ে না কিন্তু মাশওয়ারা করছে, মুসলমান নয় কিন্তু মাশওয়ারা করছে। মাশওয়ারা নামে না করলেও আলোচনা আছে, বিবেচনা আছে, চিন্তা-ফিকির আছে। তো সেই হিসেবে যেহেতু দুনিয়াদাররা করে, তাই ইবাদতের মধ্যে অনেক সময় গণনা করা হয়না। অথচ আল্লাহতাআলা দ্বীনের যত আহকাম দিয়েছেন সবগুলোকেই ইবাদতের মেজাজ নিয়ে করা। ইবাদতের মেজাজ নিয়ে করা ও এমনি থেকে একটা কাজের মেজাজ নিয়ে করার মধ্যে পার্থক্য হলো যে দুনিয়াবী একটা কাজ যখন কেউ করে, তখন ঐ কাজ থেকে একটা যৌক্তিক পরিণতি আশা করে। আর ইবাদতের মেজাজ হল কাজ থেকে যেমন সরাসরি ফায়দা আশা করা হয়, ঐরকম আশা করেনা। বরং ইবাদতকে আল্লাহর কাছে কবুল করাতে চেষ্টা করে, আর আল্লাহ যদি এই ইবাদত বা আমলের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান তাহলে আল্লাহ দিবেন।
ব্যাপারটা উদহারণ দিয়ে পরিস্কার করি। ধরা যাক কেউ রেস্টুরেন্টে রান্না করে আর ভাল রান্না করবার চেষ্টা করে। ভাল রান্না করে মানুষকে খাওয়ায়। রেস্টুরেন্টে ও যে ভাল রান্না করে মানুষকে খাওয়ায়, ঐটা বিক্রি করে সরাসরি ঐখান থেকেই লাভ আশা করে। অপর একজন, সেও ভাল রান্না করবার চেষ্টা করছে আর তার কোন প্রিয় মেহমানকে খাওয়াচ্ছে। সেও ফায়দা হাসিল করে। কিন্তু ঐ রান্নার বিনিময়ে টাকার ফায়দা নয়। এটার মাধ্যমে তার প্রিয়জনের সন্তুষ্টি অর্জন করার চেষ্টা করে। সে যদি সন্তুষ্ট হয় তাহলে কি হল সেটা ভিন্ন প্রসংগ বা বড় একটা অংশ অপ্রাসঙ্গিক হতে পারে। কেউ জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি মেহমানকে এত যত্ন করে যে খাওয়াচ্ছ, তো কি চাও? সে বলল ‘আমি উনার সন্তুষ্ট চাই, উনাকে খুশ করতে চাই’। জিজ্ঞাস করল, ‘উনার খুশ হলে তোমার কি লাভ’। অনেকের কাছেই এই প্রশ্ন একেবারেই অবাস্তব মনে হবে। তো সন্তুষ্ট হলে কি লাভ-এটা কোন প্রশ্ন হল। সন্তুষ্ট হলে আবার লাভ কি হবে, আমি শুধু সন্তুষ্ট করতে চাই। আমার ছেলে, আমার বাপ, আমার স্বামী, আমার স্ত্রী, আমার ভাই, আমার বোন আমার সাথে একটা সম্পর্ক আছে তাই তাদের সন্তুষ্ট চাই। আমার বাপকে আমি খাওয়ালাম, আমার বাপ যদি সন্তুষ্ট হয় তাহলে ঐটাই আমাকে ভাল লাগবে। আমার ছেলে ছুটিতে এসেছে, ওকে আমি খাওয়ালাম। ছেলে যদি মজা করে খায় তাহলে ঐটাই আমার কাছে ভাল লাগবে। এই কথাও সত্য যে যাকে সন্তুষ্ট করা হয় বিভিন্নসময় বিভিন্নভাবে তার কাছ থেকে ফায়দা আসে। কিন্তু সে সরাসরি ফায়দার জন্য করছে না। ঐটা অন্যভাবে আসে। ইবাদতের মেজাজও ঐরকমই যে আল্লাহ তাআলা দিবেন। কিভাবে দিবেন ঐটার কোন যৌক্তিক সম্পর্ক নেই।
وَأْمُرْ أَهْلَكَ بِالصَّلَاةِ وَاصْطَبِرْ عَلَيْهَا لَا نَسْأَلُكَ رِزْقًا نَّحْنُ نَرْزُقُكَ وَالْعَاقِبَةُ لِلتَّقْوَى
‘আপনি আপনার পরিবারের লোকদেরকে নামাযের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন। আমি আপনার কাছে কোন রিযিক চাই না। আমি আপনাকে রিযিক দেই এবং আল্লাহ ভীরুতার পরিণাম শুভ’
সুরা ত্বোয়া-হাঃ ১৩২
ওলামারা বলেন যে এই আয়াতের মধ্যে নামাযের উপর রিযিকের ওয়াদা আছে। তো নামায তো এমন ধরনের জিনিস নয় যে বিক্রি করে টাকা পাওয়া যায়। আর নামায পড়লে যে রিযিক আসবে-কোন ধরনের কোন যৌক্তিক সম্পর্ক দেখা যায় না। যদি বলা হত যে বীজ বপন কর-রিযিক আসবে, তো এই কথা বুঝা যায় যেহেতু বীজ বপনের সাথে রিযিকের একটা সম্পর্ক আছে। কিন্তু নামাযের সাথে রিযিকের কি সম্পর্ক? কোন সম্পর্কই তো দেখা যায় না। কিন্তু আল্লাহ তাআলা দিবেন। হাকীকত হচ্ছে, ঐ নামায থেকে আসবে না, নামাযকে আল্লাহ যদি কবুল করেন তবে আল্লাহ দিবেন। যেরকমঃ গাছ থেকে তো সরাসরি ফলই আসে, জাহেরীভাবে তাই দেখা যায়। ওখানে যে আল্লাহ দিচ্ছেন তো এই কথা দেখা যায় না। একজন কাফিরও সেইজন্য গাছ লাগায়। এই আম কোথায় পেয়ছে? ‘গাছে পেয়েছি’। ঈমানদাররাও সবসময় এই কথা বলেনা যে আল্লাহতাআলা দিয়েছেন। বরং বলে এই গাছের ফল। কিন্তু নামাযে তো ওটা দেখা যায়না। এমন না যে নামায পড়লাম আর ওখান থেকে ফল-টল পেল। আসলে ইবাদতের মেজাজ হচ্ছে যে আল্লাহ যদি কবুল করেন তাহলে দিবেন।
তো মাশওয়ারাও ঐরকম একটা আমল যে আল্লাহ যদি কবুল করেন তাহলে আল্লাহ তাআলা ঐখান থেকে ফায়দা দিবেন। আর যদি কবুল না হয় তাহলে কোন ফায়দা আসবে না। গাছ লাগালাম, তো জাহেরীভাবে আল্লাহর কাছে কবুল হোক আর না হোক, বড় হলে তো ফল ধরবেই। আর কবুলিয়্যাতের চিন্তা করেনা। তো যে আল্লাহর উপর বিশ্বাস করেনা সেও গাছ লাগায়, আর সেও ফল পায়। কিন্তু নামাযের ব্যাপারে এই চিন্তা করেনা। যেই নামায পড়ছে সে কোন না কোন ভাবে কবুলিয়্যাতের চিন্তা তার মধ্যে আছে। নইলে সে পড়তোই না। আর সেজন্য একেবারে মোটেই দ্বিনদার লোক নয়, একজন মদখোর, কিন্তু যদি এক-আধবার নামায পড়েও, তো অযু করে নিয়্যত করেই নামায পড়ে। এজন্য যে সেও একথা জানে যে পড়ছিই যখন তো কবুল হওয়ার জন্যই পড়ি। বিনা অযুতে যদি পড়ি, বিনা নিয়্যতে যদি পড়ি তো কবুলিয়্যাত হবে না। পড়লাম তো কবুল করার জন্যই পড়লাম। কিন্তু এই কথা সে গাছ লাগানোর ব্যাপারে, বীজ বপন করার ব্যাপারে চিন্তা করবে না। গাছ লাগাচ্ছি, গাছ লাগালে ফল পাব। তো ইবাদতের মেজাজ হচ্ছে ঐরকম।
কথা হচ্ছে মাশওয়ারার সম্বন্ধে। মাশওয়ারাকেও ইবাদতের মেজাজে করা যেন আল্লাহ যদি কবুল করেন, তবে এখান থেকে ফায়দা দিবেন। ইবাদতের আলামত। আল্লাহ তাআলা দুই ইবাদতের মাঝখানে, নামায ও যাকাত ইবাদতের বড় রুকুন, তো দুই রুকুনের মাঝখানে মাশওয়ারাকে উল্লেখ করেছেন। এখানে একটা ইংগিত যে এটাকে ইবাদতের মেজাজে করা। যদিও দুনিয়াররা, বেঈমানরা, বেদ্বীনরা মাশওয়ারা করছে। ডাকাতও ডাকাতি করার আগে মাশওয়ারা করে, চোররা চুরি করতে যাওয়ার আগে মাশওয়ারা করে কোন বাড়িতে যাবে, কোন পদ্ধতিতে চুরি করবে। কিন্তু এই মাশওয়ারা যে সে করছে, এই কথা সে কখনো চিন্তা করেনা তাতে সে মুসলমান হোক, হিন্দু হোক আর ডাকাত হোক যে আল্লাহ তাআলা আমার মাশওয়ারাকে কবুল করবেন কিনা। মাশওয়ারা করছে, কিন্তু কবুলিয়্যাতের প্রশ্ন আসছে না। কিন্তু ঈমানদার যখন মাশওয়ারা করবে তখন তার মধ্যে এই চিন্তা জরুর থাকা চাই যে আমার এই মাশওয়ারা যে করছি, এই মাশওয়ারা আল্লাহর কাছে মকবুল হবে কিনা। আর একে মকবুল বানাবার চেষ্টা করা, চিন্তা ফিকির করা। এইভাবে মাশওয়ারা করা যেন আল্লাহ তাআলা একে কবুল করেন। আল্লাহ যদি কবুল করেন তো আল্লাহ তাআলা এখান থেকেই ফায়দা দিবেন। আর আল্লাহ যখন কোন ফায়দা বের করেন, তখন তার কখন বা কি ফায়দা আসবে মানুষ তা চিন্তাও করতে পারেনা। কেউ একটা কথা বলল আর তার কি ফায়দা হতে পারে, কি লোকসান হতে পারে মানুষ চিন্তা করে না। একটা কথা বলল আর চিন্তাও করেনি অথচ এই কথাটায় বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। আবার আরেকটা কথা বলেছে আর চিন্তাও করেনি অথচ বিরাট ফায়দা হয়ে গেছে।
১৪০০ বছর পূর্বে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বলেছেন। এখন যেসব ফায়দা বের হচ্ছে সেসব কথা থেকে তার বেশিরভাগ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জানা ছিলনা। কিন্তু আল্লাহতাআলা ফায়দা বের করছেন। এছাড়াও আরো দ্বীনদার লোকেরা, আল্লাহওয়ালারা, ওলামারা দ্বীনের বিভিন্ন মেহনত করে গেছেন। তারা মেহনত করেছেন একটা জিনিসকে সামনে রেখে আর আল্লাহতাআলা এরচেয়ে বহুত বেশি ফায়দা দান করছেন।
আল্লাহর রাসূল এক সফরে ছিলেন। সফরেই একটা ঘোড়া কিনলেন। ঘোড়া মালিকের কাছে হাতে রয়েছে। আর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টাকাও দিলেন। কিন্তু কেনাবেচা কথায় হয়ে গেছে। এটা আমি কিনলাম, এটা আমি বেচলাম, কিন্তু হস্তান্তর হয়নি। সফর চলছে। কিছুদুর যাওয়ার পরে আরেক লোক এসে ঐ ঘোড়ার দামাদামি করতে লেগেছে আর সে ভাল দাম দিচ্ছে। ঘোড়ার বিক্রেতা যে, তার নিয়্যত বদলে গেছে। সে রাসূলে সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন যে আপনি কি কিনবেন নাকি বিক্রি করে দিব? রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমিতো কিনে নিয়েছি’। উনি বললেন, ‘না, কিনেননি’। । তো যখন মতৈনক্য হয়ে গেল, স্বাক্ষী পাবে কোথায়? তো খুযায়মা রাঃ একজন সাহাবী, উনি স্বাক্ষ্য দিলেন। উনি স্বাক্ষ্য দিলেন যে, ‘আমি স্বাক্ষী যে আপনি ঘোড়া কিনেছেন’। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কথার উপর ফায়সালা করে দিলেন যে, ‘তুমি স্বাক্ষী’। কিন্তু দুই স্বাক্ষী লাগবে, এক স্বাক্ষী পাওয়া গেল। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাও ফায়সালা করে দিলেন যে ‘খুযায়মার স্বাক্ষ্য দুই স্বাক্ষীর সমান’। প্রসংগ আপাতত ঘোড়ার শেষ হয়ে গেল, আর ঘোড়ার ব্যাপারেই ছিল।
রাসূল করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরে আবুবকর সিদ্দীক রাঃ এর জমানায় কুরআন শরীফের সংকলন হচ্ছে আর নিয়ম বানানো হয়েছে যে যার কাছে যে আয়াত লিখা আছে সে ওটা নিয়ে আসবে আর প্রত্যেক আয়াতের সমর্থনে দুই স্বাক্ষী লাগবে। খুযায়মা রাঃ যখন আয়াত নিয়ে এলেন, দ্বিতীয় স্বাক্ষী নাই। সুরা তওবার শেষের আয়াত।
لَقَدْ جَاءكُمْ رَسُولٌ مِّنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِالْمُؤْمِنِينَ رَؤُوفٌ رَّحِيمٌ فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُلْ حَسْبِيَ اللّهُ لا إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ
বহুত ফযিলতের আয়াত। বড় বড় ফযিলতের ওয়াদা আছে এই আয়াত পড়ার উপর। তো খুযায়মা রাঃ ঐ আয়াতের ব্যাপারে স্বাক্ষ্য দিলেন। যায়েদ ইবনে সাবিত রাঃ ফায়সালা করলেন যে, ‘খুযায়মা রাঃ এর সম্বন্ধে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন তার স্বাক্ষ্য দুই স্বাক্ষীর সমান’। সেই কথার উপর সিদ্ধান্ত নেওয়া হল। তো কোথায় ঘোড়ার কেনাবেচা আর কোথায় কুরআন শরীফের সংকলন। ওখানে এসে কথার ফায়দা পাওয়া যাচ্ছে। তো আল্লাহ তাআলা যখন কোন একটা কথা থেকে ফায়দা পৌছাতে চান, কোথায় ফায়দা পৌছাবেন আল্লাহতাআলায় বেহতার জানেন। ঐটা তখন হবে যখন আল্লাহতাআলা কবুল করবেন। কবুল যদি করে নেন, তো বহু দূর দূর ফায়দা পৌছাবেন যা একজন মানুষ ধারণাও করতে পারেনা।
হিন্দুস্তান-পাকিস্তান যখন ভাগ হয়ে গেল, হিন্দুস্তান থেকে মুসলমানরা পাকিস্তানের দিকে যাচ্ছেন। এদিকে হয়ত কিছু আসাম এগুলোর দিক থেকে কিছু পাকিস্তানে এসেছে, কিন্তু বাকি বেশিরভাগ দিল্লী ঐসব অঞ্চল থেকে ব্যাপকভাবে পাকিস্তানে এসেছে। আর বিরাট দাঙ্গা হয়েছে। নিজামুদ্দীনে হযরত মাওলানা ইউসুফ রহঃ ছিলেন, মাওলানা যাকারিয়্যা রহঃ ছিলেন আর প্রত্যেকদিনই বিশ-ত্রিশটা টিকিট কেউ নিয়ে আসত। এসে ইউসুফ রহঃ এর কাছে পরিবারসহ পাকিস্তান যাওয়ার জন্য বলতেন। হযরত ইউসুফ রহঃ এর একই উত্তর ছিল, ‘ভাইজান যে ফায়সালা করেন অর্থাৎ মাওলানা যাকারিয়্যা সাহেব রহঃ’। আর অবস্থা খুবই খারাপ, ভবিষ্যত আন্দাজ করাও মুশকিল। সব মুসলমান যদি চলে যায় তো হিন্দুস্তান মুসলমান শূন্য হলে এই মুলকে দ্বীনের কাজের কি হবে। তো মানুষজন টিকিট নিয়ে আসতেন। মাওলানা ইউসুফ রহঃ যাকারিয়্যা রহঃ এর দিকে ইংগিত করে বলতেন যে ‘উনি যা ফায়সালা করেন’। আর উনাকে যখন জিজ্ঞাস করতেন উনি চুপ থাকতেন বা বলতেন, ‘আমি একাই ফায়সাল করতে পারব না’।
তার জন্য একটা কথা ঝুলেই আছে, আর কোন ফায়সালা হচ্ছে না। কিছুদিন পরে সুযোগ হলো যাওয়ার, তো সাহারানপুর গেলেন। সাহারানপুরে একটা সুযোগ হলো, সাহারানপুরে মাওলানা মাদানী রহঃ এলেন আর রায়পুরী রহঃ এলেন। তিনজন মাশওয়ারায় বসলেন একটা কামরার ভিতরে। লম্বা মাশওয়ারা হলো। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত, যোহরের নামায পড়ে আবার। মাদানী রহঃ এর ভাই মাহমুদ মাদানী রহঃ, উনি মদীনায় ছিলেন, তৎকালীন সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। উনি বারবার করে বলছেন যে ‘আপনার (ইউসুফ রহঃ, জাকারিয়্যা রহঃ) জন্য আমি স্পেশাল টিকিট পাঠাচ্ছি, পরিবারসহ মদীনায় চলে আসুন। তো এরচেয়ে ভাল সুযোগ আর কি আছে। পরিবারসহ নিরাপদে থাকবে মদীনায়। তো এই ব্যাপারগুলো সামনে আছে। ফায়সাল তো মাদানী রহঃ এর ছিল। । আর এরপরে উনি ফায়সালা করলেন হিন্দুস্তানে থাকার।
তো এই মাত্র তিনজন মাশওয়ারা করলেন আর এই কথাকে আল্লাহতাআলা হিন্দুস্তানে ছড়িয়ে দিলেন। খুব দ্রুত এই কথা ছড়াল আর বেশুমার মানুষ যারা যাওয়ার ফায়সাল করেছিল, তারা ফায়সালা পরিবর্তন করলেন। তো তারা বাড়িতে ফিরে এলো। ইনারা ফায়সাল করছেন তাদের নিজেদের ব্যাপারে, তাদেরকে কেউ দায়িত্ব দেয়নি যে অন্যরা যাবে কি যাবে না তার ফায়সালা করো। তো নিজের ব্যাপারে ফায়সালা করছেন। কিন্তু এই ফায়সালা এত গুরুত্বপূর্ণ যে তখন তো বুঝায় গেল, আর পরে এখন বুঝা যাচ্ছে। কতবড় গুরুত্বপূর্ণ। যদি খোদা না খাস্তা হিন্দুস্তানে না থাকার ফায়সালা করতেন, সব হিন্দুস্তানের লোকের জন্য পাকিস্তান আর ইস্ট পাকিস্তানে জায়গাও হতো না, যেতেও পারতেন না। আর হিন্দুস্তানের কি অবস্থা যে হতো পরবর্তীতে মানে কল্পনাও করায় মুশকিল। কিন্তু মাত্র তিনজন লোক তাদের নিজেদের ব্যাপারে ফায়সালা করলেন যে ফায়সালায় আল্লাহতাআলা এত বড় বরকত দিলেন, মুসলমানদের উপর কত বড় ক্ষতি থেকে বাঁচালেন। কত হাজারও লাখো মুসলমান হিম্মত করে হিন্দুস্তানে থাকার ফয়সালা করলো। থাকলো আর এখন দ্বীনের মেহনত চলছে।
মাশওয়ারা যদি মকবুল হয়ে যায় আল্লাহতাআলা বহুত ফায়দা দিবেন কিন্তু শর্ত হচ্ছে সেটাকে মকবুল বানাতে হবে। একজন ব্যাক্তির জন্য নামায, মাশওয়ারা, যাকাত এই সবকছু শুদ্ধভাবে কবুল করাতে হলে তার নিজস্ব ইসলাহের প্রয়োজন। নামাযের মধ্যে যেরকম নামায পড়তে দাড়িয়েছি, এদিক ওদিক ধ্যান চলে গেল, মাশওয়ারার মধ্যে মাশওয়ারা করতে বসেছি কিন্তু মনে নানানধরনের টান চলে আসল। ধরা যাক, একটা প্রসংগ এলো। এটা রায় দিলে কার কি সুবিধা হবে, কার কি অসুবিধা হবে, আমার কি সুবিধা, ওর কি সুবিধা, ওকে আমি পছন্দ করিনা, সে আমাকে পছন্দ করেনা, আমি এই দলের দিকে যাব নাকি ঐ দলের দিকে যাব। তো এই সবকথাগুলো কিন্তু চলে আসবে, মানুষ তো। পছন্দ অপছন্দ, তার নিজের স্বার্থ, জামাতের স্বার্থ, পরের স্বার্থ, এই স্বার্থ ঐ স্বার্থ কত ধরনের জিনিস আছে। উচিত ছিল এইসবগুলো থেকে বেচে মাশওয়ারাকে শুদ্ধ রাখা।
তো মাত্র দুই রাকআত নামায ঠিকমত শেষ করতে পারিনা, মন এদিক ওদিক চলে যায়। অথচ কেউ নামায পড়ার সময় অন্য চিন্তা করার জন্য নামায পড়েনি। নামায পড়েছে আর নামায পড়ার জন্যই নিয়্যত করেছে। কখন তার চিন্তা অন্য দিকে চলে গেল সে নিজেই জানেনা। তো দুই রাকআত নামাযের ভিতর যদি আমি আমার নিজেকে সামলিয়ে না রাখতে পারি, তো মাশওয়ারার ভিতর কেমন করে সামলাবো। তো নামাযকে শুদ্ধ করতে যেরকম তার সম্পূর্ণ চিন্তা ফিকিরে আল্লাহকে সামনে রেখে পড়তে হবে, মাশওয়ারাও তাই। আর এজন্য সম্পূর্ণ মেহনতের প্রয়োজন।
নামাযের মধ্যে যেরকম মন যায়, তো যার নফস যেদিকে আছে ঐদিকেই যায়। নামায এখানে পড়ছে আর বাইরে কোথাও গান-বাজনা হচ্ছে, শব্দ আসছে। তো ঐ গানের রসিক সে যদি হয়, মন অলরেডি ঐদিকে চলে যাবে। আর যদি সে এটার সাথে বেশি সম্পৃক্ত হয়, তো দূর কোথাও অল্পটুকু শোনা যাচ্ছে, শব্দগুলো শোনাও যাচ্ছে না, কিছু মাঝে মাঝে ধ্বনি শুনা যায়। সেক্ষেত্রে বাকি শব্দগুলো ও নিজে থেকেই কল্পনা করে নিবে আর মনে মনে গান গাইবে। এদিকে নামাযও চলবে। আবার আরেকজন গান শুনতেই পাবেনা। তাকে জিজ্ঞাস করল যে ‘নামাযের মধ্যে যে বাজনা বাজছিল’, সে বলবে ‘কোথায় কি’। তার গানের দিকে খেয়ালই নেই। সেও যে বড় ওলিআল্লাহ তাও নয়। কিন্তু ওর খেয়াল নামাযের দিকে নয়, ওর খেয়াল অন্যদিকে। তার খেয়াল হচ্ছে সারের দাম কমলো না বাড়লো।
তো নফসের একেকজনের একেক দিকে টান আছে। মাশওয়ারার মধ্যেও এ টানগুলো খুব কাজ করবে। কে কোন রায় দিচ্ছে, কোন রায় হলে আমার সুবিধা, কোন রায় হলে আমার অসুবিধা, কোন ফয়সালা কি হওয়া চাই।
তো সচেতনভাবে, অবচেতনভাবে নিজের রায়কে ঐদিকে ঘুরাতে চাইবে। এজন্য মাশওয়ারাকে শুদ্ধ রাখা, শুদ্ধভাবে রায় দিতে পারা এটা তার নফসের ইসলাহের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। নামায শুদ্ধ রাখা যেমন তার নফস শুদ্ধ রাখার সাথে জড়িত, মাশওয়ারাও তেমন। আল্লাহ তাআলা আমাদের তৌফিক নসীব করুন। এইজন্য সম্পূর্ণ দ্বীনকে ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে আনা। আর বিশেষ করে নামাযের ভিতর শুদ্ধ করা। মাশওয়ারার ভিতর কোন দলাদলির দিকে না যাওয়া, এইটা একটা বড় গুরুত্বপূর্ণ মাসআলা। আর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের প্রথম মাশওয়ারাতে এটা পরিস্কার করে দিয়েছেন।
ইসলামের প্রথম মাশওয়ারা ছিল বদরের কয়েদীদের নিয়ে। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এদের ব্যাপারে রায় জিজ্ঞাস করলেন যে কয়েদীদের কি করা হবে। রায় জিজ্ঞাস করায় ছোট্ট একটি ভূমিকা ছিল ‘গতকাল তোমাদের ভাই, আজ তোমাদের হাতে বন্দী অর্থাৎ কুরাইশরা। তারা সব আত্মীয়। ‘গতকাল তোমাদের ভাই, আজ তোমাদের হাতে বন্দী, কি করবে’? আবু বকর সিদ্দীক রাঃ রায় দিলেন যে মুক্তিপণ নিয়ে তাদের ছেড়ে দেওয়া হোক। ওমর রাঃ রায় দিলেন ‘প্রত্যেককে তার নিকট আত্মীয়র হাতে সোপর্দ করা হবে আর সে তাকে কতল করবে’’। আরো অনেকে রায় দিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহ রাঃ রায় দিলেন জংগলের ভিতর ঢুকিয়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হোক। ওরকম বিভিন্ন ধরনের রায় ছিল। রাসূল কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঐ একই ভূমিকাসহ আবার প্রশ্ন করলেন, ‘গতকাল তোমাদের ভাই, আজ তোমাদের হাতে বন্দী, কি করা উচিত’। আবু বকর সিদ্দীক রাঃ আবার ঐ একই রায় দিলেন যে মুক্তিপণে ছেড়ে দেওয়া হবে। উমর রাঃ একই রায় দিলেন ‘প্রত্যেককে তার নিজের আত্মীয়র হাতে সোপর্দ করা হোক আর সে তাকে কতল করবে’। আবু বকর সিদ্দীক রাঃ যেভাবে রায় দিয়েছিলেন সেভাবে ফায়সালা হলো। উমর রাঃ কোন বোকা মানুষ না। কোন ধরনের কথার সাথে কি কি জড়িত তিনি জানেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই ভূমিকার মধ্যে একটা নির্দেশনা আছে। ‘গতকাল তোমাদের ভাই’ বলার মাধ্যমে নরম হওয়া, গতদিনের ভাইয়ের কথা মনে করিয়ে দিলেন। উমর রাঃ ঐভাবে রায় দিলেন।
আমরা জানি, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি আল্লাহর সন্তুষ্টির মাধ্যম। আর সাহাবারা বিভিন্ন সময় রাসূল সাঃ কে সন্তুষ্ট করতে চেয়েছেন। সাহাবী আবু মুসা আশআরী রাঃ ঘরে কুরান পড়ছিলেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন আর উনার কুরান শরীফ পড়া শুনলেন। সুন্দর পড়ছিলেন আর আল্লাহর রাসূল বেশ কিছু আগে থেকেই শুনছিলেন। উনি ঘরে যখন এলেন, তখন বললেন, ‘তুমি কুরান শরীফ পড়ছিলে আর আমি শুনছিলাম, খুব সুন্দর লাগছিল’। আবু মুসা আশআরি রাঃ বললেন, ‘ইয়া রাসূলুল্লাহ, যদি জানতাম আপনি শুনছেন, তাহলে আমি আরো সাজিয়ে পড়তাম’। প্রশ্ন হলোঃ ইখলাস থাকলো কই? আমি আরও ভাল করে পড়তাম এই কথার দ্বারা ইখলাস থাকলো কোথায়?
ইখলাস আছে দুই কারণে। একটা হলো রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি, ঐটা ঈমানের সাথে জড়িত। ঐটা অন্য মানুষের সন্তুষ্টির মত না। আরেক হলো, অন্য মানুষকেও যদি সন্তুষ্ট করা হয় আল্লাহর ওয়াস্তে, তাহলে সেটাও ঠিক আছে। আর রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টি আল্লাহর ওয়াস্তেই করা হয়। তাই রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সন্তুষ্টিতে ইখলাস নষ্ট হয়নি। কিন্তু বদরের বন্দীদের ব্যাপারে উমর রাঃ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মাশওয়ারাতে কেন সন্তুষ্ট করতে চাইলেন না? এই জায়গায় মাশওয়ারা ঐ ময়দান নয়। অন্যান্য ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম হচ্ছে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পছন্দ, রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মত করে করা। এমনকি চিন্তা, ভিতরের চিন্তাও যেন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মত হয়। কিন্তু মাশওয়ারাতে নিজের মত করে করা। আমি যেটাকে শুদ্ধ মনে করছি ঐটাকেই পেশ করতে হবে। এখানে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেটাকে পছন্দ করছেন, ঐটাকে না। ঐটা মাশওয়ারায় না। এমন না যে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বললেন, আমিও তাই বলি। বরং মাশওয়ারা হচ্ছে নিজের মত, নিজের চিন্তাকে পেশ করা।
মাশওয়ারাতে যখন কেউ অন্যের মত রায় দেয় বা অন্যের কোন সন্তুষ্টি চায়, ঐটায় মাশওয়ারাকে নষ্ট করে। দ্বীনি মাশওয়ারা আর দলীয় মাশওয়ারা, পার্টি-টার্টির মৌলিক পার্থক্য এটাই। দ্বীনি মাশওয়ারাতে প্রত্যেকে তার নিজস্ব রায় দিবে এবং নিজে যেটাকে শুদ্ধ মনে করবে। আর দলীয় মাশওয়ারা হচ্ছে যে তার দলের সাথে সুর মিলানো।
আর দলের মধ্যেও দলের যে প্রধান, তার সাথে সুর মিলানো। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে বেশি প্রধান আর কে হতে পারে। তো রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের প্রথম মাশওয়ারাতেই এই কথাকে সাফ করে দিলেন যে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রায় বা মতের সাথে না মিলানো। কোন মাশওয়ারাতে কেউ অন্য একজনের সাথে, বিশেষ করে যার গুরুত্ব আছে, যার কোন প্রাধান্য আছে এর সাথে যদি তার সুর মিলালো, ঐখানেই সে খেয়ানত করলো। সে মাশওয়ারার সওয়াব তো পাবেই না, বরং আমানতের খাইন হিসেবে পরিগণিত হবে। আর ঐ জায়গায় তখন দলীয় বিবেচনা ঢুকবে। তখন ঐটা দ্বীন আর থাকবে না, ঐটা দলবাজি হয়ে যাবে। বড় গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য।
অন্যের সাথে মিলানো যায় খাতির করার ক্ষেত্রে। খাতির করার ব্যাপার এগুলো দ্বীনের মধ্যে আছে, কারো সম্মানে খাতির করা। মাশওয়ারা ঐ ময়দান নয় যেখানে কোন বড় কারো খাতির করতে হবে। অবশ্য মাশওয়ারাতেও খাতির করা যায় অন্যভাবে। ধরা যাক একজন দুর্বল ব্যাক্তি, নতুন এসেছে, রায় দিতে সাহস পায় না। তাকে আপন করে নেওয়া, জুড়ে নেওয়া। সে একটা রায় দিল, যে রায়ে হাসাহাসি হতে পারে। তো তার মন ভেংগে যাবে, লজ্জা পেয়ে যাবে, তখন তাকে সাহস দেওয়ার জন্য ‘ভাই, উনি খুব সুন্দর কথা বলেছেন’। আর তার সাথে মিলিয়ে নিজেও তার কথা সমর্থন করলো, ফায়সালাও হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এগুলো হবে মৌলিক বিষয়ে না।
ইজতিমার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সব আলোচনা হচ্ছিল। নতুন একজন এসে বললো যে, “একটু তরমুজ খাওয়ালে ভাল হয়”। এমন সময় কথাগুলো বলল যে ঐসময় গুরত্বপূর্ণ মাশওয়ারা হচ্ছিল। একেবারে বেচারা লজ্জিত। কিছু কিছু লোক তার দিকে তাকাচ্ছে। আর সেও বুঝতে পারল ‘আমি খুব বড় বোকামী কাজ করেছি’। খুব লজ্জা পেল। সেইসময় কয়েকজন মুরব্বী বললেন যে, ‘হ্যা হ্যা, কথা তো ঠিক। অনেক লোকজন এসেছে আর আরো আসবে। খাতির টাতির না করলে তো হয় না। তো একজন লোক বেচারা যেন লজ্জা না পেয়ে যায়, তাকে সামলাবার জন্য একটু সময় খরচও হলো, তরমুজ খাওয়ার ফায়সালাও করে দিলেন। কিন্তু মৌলিক কোন বিষয়ে নয়। আর এটা নতুন লোকের জন্য। পুরনোদের ব্যাপারে এরকম না। জিম্মাদার কারো সাথে রায় মিলানো, এটা খেয়ানত। আল্লাহতাআলা আমাদের সহীহভাবে মাশওয়ারা করার তৌফিক নসীব করুক। আর এজন্য নিজের দ্বিলকে পাক করা, নিজের জজবাকে পাক করা। কারো সন্তুষ্টি, মাশওয়ারাকে উপলক্ষ্য না বানানো যে আমি একটা রায় দিয়ে উনার কাছে প্রিয় হয়ে যায়। বড় গলদ জিনিস হবে যে মাশওয়ারাকে উপলক্ষ্য করে আমি অন্যের প্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছি। বড় খেয়ানত হবে। আল্লাহ আমাদের আমানতদারীর সাথে আমল করা তৌফিক নসীব করুন।
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ
(মাজালিসে মুশফিক আহমেদ রহঃ)
বয়ানটির pdf ফাইল পেতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন
https://www.mediafire.com/?bue48c1apngbbba

গত রমযানের আগের রমযানে আমার এক ভাগ্নে ইন্তিকাল করেছে। তার আগে ও অসুস্থ ছিল। হসপিটালে, অবস্থা খুব খারাপ, অবনতি হচ্ছে। ঐ সময় ওর অবস্থা যখন খুব খারাপ, ওর বোন স্বপ্নে তার মাকে বলছে, যিনি আগে ইন্তিকাল করেছেন মানে আমার বোন। আর স্বপ্নের মধ্যে ওর বোন বলল যে, অবস্থা খুব খারাপ, অসুস্থ ইত্যাদি। ওর মা একথা শুনে মোটামাটি কোন গুরুত্বই দিল না, স্বপ্নের ভিতরে।
এটাই হওয়ার কথা। দুনিয়াতে যেসব জিনিস অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন জাহেরী জগতে, গায়েবী জগতে ঐটার কোন গুরুত্বই নাই। আর গায়েবের জগতে যেগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, জাহেরী জগতে কোন গুরুত্বই নাই। দুনিয়ার জগতে কারো বাদশা হওয়া বহুত বড় ব্যাপার, আর ফকির হওয়ার তার একেবারে বিপরীত অবস্থা। আখিরাতে গেলে হয়তো দেখা যাবে তার উল্টো, ফকির হলেই সুবিধা, মানসম্মানও বেশী। আর রাজাবাদশাদেরই মুসীবত। সব উলট-পালট হয়ে যাবে। এখানে যেটা বড়, ওখানে সেটা ছোট। এখানে যেটা ভাল, ওখানে ঐটা মন্দ। তো এই ভাল মন্দের পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার কারণে যার কাছে আখিরাত চোখের সামনে, তার সবকিছু দেখাও ঠিক, কারণ মানুষ জাহেরীভাবে দেখে চোখ দিয়ে, কিন্তু আসলে সে তার মন দিয়ে দেখে।
এক জানাযা যাচ্ছে। জানাযা দু’জন দেখল, একজন এই দুনিয়ার চিন্তার মধ্যে আছে, আর আরেকজন আখিরাতের চিন্তার মধ্যে আছে। দুনিয়ার চিন্তার মধ্যে যে আছে, এই জানাযা দেখে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করবে যে এই লোকটা কে? পিছনে তার পরিচয় কি? সম্পত্তি কি কি রেখে গেল, ছেলেদের কি আছে, ওদের ভাগ বাটোয়ারা কেমন হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এই লাইনেই জিজ্ঞেস করে। পত্রিকায় দেয়ও কি কি রেখে গেছে। পত্রিকায় সাধারণত সন্তানের কথা লিখে; (কিন্তু) কি সম্পত্তি রেখে গেছে এগুলো একটু লজ্জা করে লিখেনা, কিন্তু আনঅফিসিয়ালি ওগুলো আলোচনা করে। জমিজমা, বাড়ি, কি কি রেখে গেছে ইত্যাদি।
ঐ জানাযা দেখেই আখিরাতমুখী যে, তার মনে কোন প্রশ্নই জাগল না যে কি রেখে গেছে। তার মনে প্রশ্ন হল যে কি নিয়ে গেছে। ওখানে থাকবার জন্য সে কি সম্পদ নিয়ে যাচ্ছে। তো একজন ভাবছে কি সম্পদ রেখে গেল আর আরেকজন ভাবছে কি সম্পদ সামনে নিয়ে গেল। দেখছে একই জানাযা, কিন্তু দুজনের দেখা একই রকম নয়।
তো আল্লাহওয়ালাদের দেখা আর দুনিয়াদারদের দেখা ভিন্ন। আর দেখা যদি ভিন্ন হয় তাহলে তার পরিপ্রেক্ষিতে সব চিন্তা,  পরবর্তী সব পদক্ষেপ ভিন্ন হবে।
হাদীস শরীফে কয়েকটা ঘটনা আছে যেখানে ছোট শিশু কথা বলেছে। তার মধ্যে একটা হল ‘এক মায়ের কোলে তার বাচ্চা’। একজন রাজা বা বাদশা বা ঐ ধরনের কিছু মহা ধুমধামে যাচ্ছে। দেখে মা বলল, ‘হে আল্লাহ, আমার ছেলেকে এরকম বানাও’। ঐ শিশু মায়ের দুধ খাচ্ছিল। সে মুখ থেকে দুধ ছেড়ে বলল, “আমাকে এরকম বানাবে না’। তারপর চলল। কিছুক্ষন পরে দেখল একজন মহিলাকে চুল ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে লাঞ্চিত অপদস্থ অবস্থায়, আর মানুষ তাকে গালাগালি দিচ্ছে। দেখে মা বলল যে, ‘আল্লাহ, আমার ছেলেকে এরকম বানাবে না’। ছেলে আবার ঐ দুধ ছেড়ে বলল, ‘আমাকে এরকমই বানাও’।
ছেলেকে, বাচ্চাকে আল্লাহ তাআলা গায়েবের দৃষ্টি দিয়েছেন। শিশুরাতো এখনো দুনিয়ার পরশ পায়নি, প্রভাবও পরেনি। (তবে) কখনো কখনো দেখতে পারে, কখনো বুঝতে পারে। তো ঐ বাদশাকে দেখে দুনিয়ার দৃষ্টিতে বহুত বড় মনে হয়, অথচ হক্বীকতে তার অবস্থা খুবই খারাপ। একজন ফাসিক ব্যাক্তি, গুনাহগার, জালিম দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরেই তো তার আযাবের জিন্দেগী আরম্ভ হল। বরং আগেই আরম্ভ হয়ে যায়।
উমাইয়্যাদের মধ্যে একজন বাদশা, খলিফাই বলত, কিন্তু খারাপ হতে বেশী দেরী লাগে না, ভাল একটা জিনিস করতে দেরি লাগে। কিন্তু এটা নষ্ট হতে দেরি লাগে না। কখনো কখনো তরকারিও এমন হয়।
পরিবারের বেশ কয়েক বছর আগের কথা। নতুন এক বিয়ে হয়েছে আর সেই বিয়ে উপলক্ষে পরিবারের লোকজন সবাই আনন্দ ফুর্তি করবে। কয়েকজন মিলে কোথাও যাচ্ছে, সাথে খাবার নিয়েছে রান্না করে। কয়েকজনে কিছু ভাল খাবার নিয়েছে। এক জায়গায় গিয়ে কোন কারণে গাড়ির পিছনের ট্রাংক খুলেছে, খোলার সাথে সাথে প্রবল দুর্গন্ধ বের হয়েছে। একটা পাতিলের মধ্যে রান্না করা কোন কিছু ছিল। ঐটা পঁচে, ওখান থেকে দূর্গন্ধ বের হয়েছে। অথচ এই রান্না খুব বেশিক্ষন হয়নি। অল্পসময়ের মধ্যে পঁচেছে, শুধু পঁচেছে যে তাই নয়, পঁচে একেবারে দূর্গন্ধে সম্পূর্ণ পরিবেশ ভরিয়ে ফেলেছে। পঁচতে বেশি দেরি লাগে না।
তো উমাইয়্যাদের জমানায় একজন বাদশা ছিলেন। বাদশাদের হাতে ক্ষমতা প্রচুর। বড় বিলাসী ছিল, বদ আখলাক ছিল। গোটা দেশের সুন্দরী মহিলাদেরকে আনত। জাহেরীভাবে একটা শরীয়তের সূরতে রাখত। কিছুদিন রেখে তালাক দিয়ে ছেড়ে দিল, আরেকজন বিয়ে করল। পরবর্তীতে বিয়ের তো কোন বালাই নেই, ওখানে কিছু আইন রক্ষা করত, বলা যেতে পারে যে লাইন ধরে আনছে আর কিছুদিন রেখে রেখে ছাড়ছে। অল্প বয়সেই তার ইন্তিকাল হয়ে গেছে। জানাযা, দাফন ইত্যাদির প্রস্তুতি হচ্ছে। যখন কাফন পড়ানো হয়েছে, ঐ সময় ভিতর থেকে নড়ে উঠল। একটু ঝাকুনি দেখেই (বাদশার) ছেলে ভেবেছে বোধহয় বেঁচে আছে। তার আগ্রহ হয়েছে যে বোধহয় মারা যায়নি। পরিবারে একজন আল্লাহওয়ালা মুরব্বী ছিলেন, সাথে সাথে বললেন, ‘না, তা নয়। তোমার বাপের দিকে আযাব বড় দ্রুত আসছে’। তো এখনো দাফন করেনি, কিন্তু আযাবের ফিরিশতাদের যেন আর ধৈর্য হচ্ছে না। দাফনের আগে থেকেই তার উপর আযাব আরম্ভ হয়ে গেছে। তো উনি পরিবারের আল্লাহওয়ালা মুরব্বী ছিলেন। উনি বললেন ছেলেকে বুঝিয়ে (ছেলে যখন বলল নড়া দেখে যে বোধহয় মারা যায়নি), না না, মারা গেছে ঠিকই, তোমার বাপের দিকে আযাব বড় দ্রুত আসছে। তো দুনিয়ার দৃষ্টি এক ধরনের, আখিরাতের দৃষ্টি আরেক ধরনের। দুনিয়ার দৃষ্টিতে মনে হয় রাজা কত ভাল। আর এই অপদস্থ মহিলা কত খারাপ। আর সেই দৃষ্টিতে মা দোয়া করছে আর বাচ্চা ছেলে সেই দোয়া খন্ডন করছে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীন দিয়েছেন। এক হল আমরা দ্বীনকে জাহেরী জগতের সব নিয়ম কানুন এগুলোর উপর প্রয়োগ করতে চাই। দুনিয়ার মানুষ দুনিয়াকে যেভাবে দেখে, সেইভাবে দেখব আর দ্বীনদারীর উপর চলব। দুনিয়ার মানুষ সম্পদকে খুব ভাল দৃষ্টিতে দেখে, আমিও সম্পদশালী হব। পার্থক্য এটুকু ‘হালালভাবে’। কিন্তু সম্পদ হবে। দুনিয়ার মানুষ সম্মান চায়, আমিও সম্মানিত হবে, কিন্তু ঐসব জায়গায় একটা শব্দ আল্লাহ তাআলা লাগিয়ে দিয়েছেন, ঐটা সে ফেলতে পারে না, যে হালালভাবে হব। দুনিয়াদাররা যা দুনিয়া চায়, এ সব আমি ঐগুলোই ওদের মতোই চাই, শুধু একটু ফর্মুলার পার্থক্য, পদ্ধতির পার্থক্য, ওরা হারামভাবে চায়, আমরা দ্বীনদার হালালভাবে চাইব।
কিন্তু যদি দুনিয়াদাররা যা কিছু চায়, ঐটাই চাই, যদিও সে হালালভাবে চায়, যদি শেষ পর্যন্ত মওত পর্যন্ত হালালের উপর থেকেও যায়, সে ঈমানের স্বাদ থেকে বঞ্চিত, দুনিয়াতে। আখিরাতে সে নাজাত পেয়ে যাবে, কিন্তু আল্লাহওয়ালাদের যে উপরের দরজা, ঐ দরজা তার জন্য নয়। যদিও সে গুনাহ যেহেতু করেনি, সে নাজাত পাবে, কিন্তু মুকার‍্যেবিনদের, আল্লাহওয়ালাদের যে দরজা, সেই দরজা সে আর আশা করতে পারবে না। আর দুনিয়াতে সে পেরশানীর মধ্যে থাকবে, কারণ ধন-দৌলত চায়। তারই সাথে যে হারাম-হালাল পরওয়া করেনা, সে অনেকে কিছুই করতে পারছে আর এই হালাল-হারামের কারণে সে অনেক জায়গায় আটকা পরে যাচ্ছে। প্রত্যেকবারই মনে হয় যে আমি তো এগুলোতে বাধা পড়ে গেলাম (কিংবা) এই মুসলমান হওয়ার কারণে, দ্বীনের কারণে এটা করতে পারছি না। এই ব্যাবসা করতে পারিনা, এই ভাবে করতে পারিনা, সুন্দর বড় বাড়ি বানাতে চাই, কেউ একজন এসে আবার বলল যে, এই বাড়ির ব্যাপারেও শরীয়তের কিছু মাসআলা আছে। নিজে শুনতে চায়নি, কিন্তু অন্যজন এসে বলল, এত উচু করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি। আরেক অসুবিধা।
যেখানেই সে অগ্রসর হতে চায়, ওখানেই গিয়ে কিছু বাধা পড়ে, প্রত্যেক জায়গায় সে বারবার করে পেরেশান হয়। আল্লাহর মেহেরবানী, নাফরমানী সে করতে রাজি নয়, কিন্তু দ্বীন তাকে প্রত্যেকবার বাধা দিচ্ছে, পেরেশান বাড়ছে। যে দুনিয়ার দৃষ্টিতে দেখে, সে এই বাধাগুলোকে বাধা হিসেবে দেখবে। গায়েবের দৃষ্টিতে যখন দেখবে, তখন সে প্রত্যেক শরীয়তের যত হুকুম আছে, যেগুলো দুনিয়াদার মনে করে যে তাকে শিকল দিয়ে আটকে রেখেছে, হাতে পায়ে বাধা, দৌড়াতে পারছে না অন্যদের মত, আরে সে জন্য বারবার সে প্রতিযোগীতায় পিছনে পড়ে যাচ্ছে, তো ঐ জিনিসকেই আল্লাহওয়ালারা দেখবে যে আল্লাহ তাআলার কত মেহেরবাণী আমি নিজে অনেক জিনিস বুঝতে পারছিলাম না, আল্লাহ তাআলা আমাকে বুঝিয়ে দিলেন আর আমার পথ চলা অনেক বেশী সহজ হয়ে গেল। ঐগুলোকে সে একটা বিরাট সাহায্য হিসেবে দেখে। কোন একটা সিদ্ধান্ত, আমি কি করব, কি করব না বুঝতে পারছিলাম না, শরীয়ত আমাকে বলে দিল যে এইটা কর।
তো যে জিনিসকে দুনিয়াদার প্রত্যেক জায়গায় একটা বাধা হিসেবে দেখবে, আল্লাহওয়ালা ঐ জিনিসকেই আল্লাহর সাহায্য হিসেবে দেখবে আর তার মনে বড় ভাল লাগবে। তো সাহাবারা রাঃ যখন নামাযের হুকুম পেলেন, বড়ই আনন্দিত হলেন যে আল্লাহর কাছে চাওয়ার, আল্লাহর সাথে সম্পর্ক করার, আল্লাহর সাথে যোগাযোগ করার একটা সহজ উপায় আল্লাহতাআলা আমাদেরকে দিয়ে দিলেন। বড় খুশীর কথা।
আমরা দেখি আমাদের নিজেদের ক্ষেত্রেই, আমাদের পরিবারের ক্ষেত্রে তো ছেলেকে নামায পড়তে বলি, সে নামায পড়েও, কিন্তু এটা বোঝা, তার অনেক বন্ধুরা নামায পড়ে না, তাদের মা বাবা নামায পড়তে বলেও না, ওদেরকে সে ঈর্ষা করে, ওরা কত ভাল আছে। তাকে নামায পড়তে হয় না, আমাকে পড়তে হয়। সে পড়েও, কিন্তু একটা মুসীবত মনে করে। ঐ নামাযই আল্লাহওয়ালারা নিয়ামত মনে করতেন দুনিয়াতেই। ইবনে সীরিন রহঃ এর কথা, ‘আমাকে যদি আখিরাতে জান্নাতের মধ্যে জান্নাত ও নামায এর মধ্যে বেছে নিতে বলা হয়, নামাযই বেছে নিব’। নামাযে যে আনন্দ আছে জান্নাতে ঐ আনন্দ আর পাব কোথায়। আর দুনিয়াতেই এটি পাচ্ছেন। ওখানেও পাবে। ফাযায়েলের কিতাবের মধ্যে আছে যে কোন কারণে একটা কবরের ভিতর টাকার থলি নাকি পড়ে গিয়েছিল, আবার যখন খুজতে গেছে ঐটাতে, দেখে যে উনি দাঁড়িয়ে নামায পড়ছেন। (এরকম আছে নাকি? মজমা থেকে কেউ বলল ফাযায়েলে সাদাকাতে) খোজ করে দেখল , মেয়ে বলল যে আব্বা সবসময় এই দোয়া করতে যে কবরে যদি কাউকে নামায পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়, আমি যেন সেটা পাই। খুব ভাল করে জানেন ঐ নামাযে কোন সওয়াব নেই। কোন সওয়াব নেই, ভাল করেই জানেন। তো কেন করছেন? সওয়াব এর জন্য নয়, আনন্দের জন্য। তো দ্বীন তার জন্য, প্রত্যেক হুকুম যার জন্যে আনন্দ নিয়ে আনে। যাকাত দেওয়াও আনন্দময়।
আমি কারো কাছে শুনেছিলাম, একজন দ্বীনদার লোক ছিলেন, কিন্তু মালের মহব্বত বড় প্রবল ছিল, আর সেই হিসেবে কৃপণও ছিলেন, কিন্তু আবার আল্লাহর হুকুম মানতেনও। উনার ছেলেদেরকে নাকি বলতেন “হিসাব-টিসাব করে যাকাত যা দেওয়ার তোমরা দিও, আমি যদি বাধা দিই, তো আমাকে দরকার হলে রশি দিয়ে বেধে বের করে দিও”। আর তারা করতও তাই। নিজেকে সামলাতে পারতেন না, যে এতটাকা নিয়ে গেল। কিন্তু আবার দ্বীনদারও, সেজন্য নিজের ছেলেদেরকে বলতেন। তো উনাকে বেধে চাবি জবরদস্তি নিয়ে টাকা বের করে দিতে হত। আমলের যে আনন্দ আল্লাহতাআলা দুনিয়ার মধ্যে রেখেছেন, ঐটা থেকে সে বঞ্চিত হবে। (অস্পষ্টঃ মুজাহেদা করলে সওয়াব আছে সেটা ভিন্ন কথা বা এইরকম কিছু কথা)
তো আল্লাহ তাআলা বড় মেহেরবাণী করে আমাদেরকে দ্বীন দিয়েছেন। দ্বীনের উদ্দেশ্য শরীয়তের শুধু আহকামগুলো মেনে নেওয়া নয়। (ব্যাপারটা এমন) যে শরীয়তের আহকাম মেনে নেয়, এর বিরুদ্ধে করছে না, কিন্তু মন মানছে না, সে ঐটার স্বাদ পাবে না। আর জীবন তার কাছে বড় খালি লাগবে, আর নিজের কাছে জীবন এত ভারি লাগছে, ওর কাছ থেকে অন্যান্যরা আকৃষ্ট হবে না। (এরকম) আব্বা বুড়ো হয়েছেন, নামায পড়তে হচ্ছে, আমার কি দরকার। আর কেউ যদি ঐটা খুব আনন্দের সাথে করে, অন্যরা আকৃষ্ট হবে।
আমি ছোট থাকতে আমার বাবা কি একটা কবিরাজী কিছু ঔষুধ খেতেন। আগে ঔষুধ বানাবার জন্য নৌকার মত কি একটা জিনিস থাকত। ঐটা দিয়ে ঘষে ঘষে মধু দিয়ে কাল রঙের একটা জিনিস। নিয়ম হচ্ছে ঐটা চেটে চেটে খেতে হবে। তো চেটে খেতেন। আমার খুব ইচ্ছা ঐটা আমি খাব। চেয়েছিও, কিন্তু দেননি। তো একদিন ঐটা রেডি করে তারপর একটু বাইরে গেছেন, এই সুযোগে এসে আমি একটু খেয়ে নিয়েছি। সর্বনাশ-তিতা যারে বলে! কিন্তু উনার খাওয়ার ধরন দেখে আমার আগ্রহ হয়েছে। তো আমি যেটা আমল করলাম, আমল এমনভাবে করি যেন মুসীবত। আশেপাশের কেউই ঐ আমলের দিকে আকৃষ্ট হবে না।
আল্লাহওয়ালাদের এক একজন একটা দেশে যেতেন। আর গোটা দেশ তার পিছনে মুসলমান হয়ে যেত। এত আকৃষ্ট হতেন যে, (মানুষ ভাবত) এই লোক যে মজা পাচ্ছে, আমি কেন বঞ্চিত থাকব। এটা বুঝা যায়। কিন্তু আমরা যদি অনেক আমল করলাম, আমলে তো আকৃষ্ট হবে না, আমল করনেওয়ালার ধরন দেখে। আল্লাহতায়ালাও দেখেন যে কেমন করে করছে।
فَيَنظُرَ كَيْفَ تَعْمَلُون(সুরা আরাফঃ১২৯)
“দেখতে চাই তুমি কেমন করে কর”
মনে যদি কারো গভীর আনন্দ থাকে, ও ইচ্ছা করলেও ঐটা গোপন করতে পারে না। ঐটা কোন না কোনভাবে বের হয়েই যায়। আর যদি না থাকে, জবরদস্তি ঐটা বলতেও পারেনা। তো আল্লাহওয়ালারা তাদের দ্বীনের উপর যে চলতেন, ঐ চলার যে আনন্দ ছিল, ঐ আনন্দই মানুষকে ডেকে আনত। ঐ একজনের কারণে লাখো মানুষ মুসলমান হয়ে যায়। এদেরকে কি বুঝিয়েছে? কিচ্ছু না, বুঝাতে হবেও না। ঐ দেখেই। তো আল্লাহর কাছে চাওয়া যে, আল্লাহ তুমি মেহেরবানী করে আমাকে দ্বীনের উপর চালাও। আর এই দ্বীনের স্বাদ যে আছে ঐটা যেন আমি পাই।
ذَاقَ طَعْمَ الإِيمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولاً (-সহীহ মুসলিম /৪৭, হাদীস : ৩৪)  
‘ঈমানের স্বাদ ঐ ব্যক্তি আস্বাদন করেছে, যে সন্তুষ্ট হয়েছে আল্লাহকে রব হিসেবে পেয়ে, ইসলামকে দ্বীন হিসেবে পেয়ে এবং মুহাম্মাদকে রাসূল হিসেবে পেয়ে।’
যাতা তামাল ঈমান, ঈমানের স্বাদ পেয়েছে, যা’ত বলে জিহ্ববার স্বাদ, মজা, ঈমানের মজা পেয়েছে। কে? রাদিয়া বিল্লাহি রব্বান”। আল্লাহকে রব হিসাবে যে সন্তুষ্ট হয়েছে। আদেশ পালনের কথা বলা হচ্ছে না, (বরং) “রাদি” সন্তুষ্ট (বলা হচ্ছে), বিন ইসলামী দ্বীনা” আর ইসলামকে দ্বীন হিসাবে পেয়ে সে সন্তুষ্ট, তার মনের ভিতর তৃপ্তি, আল্লাহর শুকর করে। ওয়াবি মুহাম্মাদান সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, রাসুলাও ওয়া নাবীয়্যা” আর মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাসূল পেয়ে সে সন্তুষ্ট।
রাসূল পেয়ে সন্তুষ্ট, তার মধ্যে এটাও আছে যে প্রত্যেক সুন্নত তার কাছে বড় আনন্দের। এরকম নয় যে আমল করলাম, কিন্তু এইজন্য করছি যে এটা সুন্নাত, করা উচিত, আর আরেক হল যে এটার উপর আমল করছি, কিন্তু উচিত হিসেবে না, একটা সুযোগ আমি পেয়েছি, বিরাটা একটা সুযোগ। একটা privilege.
আর যারা করতে পারছে না বিভিন্নভাবে তাদেরকে বঞ্চিত বলি। (তো যে) নিজে আমল করে, কিন্তু আমলে সন্তুষ্ট নয়, সে আমল না করনেওয়ালার উপর রাগ করে। একজন যাকাত দেয়, কিন্তু যাকাত দেয় (আর) মনে আনন্দ নেই। আরেকজন যাকাত দেয় না, সে ধনী। (তো)গাল দেয় “ঐ বেটা যাকাত দেয় না”। কারণ রাগ ঈর্ষা থেকে আসে, যাকে ঈর্ষা করে তার প্রতি রাগ হয়।
একজন যাকাত দেয় আর এটাকে বহুত বড় নিয়ামত মনে করে। আর আরেকজন যাকাত দেয়না, সে জানে, (তো) যাকাত না দেওয়ার কারণে তার উপর কোন রাগ হয়না, বরং তার প্রতি বড় স্নেহ হয়, মায়া হয়, আহা বেচারা বঞ্চিত। এতবড় নিয়ামত আমি পাচ্ছি, (আর) ও পাচ্ছে না।
প্রায়ই দেখি অন্যের প্রতি যে রাগ হয়, ঈর্ষা থেকে হয়। একজন হারাম খায়, হারাম খেয়ে বিরাট বাড়ি বানিয়েছে, ছেলেমেয়েরা মহা ধুমধামে আছে, তাদের জামা-কাপড়। আর আমি জানি। আর আমার অত বাড়িও বানাতে পারিনি, আর ছেলেমেয়েদেরকে ভাল জামা কাপড় দিতে পারিনা, ধুমধাম করতেও পারিনা, বিরাট পার্টিও দিতে পারিনা। সে দেয়। ওর দেওয়া দেখে খুব গাল দিই। বদমাইশ, হারামখোর, ঘুষখোর, সুদখোর। কেন বলি? মনে মনে আমিও চাই, কিন্তু পারছি না। কোথাও আটকা পড়ে আছি। সেজন্য ঈর্ষা হয়, তো রাগ হয়। কিন্তু আল্লাহওয়ালা সেক্ষেত্রে কোন গালাগালি দেন না, বরং তার জন্য দোয়া করে, চোখের পানি ফেলে, সুযোগ পেলে দাওয়াত দেয়। কেন রাগ হয় না? ঈর্ষা করে না? বরং তাকে বঞ্চিত মনে করে। আল্লাহ তাআলা আমাকে কতবড় নিয়ামত দিলেন, ও বেচারা তা থেকে বঞ্চিত, ওর জন্য মায়া হয়।তো আল্লাহতায়ালা আমাদেরকে দ্বীন নসীব করুক। মেহনত করা, আল্লাহর কাছে চাওয়া, ‘হে আল্লাহ, তুমি মেহেরবানি করে আমাদের এই গায়েবের পর্দা যেটা আমাদের সামনে আছে, এর হাক্বিকত খুলে দাও, গায়েবের জগতকে যেন দেখতে পাই। আমাদের দৃষ্টিকে প্রসারিত করে দাও, যেন জাহেরী জগতের মধ্যে আমাদের দৃষ্টি, আমাদের চিন্তা, ফিকির যেন আবদ্ধ না থাকে। গায়েবকে যেন দেখতে পাই, এজন্য আল্লাহর কাছে তৌফিক চাওয়া, দোয়া করা, চেষ্টা করা, আর এইজন্যই দাওয়াত দেওয়া। শুধু তাবলীগে গেলাম, চিল্লা দিলাম, এমন কি শরীয়তের আহকামের উপর চলনেওয়ালাও হয়ে গেলাম, (যদিও) এটাও জরুরী (এমন না)। বরং আমার দৃষ্টি যেন প্রসারিত হয়।আর দাওয়াতের কথার মধ্যে এটাও আছে
قُلْ هَـذِهِ سَبِيلِي أَدْعُو إِلَى اللّهِ عَلَى بَصِيرَةٍ أَنَاْ وَمَنِ اتَّبَعَنِي وَسُبْحَانَ اللّهِ وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِين (সুরা ইউসুফঃ ১০৮)
এটাই আমার রাস্তা, আল্লাহর দিকে আমি ডাকি, বাছিরাতের সাথে, অন্তর দৃষ্টির সাথে। এই বাছিরাতের সাথে যে ডাকে ওর ডাকের মধ্যে যেন কিছু আছে, দেখতে পাচ্ছে, সে আনন্দের সাথে ডাকে, আগ্রহের সাথে ডাকে।
আব্দুল ওহহাব সাব লাহোরে ছিলেন, ইসলামিয়া কলেজে সম্ভবত পড়তেন। দ্বীনি জযবা ছিল। কিন্তু তখনকার দ্বীনি যেসব চলতি আন্দোলন-টান্দোলন, ওগুলোর সাথেও একটু জড়িত ছিলেন। আর ঐ দ্বীনের লাইনে কিছু পড়াশুনা ইত্যাদিও করতেন। জান্নাত কি, তার হাক্বীকত কি, তার তাৎপর্য কি। নিজেদের মধ্যে অনেক সময় তাৎপর্য ইত্যাদির আলোচনা হয়, তো সেগুলো। সেই সময় আলোচনার প্রচলিত বই-টই ছিল, সেগুলো কিছু পড়তেন। এটা কি বাস্তব, না এটা কি রূপক, মুসলমান ফিলোসফারদের মতো নানান ধরনের ইত্যাদি ইত্যাদি।
ঐ সময় শুনলেন যে দিল্লীতে মাওলানা ইলিয়াস রহঃ একজন আছেন, দ্বীনের কাজ করা শিখান। তো উনার জযবা ছিল, উনি লাহোর থেকে দিল্লী এলেন দ্বীনের কাজ শিখবার জন্য, ইলিয়াস রহঃ এর কাছে। এজন্য নিজ আন্দাজ মত কিছু ফিস-টিস তো কিছু লাগবে, রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদি, তো সেই হিসাবে কিছু ফিস-টিসও নিয়ে এলেন, (না জানি) কত দিনের কোর্স ইত্যাদি। (মজমা হেসে ফেলল)
নিজামুদ্দিন মসজিদ গিয়ে পৌছালেন আসরের পরে সম্ভবত। মাওলানা ইলিয়াস রহঃ তখন বয়ান করছিলেন। উনি ঢুকেই শুনলেন। মাওলানা ইলিয়াস রহঃ তখন জান্নাতের কথা বলছিলেন। “জান্নাত , আহ!” এইরকম একটা বললেন। আব্দুল ওহহাব সাব বলেন, “উনার এই “জান্নাত, আহ!” বলে আমার মনে হল ওতো দেখে এসেছে। কোন ফিলোসফির কথা বলছেন না। (বরং) স্বচোক্ষে দেখে এসে বলছেন, কথার ধরন এইরকম। আর ঐ এক কথাতে আমার মাথার ভিতর যত ঘুরপাক, যতসব ফিলোসফি ছিল, সব উড়ে গেল, কারণ এগুলো সরাসরি দেখে এসেছে ও, এরপরে আর কোন ফিলোসফি টিকে। উনি তো দেখে বলছেন।
তো আল্লাহ তাআলা চান যে দাওয়াত দেওয়া, বাছিরাতের সাথে দেখে যেন দিই, অন্ধের মত না। দাওয়াত দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু না দেখে দিচ্ছি। অথচ আল্লাহতাআলা চান যেন বাছিরাতের সাথে দিই, অন্তরদৃষ্টির সাথে। আল্লাহর কাছে চাওয়া, যত বেশি তাক্বওয়ার উপর চলব, যত বেশি দুনিয়াবি জযবা থেকে, মালের জযবা, ক্ষমতার জযবা, পরিচিতির জযবা, এইসব থেকে নিজেকে যত বেশি সরাব, আল্লাহতাআলা তত বেশি ইনশাআল্লাহ দ্বীনকে বুঝবার তৌফিক নসীব করবেন। আল্লাহ তৌফিক নসীব করুন। আ’মিন।
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ
[মাজালিসে মুশফিক আহমেদ রহঃ থেকে]pdf ফাইলে পেতে ক্লিক করুন http://www.mediafire.com/?7l7lqv3n8qd8m
পুরো বয়ানের অডিও ডাউনলোড লিংক https://onedrive.live.com/redir?resid=21222341ccf1c751!6522&authkey=!AMDo36Blq58aGIY&ithint=file%2cmp3
আবু তালহা (রা) রসূল করীম (স) এর মজলিসে তাশরিফ আনলেন। রসূল (স) ঐ মজলিসের মধ্যে কুরআন শরীফের এই আয়াত পড়লেন-
لَن تَنَالُواْ الْبِرَّ حَتَّى تُنفِقُواْ مِمَّا تُحِبُّونَ وَمَا تُنفِقُواْ مِن شَيْءٍ
“তোমরা যা ভালবাস, তা হতে ব্যয় না করা পর্যন্ত তোমরা কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না”
-সুরা আল-ইমরানঃ ৯২
আবু তালহা (রা) জিজ্ঞেস করলেন- “ইয়া রাসূলুল্লাহ, আল্লাহ তা’আলা কি আমাদের কাছে আমাদের প্রিয় জিনিস চান?” রসূল (স) বললেন-“হ্যাঁ”। আবু তালহা (রা) বললেন- “আমার কাছে আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা হল “বাইরুহা”। এটা একটা বাগান, যেখানে ঝরনাও আছে, খুব ভালো পানি। রসূল করীম (স) ঐ বাগানে যান, ঐ পানি পান করেন, ঐখানে বসেন, ওযূ করেন। তো আবু তালহা (রা) বললেন-“এটিই আমার কাছে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস। আমি এটাই আল্লাহর ওয়াস্তে সদকা করলাম”। রসূল করীম (স) কবুল করলেন আর উনার আত্নীয়দের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়ার জন্যে বললেন। লক্ষণীয়, সাহাবারা আল্লাহকে যে চাচ্ছেন- কিছু দিয়ে, আর শুধু দিয়ে নয়, প্রিয় জিনিস দিয়ে।
বারাহ বিন আযেব (রা), ইয়ামামার যুদ্ধের সময় উনার কাছে সবাই এসে বললেন যে, রসূল করীম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে মুসতাযাবুত দু’আ বলেছেন। আপনি দু’আ করুন আল্লাহ তাআ’লা যেন আমাদেরকে ফাতাহ দেন। তখন মুসলমানরা খুব বিপদের মধ্যে। মুসায়লাবা কাযযাবের বাহিনী খুব জোর আক্রমণ চালিয়েছে। অনেক সাহাবী (রা) শহীদ হয়ে গেছেন, আর মোকাবিলায় যেন পারছেন না। ঐ সময় তারা চিন্তা করলেন যে বারাহ বিন আযেব (রা) এর কাছ থেকে গিয়ে আমরা দু’আ চাইব। রসূল করীম (স) তার ব্যাপারে বলেছেন যে তার দু’আ মুসতাযাবুত। তো উনারা এলেন; এসে উনার কাছে বললেন আর উনি দু’আ করতে রাজি হলেন। কিন্তু নিজে থেকেই আরেকটা কথা বাড়িয়ে দিলেন। দু’আ করলেন,“আল্লাহ! মুসলমানদেরকে ফাতাহ দাও আর আমাকে শাহাদত দাও”। তো তাই হল। উনার দু’আ কবুল হল। মুসলমানরা ফাতাহ পেলেন আর উনি শাহাদত পেয়ে গেলেন। তারা তো উনার কাছ থেকে শুধু ফাতাহর দু’আই চেয়েছিলেন, এইটা উনি আবার বাড়িয়ে দিলেন কেন?
উনি যে মুসতাযাবুত দু’আ হয়েছেন দু’আর আদব জানেন বলেই উনার দু’আ মুসতাযাবুত। আর এটাই দু’আর আদব। কিছু দিয়ে কিছু চাইতে হয়। আর মূল্যবান কিছুই দিতে হয়। জিনিসের দিক থেকে আবু তালহা (রা) উনার সবচেয়ে প্রিয় মূল্যবান সম্পত্তি দিলেন, বারাহ (রা) উনার জীবন দিলেন।
তো সাহাবাদের (রা) কাছে দেওয়া কখনও কখনও শুধুই দেওয়া, বিনিময়ে যে কিছু চাচ্ছেন এরকম দেখা যায়না পরিষ্কার ভাবে। যেরকম ওহূদের যুদ্ধের আগে দু’আ করলেন আব্দুল্লাহ বিন জাহাশ (রা), যে আমাকে যেন কতল করে ফেলে, আমার নাক, কান কেটে ফেলে। এই কথা বলছেন না যে বিনিময়ে আমাকে এটা দিও। কিন্তু বুঝা যায় যে আল্লাহ তাআ’লার ভালোবাসা চাচ্ছেন। আল্লাহর ভালোবাসা চাচ্ছেন তো কিছু দিয়ে চাচ্ছেন। আর এখানে “বির” চাচ্ছেন, “লান তানালুল বির”-এটাও আল্লাহর সন্তুষ্টি। কিন্তু তোমার প্রিয় জিনিস দিয়ে, এখানে আল্লাহ তাআ’লা বলেই দিয়েছেন এটা আদব। বারাহ (রা) ফাতাহর দু’আ করছেন নিজের জীবন দিয়ে। নিজে থেকে বলছেন-“আমাকে শাহাদত দাও”।
আল্লাহ নিজেই বলেছেন “আমি কি তোমাদের ওপর চাপিয়ে দিব? আরোপ করে দিব? আর তুমি চাও না”। তো আল্লাহ তাআলা জবরদস্তি দিয়ে দিবেন না। আল্লাহ তাআ’লা তো দেবেন, কিন্তু আল্লাহ তাআ’লা চান যে আমি আগ্রহী কিনা?
আমরা বলছি, আমরা তো হেদায়াত চাই। ঐটার নাম চাওয়া নয়, যেহেতু আমি দাম দিতে রাজি না। আমরা তো চাই যে, ‘হে আল্লাহ, এমনি থেকেই দিয়ে দাও’। কিন্তু ঐ ভাবে এমনি থেকে যদি পেয়ে যায় তো কদরও করতে পারব না। যেরকম প্রচলিত কথা আছে- বাপের কাছ থেকে সম্পত্তি পাওয়া, ওটা তো গাঁজা খেয়েই উড়াবে। নিজে থেকে উপার্জন করুক তবে তার কদর জানবে। হেদায়াতের মত সম্পত্তি, সম্পদ- এটাকেও প্রিয় জিনিস দিয়ে নিতে হয়।
দুই ধরণের প্রিয় জিনিস আছে। এক ধরণের প্রিয় জিনিস হল যে আমার কাছে আছে। অপর দিকে মানুষের কাছে অনেক ধরণের কাল্পনিক প্রিয় জিনিসও থাকে। কাল্পনিক প্রিয় জিনিস যেমন থাকে তেমনি কাল্পনিক ভয়ের জিনিসও আছে। ভবিষ্যতে রাজা হবে- তার একটা কল্পনা। এই যে কল্পনা- সে উপভোগ করে। বর্তমান রাজা হওয়ার চেয়ে রাজা হওয়ার স্বপ্ন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অনেক বেশি উপভোগ্য। রাজা যখন হয়ে যায় তখন অত মজা লাগেনা। নানান সমস্যা তার মধ্যে আছে। কিন্তু রাজার স্বপ্ন দেখার মধ্যে কোন সমস্যা নেই। মনে মনে আনন্দ করা যায়। ওরকম বর্তমান মুসিবতও অনেক ক্ষেত্রে কাল্পনিক মুসিবতের চেয়ে সহজ। অভাবের কারণে মানুষ যত কষ্ট পায়, সম্ভবত তার চেয়ে বেশি কষ্ট পায় ভবিষ্যতের কাল্পনিক বা সম্ভবপর অভাবের কারণে। “হায় কি হবে?! কি হয়ে গেছে প্রায়ই ঐটা তত বড় সমস্যা না। কিন্তু কি হবে বা ভবিষ্যতে কিছু একটা হয়ে যেতে পারে কল্পনা করেই মানুষ যত ভয় পায়।
ওরকমই বর্তমানে একটা সম্পদ আছে আর এইটাও আল্লাহকে দিয়ে তার মোকাবেলায় হেদায়াত চাওয়া, আর কল্পনার সম্পদ দিয়েও আল্লাহর কাছে হেদায়াত চাওয়া; এইটাও বহুত বড় কুরবানি। যেমন আমি কিছু একটা চাই মনে মনে, দু’আ করলাম ইয়া আল্লাহ এই জিনিস আমার মন বড় বেশি চায়, তুমি এইটা না দিয়ে আমাকে হেদায়াত দিয়ে দাও। আসলে আমার পকেট থেকে কিছুই যাচ্ছে না, কিন্তু সহজও নয়।
এইটুকু একটু ভূমিকা ছিল। এখন একটু তশকিলে আসতে চাই।
বর্তমান সম্পদ দিতে নাই বা পারলাম, কল্পনার সম্পদ দিয়ে দু’আ করি। যদি ঠিকই দু’আ করতে পারি, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআ’লা বহুত বড় সম্পদ দিবেন। আর প্রত্যেকের কাছেই নিজ নিজ কল্পনা অনুযায়ী তার কিছু আছে। ছাত্র ভাল রেজাল্ট চায়, চাকরিজীবি প্রমোশন চায়, ব্যবসায়ী লাভ চায়, বন্ধু বান্ধবের কাছে সম্মান চায়, আত্মিয় স্বজনের কাছে কদর চায়। এরকম আরও কত নানান ধরণের জিনিস আছে। কিছু জিনিস আছে অনেক দিন ধরেই মনের মধ্যে আছে আর কিছু আছে অদল বদল হতে থাকে। এই যে আমার মনের মধ্যে অনেক কিছু আছে, আমি অনেক কিছুই চাই- খোঁজ করলে দেখা যাবে কিছু এমন আছে যার প্রাধান্য বেশি। অন্যান্য ছোট খাটো চাওয়ার মোকাবিলায় কিছু কিছু চাওয়া একটু বড় ধরণের, যেগুলো লেগেই থাকে। অনেকগুলোই ছিল যা সকালে চেয়েছি এখন ভুলে গেছি। আর কিছু আছে আজকেও চেয়েছি, গতকালকেও চেয়েছি, আগের দিনও চেয়েছি, লেগেই আছে। আর এইজন্য মনের মধ্যে প্ল্যান-পরিকল্পনা অনেক কিছুই আছে। যত বেশি বড় জিনিস আমার মনের মধ্যে আছে, ঐটার মোকাবিলায় যদি আল্লাহর কাছে দু’আ করতে পারি, যে আল্লাহ এই যে এই একটা জিনিস আমি অনেকদিন থেকে চাই, আমার মন বড় বেশি চায়, আর এজন্য আমি স্বপ্ন দেখি, কল্পনা করি, এই চারপাশে কল্পনার জগৎ গড়ে তুলেছি; এইটা আমি কুরবান করে দিলাম। আর এর বদলে তুমি আমাকে হেদায়াত দিয়ে দাও, তোমার সম্পর্ক নসিব কর, তোমার নৈকট্য দান কর, পথ দেখাও এই ধরণের…।
আবার বলছি, যদিও বাস্তবে কিছুই দিচ্ছি না, কিন্তু আমরা এতই কৃপণ যে কাল্পনিক জিনিসও সহজে দেওয়া যায়না। দিতে রাজি হইনা বরং ঘুরে ফিরে দু’আ করি, ‘হে আল্লাহ, দিয়ে তো দিলাম, তুমি আবার ফিরিয়ে দিও। [মজমা হেসে ফেলল]। ওরকম নয়. বরং একেবারে যত বেশি সাফ দিলে পারা যায়। কিন্তু ব্যাপারটা যেহেতু মনের ওপরে আঘাত নিয়ে আর সম্পূর্ণ দ্বীনই মনের ব্যাপার, এই জন্য এই দেওয়াও কিন্তু ছোট দেওয়া নয়। আর আল্লাহ তাআ’লা তো এই রকম কাল্পনিক জিনিসকে বড়ই কদর করেন।
মারিয়াম (আ) এর মা; উনার পেটে কাল্পনিক ছেলে বাস্তবে মেয়ে। মারইয়াম (আ) মেয়ে ছিলেন, মা ভাবছিলেন যে ছেলে। ঐ কল্পনার ছেলেকে তিনি বাইতুল মাক্কদিসের খেদমতের জন্য দিয়ে দিলেন। এটা নফসের বড় একটা ছাড়া। মানুষ তার ছেলেকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে, আর উনি দিয়ে দিলেন যে বাইতুল মাক্কদিসের খাদেম হবে। আল্লাহ তাআ’লা কবুলও করলেন। তো দিলেন যেটা আসলে নয়, আল্লাহ তাআ’লা যেটা কবুল করলেন সেটাও আসলে নয়। আর তারপর আল্লাহ তাআ’লা বহুত বাড়িয়ে মারইয়াম (আ) এর কাছ থেকে ঈসা (আ) কে বাহির করলেন। বাইতুল মাক্কদিসের খাদেম উনি দিতে চেয়েছিলেন, আল্লাহ তাআ’লা কবুল করে ঐটা বহুত বড় করে বনী ঈসরাইলের বিরাট নবী বানিয়ে দিলেন। কোথায় মসজিদের খাদেম আর কথায় উম্মতের নবী।
তখন আবার মন বলবে যে – ঠিক আছে,আমি আমার মনের জিনিস আল্লাহর ওয়াস্তে কুরবানী করে দিই, আল্লাহ তাআ’লা নিয়ে গিয়ে মারইয়াম (আ) এর মত ডাবল করে আমাকে দিবেন! [মজমা হেসে ফেলে]। ঐরকম না; বরং সাফ দিলে। আবার ফেরত পাওয়ার লোভে নয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাওফীক নসিব করুক; আল্লাহর কাছে বড় প্রতিদানেরও আশা রাখি ইনশাআল্লাহ। এই তশকিলে আমরা রাজি আছি ইনশাআল্লাহ। [ইনশাআল্লাহ]।
এটাও মন তত সহজে ইনশাআল্লাহ বোঝার জিনিসও নয়! চিন্তা ফিকির করি, বারবার নিজের মধ্যে গিয়ে, একাকী নির্জনতার মধ্যে, শেষ রাতে। মন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জিনিস চাইবে। সাহাবারা (রা) যে হেদায়াত পেয়েছেন বহুত মূল্যবান কিছু দিয়ে পেয়েছেন। প্রিয় জিনিসগুলো দিয়েছেন, একবার নয় বরং বারবার দিয়েছেন, বহুবার দিয়েছেন। আর যা যা অত্যন্ত প্রিয় ছিল সেইসব জিনিসকে সম্পূর্ণ দিয়ে দিয়েছেন।
মক্কার মত প্রিয় জায়গা, এমনই দিয়েছেন যে ফাতাহ মক্কার পরে ফিরে গিয়ে প্রত্যেকেই নিজের বাড়ি আবার দখল করতে পারতেন। এখানে অনেকগুলো জিনিস আছে; শুধু বাড়ি দখল করা না। এক তো হল মক্কা, মক্কার বাড়ি দখল করা যেখানে প্রাণ লেগে আছে। দ্বিতীয় হল শত্রু আমার কাছ থেকে জবরদস্তি, অন্যায়ভাবে জুলুম করে ছিনিয়ে নিয়েছে। সেই প্রতিশোধও আছে। আরব ঐ কওম যেই কওম প্রতিশোধ ভালো করে জানে। আর প্রতিশোধের কথা একদিন দুইদিন, দশ বিশ বছর, এক পুরুষ দুই পুরুষে ভুলে যায় না। আর এখানে ঐ কওম, যার ওপর জুলুম করা হয়েছে, এখন সে প্রতিশোধ নিতে পারে, কমপক্ষে বাড়ি ফেরত নিতে পারে। কিন্তু কেউ গিয়ে ঐ বাড়ি ফেরত নেননি। জুলুম করে যে বাড়ি দখল করেছে, সেই বাড়ি তাদেরকে দান করে দেওয়া হয়েছে। ফেরত যাননি। শুধু বাড়ি যাওয়া নয়, নফসের কতবড় যজবাকে ছেড়ে দেওয়া। আথচ জুলুম করে নিয়েছে, দামও দেয়নি। কিন্তু ফেরত যাননি। যেসব কাফেররা দখল করেছিল, তাদের কাছেই রয়ে গেছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) কোন প্রয়োজনে মক্কাতে রয়ে গিয়েছিলেন। বাকি সবাই মক্কা ফাতাহতে গিয়েছেন কিন্তু আবার মদীনায় চলে এসেছেন। অথচ মক্কায় বিজয়ী হিসেবে বাকি জীবন কাটাতে পারতেন; কিন্তু তা করেন নি। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) মক্কাতে রয়ে গেছেন, কিন্তু উনার নিজের আগের পুরনো বাড়িতে নয়, পুরনো মহল্লায়ও নয়। যদি কখনও সেই মহল্লা দিয়ে যেতে হত, তাহলে চোখের ওপর পর্দা দিয়ে দিতেন, যাতে সেই বাড়ি চোখে না পড়ে। হাদিসের মধ্যে যিনি এই কথা বলছেন, ‘রসূল (স) এর জীবনের পরে- আব্দুল্লাহ কখনও রসূল (স) কে স্মরণ করে নি চোখের পানি না ফেলে, কখনও নিজের মহল্লা দিয়ে যায়নি চোখের ওপর পর্দা না ফেলে।’ দুটো কথাকে একসাথে মিলিয়ে বলেছেন।  দুটোর মধ্যে সম্পর্ক কি? এই দুটো কথা একসাথে কেন বললেন? শুধু চোখের কারণেই? – বরং তার চেয়ে বেশি। এই যে রসূল (স) এর এই মুহাব্বত পেয়েছেন যে যখনই স্মরণ করতেন চোখে পানি আসত, এমনি থেকে নয়! কিছু দেওয়ার বিনিময়ে। প্রিয় কিছু দিয়েছেন, অন্য প্রিয় কিছু পেয়েছেন। আমরাও চাই, কিন্তু দিয়ে নিতে হবে। সেজন্য নিজেকে তশকিল করা। এটা ঐ চিল্লা, ৩ চিল্লার তশকীলের চেয়ে অনেক ভারী।
আব্দুল ওহাব সাহেব উনার কোন একজন বন্ধুকে (একজন ব্যবসায়ী) তশকীল করছেন- ঐ কথাই যে এই কাজকে নিজের কাজ বানাও। উনি কথা বুঝতে পেরেছেন, বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়ে বলেছেন আর উনিও ব্যবসায়ী মানুষ। অনেক পরে আব্দুল ওহাব সাহেবকে বললেন যে শোন আব্দুল ওহাব (সমবয়সী বন্ধু), তুমি যদি বল চিল্লা দিতে তো চিল্লা দিব, ৩ চিল্লা তাও দিব, বিদেশ সফরেও যাব। কিন্তু এই যে বলছ এই কাজকে কাজ বানাও ঐটা হবে না, আমার কাজ ব্যবসা। এইখানে টানাটানি করে লাভ নাই, চিল্লা-৩চিল্লা যত চাও দিয়ে দিব।
অনেকদিন আগে (প্রায় ২০ বছর আগে বা কাছাকাছি) আমি একবার ৩ দিনের জামাতে গিয়েছি। আমার এক ভাইও গিয়েছে। ঐ প্রথমবার আর সম্পূর্ণ ৩ দিনের জন্য বোধ হয় শেষ বার। ৩য় দিন মাগরিবের পরে আমি বয়ান করছি। আমার এক ভাগ্নেও গিয়েছিল, আমার পরিবার থেকে এই প্রথম ২ জন। আমার ভাগ্নে আর ভাই মজলিসে সবার সাথে বসে না, আলাদা আলাদা থাকে। তো বয়ানের সময় দুজন একটু পেছনে আলাদা বসেছে।
বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে কানে কানে কি সব কথাও বলে। পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম যে কি কথা বলছিলে? আমার ভাই উত্তর দিল, যে ভাগ্নেকে কানে কানে বলছিল, যে ৩ দিনে যা দেখলাম- এরা তো দেখি সম্পূর্ণ চায়। [মজমা হেসে ফেলে]।
আমি জিজ্ঞেস করলাম যে সম্পূর্ণ চাওয়ার মানে টা কি? উনি নিজে বললেন যে দেখ, নামায পড়তে বলছ ঠিক আছে নামায পড়ব, যাকাত দিতে হবে তো যাকাত দিব, হজ্জ করতে হবে তো হজ্জ করব, তোমরা চাও জীবনেরই মালিকানা নিয়ে নিবে। [মজমা আবার হাসে]। জীবনের মালিকানা দিবনা। আমার জীবনের আমি মালিক, এর থেকে টুকরো টুকরো করে যা চাও দিব।
চিল্লা, ৩ চিল্লা এগুলো সব হচ্ছে ওখান থেকে কেটে কেটে দেওয়া, প্রফিট থেকে দেওয়া। আর এই যে তশকীল- “লান তানালুল বিররা…” , এইটা প্রফিট থেকে দেওয় নয়, বরং ক্যাপিটাল চাচ্ছে। আমাদের প্রত্যেকের একটা স্বপ্ন আছে, কল্পনা আছে। ঐটার মোকাবিলায় দু’আ করা, হে আল্লাহ, এই যে আমার মনের একটা স্বপ্ন আছে, একটা স্বাদ আছে, এইটা তুমি নিয়ে নাও আর আমাকে হেদায়াত দিয়ে দাও। এইটা ত মূলধনকেই দিয়ে দেওয়া। এইজন্য চিল্লা, তিন চিল্লার চেয়ে এইটা অনেক ভারী। যদিও কিছুই নয়, কল্পনার জিনিস; কল্পনা ধরেই তো মানুষ থাকে। এইজন্যে মন অত সহজে এইটার তশকীল হবে না। নিশ্চয়ই ইনশাআল্লাহ নিয়্যত করি, বলি, মেহেনত করি, দু’আ করি, নিজেকে বার বার করে তৈয়ার করি, মনকে ভাল করে বুঝাই। তৈয়ার আছি তো ভাই ইনশাআল্লাহ? [ইনশাআল্লাহ]।
চর্চা করি, মোজাকারা করি, আল্লাহ তাআ’লা মেহেরবানী করে দেবেন ইনশাআল্লাহ। বার বার করে এই কথাই জপছি। আল্লাহ তাআ’লা আমাদের সবাইকে বুঝার এবং করার তৌফিক দান করুন। [আমিন]। যদি ঠিকই নিজের প্রিয় জিনিসকে দিতে পারি; এটাই আসলে ইবাদত চায়। মাথা নত করা মানে এটাই। আমার সবকিছু দিয়ে দেওয়া।
শাহাদতের এত মূল্য কেন? শাহাদত তো শুধু প্রিয় জিনিস নয়, বরং প্রিয়-অপ্রিয় সবই তো দিয়ে দেওয়া; জীবনই যখন দিয়ে দিল। কিন্তু নফস এত জবরদস্ত যে ওখানেও ঠকানো জানে। মানুষের অনেক কিছুই আছে জীবনের চেয়েও বেশি প্রিয়। সুনাম; এগুলোর জন্য মানুষ জীবন পর্যন্ত দিয়ে দেয়। তাজমহল দেখে বহুত আগে কোন এক ইংরেজ মহিলা বলেছিল, “আমার কবরের উপরে এই রকম বানাতে রাজি হলে আমি এই মূহুর্তে মরতে রাজি আছি”। মানুষের নানান ধরণের চিন্তা কল্পনা এত বেশি মূল্যবান তার কাছে হয়ে যায় যে জীবন দিতে রাজি হয়ে যায়। আর এগুলো খুব বেশি দূরের জিনিস নয়। আমাদের দেশের অহরহ ঘটনাই- মানুষ তার জমি দখলের জন্য যান দিয়ে দেয়।
যদি মরেই গেল, ঐ জমির  ধান কে খাবে? কিন্তু কিছু একটা তার কাছে কল্পনায় আছে যেটা তার জীবনের চাইতেও বেশি মূল্যবান। ওটা ভাত খাওয়া নয়, ভাত তো খাবে না সে জানেই। এটুকু বুদ্ধি তার কাছে আছে। কিন্তু কিছু একটা চায়। তার সম্মান, তার দাপট, তার রাগ। ওর কাছে যাবে না; মরেই গেলাম কিন্তু ও যেন না পায়। অথচ এইসব ধরা যায়না, ছোঁওয়া যায়না, মাপা যায়না। মনের অনেক কিছুই আছে জীবনের চেয়েও বেশি মূল্যবান। কাফেরও তার জীবন দিতে রাজি হয়ে যায়। ঐ মূল্যবান জিনিসগুলো বা তার মধ্য থেকে কিছু যদি আল্লাহকে দিতে পারি, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআ’লা বহুত বেশি দেনেওয়ালা। আমরা কি আর আল্লাহকে দেব; আল্লাহরই বা কি ঠেকা আছে? আর আমার পাত্রেই বা আছে কি? যদি আল্লাহকে আমার মাপের মূল্যবান জিনিস দিতে রাজি হই, ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তাআ’লা তাঁর মাপের মূল্যবান সম্পদ দিবেন।
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ
অডিও ডাউনলোড লিংক https://www.dropbox.com/s/c7w79zd10hvc21i/%E0%A6%86%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%95%E0%A7%87%20%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BC%20%E0%A6%9C%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B8%20%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%93%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE.mp3.mp3?dl=0
(লিখেছেন ভাই আবু মুশফিক)
‘রুহ আফজা’ পাকিস্তান ভারতে খুব পরিচিত শরবত, অনেকেই পছন্দ করেন। অনেকেদিন থেকেই তার সুনাম আছে। রুহ আফজার বোতলের ভিতরে যদি মদ ঢেলে দেয় আর লেবেল থাকল রুহ আফজারই, তো লেবেল থাকার কারণে ভিতরে যে জিনিস আছে তার উপর কোন আছর পড়বে না। আর ঐ মদ যদি কেউ খায়, রুহ আফজা লেবেল থাকার কারণে যে মাতাল হবে না, তাও নয়। ঠিকই মাতাল হবে যেরকম মদ খেলে মাতাল হয়। তো দুনিয়ার নানা ধরনের জিনিসে যেরকম প্রতারনা থাকে; ধরা যাক কোন একটা জিনিস বাজারে খুব চলছে, কোন ব্র্যান্ড, তখন তার নকল বের করতে আরম্ভ করে। আল-আমিন বিস্কুট যখন বাজারে খুব চলল তো আরো অনেক নকল আল-আমিন বিস্কুট বের হয়ে গেল, কিন্তু নিম্নমানের।
মানুষ দ্বীন চায়, দ্বীনের কদর আছে। আর দ্বীনের কদর যে আছে ঐটা আল্লাহওয়ালাদের কারণে। এক একজন আল্লাহওয়ালার কারণে এক এক জামানায় এক এক দেশে লাখো কোটি মানুষের কাছে দ্বীনের কদর বেড়ে যায়। ঐ কদর থাকার কারণে অন্যান্যরাও ওখান থেকে ফায়দা নিতে চায়। একই নাম দিয়ে, একই হাব-ভাব দিয়ে সে তার নিজের স্বার্থ লুটতে চায়। রাসূলে কারিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসবার আগে এই গোটা আরব অঞ্চলের মধ্যে বা দুনিয়ার অন্য কোন জায়গায় নবীর আবির্ভাবের কোন কথা, কোন খবর পাওয়া যায়নি। কিন্তু রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসার পরে উনার কারণে অনেকেই ভাবল এটা তো এক বিরাট বিজনেস। একজন, দুইজন নয়, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পর কিছুদিনের মধ্যেই অন্ততপক্ষে ত্রিশজন মিথ্যা নবীর দাবিদার আসল। তার মধ্যে মহিলাও ছিল। [মজমার হাসি] তো নবী দাবীদার সেই মহিলা আর এক পুরুষ দাবীদার, তারা দু’জন আবার বিয়ে করে ফেলল।
ব্যবসার ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায় স্বতন্ত্র কোম্পানী চালানোর চেয়ে মার্জ করে ফেললে আরো বেশি লাভ হয়, যাকে মার্জার বলে। ব্যাবসার ক্ষেত্রে মার্জার প্রচুর দেখা যায়, যেমনঃ ইউনিলিভার, মার্সিডিজ বেঞ্জ ইত্যাদি। তো ওরা দু’জন বিয়ে করে একটা জয়েন্ট এন্টারপ্রাইজ খুলল। [মজমার হাসি] একসাথে তারা নবুওয়্যাত করবে! সেই বিয়ের পরে হাদীয়া হিসেবে তাদের ‘উম্মতের’ জন্য দুই ওয়াক্ত নামায মাফ করে দিল! তাদের বিয়ে উপলক্ষ্যে। [মজমার হাসি]
তো সব জামানায় মানুষের কাছে দ্বীনের কদর আছে। আর কদর দ্বীনদার লোকের কারণে। ঐ এক নাম বিক্রি করে যুগ যুগ ধরে মানুষ অসৎ ব্যবসা করতে থাকে। ঈসা আঃ তো চলে গেলেন, কিন্তু ঈসা আঃ এর নাম নিয়ে কত ব্যাবসা তো এখনো চলে। আল্লাহওয়ালারা আসেন, তাদের নাম নিয়েও কত ব্যাবসা চলে। গ্রামে পর্যন্ত দেখা যায় লাল বাক্স একটা চেইন দিয়ে আটকে রেখেছে আর বলছে ‘টাকা দাও’। কিনু না কিছু টাকা পেয়েও যায়। আর বিশেষ করে দুর্বল যারা, দ্বীন থেকে দূরে, দ্বীনের উপর চলা মুশকিল হয়, তারাও মনে করে এখানে কিছু টাকা পয়সা দিয়ে পার পেয়ে যাই! আর মানুষের ভয় কাজ করে। আমাদের দেশে রাস্তার পাশে প্রচুর মাজার আছে আর এই মাজারগুলো প্রায় বেশিরভাগই শার্প টার্নিং এ থাকে। আর সাধারণত শার্প টার্নিংগুলোতে এক্সিডেন্ট বেশি হয়। তো ওখানে মাজার বসায় আর বলে এই মাজারে টাকা না দিলে এক্সিডেন্ট হবে। শার্প টার্নিংয়ের কারণে অনেক এক্সিডেন্ট হয়েও থাকে। তখন বলে যে এরা মাজারে টাকা দেয়নি, এজন্য এক্সিডেন্ট হয়েছে। একবার একজন ওয়াজ করছিল রাজশাহীতে, বলতে পারি না কি নাম, ঐ আহলে হাদীসদের ওয়াইজ, কিন্তু কথাটা শুদ্ধ লেগেছিল। কথাটা কি? ‘এরা যেসব পীরদের নামে টাকা তুলে, এই পীররা হাশরের ময়দানে আল্লাহর কাছে নালিশ করবে যে, ‘হে আল্লাহ, এরা আমাকে ছিনতাইকারী বলত। ছিনতাইকারী হিসেবে এরা আমার দুর্নাম রটিয়েছিল। টাকা না দিলে নাকি আমি এক্সিডেন্ট করাতাম’।
তো মানুষ বিভিন্নভাবে নিজের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য দ্বীনকে ব্যাবহার করে। দেওয়ানবাগী, আটরশি আরো কিকিসব আর এগুলো চলতেই থাকবে। যখনই কোন একটা জিনিস মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে, তখনই ঐটাকে ব্যাবহার করে। আল্লাহর মেহেরবানী, আল্লাহওয়ালাদের কুরবানি, মানুষের কুরবানির কারণে তাবলীগের কাজ পুরো দুনিয়াতে বড়ভাবে গ্রহনযোগ্যতা অর্জন করেছে। চাইলেই বিভিন্ন ধরনের মানুষ এখান থেকে তার ফায়দা নিতে পারে। এই বিষয়ে হযরত মাওলানা পালনপুরি রহঃ উনার হায়াতের শেষের দিকে খুব বেশি বয়ান করতেন।
উনার জীবনের শেষের দিকের বয়ানের বড় একটা অংশ এইটার উপর থাকত যে ‘দুনিয়াদাররা এসে ভীড় করবে’। হয়ত এরকম প্রবনতা উনি লক্ষ করেছেন।
আল্লাহতাআলা আমাদের দ্বীন দিয়েছেন আর আমাদের যাচাই করার দায়িত্ব দিয়েছেন আর আক্বলও দিয়েছেন। প্রত্যেকের দায়িত্ব দ্বীনের মানদন্ডে সে যেন দ্বীনকে বিচার করে। যারা নির্ভরযোগ্য দ্বীনদার, তাদের আচরন, তাদের কথা, তাদের দৃষ্টান্ত – ঐটা যদি চোখের সামনে থাকে, পরবর্তীতে প্রতারক যারা আসে তারা বেশি সুবিধা করতে পারবে না। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমরা মূলকে যথেষ্ট নজরের মধ্যে রাখি না – যার কারণে প্রতারকরা এসে সুযোগ পায়। মূল নজরের মধ্যে থাকলে প্রতারকরা সুযোগ পেত না। এই যে আমাদের দেশভরা, গ্রামে গ্রামে চিশতীয়া, কাদেরিয়া, মুজাদ্দেদিয়া ইত্যাদির নাম করে (কত কিছু করে)।
তো মূল যারা ছিলেন তাদের দৃষ্টান্ত, জীবনী যদি আমাদের চোখে থাকত। যেমনঃ কয়েকটা জিনিস। এক হল-নিজে সম্পদলোভী ছিলেন না, তাদের সংস্পর্শে যারা আসত, তাদের অন্তর থেকে সম্পদের মোহ কমে যেত, বাড়ত না। মুরিদ একজন জিকির করতে আরম্ভ করল, যদি জিকিরের আছর বেশি নাও পড়ে, সম্পদের মোহ কমল না, কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে বাড়বে না। তার ব্যাক্তিগত জীবনে শরীয়তের পাবন্দী বাড়বে, হালাল-হারামের সচেতনতা বাড়বে, এগুলো হল মৌলিক কিছু জিনিস। মূল প্রতারক যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে খুব বেশি চালাক হয়, তার প্রতারণা সরাসরি ধরা যায় না, কিন্তু ওর অনুসারী যারা, তাদের দিকে লক্ষ করলে তখন একজন মানুষ বুঝতে পারবে যে মূলটা ভাল না মন্দ। মোটামুটি এইধরনের যে আমগাছের পাতা দেখে বিচার করা যে এটা ল্যাংড়া নাকি ফজলি-এটা এক্সপার্ট ছাড়া পারবে না। কিন্তু খেয়ে পার্থক্য করা যে এটা ফজলি নাকি আশ্বিনা-এটা খুব সহজ।
ওরকম মূল প্রতারকের দিকে লক্ষ করে ও সত্য না প্রতারক-এটা বেশিরভাব মানুষ ধরতে পারবে না, কারণ যে এতবড় প্রতারক সে খুব চালাকও হয়। কিন্তু তার অনুসারীদের দিকে যদি লক্ষ করা হয়, তখন ধরা পড়ে সহজেই। অনুসারীরা কারা, আসার পরে তাদের আচরণের পার্থক্য কোন ধরনের, মাল-দৌলত সম্পদ বাড়ল না কমল ইত্যাদি। খুব দূর্ভাগ্যবশত আজকাল চোখে পড়ছে যে তাবলীগে আসার পরে বড় দ্রুত বিভিন্ন অঞ্চলে, এক জায়গায় নয়, বিভিন্ন অঞ্চলে বড় দ্রুত কিছু লোক তাবলীগের মুরব্বী কাম সম্পদশালী হয়ে যাচ্ছে।
কোন সম্পদ ছিল না, অন্য কোন ব্যাবসাও নাই, একেবারে শ্রেফ গায়েবি মদদ!!! [মজমার হাসি] বিরাট বিরাট দামি জমির মালিক হয়ে যাচ্ছে। এটা যদি লক্ষ্য করি যে কার সাথে তার সম্পর্ক, বুঝতে পারবে যে প্রতারনা কোথায়। কারণ তাবলীগে এসে তার সম্পত্তি বাড়ার কথা নয়। দ্বীনদার লোকের মধ্যে সম্পত্তি যে  হয় না-তা নয়। নবীও ছিলেন সুলাইমান আঃ, দাউদ আঃ; ছিলেন বাদশা নবী। সাহাবাদের মধ্যে আব্দুর রহমান রাঃ ছিলেন অত্যান্ত ধনী ব্যাবসায়ী। বড় সাহাবী-ওগুলো ছিল। প্রথম কথা হল নবী হওয়ার পরে সুলাইমান আঃ বাদশা হননি, ছিলেনই । সাহাবী হওয়ার পরে আব্দুর রহমান রাঃ ধনী হয়ে যাননি; এটা উনার আগে থেকেই ছিল। বরং বেশিরভাগ হল ধন-দৌলত ছিল, কমে গেছে। আবু বকর সিদ্দীক রাঃ, উসমান রাঃ আরো অনেক সাহাবী।
আল্লাহ তাআলা ধনী মানুষকে, ব্যাবসায়ী মানুষকে হিম্মত দেওয়ার জন্য হয়তোবা যাতে তারা নিরাশ না হয়ে যায়, এজন্য কিছু কিছু ব্যাতিক্রমী ধনী লোকও রেখেছেন। যাতে ধনীরা নিরাশ না হয়ে যায়, যে আমি তো জাহান্নামী হয়ে গেলাম। কিন্তু আমভাবে হল ঐটাই। কিন্তু যদি তার ব্যাতিক্রম দেখা দেয়, আর বিশেষ করে তার কাছের আচরণ, তার লোকের সাথে উঠাবসা ইত্যাদি যদি লক্ষ্য করে, তাহলে বুঝা যাবে মূল জিনিস মোটেই শুদ্ধ নয়। নাম, লেবেল ভাল কিনা ঐটা দিয়ে কিছুই প্রমাণ করা যাবে না। বোতলের ভিতরে যদি থাকে মদ, তার লেবেল রুহ আফজা থাকুক আর যে শরবতই থাকুক, ঐ লেবেল দিয়ে কিছু আসে যায় না। ঐটা যদি কেউ খায় তাহলে সে ঠিকই মাতাল হবে।
কোন একজন পীরের বেশভুষা যতই থাকুক না কেন, ওর দ্বীলের ভিতরে যদি দুনিয়ার মোহাব্বত আর প্রতারণা থাকে, যে ওর সাথে সম্পর্ক করবে তার ভিতর ঐ প্রতারণা, দুনিয়ার মোহাব্বত ইত্যাদি বাড়ানোর প্রবনতা হবেই। এর এজন্য সে আসলে এসেওছে বা ঐ আশাতেই এসেছে। বা হয়ত কখনো আসবার সময় দ্বীন মনে করেই এসেছে, কিন্তু তার কাছে গেলে তার মধ্যে ঐ আকর্ষন পয়দা হয় যে আমিও সম্পদশালি হয়ে যাই, ধনী হয়ে যাই। আজ দেখা যাচ্ছে এটা, বিশেষ করে বুয়েট, ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের মধ্যে দেখা যায়, তাবলীগে যাওয়ার পরে দুনিয়ার প্রতি ওর মোহ আরো বেড়ে গেছে। সাধারণ ছেলের তুলনায় এইসব তাবলীগী ছেলেদের দুনিয়া খাই খাই ভাব আরো বেশি। এতে বুঝা গেল যে ও দ্বীনের নামে যে মেহনতের মধ্যে এসেছে, ঐটার মধ্যে গভীর কোন প্রতারণা আছে। নইলে দুনিয়ার মোহ বাড়ার কথা নয়। এটাতো আল্লাহর মেহেরবাণী যে সে নামাযের পাবন্দী হয়েছে, দাড়ি রেখেছে, আরো কোন কোন ব্যাপারে দ্বীনদারি এসেছে। একেবারে যে আসেনি তা নয়, আল্লাহর ফজলে ঐটাও এসেছে। কিন্তু তার দুনিয়ার বড় বড় চাকরীর মোহ, সম্পদের মোহ এগুলো বেড়ে যাওয়াতে আগের তুলনায় বা ওর বন্ধুবান্ধব যারা তাবলীগে আসেনি তাদের তুলনায় ওর মধ্যে দেখা যায় যে দুনিয়া খাওয়ার চেষ্টা আরো বেশি। আমার কাছে এমনই মনে হয়েছে। বিশেষ করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি, বুয়েট, কৃষি ইউনিভার্সিটি ইত্যাদি। বুঝে নিতে হবে যে এর ভিতরে বড় মারাত্মক ধরনের কোন প্রতারণা আছে, ইচ্ছাকৃত হোক আর অনিচ্ছাকৃত হোক, আছে। কারণ দ্বীনের বড় অংশ হল দুনিয়ার মোহাব্বত কমা। দ্বীনের মৌলিক জিনিস এটা।
(সম্ভবত) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাঃ তাবেয়ীদের এক মজলিসে গেলেন। এই মজলিস তাবেয়ীদের। এই মজলিসে তাবেয়ীদেরকে আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাঃ বললেন ‘তোমরা ইবাদত বন্দেগী সাহাবাদের তুলনায় বেশি কর কিন্তু সাহাবারা তোমাদের চেয়ে ভাল ছিল’। মজলিসের মধ্যে উপস্থিত একজন উনাকে জিজ্ঞাসা করলেন যে ‘হে আবু আব্দুর রহমান, যদি আমরা সাহাবাদের চেয়ে ইবাদত বেশি করি তাহলে সাহাবারা আমাদের চেয়ে ভাল কেন ছিল?’ উত্তরে উনি বললেন যে, তারা তোমাদের চেয়ে বেশি যাহিদ ফিদ দুনিয়া আর রাগিব ফিল আখিরাত’। দুনিয়ার ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে বেশি যাহিদ (অনীহা, অনাগ্রহ) আর আখিরাতের ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে রাগিব (আসক্ত, আগ্রহী)। আমল কিন্তু অতবেশি ছিল না। আমল বেশি করলেই যে সে আখিরাতমুখী, তা কিন্তু নয়। অনেক সময় দুনিয়ার জন্য আমল করে। মোকদ্দমায় ফেঁসে গেছে, সারারাত তাহাজ্জুদ পড়ছে। তাহাজ্জুদ পড়ছে কিন্তু আল্লাহকে পাওয়ার জন্য নয়, মোকদ্দমা জিতবার জন্য। তো দ্বীন না দুনিয়া ঐটার বিচার তো সে কি করছে ঐটা দিয়ে নয়, বরং কেন করছে।
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمًا يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّهِ قل هل يستوي الذين يعلمون والذين لا يعلمون
أَمَّنْ هُوَ قَانِتٌ آنَاءَ اللَّيْلِ سَاجِدًا وَقَائِمً যে রাতের অংশ যাপন করে সিজদায় দাঁড়িয়ে অর্থাৎ নামাযে মধ্যে, কিয়ামের মধ্যে يَحْذَرُ الْآخِرَةَ وَيَرْجُو رَحْمَةَ رَبِّه আখিরাতের প্রস্তুতি নেয় আর আল্লাহর রহমতের আশায়
তো শুধু রাত যাপন করা, ক্বিয়াম সিজদা করা ঐটা ইবাদত নয়, ঐটা দ্বীনদারিও নয়, ঐটা যদি আখিরাতের জন্য করে তবেই দ্বীনদারি হবে। ঐটা দুনিয়ার জন্যও করতে পারে, আর করেও। দুনিয়ার জন্য করার বিভিন্ন ধরন আছে। এক তো হল একেবারেই প্রতারক। দাঁড়িয়ে আছে, তাহাজ্জুদ দেখাচ্ছে অথচ ওযুও করেনি, ঐটা হল একেবারে ঠিকই প্রতারক। [মজমার হাসি] কাফির, মুশরিক হতে পারে।
আরেক আছে, ওযু ঠিকই করেছে, নামায পড়ছে নির্জন জায়গায়, কেউ দেখছে না। তো সে কি আল্লাহওয়ালা হয়ে গেল? না। সে নামায পড়ছে আর আল্লাহর কাছ থেকেই চায় মোকদ্দমা যেন জিতে। জজকে দেখাচ্ছে না, উকিলকেও দেখাচ্ছে না, কেউ দেখছে না, নির্জন জায়গায় আল্লাহর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু তার লক্ষ্য হলো দুনিয়া, মোকদ্দমা জিতা। তো এই ব্যাক্তি একেবারে প্রচলিত অর্থে প্রতারক নয়, কিন্তু সে আল্লাহওয়ালাও নয়। যেহেতু তার লক্ষ্য দুনিয়া, যদিও আবিদ কিন্তু আল্লাহওয়ালা নয়।
এই জাতীয় একটা অর্থ সম্ভবত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রাঃ কথার মধ্যে ছিল যে তোমরা ইবাদত বেশি কর, কিন্তু সাহাবারা তোমাদের চেয়ে বেশি ভাল ছিল। বলছেন কিন্তু আমাদের জমানার মানুষকে নয়, তাবেয়ীদের বলছেন। ‘তোমরা ইবাদত বন্দেগী সাহাবাদের তুলনায় বেশি কর কিন্তু সাহাবারা তোমাদের চেয়ে ভাল ছিল’। কেন ভাল ছিল? সাহাবারা দুনিয়ার ব্যাপারে বেশি অনাগ্রহী আর আখিরাতের ব্যাপারে বেশি আগ্রহী ছিলেন। আমার দ্বীনদারি তখনই বাড়বে যদি আমার মধ্যে দুনিয়ার আগ্রহ কমে আর আখিরাতের আগ্রহ বাড়ে। এটা হলো সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মানদন্ড।
আর আমি দ্বীনের মধ্যে গেলাম, চিল্লা দিলাম, তিন চিল্লা দিলাম আর আমার দুনিয়ার আগ্রহ যদি বেড়ে যায়। (ধরা যাক) ইবাদত বাড়ল, আগে দাড়ি ছিলনা, এখন দাড়ি আছে, আগে টুপি ছিলনা এখন টুপি আছে। এসব ঠিক আছে, কিন্তু আমার দুনিয়ার আগ্রহ যদি বেড়ে যায়, আগের চেয়ে কমলো তো না-ই বরং আরো বেশি হয়ে গেল- তাহলে তো বড় খারাপ দিকে যাচ্ছি। অনেকসময় আনুসাঙ্গিক কারণে হয়ে যায়।
গ্রামের একজন সাদাসিধা অশিক্ষিত মানুষ। তাবলীগে এসে খুব মেহনত করল, মেহনত করার কারণে ওখানে অন্যান্য তাবলীগীদের সাথে তার পরিচয় হল, আর তারা তার খুব খাতিরও করে আর খাতির করে বড় বড় অফিসাররা। ডিসি, এসপি, জজ এরা দ্বীনের কারণে খাতির করে। কিন্তু ঐ বেচারার জন্যে এই খাতির হজম করা মুশকিল। যে ব্যাক্তি কখনো ডিসির বাড়ির এরিয়ার ভিতরে ঢুকতে পারনি আর তাকে যদি এখন ডিসি নিজের গাড়িতে করে পাশে বসিয়ে নিয়ে যায়, তাহলে সে এমন নতুন একটা স্বাদ পাবে -কিছু লোক আছে এটা হজম করতে পারে, কেউ কেউ পারে না।
আমরা অনেকে সময় টাকা পয়সা চাইনা। কিন্তু আমি যে একজন ডিসির সাথে পাশে বসছি, লোকে দেখুক এটা আমার মন চাই। আর কেউ যদি আমাকে একটু তাচ্ছিল্যের সাথে কথা বলে, যেটা আগে আমি সহ্য করতে পারতাম, এখন আর সহ্য করতে পারিনা। কেন? কারণ এখন আমি যেনতেন লোক না। আগে যেনতেন লোক ছিলাম। লোকে যদি ধাক্কা দিত, ‘বস’, তাহলে বসে যেতাম, কিন্তু এখন আমি আর যেনতেন লোক না। আমি ডিসির সাথে গাস্ত করি ইত্যাদি ইত্যাদি। এইসব কারণেও হয়ে থাকে যেটা সরাসরি তাকে দোষ দেওয়া যায় না। কিন্তু এছাড়া যাদের সাথে আমি যাচ্ছি, তাদের দুনিয়ার (আগ্রহ) প্রবল হওয়ার কারণে তবলীগে যাওয়ার পরে আমি এদের সাথে উঠাবসার কারনে আমার দুনিয়ার মোহ বেড়ে গেছে। এই জিনিস যদি হয়, তো আমি বড় খারাপ পথে চলছি।
বলা হয়, প্যারিসে গিয়ে যে নষ্ট হল, ওর ভাল হওয়ার জায়গা আছে, মক্কায় যাবে। কিন্তু মক্কায় গিয়ে যে নষ্ট হল, ও কোথায় গিয়ে ভাল হবে? প্যারিসে গিয়ে তো আর ভাল হবেনা। ঠিক ওরকম দুনিয়ার পরিবেশে থেকে যে নষ্ট হল, তার জন্যে ভাল হওয়ার জায়গা আছে। (কিন্তু) দ্বীন; দ্বীনে গিয়ে যে নষ্ট হল, ও কোথায় গিয়ে ভাল হবে? ওর আর কোন জায়গাই নাই।
তো আমাদের নিজেদেরও সতর্ক হওয়া, আর অন্যান্যদের ব্যাপারেও আমাদের চিন্তাফিকির করা। কখনো কখনো মানুষ, বিশেষ করে নতুন যারা তবলীগে এসেছে, তার একটা জযবা থাকে ‘একে ওকে সাহায্য করব’। তো কেউ চিল্লায় যেতে চায়, টাকা নাই। তো তাকে পকেট থেকে দিয়ে দিল। সে তো ভাল নিয়্যতেই দিচ্ছে, কিন্তু যাকে দিল, অনেক ক্ষেত্রেই তার ক্ষতি হল। ও এসেছিল আল্লাহর কাছ থেকে নেওয়া শিখবার জন্য, আর এসে মানুষের কাছ থেকে নেওয়া শিখে ফেলল। (আর) তার ক্ষতি হয়ে গেল। এর মধ্যে যে দিয়েছে না বুঝে হলেও সে দোষী। সাহায্য করাও দরকার, এটাও শরীয়তের হুকুম আছে, প্রয়োজনও আছে, কিন্তু বুঝে শুনে। এজন্য উত্তম জিনিস হল নির্ভরযোগ্য লোকের সাথে পরামর্শ করা। তা না হলে তার উপকার করতে গিয়ে ক্ষতি করে ফেলবে। ও এসেছিল আল্লাহর কাছ থেকে নেওয়া শিখবার জন্য, তাকে মানুষের কাছ থেকে নেওয়া শিখিয়ে দিল। এখন সে এর পরবর্তীতে যখন চিল্লায় যাবে তখন ধনী লোকের সাথে যাওয়ার চেষ্টা করবে। মন চাইবে ধনীদের সাথে যাই, আর ধনীদের সাথে যাই এজন্য যে অপেক্ষা করবে কোন ফাঁকে ওরা দিবে। এটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।
তো আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীন দিয়েছেন, দ্বীন তো শুদ্ধ, কিন্তু আমাকে তার শুদ্ধতা রক্ষা করতে হবে। তাবলীগের কাজের মধ্যে মৌলিক কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এর কথা, মালফুজাতে আছে। সুযোগ পেলেই একথা বলি যে, ‘মালফুজাত’ (মঞ্জুর নোমানী রহঃ এর) আর ‘মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এবং তার দ্বীনী দাওয়াত’ (নদভী রহঃ এর) এই দুটো বই যেন সব তবলীগওয়ালাদের কাছে থাকে আর এটা যেন তার হাতের কাছে থাকে, যখন তখন যাতে পড়তে পারে। শুধু যে এটা সিলেবাসের বইয়ের মত প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একবারে পড়ে ফেলল ওরকম নয়। হাতের কাছে থাকলে উল্টাবে-পাল্টাবে, যখন তখন পড়বে। একটা হয়ত সতেরবার পড়া হবে আরেকটা হয়তো একবারও পড়া হবে না, কিন্তু যদি উলট-পালট করতে থাকে, আল্লাহ তাআলাই হয়তো কখনো কখনো তার সামনে ঐটাই খুলবেন, যেটা ওর জন্য দরকার ছিল।
‘মালফুজাত’ আর ‘মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এর দ্বীনী দাওয়াত’ এই দুটোর চর্চা থাকলে মূল উৎস কি, ঐটা আমার চোখের সামনে ভাসবে। তখন পথে আসা জিনিস বুঝতে পারব, কোথায় গন্ডগোল।
বহুদিন আগে আমার পরিচিত একজন, তার শখ হল ব্যাবসা করবে। সে ব্যাবসা জানে না, কিন্তু করার দরকার, অন্য কিছু নাই আর ওর পকেটে টাকা আছে। তো সস্তায় পেল ডেটল, এন্টিসেপটিক বোতল। সস্তায় পেয়ে অনেকগুলো কিনল, এসে খুচরা বিক্রি করবে বলে। আনার পরে দেখে সব দুই নম্বর। ডেটলের বোতলে উপরে সীল ঠিকই আছে, কিন্তু ভিতরের জিনিস ভিন্ন। এই প্রতারনা থেকে সাধারন মানুষের জন্য বাঁচার একটা উপায় হল যে শুধু ডেটলের শিশি না দেখে একেবারে পাশাপাশি নিয়ে যদি মূলটা আর নকলটাকে একসাথে রাখে, দুটোর মুখ খুলে, দুটোর গন্ধ একসাথে নেয়, তখন হয়তো নন-এক্সপার্টও ধরতে পারবে। কিন্তু গতকালকে দেখেছিলাম আসল ডেটলের শিশি, আর আজকে দেখছি এই  ডেটলের শিশি, তাহলে পার্থক্য বুঝা মুশকিল। গতকাল আসল ডেটলের গন্ধ নিয়েছি আর আজকে এই নকল ডেটলের গন্ধ নিচ্ছি, তাহলেও পার্থক্য বুঝা মুশকিল। একই সাথে যদি দুটোর গন্ধ নিই, একই সাথে পাশাপাশি দাড় করিয়ে যদি দুটোকে দেখি, তাহলে আশা করা যায় যে ধরা পড়বে।
মালফুজাত ও মাওলানা ইলিয়াস ও তার দ্বীনী দাওয়াত এগুলোর যদি সবসময় চর্চা চলত, আশা করা যায় ভুল-ত্রুটি বা প্রতারনা যেটাই হোক না কেন চোখে ধরা পড়বেই। আর তা না হলে সাধারণ মানুষের জন্য এসব ধরা মুশকিল। মালফুজাতের মধ্যে একটা কথা আছে, দুনিয়ার যত কাজ হয়, মানুষ স্বার্থ উদ্ধার করে তিনটা ‘জে’ কে ব্যাবহার করে। আরবীতে বলে ‘জা’, উর্দুতে ফার্সীতে বলে ‘জে’। জোর, জর, জারি। জোর হল শক্তি, জর হল সোনা, জারি হল কান্না।
মানুষ তার স্বার্থ হাসিল করবার জন্য, রাজা বাদশারা শক্তি প্রয়োগ করে। ব্যাবসায়ীরা, ধনীরা জর সোনা ব্যাবহার করে অর্থাৎ সম্পদ। আর তৃতীয়টা হল জারি মানে কান্না। আমাদের দেশে জারি গান বলে। জারি গান মূলত যেটার কোন বিষাদ গল্প থাকে, যেমন কান্নাকাটি। দ্বীনের কাজ ‘জোর’ এও হয়না, ‘জর’এও হয়না, ‘জারি’তে হয়। দ্বীনের কাজের মধ্যে ঢুকে যদি আমি দেখি সম্পদ প্রয়োগ করছে, সম্পদের লেনদেন হচ্ছে, আরেক ধাপ আগে অশুদ্ধ লেনদেন হচ্ছে বা শক্তি প্রয়োগ করছে, বুঝে নিতে হবে এটা দ্বীনের কাজ নয়।
আর এটাতো খুব সহজেই ধরা যাচ্ছে। কিন্তু মানুষ প্রতারিত হচ্ছে, কেন প্রতারিত হচ্ছে? যদি মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এর এই ছোট্ট কথাটা ওর নজরে থাকতো যে দ্বীনের কাজ তো টাকা-পয়সা দিয়ে হয়না, দ্বীনের কাজ শক্তি প্রয়োগ করে, ভয় প্রদর্শন করেও হয়না, দ্বীনের কাজ চোখের পানি ফেলে হয়। এখানে তো চোখের পানি ফেলছে না, বরং টাকা-পয়সা ঢালছে, ভয় দেখাচ্ছে নিশ্চয় এটা দ্বীন নয়। বুঝা কঠিন হত না যদি মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এর এই কথা তার সামনে থাকত। কিন্তু যদি না থাকে প্রতারিত হবে আর হচ্ছে। নজরের সামনে থাকা দরকার। গতকালকে দেখেছি আসল ডেটলের বোতল আর গতকাল নিয়েছি আসল ডেটলের গন্ধ, আর আজকে দেখলাম নকট ডেটলের বোতল, নকল গন্ধ গতকালের সাথে আজকের এই তুলনা করা অনেকেই পারবে না। একই সাথে যদি তুলনা করি, তাহলে হয়তোবা পারবে।
তো আল্লাহ তাআলা আমাদের দ্বীন দিয়েছেন। চেষ্টা যদি বান্দা করে, তাহলে তার বাচার উপায় আছে, তবে তাকে চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে থাকতে হবে। হাদীস শরীফে খুব তাকিদ আছে ‘গরীবদের সাথে থাক’। আমাদের মন চাই ধনীদের কাছে থাকি। ঢাকায় বিশেষ করে ইজতিমার আগে ভিআইপি জামাআত বের হয়। কিছু কিছু লোক আমি চিনি, সারা বছর অন্য আর কোন তবলীগ করেই না, কিন্তু ভিআইপি জামাআতের সাথে যতদিন দরকার ততদিন দিবে, কিন্তু এর বাইরে না। সে বেচারা আল্লাহ জানে, হয়তোবা সে মনে করে দ্বীন, আসলে ওর আগ্রহ হচ্ছে বড় অফিসার, বড় শিল্পপতি এদের সাথে থাকা। এতে যে টাকা-পয়সা বেশী কিছু পাচ্ছে তাও নয়, কিন্তু ভাল লাগে। একজন শিল্পপতির পাশে বসলাম, একটু দোস্তী করলাম। হায় দোস্ত! এই বলাটাই আমার স্বার্থকতা।[মজমার হাসি] এর মোকাবিলায় গরীবদের সাথে থাকার মধ্যে আল্লাহ তাআলা বড় ফায়দা রেখেছেন।
তো ওরকম কোন ভিআইপি জামাআতে একজন গরীব লোক গেছে। আসলে সে যায়নি, (বরং) ওকে নিয়ে গেছে। আর কিছু ধনী লোক ছিল। ঐ গরীব লোক রাত্রিবেলা তাহাজ্জুদে  খুব কাঁদছে, তার পাশেই একজন বড় ব্যাবসায়ী, উনি লক্ষ্য করেছেন, ঘুম ভেঙ্গে গেছে। লক্ষ্য করলেন খুব কাঁদছে, কৌতুহল হল। পরেরদিন এক সুযোগে তাকে এত কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। ও বলল, ‘আল্লাহর কাছে আমি কি জবাব (হিসাব) দিব এই ভয়ে কাঁদছি’। উনি জিজ্ঞেস করলেন ‘আপনি কি করেন?’ সে বলল ‘মাছ ধরি’। মাছ ধরার কথা শুনে শিল্পপতি সাহেব তার নিজের মত করে মনে করেছেন যে ট্রলার ইত্যাদি আছে। আসলে ওর আছে একটা উড়াল জাল। রাস্তায় রাস্তায় হাটে, ড্রেনে জাল ফেলে, কখনো পুটি, কখনো ট্যাংরা এক-দুইটা উঠে, কিছু হয়ত নিজে খায় আর কিছু পাঁচ-দশটাকায় বিক্রি করে এভাবেই ওর চলছে। কিন্তু উনি নিজের মত আন্দাজ করেছেন যে বোধহয় ট্রলার ইত্যাদি আছে, ফিশিং ইন্ডাস্ট্রি। আরো যখন ঘাটাঘাটি করলেন, তখন বুঝতে পারলেন যে আসলে ট্রলারও নয়, ফিশিং ইন্ডাস্ট্রিও নয়, একখানা উড়াল জাল মাত্র। উনার দ্বীলে খুব ধাক্কা লাগল যে মাত্র একটা উড়াল জাল তার, আর সেটা নিয়ে সে চিন্তিত ‘হিসাব দিবেন কেমন করে’। তো আমার কি উপায় হবে?
তো গরীবদের সাথে থাকলে এই ফায়দা হবে। উনার দ্বীলে খুব আছর পড়ল যে আমি যে লাখো কোটি টাকা নিয়ে হামেশা খেলছি, কখনো তো আমার চিন্তাই হয়না যে হিসাব দিব কেমন করে। আর মাত্র কয়টা পুটি মাছ ধরে আর ওর চিন্তা যে কি হিসাব দেবে!
কিন্তু তার বিপরীত যদি হয়, লাখো কোটি টাকা, তখন অপর কথা মনের মধ্যে ঢুকবে। মন বলবে তবলীগ আমিও করি, আর তবলীগ সেও করে। আর আমার তবলীগ কি দুই নম্বর নাকি! এত বছর তবলীগ করেও একখানা ফ্লাটই কিনতে পারলাম না আর কত বিল্ডিংয়ের মালিক সে হয়ে গেল। ধুর! শেষ কথা এটাই হবে। [মজমার হাসি]
যার সম্পদ, টাকা পয়সা দেখছে, হতে পারে তার সম্পূর্ণটা হালাল এবং সে একজন মুত্তাকী, পরহেজগার ব্যাক্তি সেটা ভিন্ন। মুত্তাকী, পরহেজগার লোক সম্পদশালী হয়না, এমন নয়। বড় বড় আল্লাহওয়ালারা বিরাট সম্পদশালী হন, যদিও ওগুলো খুবই কম। কিন্তু একেবারে অসম্ভব, তা নয়। কিন্তু উনাদের তাকওয়া, পরহেজগারি আমি দেখলাম না, দেখলাম শুধু দামি গাড়ি আর দামি জায়গায় তার বাড়ি, এটা দেখে আমি নষ্ট হয়ে গেলাম। (তো) ধারে কাছে যাওয়াই নিরাপদ নয়। এজন্য বড় তাকিদ আছে গরীবদের সাথে থাকার। খুব তাকিদ আছে। রিয়াদুস সালেহীনে স্বতন্ত্র বাব আছে। এতে নিজের শুদ্ধতা আসে।
করাচী থেকে মাস্তুরাতের জামাআত গেছে পেশোয়ার। পেশোয়ার ওয়ালারা বলছে ‘ভাই জামাআতের নূসরত কর’। নূসরত মানে তাদের পরিবার নিয়ে ওদের কাছে নূসরত করতে গিয়েছে। একদিন গিয়ে দ্বিতীয় দিন আর অনেকেই যায়না। কেন? ঐ করাচীর মহিলাদের সাথে প্রথমদিন বসেই আমার বিবি নষ্ট হয়ে গেছে। [মজমার হাসি] তার জামা-কাপড়, গয়নাগাটি, অলংকার, কথাবার্তার ধরন একদিনেই আমার বউকে নষ্ট করে দিয়েছে। কারণ খারাপের আছর দ্রুত পরে। আর এটাতো আমাদের প্রচুর অভিজ্ঞতা অনেকেরই আছে। পরিবারের দিক থেকে এরবাড়ি, ওরবাড়ি যায়। তবলীগওয়ালাদের যাদের বাড়ি যায় তাদের মধ্যে গরীব মানুষও আছে, ধনীমানুষও আছে। গরীব একজনের বাড়ি গিয়ে ফিরে এসে আমার বউ এইকথা বলেনা যে ওর বাড়িতে তো কিছুই নাই, আমার বাড়িতে এত বেশি জিনিস কেন? এগুলো সদকা-খয়রাত করে কিছু কমাই একথা বলে না। কিন্তু ধনী বাড়িতে গিয়ে কোন একটা জিনিস দেখল যেটা আমার বাড়িতে নাই, ব্যাস, সে লাফালাফি শুর করে ‘সেও তবলীগ করে, তুমিও তবলীগ কর, আর তুমি ফকির এর মত কেন? আসলে তোমার তবলীগই দুই নম্বর। জেনুইন তবলীগ করলে তোমারোতো এরকম টাকাপয়সা  থাকত। [মজমা  হেসে ফেলল]। তো তোমরা অনেকেই হাসছ, কারণ বোধহয় তোমাদের অভিজ্ঞতা আছে এরকম। [মজমা আবার হেসে ফেলল]।
তবলীগের কাজ এমন যে আমরা ধনী লোকের কাছে যাবই না, যেতে পারবই না এমন না। সরে থাকা মুশকিল। কিন্তু আমার নিজের সতর্কতা আমি অবলম্বন করব। সাপুরে সাপ তো ধরবেই, কিন্তু নিজের জান বাঁচাবার ফিকিরও যেন সে করে। গাস্তে আমাকে যেতে হবে, আমি যদি বলি ‘না, ধনী লোকের কাছে আমি গাস্তে যাব না’ এমনটাও হয় না। জামাআতের আমীর বলেছে আমাকে যেতে হবে। তার বাড়িতে আমি ঢুকব, কিন্তু নিজেকে রক্ষা করি। যদি আমি সতর্ক থাকি, চেষ্টা-ফিকির করতে থাকি, ইন’শা’আল্লাহ, আল্লাহ তাআলা আমাকে হেফাজত করবেন।
কয়েকটা জিনিস। এক হল আল্লাহর পথে যাওয়ার পরে আমার সম্পদের মোহ যেন না বাড়ে, চাকরি-বাকরি যারা করছে, আরো উপরের পদে যাওয়ার মোহ যেন না বাড়ে। এত জোর দিয়ে এজন্য বলছি, চোখের সামনে প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে যেগুলো তবলীগে না গেলে এত দুনিয়াদার হত না, তবলীগে যাওয়ার কারণে যত দুনিয়াদার হয়েছে। আর তার বড় মোহ। এখন দুআ করে, চেষ্টা তো আছেই, তার সাথে দুআ, বড় বাড়ি থাকা দরকার, বাড়ির আবার দুটো entrance স্বতন্ত্র গেট থাকা দরকার, দামি গাড়ি থাকা দরকার। যে গাড়ির বাইরে থেকে ভিতরে দেখা যায় না, ভিতর থেকে বাইরে দেখা যায়। জান্নাতে যেরকম আছে [মজমা হেসে ফেলল]। আর এগুলোর জন্য সে নানান চেষ্টাও করে, দুআও করে। আবার আল্লাহকে বুঝায় ‘এগুলো আমি যে করছি শুধু তোমার জন্য করছি, আমার নিজের কোন স্বার্থ নাই, মাস্তুরাতের জামাআত আনতে হবে, দেশ-বিদেশের জামাআত। যদি এরকম উপযুক্ত বাড়ি না থাকে তাহলে মাস্তুরাতকে রাখব কোথায়? সেজন্য বড় বাড়ির দরকার, বড় গাড়ির দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি। আবার আল্লাহকে বারবার করে বলে যে তুমি আসলে ব্যাপারটা ভাল করে বুঝতে পারছ না বোধহয়, আমার নফসের কোন দাবী এখানে নাই। [মজমার হাসি] একেবারে পিউরলি তোমার খাতিরেই করছি এগুলো। তো ওর সন্দেহ রয়ে যায় যে আল্লাহ ঠিকমত বুঝতে পারল কিনা, সেজন্য বারবার করে বুঝায় যেন সব আসলে আল্লাহর ওয়াস্তে। শয়তানও তাকে ধোকা দিয়েছে, আর সেও মনে করে আল্লাহর ওয়াস্তে, অথচ এই তাবলীগ ইত্যাদির সাথে জড়িত হওয়ার আগে তার মোটামাটি হলেই চলে যেত। আর এখন গাস্তের জন্যও তার গাড়ি দরকার।
তো ভাই আল্লাহ তাআলা দ্বীন দিয়েছেন, আল্লাহওয়ালাদের জীবনের দিকে যেন আমাদের নজর থাকে। ফাযায়েলে সাদাকাতের খুব বেশি যেন চর্চা করি। ফাযায়েলে সাদাকাত ও ফাযায়েলে আমল দুটোই আমাদের তবলীগের নিসাবের মধ্যে, কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত ফাযায়েলে সাদাকাতের চর্চা কম। কম পড়া হয়, অথচ ঐটা পড়ার প্রয়োজন খুব বেশি। এমনকি কিছু কিছু এমন কথাও শুনেছি, পুরনো তবলীগী সমালোচনা করছে শাইখুল হাদীস হযরত মাওলানা যাকারিয়্যা রহঃ এর। ‘উনি এই ফালতু! কিতাব কেন লিখলেন? এই জাতীয় কথা যে আসলে এটা কাজের সাথে সামঞ্জস্য নয়, এটাতো দরবেশ বানায়। এমন কথা থাকা উচিত যেগুলো মানুষকে ফিকিরমন্দ বানাবে’। কি যে ফিকির, কি যে দরবেশ কিছুই বুঝা যায় না।
অথচ আমাদের মেজাজের মধ্যে যদি দুনিয়ার আগ্রহ না কমে তবে দ্বীন বুঝতে পারব না। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) এর ছোট্ট উক্তি, বলছেন তাবেয়ীদেরকে “তোমরা সাহাবাদের চেয়ে ইবাদত বন্দেগী বেশি কর, কিন্তু সাহাবারা তোমাদের চেয়ে বেশি ভাল”। কথাটা কি? কথা একটাই ‘তারা দুনিয়ার ব্যাপারে বেশি যাহিদ ছিলেন আর আখিরাতের ব্যাপারে বেশি রাগিব ছিলেন’। আর তবলীগে আসার পরে মানুষের সাথে উঠাবসার কারণে অজান্তেই আমাদের সামাজিক উপরে অবস্থানের মোহ হয়ে যায়। আর একজন গরীব মানুষ গরীবের সাথে থাকত, সে কোন বাড়িতে ঢুকতও না, ঢুকতে পারতও না, তাকে বসাতও না। (কিন্তু) এখন ঢুকতে পারে, বসতে পারে আর তার শখ এরকম আমারও থাকুক। আগে এগুলি তার চোখের সামনে ছিলই না।
গল্প আছে মেওয়াতী নাকি এসেছে দিল্লীতে, লালকেল্লা দেখেছে, শাহজাহানের রাজবাড়িতে যেটা, ঐটা বিরাট এরিয়া চারপাশ ঘুরে দেখতে অর্ধেক দিন হয়ত লাগবে প্রায়, বাইরে বাইরে থেকে দেখেছে। সম্পূর্ণ দেখার পরে আন্দাজ তো করতে পারল যে বানিয়েছে কত বড়লোক হবে। তারপর সে বলল, ‘যে এই বাড়ি বানিয়েছে ও বোধহয় রোজ গুড় দিয়ে রুটি খায়’।[মজমার  হাসি]
তার জন্যে নিজেকে সামলিয়ে রাখা সহজ, কারণ বড়লোকই তার চোখের সামনে নেই। কিন্তু যার সামনে বিলাসিতার নানান সুরত, তার চোখের সামনে আছে, তার জন্যে নিজেকে সামলে রাখা একটু বেশীই শক্তি লাগবে। দূরে দেখলাম, বড়লোকরা কি করে জানিই না, বা তাদের ধারে কাছেই যাইনা, রাজা-বাদশাদের কাছে গেলে না বুঝব ক্ষমতার মোহ কি জিনিস। রাজাদের ইতিহাসে প্রচুর পাওয়া যায় ভাইকে মেরে ফেলা এটা তো ডালভাত, নিয়মই। মোঘল রাজবংশের নিয়মই ছিল এটা যে ভাইদের মধ্যে একজন থাকবে আর বাকি সবাইকে মেরে ফেলবে।
বড় হলে পরে একজন থাকবে, বাকি ভাইদেরকে মেরে ফেলবে। এটাই নিয়ম। লিখিত নয়, কিন্তু এটা মাও জানে, বাপও জানে যে এরা কয়েকজন বড় হবে, তারপর এদের মধ্যে যুদ্ধ হবে। একজন দিল্লীর সম্রাট হবে আর বাকিদেরকে মেরে ফেলবে।
বাপ তার ছেলেকে মেরে ফেলে। তৈমুর লং ওর সবচেয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন যে ছেলে, বুদ্ধিশুদ্ধির দিক থেকে, ও যখন একটু বড় হয়ে উঠেছে, বাপের ভয় লেগেছে যে এই ছেলে না আমার সিংহাসন নিয়ে নেয়। তো বাপের আদেশে তার চোখ তুলে ফেলা হয়েছে। বাপ তো দূরে, একথা শুনতেই কেমন লাগে যে একজন মানুষ জীবিত আর তার চোখ তুলে ফেলা হল। চিনিনা, জানিওনা, শুধু পত্রিকায় যদি কথাটা বের হয়, তাও কত পাঠক পড়ে পেরেশান হয়ে যায়। আর বাপ তার ছেলের ব্যাপারে আদেশ  দিচ্ছে তার চোখ তুলে ফেলার জন্য।
দুনিয়ার মোহ কত প্রবল যে হতে পারে এটা সাধারণ মানুষের জন্য আন্দাজ করা মুশকিল। ওর কাছে যদি কেউ উঠাবসা করে, তার আছর তো পড়বেই। এজন্য ভাই, দুনিয়া থেকে তো সরে থাকতে পারব না, কিন্তু আত্মরক্ষার হামেশা চেষ্টা করা। এজন্য যদি আমি কখনো দুনিয়ার পরিবেশে যাই, ফিরে এসে আবার তার উপযুক্ত মেহনত করবার চেষ্টা করি যাতে নিজেকে সাফ করতে পারি। মাওলানা ইলিয়াস রহঃ মেওয়াত যেতেন, মেওয়াত থেকে ফিরে আসার পরে রায়পুরে গিয়ে ইতেকাফ করতেন, সাহারাণপুরে গিয়ে ইতেকাফ করতেন। মেওয়াতের যে দুনিয়াদারির আছর পড়ে গেছে বোধহয় এজন্য ই্তেকাফ করে ঐটাকে পরিস্কার করতেন। তো মেওয়াত গিয়ে ফিরে এসে যদি ইতেকাফ করে নিজেকে পরিস্কার করতে হয়
আমরা যদি মেওয়াতে গিয়ে একচিল্লা কাটাতে পারি, (মনে মনে ভাবি) সারাজীবনের ময়লা চলে যাবে। আর উনি মেওয়াতের ময়লা দূর করার জন্যে ইতিক্বাফ করছেন। দুনিয়া থেকে তো পালিয়ে যেতে পারব না, দুনিয়ার পরিবেশের ভিতরেই আছি, কিন্তু নিজেকে রক্ষা করা দরকার আর বুঝা দরকার যে তবলীগ কি? নাম লেগে গেলেই তবলীগ হয় না। টাকা পয়সা, লেনদেন এটা তবলীগ নয়, সন্ত্রাস ঐটাও তবলীগ নয়।
সহজেই বুঝতে পারবে ঐ ব্যাক্তি যার সামনে মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এর এই কথাটা আছে যে দ্বীনের কাজ ‘জোর’ এও হয় না, ‘জর’ এও হয়না, এটা তো ‘জারি’তে হয়। আর করেছেন হামেশা। পায়ে পড়া, চোখের পানি ফেলা। মাওলানা ইলিয়াস রহঃ কে থাপ্পর মেরেছে আর উনি তার পায়ে পড়েছেন। ধাক্কা দিয়েছে পায়ে পড়েছেন। আর তবলীগের কাজ এভাবেই হত।
আব্দুল হামিদ সাহেব ছিলেন একজন। মোহামেডান স্পোর্টিং এর নামকরা ফুটবলার ছিলেন, ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। এটা ছিল বৃটিশ জমানা, তখন একজন ইঞ্জিনিয়ার সাংঘাতিক ব্যাপার । বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, সাংঘাতিক কথা; যে জমানায় মেট্রিক পাশ করা লোকে দেখতে আসত। [মজমা হেসে ফেলল] উনি ছিলেন বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার, তারপর আবার মোহামেডান এর সেন্ট্রাল ফরোয়ার্ড। দুই লাইনেই একেবারে টপে। তো আকাশের চেয়েও উপরে উড়েন। উনি কোথাও যাচ্ছিলেন। প্লাটফর্মে একটা তবলীগী জামাআত যাচ্ছে। ঐ তবলীগী জামাআত যাওয়ার সময় ভীরের মধ্যে ট্রেনে উঠতে গিয়ে তবলীগওয়ালার গাট্টি উনার গায়ে লেগেছে। উনি দিয়েছেন চড়। যার গাট্টি লেগেছে সেই তবলীগওয়ালা মোটামাটি বয়স্ক, চড় খেয়ে উনার কাছে মাফ চেয়েছে, ‘আমাকে মাফ করে দিন, আমি আপনাকে দেখতে পাইনি, বুঝতে পারিনি, আর বারবার মাফ চাচ্ছেন’। মাফ যে চাচ্ছেন কোন নকল মাফ চাচ্ছেন না। মাফ চাওয়ার বিষয় হল আপনার মত ব্যাক্তির মর্যাদা আমি রক্ষা করতে পারিনি এটা আমার অপরাধ আর একেবারে দ্বীল দিয়ে মাফ চাচ্ছেন। আব্দুল হামিদ সাহেব যদিও চড় মেরে দিয়েছেন, কিন্তু ভিতরে একজন শরীফ লোক ছিলেন। ওর মাফ চাওয়াতে উনি একেবারে গলে গেছেন। উনার টিকিট ছিল ফার্স্ট ক্লাসে, কিন্তু থার্ড ক্লাসে গিয়ে ঐ তবলীগওয়ালার পাশে গিয়ে বসেছেন। সেও সুযোগ মত পেয়ে তশকীল করে ফেলেছে। বাকি জীবন তবলীগ-ই করেছেন।
তো ঐ এক চড়ের বদলে তার মাফ চাওয়া উনার সম্পূর্ন জীবন নিয়ে নিয়েছে। আর দ্বীনের কাজ এভাবেই হয়। অমুককে পিটিয়ে, মাথা ফাটিয়ে, তাকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে তবলীগী বানিয়ে দিব এটাতো পার্টি হয়, সন্ত্রাস হয় অনেক কিছু হয়, কিন্তু দ্বীন হয় না
কিন্তু বেশুমার মানুষ ধোকায় পড়ে গেছে, একজন দুজন নয়, লাখো মানুষ বলছে এটাই তবলীগ। কেন করছে? আসল তবলীগের রূপ তার সামনে দেখানো হয়নি, দেখানো দরকার। কিছু লোকও যদি তার আসল জিনিস দেখাতে পারে, হাজারো নকল কেটে যাবে। একটা ভাল স্যাম্পল দেখাতে পারলে হাজারো নকল কেটে যাবে। আল্লাহ আমাদের তৌফিক নসীব করুন আমরা যেন সেই ভাল স্যাম্পল হতে পারি, অন্যদেরকেও ভাল স্যাম্পল দেখাতে পারি। আল্লাহ আমাদের তৌফিক নসীব করুন।
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ
(মাজালিসে মুশফিক আহমেদ রহঃ  ২৩-০৩-২০১৫)
অডিও ডাউনলোড লিংক



দ্বীনের লক্ষ্যই এটা যে, একজন মানুষের নিজ চেতনা এত উন্নত হয়ে যায়, স্বতস্ফুর্তভাবে যে কাজ করবে (স্বতস্ফুর্তভাবে), কোন দলিল প্রমাণ দেখে নয়, কোন যুক্তি দিয়ে নয়, স্বতস্ফুর্তভাবে যে কাজ করবে, ঐটাই যেন আল্লাহর পছন্দের সাথে মিলে যায়। তার অন্তর আল্লাহর নিয়মের সাথে মিলে যায়।

صِبْغَةَ اللَّهِ ۖ وَمَنْ أَحْسَنُ مِنَ اللَّهِ صِبْغَةً ۖ وَنَحْنُ لَهُ عَابِدُونَ 
আমরা আল্লাহর রং গ্রহন করেছি। আল্লাহর রং আর আল্লাহর চেয়ে ভাল কে রাঙ্গায়? আমরা তারই ইবাদত করি। (সুরা বাকারাঃ ১৩৮)
তো আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে নিজের অন্তরের রং আল্লাহর সাথে মিলেয়ে নেওয়া। তো যে কথা সে তার নিজ অন্তর থেকে বলবে ঐটা যেন, এভাবে বলা যেতে পারে যেরকম আমরা বলে থাকি যেন  (প্রচলিত লোকে যেমন বলে) by chance, আল্লাহর কথার সাথে মিলে যায়, আর এরকম যেন সবসময় হয়। ওর মন যে কথা বলে, প্রত্যেকবারই by chance, ঐটা আল্লাহর কথার সাথে মিলে যায়। এই দুটোর সাথে এত বেশী সামঞ্জস্য-এটা অর্জন করা। সাহাবারা রাঃ আল্লাহর ফজলে এটা এত বেশী অর্জন করেছিলেন যে, যার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তীকালের ফুকাহারা সাহাবাদের ব্যাক্তিগত আচরণ, ব্যাক্তিগত উক্তি যেটা বুঝে শুনে, সচেতনভাবে, বলে-কয়ে করেননি, (কিন্তু) করেছেন-এই আচরণগুলো, তাঁদের এই কথাগুলো, তাঁদের এই উক্তিগুলো, এই সবগুলোই ফিক্বাহর বুনিয়াদ হিসেবে ফুক্বাহারা গ্রহণ করেন। (যেমন) উনি এই সময় এটা করেছেন, তো এটাই নিয়ম। হায়াতুস সাহাবার মধ্যে সাহাবীদের রসিকতার উপর বাব আছে, আজীব আজীব ঘটনাও আছে। যেমন আমাদের কিছু ক্লান্তি দুর হবে-এজন্য কিছু রসিকতা করি। কিন্তু সেটা সাহাবীদের জীবনী থেকে আর ঐটাও দ্বীন। এক মজলিস ছিল, একজন অন্ধ ছিলেন। তো সে জমানায় তো আর বাথরুম ছিল না। একটু আড়ালে গিয়ে পেশাব করতে হত। আরেকজনকে গিয়ে বলেছেন যে আমাকে একটু নিয়ে যাও, পেশাব করব। এক মজলিস ছিল। উনি নিয়ে গেছেন এমন এক উঁচু জায়গায় যেখান থেকে পেশাব করলে ঐ মজলিসের উপর গিয়ে পড়ে। তো তাই। বেচারা তো অন্ধ মানুষ, তখন করেছে, তারপরে টের পেয়েছে, খুব রাগ করেছে তার উপর। পরে আবার উনি এসেছেন, কন্ঠস্বর পরিবর্তন করে, (বললেন) ‘যে তোমাকে নিয়ে গিয়েছিল, তাকে দেখিয়ে দেব? হ্যা, এখানেই আছে’। (তো) আরেকজনের সামনে নিয়ে (বললেন) ‘এই’। (অন্ধ সাহাবী) ওর মাথায় বসিয়েছেন। প্রথমে উনাকে দিয়ে পেশাব করালেন মজলিসের উপর, আরেকবার আরেকজনের মাথার উপর লাঠি দিয়ে মারালেন। এগুলো হায়াতুস সাহাবাতে আছে, সাহাবীদের ঠাট্টা-রসিকতার উপর বাব।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়েশা রাঃ এর সাথে ঝগড়া করেছেন, সালিশ করেছেন, এগুলো হাদীসের কিতাবের মধ্যে পড়ানো হয়। প্রশ্ন হলঃ ঠাট্টা, রসিকতা, ঝগড়া এটা একটা শিখবার জিনিস নাকি? তাহলে কেন পড়ানো হয়? আর হাদীসে আছেই বা কেন? তাদের যে এই অন্তর, মানুষের অন্তরের প্রকাশ বিভিন্নভাবে হয়। একজন মানুষকে যে চেনা যায় শুধু তার সচেতন সতর্ক কথা দিয়ে চিনা যায় না, বরং তার বিভিন্ন অবস্থার ভিতর দিয়ে তাকে চেনা যায়। আর সাহাবারা রাঃ এত শুদ্ধ, দুনিয়ার মানুষের জন্য এত উন্নত মানের দৃষ্টান্ত-এটা আল্লাহতাআলার বলে দেওয়া সার্টিফিকেট।

آمِنُواْ كَمَا آمَنَ النَّاسُ 
“আমিনু কামা আমানান্নাস” 
“মানুষের মত ঈমান আন”
ওলামারা এইব্যাপারে একমত, এখানে মানুষের মত বলতে সাহাবাদেরকে বুঝায়। যে এরাই হল আসল মানুষ। তাদেরকে চিনা, বিভিন্ন অবস্থায় চেনা যায়। গল্প আছে এটা বোধ হয় আমাদের দেশেরই প্রাচীন গ্রামীন গল্প বা কিছু একটা। একজন বিদেশী লোক এসেছে, মহা পন্ডিত। তার এত জ্ঞান, কিন্তু অপরিচিত। তো রাজা মন্ত্রীকে বলল, “এই লোকটার আসল কি (আর) তার পরিচয় বের কর”। তো মন্ত্রীর সাথে ও হাটছে। হাটতে হাটতে মন্ত্রীর পায়ের নীচের দিক ছিল শক্ত। তো যে আগন্তুক তার পায়ে উপর জোরে আঘাত করেছে। হাবভাবে এমন যেন ভুল করে করেছে দিয়েছে। তো ব্যাথা যখন পেয়েছে তখন গালি দিয়েছে, আর গালি যখন দিয়েছে তখন মাতৃভাষা প্রকাশ পেয়েছে।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জায়গায় বলেছেন, “তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল ঐ ব্যাক্তি যে তার পরিবারের কাছে ভাল”। পরিবারের মধ্যে ভাল- এটার একটা বিশেষ অর্থ আছে। সেই অর্থ হল বাইরে একজন মানুষের আচরণ, সে তার সচেতন নিয়ন্ত্রনে রাখে। আমল পরিচয় অনেকসময় বের হয় না। কিন্তু তার পরিবারের ভিতর, নিজের স্ত্রীর কাছে, নিজের অধীনস্থ লোকের কাছে, নিজের সন্তানের কাছে, ওখানে তার স্বতস্ফুর্ত পরিচয় পাওয়া যায়। বাইরে তো ও খুব ভদ্র মানুষ। বাড়ির ভিতর বুঝা যাবে ও কতটুকু ভদ্র।
তো সাহাবাদের রাঃ হাসি, রসিকতা, রাগ- এসবগুলো আমাদের জন্য শিক্ষনীয়। সাহাবাদের মত কেউ যদি রাগ করতে পারে, সেই রাগও হয়ত তাকে নাজাত দিবে। যে রসিকতা করতে পারে, সে রসিকতাও হয়তো তার নাজাতের কারণ হবে। কারণ এই সবকিছুই তাদের পরিশুদ্ধ অন্তরের পরিচয়। (আর) লক্ষ্য ঐটা অর্জন করা।
দ্বীন কিছু আনুষ্ঠানিক আমলের নাম নয়, এই আমলগুলো হল উপলক্ষ্য। শরীয়তের মধ্যে সবচেয়ে বড় হুকুম যেটা নামায, নামাযকেও আল্লাহতাআলা এক জায়গায় উপলক্ষ্য হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। “আক্বিমিস সালাতাল লি যিকরি- নামায কায়েম কর, আমার স্মরণের জন্য”। যিকিরের জন্য। তোমার নামায হল উপলক্ষ্য, লক্ষ্য হল যিকির-আল্লাহর সাথে সম্পর্ক কায়েম করার জন্য। তো নামায, সবচেয়ে বড় হুকুম যেটা, ঐটাও যদি উপলক্ষ্য হয়, তো বাকি হুকুমগুলো তো উপলক্ষ্যই হবে। প্রশ্ন হল তাহলে লক্ষ্য কি?
লক্ষ্য সম্ভবত এটাই যে, তার অন্তর, তার ক্বলব যেন আল্লাহর কাছে মক্ববুল হয়ে যায়। ইয়াওমা লা ইয়ানফাউসালিম। এমন এক দিন আমাদের সামনে আসছে, তোমাদের সন্তান, সম্পদ কিছুই তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে না- ক্বলবে সালিম-শুদ্ধ দ্বীল। কাম্য তো শুদ্ধ দ্বীল, কিন্তু শুদ্ধ দ্বীলকে চিনবার জন্যে আর তার আমল দিয়ে অনেকসময় চেনা যায় বা ঐটাকে আমল দিয়ে পরিস্কার করা যায়।
মানুষ কাউকে যে ভালবাসে, ভালবাসে ঐ ব্যাক্তিকে, তার বিশেষ কোন আমলকে নয়। তার বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন আমল, সেই ব্যাক্তির প্রতি ভালবাসার উপলক্ষ্য। অমুককে আমি কেন ভালবাসি? বড় বিপদের সময় তাকে আমার কাছে পেয়েছি যখন অন্যরা কাছে ছিল না। কিন্তু এখন ভালবাসি, সেই ঘটনাকে ভালবাসি না, ভালবাসি ওকে।
সেই ঘটনাগুলো উপলক্ষ্য হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে যে ওকে তুমি কেন ভালবাস? ও কোন উত্তরই দিতে পারবে না। এজন্য ভালবাসি এটা কোন উত্তর না, ওকে ভালবাসি ব্যাস এটুকুই। আমাদের যে কারো সামনে যদি একটা সুন্দর গোলাপ ফুল ধরা হয়, আর যদি জিজ্ঞাসা করা হয় ‘এটা কেমন’? বলে ‘সুন্দর’। কেন সুন্দর ব্যাখ্যা কর। কোন ব্যাখ্যা আছে নাকি? কোন ব্যাখ্যা নাই, সুন্দর ব্যাস এটুকুই। আসল কথা হচ্ছে এটা সুন্দর।
কোন ব্যাক্তি আল্লাহর কাছে মক্ববুল হয় (কিতাবের মধ্যে পাওয়া যায়), কখনো ঘটনা একেবারেই ছোট, কিন্তু আল্লাহ তাআলা সারা জীবনের গোনাহকে মাফ করে দেন। এক কুকুরকে পানি খাওয়াল। আরো কত বড় গুনাহ হয়ত করেছে। যদি পাল্লায় তোলা হয়, এক কুকুরকে পানি খাওয়ানো আর এর মুকাবিলা তার অনেকগুলো গুনাহ টিকেই না। তো ঐটা আমল কারণ নয়, ওটা একটা উপলক্ষ্য, যে উপলক্ষ্যের কারণে সে প্রিয় হয়ে গেছে।
আর তার বিপরীত হল এমন কিছু দিয়ে  যার কারণে ঐ ব্যাক্তিটা অপ্রিয় হয়ে গেছে, ঘটনাটা উপলক্ষ্য। তো ঐ সুওর বা সচেতনতা অন্তরের মধ্যে গড়ে তোলা যেন আল্লাহর কাছে মকবুল হই। আল্লাহর দৃষ্টিতে সুন্দর হই, আল্লাহ সুন্দরকে ভালবাসেন, এটা যদি নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে তার সব দ্বীন গেল।
যে প্রসঙ্গে কথাটা এসেছিল, তাবলীগে এসেছি সুন্দর অন্তর গড়বার জন্য। এখানে আসার পরে তার রুচি যদি আরো উন্নত না হয়ে আরো অবনত হয়ে যায়, তাবলীগে আসার আগে সে কথার মধ্যে খারাপ শব্দ ব্যবহার করে অভ্যস্ত ছিল না, আসার পরে সে গালাগালিতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। কাউকে মারার ব্যাপারে অভ্যস্ত ছিলনা, মারামারিতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। (এই) ধর, মার। আর এটা তার কাছে এখন ভালই লাগে, অনেকের মনের ভিতর তার সুপ্ত প্রবণতা আছে। এ খারাপ প্রবণতাগুলোকে প্রকাশের সাধারণত সুযোগ পায় না, দমিয়ে রাখে, কিন্তু ইচ্ছা আছে। কখনো কখনো সুযোগ পেলে প্রকাশ পায়।
কয়েক বছর আগে মহাখালি রেল ক্রসিং এর ওখানে এক মহিলা তার বাচ্চাকে নিয়ে যাচ্ছিল। বাচ্চা বোধহয় কান্নাকাটি করছিল। কি জানি কে হঠাৎ করে বলেছে যে ‘ছেলেধরা’ বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছে। (তো) ভিড় একটা এসে আক্রমণ করেছে, ঐ বেচারী মহিলাকে মেরে ফেলেছে আর ছোট বাচ্চাকে মা-হারা করেছে। ওখানেই জানে মেরে ফেলেছে। এরা যে মারল, কি কারণে?
বেশীরভাগ মানুষ দুর্বল, সমাজে বিভিন্ন জায়গায় মার খায়, শারীরিকভাবে না হোক, অবহেলিত, লাঞ্চিত, এর এগুলোর একটা ক্ষোভ তার মনে আছে। রেল লাইনের মধ্যে একজন লোক পেল, এই সুযোগ, একে মার, একে আমি নিরাপদে মারতে পারি। আমাকে কেউ ধরবে না, সবাই মারছে, তার মধ্যে আমিও একজন মারলাম। এছাড়া ওকে মারবার অন্য কোন কারণ নেই। অন্য কোন কারণ যদি থাকত তাহলে খোজ নিত ‘কোন বাচ্চা’ ‘কোন মা’ ‘কি হয়েছে’ ‘কি ব্যাপার’? কোন কিছুর খোঁজ না নিয়ে সে গিয়ে মারতে আরম্ভ করল, তার কারণ এটাই যে ‘মারার একটা সুযোগ, কাউকে কোনদিন মারতে পারি না, মার খেয়েছি অনেক, এই সুযোগে কিছু মারি’।
তাবলীগে আসার পরেও ওর মনের ভিতর এগুলো তো আছে, আর আমরা তাবলীগের মধ্যে যারা এসেছি, আমরা কোন রাজকুমার না, সাধারণ সমাজ থেকেই এসেছি। আমাদের মনের ভিতর এরকম নানান ধরনের দুঃখ, ক্ষোভ এগুলো আছে। এখানে এসে যখন পেয়েছি যে বিরাট ভিড়ের মধ্যে আমি একটা লোককে মারতে পারছি তো এই সুযোগ হাতছাড়া করব কেন?
অথচ এখানে এসেছিল নিজেই হোক বা অন্যদের তশকীল হোক, তাকে বলে কয়ে চেষ্টা করে আনা হয়েছে তার অন্তরকে পাক-পবিত্র করার জন্য। ঐ ওয়াদা করে আনা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পাক-পবিত্র তো আর একদিনে বা এক চিল্লায় হয়ে যায় না। এর মধ্যে যখন একটা সুযোগ পেল, তার উপর তাকে বললে যে ‘এই মারলে তুমি সওয়াব পাবে’- বড় ভাল কথা, এরকম সওয়াব পেলে কে ছাড়ে?
ব্যাপার হল এটাই। মদ তো খেতে চাই, যে আগে থেকে কোন কারণে নেশার মধ্যে ছিল, এখন যদি বলে যে ঐ বারের মধ্যে যারা আছে, এদেরকে গিয়ে তশকিল করে চিল্লায় পাঠাতে হবে। আর এদেরকে যদি তশকিল করতে হয়, তাহলে তাদের মত একজন হতে হবে। তো হিকমত হল প্রথমে গিয়ে তুমিও কিছু গিলবে, তারপর তাকে দাওয়াত দাও। কথা সে মানবে। ও ঐ ব্যাক্তি যে আগে মদ খেত, তওবা করেছে আল্লাহর ভয়ে, মনের টান এখনো বাকি আছে কিন্তু আল্লাহর ভয়ে খায় না, যেহতু হারাম (তাই) গোনাহর ভয় করে। তাকে যদি বলা হয় যে, ‘মদ খেলে সওয়াব হবে, হিকমত, আল্লাহতাআলা হিকমতের সাথে দাওয়াত দিতে বলেছেন, প্রচলিত মৌলভিরা পারবে না, তুমি পারবে’। ও উৎসাহ পেল। তো মদ সে অনেকদিন ধরে খেতে চায়, অনেকদিন ধরে বঞ্চিত, এক বছর ধরে সে তাবলীগে ঢুকেছে, তওবা করেছে, মদ খায় না, (কিন্তু) মনের এই টান আছে। (তো) এরকম যদি সওয়াবের কাজ পায়, কে ছাড়বে?
ব্যাপার অনেকটা এরকম। অনেকে মনে করে একজন ব্যাক্তি কিছু টাকা মারল, দুইশত কোটি টাকা, দুই হাজার কোটি টাকা, তো এর মধ্যে এত ব্যাপক হইচই করে এর মুকাবিলায় গোটা দেশে কাজের যে সুনাম নষ্ট হচ্ছে, এর যে ক্ষতি হচ্ছে, এর মোকাবিলায় দুই হাজার কোটি টাকা কি? একজন বা মারলই। এতে কোন সন্দেহ নেই দুই হাজার কেন, দুইশত হাজারও যদি মারে কোন ব্যাপারই নয়, উম্মতের টাকার কোন অভাব নেই। ঐটা কোন ব্যাপারই নয় যে টাকা হাতছাড়া হচ্ছে এবং মেরেই যাচ্ছে। মনে করা যাক  বিলকুল সত্য কথা যে দুইশত নয়, বরং দুই হাজার কোটি  যা কিছু বলা যায়, এটা কোন মাসআলা নয়, এই টাকা নষ্ট হয়ে যাওয়া।
মাসআলা ভিন্ন। মাসআলা হল কাজ নষ্ট হয়ে যাওয়া। এই কাজ যদি নষ্ট হয়ে যায়, উম্মতের শেষ আশ্রয়স্থল তাবলীগ। একথা শুধু তাবলীগ ওয়ালাদের নয়, অন্যান্য সরাসরি দেশের উল্লেখযোগ্য পীর, উল্লেখযোগ্য আলিম, বাকি আলিমরা যাকে ওস্তাদ মানে, বাকি পীররাও যাকে পীর মানেন, তার কাছ থেকেও সরাসরি শোনা। এছাড়া আরো লোকের কাছ থেকে শুনেছি যে, তাবলীগ ছিল আমাদের শেষ আশ্রয়, নিজে মাদ্রাসা পরিচালনা করেন আর নিজেই বলছেন যে, ‘মাদ্রাসা তো নষ্ট হয়ে গেছে’, নিজে বড় পীর, এইটাও বলছেন, ‘তরীকাও নষ্ট হয়ে গেছে’, আমাদের শেষ ঠাই হল তাবলীগ, এই তাবলীগও যদি নষ্ট হয়ে যায়, আর মানুষের যাবার কোন জায়গাই নেই। বড় দুঃখ করে এই কথাটা বলেছেন।
কথা সত্য। মাত্র দুহাজার কোটি টাকার জন্য বা যতই হোক, টাকার জন্য তাবলীগ নষ্ট করে, এর চেয়ে বড় যালিম আর কেউ নেই। কোন দাম হয় নাকি? দুহাজার, দুলক্ষ কোটি যতই হোক, এরজন্যে তাবলীগের কাজকে নষ্ট করবে। এর চেয়ে বড় আহাম্মকি, এর চেয়ে বড় জুলুম আর হতে পারে না। ব্যাপার টাকা উদ্ধার করার জন্য নয়, কাজকে রক্ষা করা। যারা পরিচালনা করছে তারা যদি ভুল পরিচালনা করতে আরম্ভ করে, যেমন তাবলীগের নামে আনল তার সুওরকে সুন্দর করবার জন্যে, আর এনে তাকে বানিয়ে দিল ক্রিমিনাল, সন্ত্রাসী, এটা বড় মারাত্মক খেয়ানাত, খুবই মারাত্মক খিয়ানত। আর এটা বড় মাত্রায় হয়ে গেছে, এটা নয় যে হওয়ার পথে, বড় মাত্রায় হয়ে গেছে।
কাকরাইলের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় জিম্মাদার যারা, তাদের একধরনের নয়, বিভিন্ন ধরনের অসৎ আচরণ এগুলো দেশে এখন ব্যাপক। আর উৎস তাবলীগ। ওখানে গিয়ে তাবলীগের মুরব্বী হয়ে তারপর এই সুযোগগুলো সে পেয়েছে। এক কথা হয়তোবা সত্য যে মনে চাওয়া আগে থেকেই ছিল, সুযোগ ছিল না, এখন তাবলীগের কারণে সুযোগ হয়ে যাচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেদিন মারল, ওখানকার বিশিষ্ট নেতা হচ্ছে মাওলানা জিয়া। এই নাম যে বলছি, গীবতের মাসআলা সম্বন্ধে সচেতন থেকেই বলছি, নইলে বিনা নামে বলতে পারতাম, কিন্তু নাম উচ্চারণ করেই বলছি। মাওলানা জিয়া যিনি, টিম নিয়ে সন্ত্রাসীসহ এসে আক্রমণ করেছিলেন, পরে যখন ঐ ইউনিভার্সিটির কিছু ছেলেরা, ছাত্রনেতা ওরা এল,  এসে যখন এই নাম শুনল, তখন বলল যে, উনি তো গতকালকে একটা জমির ব্যাপারে আমার কাছে ফোন করেছিল। বিস্তারিত কিছু বলেনি, আমরা যেটা আন্দাজ করেছি ‘জমি দখলের প্রশ্ন’। জমির ব্যাপারে ছাত্রনেতাকে ফোন করার কি দরকার? ফোন করলে জজকে করবে, উকিলকে করবে, দলিলপত্র যাদের তাকে করবে, সবকিছু বাদ দিয়ে ছাত্রনেতাকে ফোন করা জমির ব্যাপারে।
পরবর্তীতে এটাও শুনলাম, সাভার অঞ্চলে তার এখন বিরাট সম্পত্তি হয়ে গেছে। বয়স বেশী নয়, কিছুদিন আগেই মাত্র সাল দিয়েছে, তাবলীগে গিয়ে এক বছর দিয়ে এত নগদ বরকত পেয়েছে যে কিছুদিনের মধ্যে বিরাট সম্পত্তির মালিক। তার ভাইও। তার ভাইকে কিছুদিন আগে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিল, জমিজমার ব্যাপারে, অনেক মারপিটও করেছে, শফিক, সেও বড় গুরুত্বপূর্ণ নেতা। শফিককে আবার যখন শুনি পুলিশ ধরে নিয়ে গেল, কয়েকদিন রাখল, কিছু মারপিট করলো, এইসব জিনিসই হবে, বিস্তারিত জানা যায়নি। কিন্তু খুউব চালাক আবার, পুলিশের হাত থেকে ছুটে বাড়িতে না এসে সোজা চলে গেছে চিল্লায়, কারণ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে, জানাজানি হবে, তারচেয়ে ভাল এই পুলিশে যাওয়া ও চিল্লার মধ্যে ঢুকিয়ে দিল, সবই আল্লাহর ওয়াস্তে।
মাসআলা কেউ যদি মদ খায় তাহলে এটা ফিসক, গুনাহ, গুনাহে কবীরা। মদ যদি বিসমিল্লাহ বলে খায় তাহলে কুফর। আর এটা এই ধরনেরই যদি আমরা বুঝতে চাই। যে বারে গিয়ে মদ খেল এটাও গুনাহ, বড় গুনাহ, কিন্তু বোতল এনে মসজিদের ভিতর মদ খেল, ঐটা অনেক বেশী বড়। কারণ যে বারে গিয়ে মদ খেল, সে একটা ইনফিরাদি গুনাহ করল। মসজিদের মধ্যে খেল, এ গুনাহের সাথে গোটা মসজিদকে নষ্ট করছে।
ব্যাপার এইরকমই হয়ে গেছে। শুধু যে একজন ব্যাক্তি তা নয়, সেই ব্যাক্তি আবার গোটা টিমকে তার নিয়ন্ত্রনে নিয়ে এসেছে। আর সেই টিম পরবর্তীতে অঞ্চলের মধ্যে কোন একজন সৎ লোক যদি থাকতে চায়, তাকে টিকতে দেয়না,  কাকরাইলের ভিতর তো সম্ভবই নয়, বের করে দিবে। গতকালকে একজন সাথী বলছিল, এই কথা সে আমাকে অনেক আগেও বলেছে, গতকালকে আবার বলল। বেশ কয়েক বছর আগে শুরার একজন সাথী, কাকরাইলের ভিতর হঠাৎ একজন পাগল এসে মেরে ওর পা ভেংগে দিল। তো ঘটনা এই মেরে পা ভেংগে দিল। এর কাছ থেকে শুনলাম। ঘটনা হল ও নিউট্রাল থাকতে চেয়েছিল, বিরোধিতাও করছে না। কিন্তু এগুলোর অংশীদার হতে চায় না, রাজি হয় না, এজন্যে পাগল এনে ওর পা ভাংগাল, সেই পাগল পরিকল্পিত, পেইড পাগল। সে বুঝতে পেরেছে, কিন্তু এরচেয়ে বেশি অগ্রসর হলে এখন পা গেছে, আরো যাবে। তো নিউট্রালও থাকতে পারল না। তোমাকে শেয়ার নিতে হবে, আর এটা শুধু দেশের ভিতরে সীমাবদ্ধ নয়, এটা দেশের বাইরেও চলে যাচ্ছে, যার ফলে এত লোক থাকতে জিয়াই কেন ওখানে আমীর বা মাতব্বর হয়ে গেল। গোটা সাভার অঞ্চলে কি ভাল মানুষ নাই? (আসল কথা হল) টিকতে পারবে না। যেরকম বলে যে অফিসার যদি corrupt (দুর্নীতিগ্রস্থ) হয়, তাহলে নিচের অধীনস্থ যে তাকে দুর্নীতিগ্রস্থ ছাড়া রাখবে না কারণ তার কাছ থেকে নিতে হবে, আর তার কাছ থেকে নিতে হলে
এভাবে ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ ভালটা নিঃশেষ হয়ে যায়। অতীতের ধর্মগুলো নষ্ট হল কিভাবে? খ্রিস্টান ধর্ম, আল্লাহর দেওয়া দ্বীন, ঈসা আঃ এর কথা, সেই ধর্ম এত বিকৃত হয়ে গেল। ঈসা আঃ কি বলেছেন, কোন ভাষায় বলেছেন, সেটা পর্যন্ত ঐতিহাসিকরা বের করতে পারে না। কথা তো নাই, (আর) এত বেশি পার্থক্য। বর্তমান বাইবেলের মধ্যে প্রধানত ৪ টা গসপেল আছে। মার্ক, লুক, ম্যাথিউ, জন। বাংলায় নাম একটু অন্য ধরনের, সবগুলোই ঈসা আঃ এর জীবনী বলা যেতে পারে। আমরা যেরকম বলি সীরাত। তার মধ্যে ঈসা আঃ এর কিছু কথা আছে, এই ৪টার মধ্যে এতবেশি পার্থক্য যে একই ব্যাক্তির জীবন বলছে, কিন্তু একটা আরেকটার সাথে কোন মিলই নেই। আসলে বের করা মুশকিল।
ঈসা আঃ এর চেয়েও সাড়ে তিনশত বছর আগের জুলিয়াস সিজার, রোম সম্রাট। জুলিয়াস সিজারের লিখা, তার জীবনী এগুলো হুবহু পাওয়া যায়, কিন্তু ঈসা আঃ এর জীবনী বের করাই মুশকিল। (তো) জুলিয়াস সিজারের সাড়ে তিনশত বছর আগের লিখা (কথা) সব পাওয়া যায়। ঈসা আঃ এর গুরুত্ব বেশি না জুলিয়াস সিজারের? উনার কথা কেন হারিয়ে গেল? সব কেন টিকলনা কেন? এমনি হারিয়ে যায়নি। এগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে বিলুপ্ত করা হয়েছে। জুলিয়াস সিজারকে গোপন করার জন্যে এমন কোন ঠেকা নাই। ওরা কথা থাকলেই বা কি আর না থাকলেই বা কি। কিন্তু এটাকে দখল করা দরকার, এটা পরিবর্তন না করলে যারা এই ধর্মের নামে জিনিসটা দখল নিয়েছে, তারা তাদের কথা চালাতে পারে না। পরবর্তীতে শেষে যে কথা আছে খ্রিষ্টধর্মের, বড় গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ট্রিনিটি, সেটা হলো ত্রিতত্ত্ববাদ। এর সবচেয়ে মূল ডকুমেন্ট-এইটা আরবী। গ্রীক নয়, ল্যাটিনও নয়, হিব্রুও নয়, (বরং) আরবীতে এর প্রথম ডকুমেন্টগুলো পাওয়া যায়। এখন প্রশ্ন হল আরবী কেন? আরবী এইজন্যে যে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসার পরে আরব জাতির উত্থান। তখন সাহাবারা রাঃ, তাবেয়ীরা বা তাবে তাবেঈরা ছড়িয়ে পড়েছেন। অন্যান্য দ্বীনের কথাও তাঁরা সংগ্রহ করেছেন, লিখেছেন, তারমধ্যে আরবীতে লিখেছেন। ল্যাটিন, গ্রিক ভাষায় যেগুলো ছিল ঐটা তাদের (খ্রিস্টানরা) দখলে ছিল আর তারা ধ্বংশ করে দিয়েছেন। মুসলমানদের হাতে আরবীতে যেটা ছিল, ঐটার উপর তো নিয়ন্ত্রন নাই। ঐটা ছিড়তে বা ধ্বংশ করতে পারেনি। যার ফলে ঐটা রয়ে গেছে।
তো বিদআতীরা তার গোটা অঞ্চলকে, কওমকে খারাপের দিকে নিয়ে যায়। খোদা না খাস্তা, তাবলীগও যদি ওরকম খারাপ হাতে পড়ে যায়, সে খারাপ কথাকে শুদ্ধ কথা হিসেবে চালাবে, আর দ্বীনের নামে এনে মানুষকে আরো বেদ্বীন বানাবে। এখন পর্যন্ত এদের সন্ত্রাসী কাজে লাগাচ্ছে, এটাতো ইতিমধ্যে বেশকিছু লোককে দিয়ে সন্ত্রাসী কাজ করানো হয়েছে, হচ্ছে। রাজশাহীতে, রংপুরে, ঢাকায় এরা যে এই মারার কাজগুলো করায়, সবগুলো পেইড না, ফ্রি করায়। দুই দিকে তার লাভ। এক হল টাকা দিতে হচ্ছে না, ফ্রি করালো আর দ্বিতীয় হল যে বড় নিরাপদে করতে পারে, পেমেন্ট হলে পুলিশের কাছে ধরা পড়েও যেত। আর দ্বীনের নামে করলে তো ধরাও পড়বে না। ইতিমধ্যে যদি এতদুর এগিয়ে গিয়ে থাকে, যেখানে বাংলাদেশের তাবলীগ একটা অংশ, পুরা দুনিয়াতে তাবলীগের কাজ হচ্ছে, এইটা যদি চলতে থাকে তো কিছুদিন পরে কোন ভালমানুষ এখানে টিকতে পারবে না।
কাকরাইলের ভিতরে শুরাদের মধ্যে একজন শুধু নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিল, এইজন্য বাইরে থেকে পাগল আনিয়ে ওর পা ভাঙ্গিয়ে দেওয়া হল। তো সেও বুঝে ফেলেছে।
তো এজন্য আল্লাহতাআলা মেহেরবাণী করে আমাদের দ্বীনের এই কাজ দিয়েছেন, এই কাজকে রক্ষা করা বড় দায়িত্ব। আবার বলছি সমস্যা ব্যাক্তি নয়, সমস্যা টাকাও নয়, কিন্তু সমস্যা হল গোটা কাজ যখন বে-হাতে চলে যায়, ঐটা অসুবিধা হয়ে যায়। যদি কেউ জিজ্ঞেস করে যে কি চাও? (বাস্তবতা হচ্ছে) ওতো ব্যাপক বিস্তারিত কথা তো সে শুনতে চায় না, হাটতে হাটতে উত্তর একটা পেতে চায়। তখন সংক্ষিপ্তভাবে আংশিক উত্তর হবে। এইটা হয়তোবা বলা যায় যে ‘প্রশ্ন যে করা যায়, প্রশ্ন করার অধিকার আছে, এই নীতি প্রতিষ্ঠিত করা”। পুরো দুনিয়াতে যে কোন প্রতিষ্ঠানে, দ্বীন হোক বা দুনিয়া হোক, যে নেতৃত্বে আছে, যেমনঃ যার কাছে একাউন্ট বা কিছু একটা, তাকে এই প্রশ্ন করার অধিকার আছে যে তুমি হিসাব দেখাও। আর এটা যে কোন কেউ করতে পারে, করা উচিতও। আর এটা বারবার করে দ্বীনের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।
উমর রাঃ খুতবায় দাঁড়িয়েছেন, উনাকে জিজ্ঞেস করল যে আমরা সবাই কাপড়ের এক টুকরো পেয়েছি, আপনি দু’টুকরো কেমন করে পেলেন? সাধারণ মানুষ। উনি এই কথা বললেন না যে তোমাকে এই প্রশ্ন করার অধিকার দিল কে? এটা করেননি। বরং উত্তর দিলেন। উনার এই সাবিত প্রশ্ন করা আর উমর রাঃ এর ভাল করে উত্তর দেওয়া, এটাই ভাল করে প্রমাণ করে দেয় যে তার প্রশ্ন করার অধিকার আছে আর যাকে প্রশ্ন করেছেন তার উত্তর দেওয়া দায়িত্ব। এটা একমাত্র ঘটনা নয়, সাহাবাদের জীবন এটা দিয়ে ভরা।
টাকা কোন বড় ব্যাপার নয়, আল্লাহর ফজলে মুসলমানদের হাতে টাকা এত আছে যে সেটা কোন ব্যাপারই না। এর চেয়ে দশগুণ টাকা দেওয়ার মত মন উম্মতের আছে। এখানে মৌলিক যেটা সমস্যা (সেটা হলো) যে প্রশ্ন করার অধিকার নেই- (বাতিল) এই নীতি প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। এই একটা জিনিস যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, এর পরে বাকি সব দুর্নীতি তার জন্য বৈধ হয়ে গেল, জিজ্ঞেস করতে পারবে না। আর (হক্বের) মোকাবিলা এটারই। আমাদের যে চিঠি, ঐ চিঠির মধ্যে দাবী এইটাই যে মাসোওয়ারায় কথা উঠানো অর্থাৎ প্রশ্ন করার অধিকার দিতে হবে। (কিন্তু) এইটাতে রাজি নয়। এর জন্যে একেকবার একেক কথা বলে।
একবার বলে ‘মাওলানা সা’দ সাহেব নাকি নিষেধ করেছেন’। প্রথম কথা (উনি) নিষেধ করেন নি। মিথ্যা কথা। দ্বিতীয় কথা, নিষেধ করা থাকলেও আল্লাহর হুকুম এর বিরুদ্ধে কারো কোন কথা মানা যাবে না, সে যত বড় আমীর-ই হোক। আল্লাহর হুকুম মাসওয়ারা, তাবলীগে ঢুকার পরেই প্রথম যে কথাগুলো শিখে তার একটা কথা হল ছয় নম্বর। প্রায়ই দ্বিতীয় কথাই শিখে মাসওয়ারার আদবের মধ্যে-আল্লাহর হুকুম, নবীর সুন্নাত। একজন মাওলানা সা’দ বলল আর আল্লাহর হুকুমও বাতিল, নবীর সুন্নাতও বাতিল। এইটাই যদি হয়, এই জাতীয় দ্বীন শিখবার জন্য আমরা তো এখানে (তাবলীগে) আসিনি। আমরা এসেছি আল্লাহর হুকুম শিখবার জন্য, অন্য কারো নয়। মাওলানা সা’দ সাহেব বলেনওনি। মিথ্যা কথা। বলে থাকলেও এটা গ্রহনযোগ্য নয়। তো একেকবার একেক কথা বলে।
মূল কথা, (তারা বুঝাতে চায়) তোমার প্রশ্ন করার অধিকার নেই। দূর্ভাগ্যবশত, এই তাবলীগের মধ্যে জড়িত যারা আমাদের দেশের লোক, লাখো নয়, কোটিরও হিসেবে এই বেদ্বীনি নীতি, তাদেরকে দিয়ে মানিয়ে নিয়েছে। তারা এখন গ্রহন করে। একেবারে গ্রাম পর্যায়ে একজন লোক বলে যে, ‘মুরব্বীদের ব্যাপারে এসব প্রশ্ন করা ঠিক নয়’। বলে কিনা? [মজমা জীসূচক উত্তর দিল] কুফরী আক্বিদা গ্রাম লেভেলে পর্যন্ত ঢুকে গেছে। এটা ইসলামী আক্বীদা নয়, ইসলামী আক্বীদা হল জিজ্ঞেস করা যায়, করা উচিত। এই ক’দিনের মধ্যে একেবারে নীচের লেভেল পর্যন্ত লাখো কোটি মানুষকে একটা বেদ্বীনী আক্বীদার উপর যদি উঠিয়ে ফেলে, এরপরে আর দ্বীন থাকলো কোথায়? অথচ উচিত ছিল সাধারণ মানুষ যেন বলে যে প্রশ্ন তো করতে পারে, সে উত্তর দিক। তাও বলেনা। বরং বলে যে মুরব্বীদের উপর এমন বেয়াদবি করলে উচিত শাস্তি হবে, আল্লাহ দেখবে। একথা বলে।
মানে একেবারে একটা কুফরী কথা তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। কিছুদিন আগে বলছিলাম পাদ্রী বলছে যে বাইবেলের থুড়ি পরোয়া করি। (অথচ) ও পার পেয়ে যাচ্ছে, কারণ মূলত একথা সে গোটা খ্রিস্টান জগতকে মানিয়ে নিয়েছে যে বাইবেল পড়া তোমার ব্যাপার নয়, আমি যা বলি ঐটাই মানবে। এই ব্যাপারে প্রশ্ন করতে পারবে না।
ব্রাহ্মনরা এই কথা গোটা হিন্দু জগতকে মানিয়ে নিয়েছে যে, বেদে কি আছে, গ্রন্থে কি আছে, ঐটা দেখা, বুঝা তোমার কাজ নয়। (বরং) আমি যা বলি তাই মানতে হবে। এই একটা কথা দিয়ে ব্রাহ্মণ সম্পূর্ণ হিন্দু জগতকে নিজের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। যা বলে তাই মানতে হবে। এই কথা দিয়ে পাদ্রীরা সম্পূর্ণ খ্রিস্টান জগতকে নিজের মুঠোয় নিয়ে নিয়েছে। বেদআতিরা এই জাতীয় কথা দিয়েই গোটা মজমাকে তার হাতে নেয়।
জায়েজ, নাজায়েজ, হালাল-হারাম কিচ্ছু দেখবে না, (বলবে) আমার পীর বলেছে। এখন পর্যন্ত এরকম আছে যে শুনেছি, রাজশাহীতে আছে, যে পীরের খেদমতের জন্যে রাতের বেলা নিজের স্ত্রীকে দিয়ে দেয়। অথচ সে নিজেকে মুসলমান মনে করে, সওয়াব মনে করে। এটার বিশেষ নাম আছে ‘সিনা চাক’ বলে। এর দ্বারা নাকি অন্তর পবিত্র হয়ে যায়। তো মানুষকে দিয়ে কি না করানো যায়। তাকে যদি ওরকম মেক্যানিজমের মধ্যে ফেলে দেয় তো হাজার জিনিস করানো যায়।
আমেরিকায় বেশ কয়েক বছর আগে এক লোক একটা ধর্ম বানিয়েছে, তার বেশ কিছু “উম্মত”ও পেয়েছে, প্রায় নয়শত লোক। এদেরকে নিয়ে সেন্ট্রাল আমেরিকার ছোট একটা কলোনিতে গিয়ে বসবাস করতে আরম্ভ করেছে। তার কথা চালায়। এক পর্যায়ে কোন বে-আইনি কাজ করেছে। পুলিশ এসেছে আক্রমণ করার জন্যে। যখন অবস্থা বেগতিক দেখেছে তো সে তার নয়শত লোকসহ আত্মহত্যা করেছে। হত্যা নয়, আত্মহত্যা। নয়শত লোক হত্যা করেছে-তাতো বুঝা যায়, কিন্তু নয়শত লোক নিয়ে আত্মহত্যা করেছে, পরিবারসহ। বিরাট গামলার মধ্যে পটাসিয়াম সায়ানাইড সলিউশন করেছে, সবাইকে বলেছে এগুলো খাও। মায়েরা বাচ্চাদেরসহ ওখানে কলোনিতে ছিল। সিরিঞ্জের মধ্যে নিয়ে বাচ্চাকে ইনজেকশন দিয়েছে, নিজে ইনজেকশন নিয়েছে। আর এরকম করে নয়শত লোক একসাথে সব মরেছে। তো মানুষ এমন ধরনের যে তাকে যদি ভাল করে বুঝাতে পারে, বলতে পারে, তো তাকে দিয়ে আত্মহত্যা করানো যায়, মাকে দিয়ে তার শিশুকেও হত্যা করানো যায়। তাকে দিয়ে তার বউকে দিয়ে দেওয়া এমন কোন বড় ব্যাপার নয়, সবকিছু করতে পারে। তো এভাবে করছে।
গোটা খ্রিস্টান জগত পাদ্রীর কথামত চলছে। আজ থেকে প্রায় আটশত বছর আগে খ্রিস্টানদের যে প্রোটেষ্ট্যান্ট ধর্ম আরম্ভ হল তার আগের কথা। যে ব্যাকগ্রাউন্ডের উপর ক্যাথলিক থেকে প্রোটেষ্ট্যান্টরা বের হয়ে গেল তার মধ্যে বড় একটা অংশ ছিল যে পাদ্রীরা গির্জাতে জান্নাতের সার্টিফিকেট বিক্রি করত। তো মানুষ কিরকম বোকা (যে) কাগজে লিখা, পাদ্রীর সাইন করা সার্টিফিকেট ঐটা দিয়ে সে মনে করে জান্নাত পেয়ে যাবে। কিন্তু এক-দুইজন নয়, লাখো-কোটি মানুষের কাছে বিক্রি করেছে, প্রচুর টাকা উপার্জন করেছে। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে করে ওড়া চিন্তা করতে লেগেছে যে ‘কি কিনলাম’?
কিন্তু ঐ চিন্তা করতে লেগেছে পঞ্চাশ বছর। তারপর বিদ্রোহ করেছে চার্চের বিরুদ্ধে যে ‘তোমরা কি বিক্রি করলে’? কিন্তু বিক্রি তো করে ফেলেছে, আর এই ‘কি বিক্রি করলে’ এই প্রশ্ন তুলতে তুলতে লেগেছে পঞ্চাশ বছর। তো মাত্র এই একটা কথা বুঝতে তার পঞ্চাশ বছর লাগল? হ্যা-লাগলো।
আল্লাহ তাআলা আমাদের দ্বীন দিয়েছেন, যত তাড়াতাড়ি এটাকে ধরতে পারি, আল্লাহতাআলা ইনশাআল্লাহ আমাদেরকে বহুত বড় আজর দিবেন। এখনো সব মানুষ বেদ্বীন হয়ে যায়নি, এখনো দেশে দ্বীনদার লোক আছে, শুধু একটু ভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেছে। শুধু একটু মেহনত করলে ইনশাআল্লাহ, আল্লাহ উদ্ধার করবেন। দ্বীনের হিফাজত বা দ্বীনের কাজের হিফাজত যারা করে আল্লাহর কাছে তাদের বড় আজর। আর এর মধ্যে যদি বিপদের সম্মুখীন হতে হয়, আল্লাহর কাছে বড় আজর পাওয়া যায়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে তৌফিক নসীব করুক। আ’মিন।
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك  سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ
pdf ফাইল ডাউনলোড করতে ক্লিক করুন



يَخْتَصُّ بِرَحْمَتِهِ مَن يَشَاء (3-74)
“আল্লাহর রহমত দিয়ে যাকে চান তাকে নির্বাচন করেন,”
يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَن يَشَاء وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَن يُنِيبُ* اللَّهُ (42-13)
“যাকে চান তাকে নিজের জন্যে নির্বাচন করে নেন, আর যে প্রত্যাবর্তন করে তাকে পথ দেখান।”
প্রথমত ঈমান পাওয়াই একটা নির্বাচন, নামাজ-রোযা করতে পারা এগুলো নির্বাচন। দাওয়াত এর কাজে শরীক হতে পারা একটা নির্বাচন, এগুলো আল্লাহ্ তায়ালার এহসান। এই সব কিছুর পরে যে কোন জমানায় দ্বীনের কাজের হেফাজতের জন্যে কাউকে নেওয়া, এটা আল্লাহ্ তায়ালার তরফ থেকে একটা বহুত বড়, খুবই বিশিষ্ট ধরনের নির্বাচন। আল্লাহ্ তায়ালা বিভিন্ন জমানায় বড় সংকটের সময় তাঁর খাস বান্দাদেরকে দ্বীনের হেফাজতের জন্যে নির্বাচন করেছেন।
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওফাতের পর গোটা উম্মত যখন বিভ্রান্ত, তখন আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু এসে সবাইকে শান্ত করেছেন। আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকেই ব্যবহার করেছেন এই বিভ্রান্তির সময় উম্মতকে শুদ্ধ পথ দেখাবার জন্য। এরপরই শুরু হলো ইরতেদাত যাকাত নিয়ে; যে আমরা যাকাত দিব না। এটা একটা হুকুমের অস্বীকার ছিল, একটা হুকুম পালনে অপারগতা নয়। যাকাত যদি কেউ না দেয় (এ যমানায় বহুত মুসলমান যাকাত দেয় না), কোন মুফতি তার উপর মুরতাদের ফতওয়া দেবে না। ওখানেও আবার আল্লাহ্ তায়ালা আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু তাআলা আনহু কে ব্যবহার করেছেন, দ্বীনের হেফাজতের জন্য। আর তখন এই আবু বকর সিদ্দীক রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহুর বহুত মশহুর কথা ছিল,
“আ ইয়ানকুসুদ্দীন ওয়াআনা হাই”                                            “দ্বীনের ক্ষতি হবে, আর আমি জীবিত ?”
নিজের জীবন দিয়েছেন দ্বীন রক্ষা করার জন্য। সংকটের সময় আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর বান্দাদেরকে ব্যবহার করেছেন; এক এক সময় এক এক জনকে। কা’দিসিয়ার যুদ্ধের সময়ে মুসলমানদের পরাজয়ের অবস্থাকে বিজয়ে পরিবর্তিত করার জন্য ব্যবহার করলেন আবু মাহ্জান সাকাফী রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু কে। উনি মদ পান করতেন আর জিহাদের ময়দানে ছিলেনও না। কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালা তাঁকেই বেছে নিলেন। উনি গিয়ে ময়দানের মধ্যে ঢুকে এমন হিম্মত দিলেন যে, গোটা ময়দানের অবস্থার পরিবর্তন হয়ে গেল। এটা আল্লাহ্র তরফ থেকে একটা নির্বাচন। বিভিন্ন যমানায় আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর প্রিয় বান্দাদেরকে দ্বীনের হেফাজতের জন্য নির্বাচন করেছেন। কোরআন শরীফ সংকলনের জন্য ওমর রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু কে আল্লাহ্ তায়ালা নির্বাচন করলেন, উনি প্রস্তাব দিলেন কোরআন শরীফ সংকলন করা হোক। এর পরবর্তী কালে দ্বীনের ময়দানে বহুত বড় অবদান মাওলানা ইলিয়াস রহমাতুল্লাহি আলাইহি এর, এটাও দ্বীনের হেফাজতের জন্যই আল্লাহ্র পক্ষ থেকে নির্বাচন। সমসাময়িক আল্লাহ্ ওয়ালাদের মধ্য থেকে আল্লাহ্ তাআ’লা এই বিশেষ মর্যাদার জন্য হযরত মাওলানা ইলিয়াস রহমাতল্লাহি আলাইহি কেই নির্বাচন করেছেন।এই বহুত বড় মেহনত বিরাট সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে, যে সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সবাই এখানে একত্রিত। এটা শুধু একজন মানুষের কিছু অপকর্ম নয়, সম্পূর্ণ কাজ ধ্বংসের পথে। একজন মানুষের অপকর্ম যদি হতো, তা আমাদের অত মাথা ঘামানোর ব্যপার ছিল না; কিন্তু সম্পূর্ণ কাজ নষ্ট হওয়ার পথে।
আর বাংলাদেশের কাজ নষ্ট হয়ে গেলে, বাকি তবলীগও দুনিয়াতে টিকে থাকা মুশকিল হবে। কারণ দ্বীন একটা জীবন্ত জিনিষ, আর জীবন্ত জিনিষের বড় অংশ না থাকলে বাকী অংশ টিকে না। বাংলাদেশের তবলীগ বলা যেতে পারে যে, সম্পূর্ণ আলমী তবলীগের এক তৃতীয়াংশ, সংখ্যা ইত্যাদির দিক থেকে। আর কোন কোন দিক থেকে আরও বড়। টঙ্গি ইজতেমার সময় পুরা দুনিয়ার মাশওয়ারা এখানেই হয়। আল্লাহ্ তায়ালা এমন কিছু অবস্থা সৃষ্টি করেছেন যে, অন্য কোন দেশে দুনিয়ার সবার আসা মুশকিল; একত্রিত হতে পারে না। বাংলাদেশে প্রায় সব জায়গা থেকে আসতে পারে। এই সুবিধা থাকার কারণে প্রধান আলমী মাশওয়ারা গুলো বাংলাদেশেই হয়। তাই বাংলাদেশের তবলীগের সংরক্ষন বা হেফাজত আসলে আলমী তবলীগের হেফাজত। এতবড় কাজ আর আল্লাহ্ তায়ালা নির্বাচন করেছেন আমাদের মত নগন্য মানুষকে। সমস্যাতো অনেক দিনের; কিন্তু সমাধানের জন্য কেউ এগিয়ে আসেননি। আমাদের এগিয়ে আসা, আল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের জন্য অনেক বড় সুযোগ।
আবু মাহ্জান সাকাফী রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু; এত জন বড় বড় সাহাবী থাকতে আল্লাহ্ তায়ালা নির্বাচন করলেন তাঁকেই, যিনি মদ পান করতেন। আর তাঁকে দিয়েই আল্লাহ্ তায়ালা এতবড় কাজ করালেন। আর এই কাজের উসিলায় আল্লাহ্ তাঁকে এ খারাপ অভ্যাস থেকে তওবাও নসীব করলেন।
আল্লাহর কাছে শুকর আদায় করা যে, আল্লাহ্ তায়ালা মেহেরবাণী করে আমাকে এই বড় কাজের জন্য পছন্দ করেছেন; আর যখন করেছেন, পু্রো গুরুত্ব ও আদবের সাথে তার হক্ক আদায় করার চেষ্টা করা উচিত। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দেহ মোবারককে যখন কিছু খ্রীষ্টানরা নিয়ে যেতে চাইল, তখন আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর হেফাজতের জন্য ব্যবহার করলেন নূরউদ্দীন জঙ্গী রহমাতুল্লাহি আলাইহি কে, অথচ উনি মদিনায় ছিলেনও না, মদিনায় আরও অনেক আল্লাহ্ ওয়ালারা ছিলেন, কিন্তু আল্লাহ্ তায়ালা মিশর থেকে উনাকে আনিয়ে হেফাজত করালেন। যখন করালেন উনি তার খুব কদর করলেন, খুব যত্নের সাথে করলেন, যারা এ অপকর্ম করতে চাচ্ছিলো, তাদের কতল অন্য কাউকে দিয়ে না করিয়ে নিজ হাতে করলেন। আদবের দাবী এটাই। খিদমত যেন নিজ হাতেই করে।
আল্লাহ তায়ালা মেহেরবানী করে আমাদেরকে এত বড় কাজের জন্যে নির্বাচন করেছেন। এর পুরা হক আদায় করবার চেষ্টা করা। দিল থেকে আল্লাহর কাছে শুকুর আদায় করা ও কদর করতে পারার তৌফিক চাওয়া ও কবুলিয়াতের জন্যে দোয়া করা। যদি এ দায়িত্বকে ঠিকমত আদবের সাথে আদায় করতে পারি, হয়তঃ এটাই আমার নাযাতের উসিলা হবে। হয়ত এ দায়িত্ব পালনই তরক্কীর উসিলা হবে। যেরকম মানুষ যিকির করে তরক্কী করে, গাশত্ করে তরক্কী করে, তালীমের মাধ্যমে তরক্কী করে বিভিন্ন ভাবে তার রুহানী তরক্কী হয়।
সাহাবাদের তা’লিম, তরবিয়ত ও তরক্কীর বড় অংশই হয়েছে সংকটের মোকাবেলার মাধ্যমে। গাল শোনা, মার খাওয়া সহ্য করার মাধ্যমে। আমাদের এই যমানায় মানুষ দ্বীনের মেহনত করবে, আর এ জন্য তাকে একটা চড় খেতে হবে বা গাল শুনতে হবে, এটা কোন ধারনার মধ্যেই ছিল না, কোন সুযোগই নাই। আল্লাহ তায়ালা সে সুযোগও করে দিয়েছেন। দ্বীনের মেহনতের মধ্যে মোকাবেলার সম্মুখীন হওয়া, এটাকে কদর করা, আর কদর আগ্রহের সাথে করা। কবি লবীদের কবিতার বিরুদ্ধে বলার কারণে উসমান ইবনে মাদঊন রাযিআল্লাহু তায়ালা আনহু কে উবাই বিন খলফ ঘুষি মারল। ঘুষি খেয়ে রক্ত জমে চোখ নীল হয়ে গেল। তাঁর চাচা বললেন যে “আমার আশ্রয়ে থাকলে তোমার এই অবস্থা হত না”। উনি বললেন, “আমার অপর চোখও এটারই আগ্রহী।” ইচ্ছা করে ঐ আশ্রয়কে বাদ দিয়েছেন যাতে মার খান। কারণ আশ্রয়ে থাকার কারণে উনি নিরাপদ, আর বাকি সবাই মার খাচ্ছেন। এই নিরাপদ থাকাই তাঁর কাছে ভাল লাগে নি। ঐ আশ্রয় প্রত্যাখ্যান করলেন মার খাওয়ার জন্যে। আমি বঞ্চিত থাকব কেন? দুনিয়ার মানুষ যেরকম মনে করে, আমার ভাগ পাব না কেন? সবাইকে দিচ্ছে, আমাকে দেবে না কেন? উনি ওরকমই ভাবলেন, সবাই মার খাচ্ছে, আমি খাব না কেন? আমারও হক্ব আছে। নিজে হক্ব নেওয়ার জন্য চাচার আশ্রয়কে উনি পরিত্যাগ করলেন। প্রথমে একাকি, তারপর বাজারে গিয়ে প্রকাশ্যে, যেন সবাই জানে যে আমি এখন উন্মুক্ত, আমি এখন মার খেতে পারি। যে কেউ যেন আমার উপর হাত তুলতে সাহস পায়। ঠিকই মার খেলেন, আর উনি তার কদর করলেন।
আল্লাহ্ তায়ালা আমাদের কে দ্বীনের কদর করার তৌফিক নসীব করুক। আমীন.
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك  سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ
(মাজালিসে মুশফিক আহমেদ রহঃ)
একজনের অসুখ আর কিছুদিন পরপর সে তার নিজের স্বাস্থ্যের অবস্থার দিকে তাকায়। শক্তি বাড়ছে কিনা, ঘুম ঠিকমত হচ্ছে কিনা, খাওয়ার রুচী হচ্ছে কিনা, শরীর ভাল লাগে কিনা। ব্যাবসায়ী ব্যাবসা করে, (কিন্তু) ব্যাবসা করার জন্য ব্যাবসা করেনা। ব্যাবসা করে লাভের জন্য। অন্য লোক তার দিকে তাকায়। তাকায় মানে কি? যে পাঁচ বছর ব্যাবসা করার পর তার জামাকাপড়ের অবস্থা কেমন। কিন্তু যদি দেখে যে আগের মত এখনো ছেড়া গেঞ্জী, তাহলে বুঝা যায় ব্যাবসা ঠিকমত হচ্ছে না।
তো আমলের জন্য আমরা কি দেখবো? যেখান থেকে বুঝবো যে তার আমল হচ্ছে কিনা। রোগীকে কেউ জিজ্ঞাসা করল যে ‘আপনার চিকিৎসার খবর কি?’ সে বলল যে ‘আমি এতগুলো বড়ি খেয়েছি আর এতগুলো শিশি খেয়েছি’। এই বলাতে প্রশ্নের উত্তর হয়না। বলল যে বড়ি খেয়েছো, শিশি খেয়েছো, শরীরের খবর কি? ভাল হয়েছো কিনা? যদি বলে যে ‘শরীরের দিকে তো খেয়াল করিনি, কিন্তু ঔষুধ ঠিকমত খেয়েছি কিনা সেই হিসাব ভালমত আছে’। লোকে বলবে যে ‘লোকটা পাগল নাকি বোকা’। বুদ্ধি তো খারাপ না, ঔষুধের হিসাব রেখেছে। বরং একজন স্বাভাবিক সুস্থ মানুষ, সে তার শরীরের অবস্থার দিকে তাকাবে। যদি স্বাস্থ্য ভাল হয় তাহলে চিকিৎসা ভাল। কতগুলো বড়ি খেয়েছো তাতে কি আসে যায়।
ব্যাবসা করেছে যে এত মাল এলো আর এত মাল গেল। এত মাল এলো আর এত মাল গেলো ঠিক আছে, কিন্তু তোমার পকেটে টাকা থাকল কত? বাড়ির খরচ ঠিকমত তুমি দিতে পারছ কিনা? বলল ‘ওটা তো জানিনা’। তো মাল কি এলো আর কি গেলো, ঐটা দিয়ে কাজ কিসের যদি না জানো।
তো দ্বীনের যে কাজই হোক, সেই কাজে আমাকে দেখতে হবে যে আমাকে ফায়দা দিচ্ছে কিনা। এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রত্যেক জিনিসের ফায়দা।
ছাত্র পড়াশোনা করে নম্বর পাওয়ার জন্য। কলেজে ভর্তি হয়েছে, ক্লাস করছে। তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “তোমার পড়াশোনার খবর কি’। তো বলল যে ‘অনেক টাকা পেয়েছি”। ক্লাস করে অনেক টাকা পেয়েছো কেমন করে। বলল যে একটা গ্রুপের সাথে ঢুকেছি তাতে ইনকাম ভালই হয়। ফিস ওরা কিছু দিয়েছে। তো বুঝতে পেরেছে পড়াশোনা তো কিছুই হচ্ছে না। দুইদিন পর হয়ত জেলে যাবে, তাও যদি কিসমত ভাল থাকে আর নাহলে লাশ পাওয়া যাবে একদিন রাস্তাঘাটে।
তো বুঝতে হবে যে কোন জিনিসের কি ধরনের লাভ। হাল চাষ করছি, কৃষি কাজ করছি আর লাভ হচ্ছে ফসল। পড়াশোনা করছে তার লাভ হচ্ছে ডিগ্রী। দ্বীনের যে কাজ করছি ঐটার লাভ কি?
তো দ্বীনের কাজ করলাম। অমুক পীরের কাছে মুরীদ হয়েছি। নিয়মিত যায়। তো পীরের কাছে যে মুরীদ হয়েছো, নিয়মিত যাও – ফায়দা কি হল? ফায়দা হল যে এক প্লট জমি কিনেছি, একটা ফ্লাটের অর্ডার দিয়েছি। এটা তো কোন লাইনের কথা হল না। তারপর খোঁজ নিল যে পীরটা কে? সে কি জিকির করে নাকি স্মাগলিং করে। তো ফায়দার লাইন জানা দরকার। কি ফায়দা আমি আশা করি। অনেক সময় দ্বীনের কাজের মধ্যে না থাকলে আর কি ফায়দা আশা করি ঐটাই জানিনা।
একজন কোন এক জায়গার, কোন এক জেলার জিম্মাদার ব্যাক্তি চিল্লা গেছেন। চিল্লায় থাকা অবস্থায় উনার চাকুরীর প্রমোশন হয়েছে। ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন, এজিএম হয়েছেন। তো ফিরে এসে দেখেন যে প্রমোশন হয়ে গেছে। ম্যানেজার ছিলেন, এজিএম হয়ে গেছেন। তো বয়ানের মধ্যে আল্লাহর পথের বরকতের কথা বলছে। আল্লাহর পথের গায়েবী নূসরত। যে জিএম ছিলাম আর এজিএম হয়ে গেছি। একজন আলিম এই কথা শুনে বললেন ‘এই লোকের উপর তো কুফরীর ফতোয়া হয়ে যাবে’। সূদের ব্যাংকে চাকুরী করে তার প্রমোশন হয়েছে, ওটাকে গায়েবী নুসরত বলছে না মদদ বলছে বা কিছু একটা বলছে আর ওর উপর তো ফতোয়া কুফরী। তবলীগে গেছে কি দ্বীনদার হওয়ার জন্য নাকি কাফির হওয়ার জন্য। তো আমি না বুঝি যদি আমি খুজছি কি তাহলে তো উল্টো জিনিস খুজবো।
খোঁজার গল্প আছে। ল্যাম্প পোষ্টের নীচে, সন্ধ্যাবেলা। অল্পরাত। ল্যাম্প পোষ্টের নীচে কিছু একটা খুজছে। ইতিমধ্যে প্রতিবেশী একজন এসে তার সাথেও শরীক হল। প্রতিবেশী শরিক হলো যেহেতু সাহায্য করার দরকার সেই হিসেবে। তো উনিও খুজতে আরম্ভ করলেন। বেশ কিছুক্ষন খুজলেন। তারপর যিনি শরিক হয়েছেন জিজ্ঞাসা করলেন ‘কি খুজছেন?’ অনেক্ষন খুজার পর জিজ্ঞাসা করলেন। এতক্ষন খুজেছেন তার সাথী হয়ে, কিন্তু কি খুজছেন তা জিজ্ঞাসা করেননি। (ভেবেছেন) উনিও খুজছেন আমিও খুজি। (তো) জিজ্ঞাসা করলেন কি খুজছেন। বললেন যে ‘চাবি’। চাবি হারিয়ে গেছে, চাবি খুজছি। তখন আবার খুজতে আরম্ভ করলেন। তখন আবার নিয়্যত পরিবর্তন করলেন। আগে তো জানতেন না যে কি খুজছেন। এখন খুজছেন চাবি। কিছুক্ষন খুজার পর পেলেননা, তখন আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চাবি আপনি হারিয়েছেন কোথায়?’ বললেন যে ‘বাড়ির ভিতরে’। তো হারিয়েছেন বাড়ির ভিতরে আর এখানে কেন খুজছেন? বললেন, ‘এখানে লাইট আছে দেখা যাবে, বাড়ির ভিতরে যেখানে চাবি হারিয়েছে সেখানে অন্ধকার’।
তো আমাদের দ্বীনের মেহনত যদি এরকম হয় যে ব্যাস্ত হয়ে খুজছি ঠিকই, কিন্তু কি খুজছি , কোথায় খুজছি, কেন খুজছি তা জানি না, তাহলে এই খুজা দিয়ে কোথায় যাব? তবলীগ করল, চিল্লা দিল আর কয়েকদিন পর দেখা গেল বেশ ধনী হয়ে গেছে। আগে টাকা পয়সা সেরকম ছিল না, এখন অবস্থা বেশ ভাল। বহুত খায়েরে বরকত দেখা যাচ্ছে। এগুলো বাস্তব ঘটনা। এই যে ব্যাংকের কথা বলা হল– এটা বাস্তব ঘটনা। আর কিছু কিছু লোক ভাল সম্পদশালী হয়ে যাচ্ছে আর সে মনে করছে বরকত আসছে। শয়তান তো সাংঘাতিক ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। জানার দরকার যে আমি কি খুজছি, কি চাই। আর এই ভুলের মধ্যে আমরা বেশিরভাগ মানুষ পড়ে আছি।
তো একজন তবলীগে গেল। যাওয়ার আগে ওর বড় দোকান ছিল। বড় কাপড়ের দোকান। কাপড়ের বিরাট ব্যাবসায়ী। তারপর আস্তে আস্তে করে চিল্লা দেয়, তিন চিল্লাও দেয়, মোকামি কাজ করে। আর এদিকে ব্যাবসার অবনতি হচ্ছে। উন্নতি তো হচ্ছেই না, বরং ধীরে ধীরে অবনতি হচ্ছে। কিন্তু তার চিল্লা, তবলীগের কাজ এগুলো কমছে না, বরং বাড়ছে। বেশ কয়েক বছর পরে এমন অবস্থা গেল যে এখন ফেরিওয়ালা হয়েছে। যে একসময় বড় কাপড়ের ব্যাবসায়ী ছিল এখন কাধে কিছু কাপড় নিয়ে মহল্লায় ফেরি দিতে যায়। তো তার ঘটনা আলোচনার মধ্যে যে এই লোক চিল্লাও দেয়, তিন চিল্লাও দেয়, তসবিয়্যাত আদায় করে, হালাল ব্যাবসাও করে। কিন্তু দোষ তো কিছুই দেখা যায় না। তখন সব বাকী যত তবলীগওয়ালা আছে, পীর-দরবেশরা আছে সবাই চিন্তায় পড়ে যাবে যে ঘটনা কি! কেউ বলবে মায়ের বদদুয়া লেগেছে। আবার কেউ বলবে ‘তবলীগ করেছে ঠিকই, কিন্তু মুরব্বীদের ইতাআদ করেনি। এজন্য পরিণতি খারাপ হয়েছে’। তো নিজ আন্দাজমত ব্যাখ্যা দিবে।
সব শুনার পর বলা হল যে ঘটনা কিন্তু আবুবকর সিদ্দীক রাঃ এর। (সুবহানাল্লাহ)। তখন বলে যে, ‘ইয়ে মানে, হ্যা, ওটার কেস আলাদা”। না বুঝার কারণে ভাল কি, মন্দ কি কিছুই বুঝে না।
আম কিনতে গেছে। আম যে বিক্রি করছে আর ক্রেতা, কারোই আমের সমন্ধে ভাল জ্ঞান নেই। আমের কোন অংশ খায় আর কোন অংশ খায়না সেই ব্যাপারে অজ্ঞ। তো আম ছোট। কিন্তু বিক্রেতা বলছে আম ছোট হলে কি হবে, আটি কিন্তু মোটা আছে। ক্রেতাও ভাবলো কথাতো ঠিক। তাহলে আম কিনি। তো এই জাতীয় যদি ক্রেতা হয় আর এই জাতীয় বিক্রেতা হয়, তাহলে মেহনত করছি কিন্তু কি চাই তাও জানিনা, কি পাই তাও জানিনা। আল্লাহতাআলা দিল, ভাল দিল না মন্দ দিল তাও বুঝতে পারছি না। ভাল দিল আল্লাহতাআলা, (অথচ) আমি নারাজ। নারাজ হওয়ায় আল্লাহ তাআলা রাগ প্রকাশ করলেন আর খারাপ জিনিস দিলেন। এখন আমি সন্তুষ্ট। এজন্য আল্লাহওয়ালাদের জীবনের দিকে খুব বেশি করে তাকানো যে আমি চাই কি? তা না হলে মেহনত তো করবো, কিন্তু কি চাই তাও জানিনা। (সেক্ষেত্রে) বড় বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যাব।
দৃষ্টান্ত হরেকরকম পাওয়া যাবে। এই তাবলীগের মেহনতের মধ্যেই পাওয়া যাবে কিছু লোক যাদের জীবন পাক হয়েছে। আগে ব্যাবসায় ভেজাল করতো, এখন আর ভেজাল করেনা। আগে অনেক টাকা ছিল, এখন খুব টানাটানির সংসার। কিন্তু হালাল। আগে প্রচুর ছিল হারাম, এখন হালাল। সে নিজে বুঝে অতএব সে সন্তুষ্ট।
তার কোন অভিযোগ নেই। বরং মনে করে আল্লাহতাআলার বড় মেহেরবানী। কেন মেহেরবানী? কারণ আল্লাহতাআলাই বড় মেহেরবানী করে হালাল খাওয়ার তৌফিক দিয়েছেন। আগে হারাম খেতাম আর এখন হালাল খাই। তো বড় সন্তুষ্ট। ওর দিকেই তাকিয়ে আরেকজন বলবে যে এই লোক তো তবলীগ করে ডুবে গেল। আগে গাড়ি ছিল আর এখন সাইকেলও নেই।
একবার রংপুর না কোন অঞ্চলে, অবশ্য ভুলে গেছি সফরে ছিলাম। তো ওখানকার একজনের কথা বলল যে কোন এক সাথী চালের ব্যাবসা করতো। এক সময় ওর ট্রাক লোড করে চাল ঢাকায় আসতো। এর মানে বেশ মোটা অংকের ব্যাবসা করে। যে ট্রাক পাঠাতে পারে সেতো আর ছোটখাটো ব্যাবসায়ী না। তো তার বর্তমান অবস্থা হলো এই যে বাজার করার জন্য বাজারে গিয়ে আধা কেজি চাল কিনে। ঘরের মধ্যেও নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলাম এরকম হালতে তার হাবভাব, কথাবার্তার ধরন কি? পেরেশান, অস্থির নাকি সে মুতমাইন (সন্তুষ্ট) আছে? তারা বলল যে সে মুতমাইন আছে। তো আলহামদুলিল্লাহ। সে ঠিক লাইনেই আছে। তা না হলে সে পেরেশান হবে; আর বলবে সর্বনাশ, এই তবলীগ করে আমার এই সর্বনাশ হয়ে গেছে। কিন্তু সে মুতমাইন আছে আর মুতমাইন তবলীগের মেহনত করেই হয়েছে। নিশ্চয় সে চিনতে পারছে যে ভাল কি মন্দ কি। পরিমাণ অনেক কম কিন্তু অবস্থা সে বুঝতে পারছে।
আরেক জায়গায় তার একেবারে বিপরীত হয়। কিছুই ছিলনা আর কিছুদিনের মধ্যেই বিরাট এক বাড়ির মালিক হয়ে গেছে। তো চিনার দরকার যে আমি কি চাই। এজন্য সাহাবাদের জীবনের দিকে খুব বেশি নজর রাখা। ফাযায়েলে সাদাকাতের যদি খুব বেশি চর্চা করি তাহলে সেটা আমাকে দিক নির্দেশনা দিবে যে আমি কোথায় চলছি। দুর্ভাগ্যবশত আমরা ফাযায়েলে সাদাকাতের চর্চা খুব কম করি। আর আল্লাহওয়ালাদের জীবনের চর্চাও খুব কম করি।
অনেক ক্ষেত্রে বেশ বড় একটা অংশ তবলীগের দিকে ঠেলে বড় গলদ দিক নির্দেশনা দেয়। ছাত্রদের মধ্যে তো প্রচলিত কথা যে ভাল রেজাল্ট করে ভাল পজিশনে যেতে হবে। ম্যাজিস্টেট হও, এই হও সেই হও। তবলীগে যাওয়ার আগে দুনিয়ার যে জযবা ছিল, তবলীগে যাওয়ার পরে ঐটা বেড়ে গেছে। কারণ আগে তো তাকে কেউ এই ব্যাপারে তরগীব (উৎসাহ) দিত না। নিজে নিজেই। আর আগেও ভাল পজিশনের মূল্য তার কাছে ছিল কিন্তু শুধু দুনিয়ার ফায়দা হিসেবে। এখন গিয়ে দেখছে ভাল পজিশনে গেলে দুনিয়া তো আছেই, জান্নাতও কিনা যায়। এখন দেখছে টাকা-পয়সা যার কাছে আছে, তবলীগের মুরব্বীদের কাছে হাই পজিসন, মাশওয়ারাতেও তার কথা খুব চলে। আর যার টাকা-পয়সা নেই, ও সেরকম পাত্তা পায়না। ও শুধু মোকামি কাজ করে। তাই মার্কাজে আমার দরকার আছে। এজন্য শুদ্ধ নির্দেশনা খুব জরুরী। আল্লাহওয়ালাদের সহবত, আল্লাহওয়ালাদের জীবনের চর্চা, হায়াতুস সাহাবা, ফাযায়েলে সাদকাত আর খুজে খুজে যেখানে কোন নির্ভরযোগ্য লোক মনে হয় যে দ্বীন বুঝে এরকম হাবভাব-লক্ষন, দুয়াও করা তাদেরকে পাবার জন্য। তো সেইসব লোকের সাথে সম্পর্ক বাড়ানো যাতে আমি ভুল রাস্তায় না পড়ে যায়। দ্বীনের মধ্যে এসে যদি কেউ ভুলের মধ্যে পড়ে যায়, ওর তো আর সংশোধনের কোন জায়গা নেই। ঐ যে প্রচলিত একটা কথা আছে। যেই তেল দিয়ে ভুত নামাবে, সেই তেলেই যদি ভুতের আছর থাকে তাহলে ভুত নামানোর জন্য যতই তেল দিক ওতে ভুত বাড়বে আরো।
সেজন্য দ্বীনের ময়দান যেন পাক থাকে, পবিত্র থাকে, চেষ্টা দুয়া করতে থাকা। কয়েকটা জিনিস। সুন্নতের উপর যদি আমরা ইহতাম করি; গরীব মিসকীনের সাথে বেশি উঠাবসা করা। শরীয়তে এর খুব তাগিদ আছে। রিয়াদুস সালেহীন কিতাবের মধ্যে সম্পূর্ণ বাব আছে ‘গরীব মিসকীনের সাথে উঠাবসা করা’। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটাকে পছন্দ করতেন, তরগীব দিয়েছেন। এতে নিজের দ্বিলের মধ্যে মালের মোহ, পরিচিতি খ্যাতির মোহ ওগুলো কমবে। আর যদি বড়লোকের সাথে বেশি উঠাবসা করা হয়, তো নিজের মনের ভিতর এগুলোর মোহ ঢুকবে। আর যখন এইসব মোহ ঢুকবে তখন তার বুদ্ধি নষ্ট হয়ে যাবে। ও তখন নিজেই সব কথাকে প্যাচাবে। তখন ওর মনে হবে যে আমার অনেকে টাকা দরকার। কিসের জন্য; বলে যে দ্বীনের খেদমত করব। দ্বীনের খেদমত কিরকম? এই যে বাড়িতে মাস্তুরাতের জামাআত আনতে পারবো। আর মাস্তুরাতে জামাআত আসলে, বিদেশের জামাআত আসলে যেহেতু তারা একটু ভাল পজিশনে থাকে, তাই বিরাট বাড়ি হবে। বাড়ির গেইটও দুটো আলাদা হবে। পুরুষের জন্য আলাদা গেইট, মাস্তুরাতের জন্য আলাদা গেইট।
আর বড় গাড়ি হবে যে গাড়ির কাঁচ এমন হবে যে বাইরে থেকে ভিতর দেখা যায় না, পর্দা রক্ষা হবে। মাস্তুরাতের জামাআতগুলো যখন আনবো তখন যেন কোন অসুবিধা না হয়। এইসবগুলো পিউর আল্লাহর ওয়াস্তে। আমার নফসের কোন তাকাজা নাই। এগুলো সব দ্বীনের খেদমত করবার জন্য।
শয়তান বুঝায়। শুধু নিজের নফস চায় তো ঐটাতে একটু কেমন কেমন লাগে বলতে। এজন্য দ্বীনের খেদমতের কথা বলে। আর যদি ঐরকম বড় বাড়ি-গাড়ি থাকে তো মুরব্বীদেরও খেদমত করতে পারবো, মুরব্বীদের দুয়া পাবো। আর আল্লাহওয়ালাদের যে দুয়া পাওয়া যায় ওতেই পার পেয়ে যাবো। আর ভাল দুয়ার জন্য একটা ভাল গাড়ীর দরকার। এই দুইনম্বর গাড়ি দিয়ে কোন হাই ক্লাস দুয়া পাওয়া যাবেনা। হাই ক্লাস দুয়া পেতে হলে হাই ক্লাস গাড়ির দরকার। তো ও এসব চক্করের মধ্যে পড়ে যায়। আর তার কাছে এসব কথা ঠিক মনে হবে যেহেতু নিজের মন চাচ্ছে। এজন্য ভাই আল্লাহর পথে বের হয়ে……। শুধু বের হওয়া নয় বরং বের হওয়া, দুয়া করা আর আল্লাহওয়ালাদের সহবত খুজা, গরীব মিসকীনদের সাথে বেশি উঠাবসা করা, ফাযায়েলে সাদাকাত পড়া বিশেষ করে ঘরের মধ্যে ইনফিরাদিভাবে আর এটাকে বাড়ানো। ফাযায়েলে সাদাকাতের চর্চা যদি খুব থাকে তাহলে ইনশাআল্লাহ ওটা আমার মধ্যে অনেক ভুল ত্রুটি কাটাবে। এই ফাযায়েলে সাদাকাতের কিতাব যে হযরত শাইখ লিখেছেন, কোন ফালতু লিখেননি। অথচ ওটার কোন চর্চাই নেই। এজন্য আল্লাহর পথে বের হওয়া। ঠিক আছেনা ইনশাআল্লাহ……
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ
(মাজালিশে মুশফিক আহমেদ দাঃ বাঃ)

এই উম্মতকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কিয়ামত পর্যন্ত তারা কাজ করবে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে জাহেরীভাবে শরীয়তের অনেকগুলো আহকামও বদলে যাবে। ঈসা আঃ যখন আবার আসবেন, ঈসা আঃ আসার পরে একপর্যায়ে জিযিয়া বাতিল করে দিবেন আর জিযিয়া থাকবে না। জিযিয়া একটা শরীয়তের হুকুম, থাকবে না। আবার এটা নতুন শরীয়তও নয়। ঈসা আঃ যে আসবেন, উনি এসে রাসূল সাঃ এর শরীয়তমত চলবেন। কিন্তু জিযিয়া বাতিল করে দিবেন। তো পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আল্লাহতাআলা উম্মতের ভিতরে বড় বড় পরিবর্তনের দায়িত্ব রেখেছেন। এগুলো হবে। যখন এই কথা সম্ভবত হোসাইন আহমেদ মাদানী রহঃ দেওবন্দ মাদ্রাসায় পড়াচ্ছিলেন আর বললেন যে (ঈসা আঃ) জিযিয়া তো বাতিল করে দিবেন। ছাত্রদের মধ্যে কেউ একজন প্রশ্ন উঠালো যে ‘তাহলে ঈসা আঃ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুগত থাকলেন কেমন করে?’ শরীয়তের একটা হুকুমকে যদি উনি পরিবর্তনই করে দেন, তাহলে তো নতুন শরীয়ত হল। তো উনি ঐ শরীয়তের মধ্যে থাকলেন কেমন করে? মাদানী রহঃ তার এই প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘উনি যে শরীয়ত (এর এই হুকুমটা) পরিবর্তন করে দিবেন এই কথা কে বলল?’ রাসূল সাঃ বলেছেন। তাহলে ওটা নতুন হুকুম হল কেমন করে? উনারই বলে দেওয়া হুকুম। ঐ অবস্থায় হবে।
তো নতুন নতুন জিনিস করতে হবে এই উম্মতকে। এইটা এই উম্মতের একটা বৈশিষ্ট্য যেটা আগের উম্মতের ছিলনা। এটা বড় গুরুত্বপূর্ণ। কুনতুম খাইরাউম্মাত উখরিজাতলিন্নাস। আগের উম্মতের জন্য যে কাজ করতে বলা হয়েছে ঐটা করে দেওয়ায় শেষ। নতুন অবস্থায়, নতুন পরিস্থিতিতে নতুন জিনিস করা আগের উম্মতের ছিলনা। নতুন কাজ করতে হলে সাধারণত যেটা কিছু প্রেসক্রিপসন বলতে বুঝায়- ঐটা মানলে চলবে না। অবস্থার অনেক পরিবর্তন হতে পারে। বলা হয়নি যে এটা কর। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে তাকে নতুন কিছু করতে হয়। অনেক কিছু পরিবর্তন করা দরকার হতে পারে। তো ডাক্তারির পরিপ্রেক্ষিতে যদি চিন্তা করা যায় আগের উম্মতদের কাজ ছিল মোটামাটি নার্সের মত। নার্স কোন প্রেসক্রিপসন লিখেনা। আর প্রেসক্রিপসনও পরিবর্তনও করেনা। যা ডাক্তার লিখে দিয়েছেন প্রেসক্রিপসন, নার্স ঐটাকে করে দেয়। আর এই উম্মতের কাজ অনেকটা ডাক্তারের মত। তাকে নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে।
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। একজন রোগী কোলকাতা থেকে চিকিৎসা করে এসেছে, ক্যান্সার ছিল। তারপর ঢাকায় চলে এসেছেন। ঢাকায় বাকি চিকিৎসা হবে। কোলকাতায় যে ডাক্তারের কাছে প্রেসক্রিপসন নিয়েছিলেন, সেই ডাক্তারও ঢাকায় এসেছে কোন একটা উপলক্ষ্যে। আর (রোগী) দেখা করল। ডাক্তারদের সাথেও আলোচনা হয়েছে। (কিন্তু সমস্যা হয়েছে), তার পরবর্তী এখানে ঢাকায় কোন ডাক্তার দেখাশুনা করবে। একটু পরিচিত ব্যাক্তি, নাম বললে হয়ত তোমরা চিনবে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। ক্যান্সার ছিল, বাকি চিকিৎসা ঢাকায় হবে।  তো ঢাকায় ওর ফলোআপ ইত্যাদি কোন ডাক্তার করবে। কয়েকজন ডাক্তার ছিল সেই কোলকাতার নামকরা ডাক্তারের উপলক্ষ্যে। রোগীও নামকরা, ডাক্তারও নামকরা। আলোচনা হচ্ছে, ডাক্তার যখন কিছু কথা বললেন, অন্যান্য সব ডাক্তাররা এই কথাকে মেনে নিলেন। (কিন্তু) একজন ডাক্তার খুব তর্ক করল। সবার মাঝে অন্যদের মাঝে একটু বেয়াদবের মত লাগল। ঐ ডাক্তার (কোলকাতায়) যাওয়ার সময় ইলিয়াসকে বলে গেল ‘যে ডাক্তার তর্ক করেছিল এর কথামত চলবে’। ওর এই তর্ক ইত্যাদি করাতে উনার আন্দাজ হয়েছে যে ও বুঝে কথা বলে। আর বাকিরা হা হু করে। আর এজন্য ওকে বলে গেল যে পরবর্তীতে এর অধীনে থাকবে।
হযরতজী মাওলানা এনামুল হাসান সাহেব রহঃ ইজতিমায় আসতেন। আর যাওয়ার আগে উনাকে অনুরোধ করা হত কিছু কথা বলবার জন্য। তো কিছু কথা বলতেন। কয়েক বছর পরে একবার উনি গতবছর কি বলেছিলেন, তার আগের বছর কি বলেছিলেন, তার আগের বছর কি বলেছিলেন তার ফাইল খুলা হয়েছে আর একসাথে অনেকগুলো পড়ে শুনানো হয়েছে। আশ্চর্যের কথা যে প্রায় একই কথা। উনি তো আর এগুলো রেকর্ড রাখতেন না। বলা যায় যে শব্দের সামান্য পার্থক্য, কিন্তু কথা ঘুরেফিরে একই। আর কথা মোটামুটি এই ধরনের যে প্রথমে আরম্ভ করতেন একটা প্রশ্ন দিয়ে ‘এ কাম কিয়া হে?’ তারপর নিজেই উত্তর দিতেন ‘এক জিম্মাদারি হে’।
জিম্মাদারি আর কর্মী ভিন্ন জিনিস। ‘জিম্মাদার’ ও নিজে চিন্তা করে আর ‘কর্মচারী’ অন্যের চিন্তাকে কার্যকর করে। আল্লাহতাআলা দ্বীনের এই কাজকে কর্মচারীর কাজের সাথে তুলনা করেননি, বরং তুলনা করেছেন ব্যাবসায়ীর সাথে। ব্যাবসায়ী সে নিজে চিন্তা করে আর চিন্তা করতে গিয়ে তার কি করণীয়, বিভিন্ন জিনিস তাকে ভাবতে হয়। বলা যেতে পারে এই উম্মতের মেজাজ হচ্ছে ঐ ব্যাবসায়ীর মত যার কাছে নতুন নতুন পরিস্থিতি আসবে। আর নতুন নতুন পরিস্থিতিতে তার ব্যাবসার নানান অবস্থা পরিবর্তন করতে হবে। আগের উম্মতের কাজ ছিল অনেকটা কর্মচারীর মত। তার নতুন পরিস্থিতি মুকাবিলা করার দায়িত্ব না, বরং নতুন পরিস্থিতি যখন আসবে, আল্লাহতাআলা নতুন নবী পাঠাবেন। এই উম্মতের জন্য তা নয়। এই উম্মতকেই কাজ করতে হবে। এইজন্য ক্ষেত্রবিশেষে নিজে থেকেই করা। আর আল্লাহতাআলা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হায়াতের ভিতরেই প্রথম থেকে এটা খুব বেশি চর্চা করিয়েছেন।  রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে দুনিয়া থেকে যাওয়ার আগে উম্মতকে ঐ মাত্রায় প্রস্তুত করে গেছেন যেন তারা নিজে কাজ করতে পারে।
একপর্যায়ে আবুবকর ও উমর (রাদিয়াল্লাহু আনহুমা) এই দুইজনকে সম্বোধন করে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘তোমরা কোন ব্যাপারে যদি একমত হয়ে যাও, তাহলে আমি ভিন্নমত রাখব না’। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে উনার মতকে এই দুইজনের সম্মিলিত মতের চেয়ে নীচে রেখেছেন। তো উম্মতকে এত উপরে উঠাচ্ছেন। কারণ এদেরকে যদি প্রথম থেকেই জিম্মাদারির উপর না উঠানো হয়, তো পরবর্তীতে এরা নিজ থেকে কিছু করতে পারবে না। এটা হল ব্যাবসায়ীর বৈশিষ্ট্য।
একটা কথা আছে মারওয়ারিদের সম্বন্ধে। সমাজের মধ্যে প্রচলিত কথা নাকি বাইরের কথা অত বিস্তারিত আমি জানিনা। তো মোটামুটি কথা এই যে, ‘মারওয়ারি তার মেয়েকে কোন ছেলের কাছে বিয়ে দেয়না যে কমপক্ষে দুইবার তার মূলধন নষ্ট করেনি’। যে মূলধন নষ্ট করেনি এইরকম ছেলের কাছে বিয়ে দেয়না। আরে এই আবার কি আশ্চর্য কথা। এরকম করতে হবে কেন? ওদের কথা হল যে ব্যাবসা করতে হলে মূলধন নষ্ট হবেই। তারপরে শিখবে। আর তার টাকাপয়সা নষ্ট হবে না, এমনি মাগনা শিখে ফেলবে তাও হবে না। ঐ ক্ষতি দিয়ে শিখতে হয়। তার দ্বিতীয় কথা হল ‘টাকা যখন নষ্ট করেছো, তখন বাপেরটা নষ্ট করে আস, আমারটা না। মূলধন নষ্ট করার যে ধাপগুলো আগেই শেষ করে আসো, আর তারপর এখানে এসে আমার মেয়েকে নাও।
বাঙালীদের সমন্ধে বলা হয় যে এরা এদের ছেলেদেরকে ব্যাবসা শিখাতে পারেনি। তো কেন ব্যাবসা শিখাতে পারেনি। বাপ যদি দেখে যে ছেলে একটা ভুল কাজ করতে যাচ্ছে, ওকে আর কাজ করতে দেয়না আর নিজে ঠেকাই। আর ব্যাবসায়ী যারা, সে তার ছেলেকে বলে টাকা যোগাড় কর, ব্যাবসা কর আর এমন কিছু একটা করতে যাচ্ছে যে বাপ বুঝতেও পারে এই টাকা যাবে, কিন্তু বলে না। যাক, না গেলে শিখবে না। তো যখন একবার দুইবার যাবে, ফকির হবে, তারপর শিখবে।
জিম্মাদারিতে একটা জিনিস নিজ দায়িত্বে বুঝে শুনে শিখতে হবে, বলে দিলে হবে না। বলে দিলে তো ঐটা আদেশ পালন হচ্ছে। নতুন পরিস্থিতিতে, নতুন অবস্থায় সে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে। দাজ্জাল আসবে আখেরি জমানায়। দাজ্জালের ডানে-বামে দুই ফিরিস্তা থাকবে। আর দজ্জাল বলবে, ‘আমি রব’। ডানের ফিরিস্তা বলবেন ‘মিথ্যা বলেছ’। কিন্তু কথাটা আস্তে বলবে। বাইরের লোক বেশি শুনতে পারবে না। বামের ফিরিস্তা ডানের ফিরিস্তার সমর্থনে বলবে, ‘ঠিক বলেছ’। জোরে। দাজ্জাল বলবে আমি রব। ডানের ফিরিস্তা বলবেন মিথ্যা বলেছ। বামের ফিরিস্তা বলবে ঠিক বলেছ। ডানের ফিরিস্তার কথা লোকজন শুনতে পাবে না। দাজ্জালের কথা আর বামের ফিরিস্তার কথা শুনতে পাবে। এই বামের ফিরিস্তার কথা শুনে ভাববে ফিরিস্তা যখন বলছে তখন ফিরিস্তা তো আর মিথ্যা কথা বলবে না। অনেকেই দাজ্জালের উপর ঈমান আনবে আর তারা জাহান্নামে যাবে।
প্রশ্ন হল ‘দোষটা কার’? ফিরিস্তা দুইজন আছেন। দুইজনেই যদি চুপ থাকতেন, তাহলে বেচারা জাহান্নামী হত না। দুইজনেই জোরে বলতেন তাও জাহান্নামী হত না। এই একজন জোরে বলে আর আরেকজন আস্তে বলে সাংঘাতিক প্যাচ লাগিয়ে দিয়েছেন। আর ও বেচারা গেল জাহান্নামে। দোষটা কার? দোষ ঐ যে জাহান্নামে যাচ্ছে তার।
দোষ একজনের আর আল্লাহতাআলা আরেকজনকে জাহান্নামে দিয়ে দিলেন এমন হতে পারে নাকি। যাকে জাহান্নামে দিচ্ছে তারই দোষ। ওর দোষটা কি?
দ্বীনের কাজ এমন নয় যেটা শুনলো আর ওটাই করলো, (বরং) তাকে কিছু বুঝেশুনেও করতে হবে। এটাই জিম্মাদারি। এই (উপরে দাজ্জালের ঘটনা) কথাগুলো তাফসিরে হাদীসে বলা হয়েছে যে এইভাবে এইভাবে হবে। এটা যে ভুল করে হবে (তা না)। (বরং) আগে থেকেই পরিকল্পিত। আর উম্মত যেন প্রস্তুত থাকে যে এই জিনিস ঘটবে। তো দাজ্জালের সময় যে জিনিস ঘটবে ওটা আজও ঘটতে পারে। আর এগুলো বলে দেওয়া হয়েছে হাদীস শরীফের মধ্যে যাতে সে প্রস্তুতি নেয়। তো ঐ প্রস্তুতি নিতে পারবে যে নিজে বুঝে, নিজ বিবেচনায় বুঝেশুনে একটা পদক্ষেপ নিতে পারে। শুধু শুনলাম আর মানলাম এটা যথেষ্ঠ নয়, শুনতে হবে, মানতে হবে, তবে তার সাথে নিজের বুঝেরও একটা ব্যাপার আছে। আর এটাই জিম্মাদারি।
আল্লাহতাআলা এই উম্মতকে বহুত আগে থেকেই জিম্মাদারির মেজাজের উপরে উঠিয়েছেন। যে প্রসংগে কথাটা এসেছিল একবার। আরব দেশ রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগে অনেকদিন পর্যন্ত লম্বা সময় তাদের উপর কোন শাসন ছিল না। আশেপাশে বড় বড় সাম্রাজ্যগুলো যেমনঃ উত্তরে রোম সাম্রাজ্য।  (আমরা জানি) আরবের উত্তরে সিরিয়া। আর রোম কোথায়। তাহলে নাম রোম সাম্রাজ্য কেন? (আসলে) ইতালির রাজধানী যে রোম ওখান থেকে নাম শুধু আর বাস্তবে ইতালি নয়, ইতালি তো অনেক দূরে। রোমান সাম্রাজ্য যখন একসময় খুব বড় হয়ে গেল আর একবার সম্রাট মরবার সময়। আগের জমানায় যেমন ছিল যে দুই ছেলেকে ভাগ করে দিল। তো রোমান সাম্রাজ্য ভাগ করে দিল। এক ভাগ হল পাশ্চাত্য রোমান সাম্রাজ্য আর আরেকভাগ হল পূর্বাঞ্চলীয় রোমান সাম্রাজ্য। ইস্টার্ন রোমান এমপায়ার আর ওয়েস্টার্ন রোমান এমপায়ার। পশ্চিম অঞ্চলের রোমান এমপায়ার যেটা ইউরোপের দিকে ছিল। ঐ অংশ আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেল। আর পূর্বের রোমান সাম্রাজ্য যেটা, ঐটা আবার খুব প্রশস্ত হয়ে বিরাট সাম্রাজ্য। তাই মূল রাজধানিও পূবের দিকে চলে এল। রোম থেকে মূল ভাগ হয়ে পূবের দিকে চলে এল আর একসময় তার রাজধানী হল দামাস্কাস, সিরিয়া। একসময় হয়ে ইস্তাম্বুল যেটা আগে ছিল কনস্টান্টিনোপল। কনস্টান্টিনোপল রোমান এমপায়ার নাম। একজন সম্রাটের নামে। তো রাজধানী মোটামাটি মাঝখানের দিকে হয়। কিন্তু পূর্ব দিকে এতদুর ছড়িয়েছে যে রাজধানী হয়ে গেল ইস্তাম্বুলে। বড় শহর। আগের নাম ছিল কনস্টান্টিনোপল। মুসলমানদের ফাতাহর পরে ঐটার নাম হল ইসলাম পোলিস বা ইসলাম পোল। শহরকে পোলিস বলে। মেট্রোপোল যেমনঃ মেট্রো মানে মা, আর পোলিস মানে শহর। বড় শহরকে মেট্রোপোল বলে মানে শহরের মা। তো ইসলাম পোলিস হল সম্ভবত ইসলাম শহর আর আরবরা আবার প বলতে পারেনা, প কে ব বলে। তো হয়ে গেল ইসলামবোল।
প্রচলিত একটা গল্প আছে যে এক আরব গিয়েছে লন্ডনে, কিন্তু গাড়ি পার্ক করার জায়গা পাচ্ছে না। গাড়ি রাখবে কোথায়, কারণ সব জায়গায় ভর্তি। তো একটা জায়গা পেল যেটা সন্দেহজনক। ওখানে একজন পুলিশকে পেল আর পার্কিং করা যাবে কি যাবেনা এইজন্য জিজ্ঞাসা করল, ‘মে আই বার্ক হেয়ার’। পুলিশ বলল, ‘স্যার, ইটস এ ফ্রি কান্ট্রি, ইউ ক্যান বার্ক এনিহোয়ার ইউ লাইক’। বার্ক মানে তো কুকুর ঘেউ ঘেউ করে। তো আরবরা প বলতে পারেনা, তাই ইসলামপোল না বলে ইসলামবোল বলত। পরে হয়ে গেছে ইস্তাম্বুল। এই হচ্ছে ঐ রোমান এমপায়ার।
তো আরবদের উত্তরে ছিল রোমান এমপায়ার। একটু পূবদিকে ছিল পার্সিয়ান এমপায়ার। একটু পশ্চিম দিকে মিশর -এগুলো ছিল গ্রীক এমপায়ারের অধীনে। দক্ষিনে ইয়ামান। এই সবগুলো উন্নত জাতি। অনেক আইন কানুন কত কি যে আছে। মাঝখানে আরবরা এমন যে একটা ফাঁকা জায়গার মধ্যে পড়েছে। আর এটার প্রতি আশেপাশের সাম্রাজ্যগুলোর কোন আগ্রহ নাই। এই মরুভুমি দিয়ে কি করবে? আর দ্বিতীয় কথা মাঝখানে যে পড়েছে সেটা আবার নো ম্যানস ল্যান্ডের মত যেখানে কেউ আসে যায় না। আর আসলেও কেউ জিজ্ঞাসা করেনা যে কেন এসেছ। যার ফলে অনেকদিন এদের উপর শাসন-টাসন কিছু ছিল না। তাই প্রসাশন জিনিসটাতে তারা অভ্যস্ত ছিল না।
আরবরা মানত; তবে নিজ বিবেচনায়, মহব্বতে, শুদ্ধতার বুনিয়াদের উপর। অন্যদের মানা প্রসাশনিক মানা আর আরবদের মানা পুরোই ভিন্ন ছিল।
মানত তাদের গোত্রের প্রধানদের, কিন্তু তার উপর আস্থার কারণে মানত, তাকে ভালবাসার কারণে মানত। ‘প্রশাসনিক মানা’ ঐটা মুনাফিকি মানা। ঐটা কোন আস্থার কারণেও নয়, মহব্বতের কারণেও নয়, মানতে হবে ঠেকাই পড়ে। এই জাতীয় মানা। আর আরবের কবিলার মেজাজ ছিল তারা মানত কিন্তু এই মানা সম্পূর্ণ মহব্বতের মানা। ছেলে যেমন মা-বাপকে মানে, মহব্বতের কারণে। যে ছেলে বাপের অবাধ্য থাকে, সেই ছেলে বাপের বাধ্য হয়ে যায় যখন বাপ অসুস্থ হয়। বাপ যখন দুর্বল হয় মরে যাওয়ার সময়, মহব্বতের কারণ মরতে মরতে যে কথা বলল, ঐ কথা আর উল্টায় না। এর মুকাবিলায় প্রশাসনিক মানা হয় যতক্ষন পর্যন্ত দাপট আছে, খুব মানে। আর যেমনি দেখল যে দাপট কমে গেছে, তো জিন্দা থাকতেই বেপরওয়া হয়ে যায় ‘তোমার কথা মানব না’। একেবারেই উল্টো। আরবদের নিফাকের মেজাজও ছিল না, প্রশাসনিক মেজাজও ছিল না। প্রশাসনের মধ্যে নিফাকি মেজাজ হয়, আর না বুঝে মানা, ঠেকাই পড়ে মানা এই ধরনের জিনিস থাকে। দ্বীন এই জাতীয় জিনিসের উপর গড়ে না। তার মানা যেন হয় এইরকম যে সে শুদ্ধ বলে মানবে। ঐ ঠেকাই পড়ে মানছি যেহেতু উনি প্রধান, তাই উনার পদের ঠেলায় মানি এই জাতীয় মানা দ্বীনের মেজাজের মধ্যে নয়। এটা মুনাফিকি মানা।
তো আল্লাহতাআলা এদেরকে এমন অবস্থায় গড়ে তুলেছেন যে যুগ যুগ ধরে তাদের উপর কোন প্রশাসন নেই। কবিলার সর্দারকে মানে, কিন্তু ওটা মা-বাপকে মানার মত। মহব্বতের উপর, পরিচিতির উপর, ঘনিষ্টতার উপর। আর এটার আজিব দৃষ্টান্ত আছে।
বনু কুরাইজার যখন পতন হল, বনু কুরাইজার উপর ফায়সালা হল। সাদ ইবনে মুয়াজ রাঃ তাদের উপর ফায়সালা করেছেন। তারাই বলেছিল সাদ ইবনে মুয়ায রাঃ যেন ফায়সালা করেন। এই হিসেবে উনিই ফায়সালা করলেন আর খুব শক্ত ফায়সালা করলেন যে সব পুরুষ কতল হবে। বালেগ পুরুষ কতল হবে আর মহিলা শিশু এরা দাস-দাসী হবে। বনু কুরাইযার গোত্রের একজনের একটা অনুগ্রহ মুসলমান একজনের উপর ছিল। এক সাহাবীর কোন উপকার কোন এক সময় করেছিলেন। ঐ সাহাবির নাম আমি ভুলে গেছি, নাম মনে নেই। ঐ অনুগ্রহের কারণে ঐ সাহাবি গিয়ে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন ‘ওর একটা অনুগ্রহ আমার উপর আছে, আমার এক উপকার করেছে’। তার বিনিময় আমি দিতে চাই। বিনিময় হিসেবে তাকে মাফ করে দেওয়া হবে, ও যেন কতল না হয়। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলা যেতে পারে যে মাফ করে দেওয়ার জন্য ছুতো চায়। কোন এক প্রসংগ পেয়ে গেলেই ব্যাস ঐটা দিয়েই তাকে ছেড়ে দেওয়া হোক। তো রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খুব সন্তুষ্ট। হ্যা হ্যা হ্যা। এই হিসেবে বললেন যে ও মাফ। উনি খুব খুশি খুশি হয়ে গিয়ে বললেন যে আমি রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছ থেকে তোমার জন্য তোমার জীবন চেয়ে নিয়েছি। সেই লোক, বনু কুরায়যার, ইহুদী সে বলল, ‘আমার পরিবারের সবাই চলে যাবে, আমার সন্তান থাকবে না, আমার বাপ থাকবে না, ভাই যারা আছে তারা মারা যাবে, আমি নিঃস্ব হয়ে যাব তাহলে আমার এই জীবনের কি অর্থ। এই জীবনের আমার দরকার নেই। উনি আবার এলেন রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আর এসে বললেন, ‘ওতো এই কথা বলছে, তার পরিবারের কথা বলছে’। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘সে এবং তার সম্পূর্ণ পরিবার- এদেরকে মাফ করে দেওয়া হল’। উনি আবার খুশি খুশি এলেন যে বিরাট জিনিস ‘সে এবং তার সম্পূর্ণ পরিবার’। উনি তাকে গিয়ে বললেন। সে বলল, ‘আমি আর আমার পরিবার রয়ে যাব, আর আমার সর্দার মারা যাবে আমি এইটা চাইনা’। তো গ্রহন করল না। নিজের জন্য, নিজের পরিবারের জন্য গ্রহন করল না। যেখানে আমার সর্দার মারা যাচ্ছে ওখানে আমি শুদ্ধ মনে করিনা যে আমি বেঁচে যাব। মানলই না। তো কত আনুগত্য ছিল। এই আনুগত্য প্রশাসনিক আনুগত্য না। প্রশাসন হলে বলত ‘কি মজা’, হাততালি বাজাতো। তো যখন অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যায়, প্রশাসনে উপরের দিকে যারা থাকে তাদের দুরাবস্থা দেখে মানুষ খুব মজা পায়, আনন্দ পায়। আর একজন আরেকজনের সাথে বলাবলি করে। ব্যাঙ্গ করতে থাকে।
একজন এসপি রিটায়ার্ড করেছে। তার গ্রামের বাড়ি ছিল। গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কিছুদিন থাকল। কিছুদিন পরে গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরের একটা ছোট্ট বাড়িতে ভাড়া নিয়ে চলে এলো। এটা বাস্তব ঘটনা। তার টাকাপয়সা বেশি নেই, টানাটানির মধ্যে, রিটায়ার্ড করেছে, পেনশন দিয়ে চালায়। তবুও শহরে ছোট বাড়িতে থাকে। কেউ জিজ্ঞাসা করলো, ‘কি ব্যাপার, গ্রামে নিজের বাড়ি আছে, ঢাকা শহরে ছুটে এসেছো কেন? ভাড়া থাকলে তো তোমার অসুবিধা?’ উনি বললেন, ‘গ্রামে থাকা যায়না’। তো কেন থাকা যায় না?
উনি বললেন, ‘আগে যারা স্যার বলত, ওরা এখন ভাই বলে’। আগে দূর থেকে দেখলেই বলত, ‘স্যার কেমন আছেন’। আর এখন বলে ‘ভাই কেমন আছেন’। তো এজন্য চলে এসেছেন। [মজমার হাসি] তো সেও চায় আমাকে স্যার বলুক আর ওরা বলে যে তখন ঠেকা ছিল তাই বলতাম, এখন কেন বলব। তাই এখন ভাই বলে। তো প্রশাসনের মধ্যে মহব্বত থাকে না। বরং চাপ থাকে, বিদ্রুপ থাকে। আর মানে ঠিকই কিন্তু এটা মুনাফিকির মানা। এই মেজাজ নিয়ে মজবুত দ্বীনদার হবে না। দ্বীনদারির বুনিয়াদ হচ্ছে ইখলাস। যেখানে সে আনুগত্য দেখাচ্ছে, ঐ আনুগত্য যেন দ্বীল থেকে হয়, ঠেকাই পড়ে নয়। এজন্য আল্লাহতাআলা আরবদেরকে প্রতিপালন করেছেন যুগ যুগ ধরে আর তারা প্রশাসনিক মেজাজ জানেই না। যাদেরকে মানে তাদেরকে মানে বড় সম্মানের সাথে। তাদের প্রধানদেরকে সম্মান করা, ভালবাসা এটা একেবারে নাড়ির ভিতরে ছিল। কেউ তার কবিলার সর্দারকে খারাপ বলেছে আরবে এটা অত্যন্ত খারাপ বিবেচনা করা হত। তাই উল্টা গাল দিত যে সে তার সর্দারকে খারাপ বলেছে। কারণ সর্দারের প্রতি আনুগত্য মহব্বতের উপরে প্রতিষ্ঠিত।
দ্বীন মহব্বতের উপর প্রতিষ্ঠিত। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সাহাবারা ভালবাসতেন। অত্যন্ত ভালবাসতেন। আর সেই ভালবাসার উপর প্রতিষ্ঠিত আনুগত্য। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মানা মহব্বতের উপর, ঠেকাই পড়ে নয়। তো আল্লাহতাআলা দ্বীন দিয়েছেন, দ্বীনের মধ্যে মেনে চলবে। কিন্তু মানা যেন পদের কারণে, ঠেকার কারণে না হয় যেটা প্রশাসনিক মেজাজ। আর ও যেন খোলা মনে ঐটাকে নিজের শুদ্ধ জ্ঞানে মানে আর এটাই জিম্মাদারি। আমি এটা করছি এটার জন্য আমিই দায়ী। এটা বড় পার্থক্য ছিল যুদ্ধের ময়দানেও। যে জিম্মাদার ও যদি চলেও যায়, আরেকজন জিম্মাদার হয়ে যাবে। পরিবারের মধ্যে বাপ মারা গেল, তো পরিবার থামবে না। ছেলে জিম্মাদার হয়ে যায়। তার ছোট ভাইদের দেখাশুনা করে।  অসুস্থ হয়ে গেল, রান্নাবান্না করতে পারছে না, পরিবারের অন্য কেউ একজন সেই কাজ নিয়ে  এটা বলতে হয় না, নিজেই নিয়ে নেয়। পরিবারে এইভাবেই হয়।
আমার দূর সম্পর্কের এক ভাগ্নী ছিল। ভাগ্নী মানে আমার ভগ্নিপতীর ভাগ্নী। সে মারা গিয়েছে বাচ্চা হওয়ার সময়। মোটামাটি আমার বয়সেরই ছিল। মারা গিয়েছে অনেকে বছর আগে। তার ছোট মেয়ে যাকে প্রসব করার সময় মারা গিয়েছে সে আর তার বড় বোন যে তার চেয়ে তিন চার বছরের বড়। ঐ ছোট বোন যেটা, একেবারেই ছোট শেষ রাত্রে কেঁদে উঠেছে। ঐ বড় বোন যে চার বছরের মত যেমনি কাঁদার আওয়াজ পেয়েছে অমনি উঠে গিয়েছে আর ঐ ছোট বোনকে কোলে নিয়েছে। আমি আবার তখন ওখানে ছিলাম। কি আশ্চর্যের জিনিস। আমার বোনের বাসায় ছিল। তো আল্লাহতাআলা আজিব জিনিস মানুষকে দিয়েছেন। নিজে ভাল করে হাটতে পারে না, অথচ ছোট বোনের যত্ন করছে। এটাই হল জিম্মাদারি।
আল্লাহতাআলা এই উম্মতকে জিম্মাদারি দিয়েছেন যেন সে তার কাজকে নিজে নিয়ে নেয়। আর এজন্য জিম্মাদারি হওয়ার কারণে যুদ্ধের ময়দানে মুসলমানে বাহিনীকে শেষ করা যেত না। গ্রীকদের গল্পের মধ্যে আছে ঐ পুরাকাহিনী ইত্যাদির মধ্যে একটা জন্তু বা যোদ্ধা যেটাই বলা হোক। ওর নাম হচ্ছে হাইড্রা। হাইড্রার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যদি হাইড্রার গলা কেটে দাও, ওর ঘাড় থেকে আরও তিনটা মাথা বের হবে। এজন্য হাইড্রার সাথে যুদ্ধ করা খুব কঠিন। একবার মাথা কেটে ফেললে ঐ সাথে সাথে আরও মাথা গজিয়ে যাবে। তো মুসীবত তো আরও বাড়ল। মুসলমানদেরও ঐ অবস্থা। বিরেমাওনা। সত্তরজনের জামাআত ছিল। আক্রমন করল, সাতষট্টি জন ওখানেই শহীদ হলেন। তিনজন ছিলেন কিছু দূরে। উনারা বেঁচে গেলেন। ফিরে এসে যখন দেখলেন যে সাতষট্টি জনই শহীদ হয়ে গেছেন, এই তিনজন তখন নতুন যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। তাদেরকে কে আদেশ দিয়েছে?
আর দুনিয়ায় আগেও ছিল, এখনো আছে প্রচলিত নিয়ম হচ্ছে যুদ্ধ যে করবে ঐ যুদ্ধ করবে আদেশ পালন করে। আদিষ্ট হয়ে। যে কাজই করুক। আদেশ দেওয়ার লোকজন যদি না থাকে তবে যুদ্ধ শেষ।
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের রাঃ এই যুদ্ধের সময়, রোমীয়দের সাথে যুদ্ধ ছিল। উনি একা গিয়েছেন আর রোমীয়দের বাহিনীর একেবারে ভিতরে ঢুকে গেছেন। একা যাওয়ার কারণে ওরাও ঠিক বুঝতে পারে নি যে কি ব্যাপার। ঐ একই জিনিস। ওরা ঐ রোমানরা তো প্রশাসনের আর্মি। আদেশ পেয়ে অভ্যস্ত, কমান্ড। আদেশ পেল, কাজ করল। ওদেরকে কেউ কোন আদেশ দেয়নি, ওরা দেখছে আর উনি ঢুকছেন। ঢুকতে ঢুকতে একেবারে ভিতরে চলে গেলেন।
ভিতরে একেবারে সম্রাট যেখানে বসে আছে তার বিশেষ বাহনের মধ্যে  আর দাসীরা ময়ুরের পাখা দিয়ে বাতাস করছে। উনি সোজা ওখানে গিয়ে তলোওয়ার বের করলেন, সম্রাটের মাথা ঘাড় থেকে ছুটালেন, বর্শার আগায় মাথাকে বসালেন আর ঐ বর্শা নিয়ে সোজা চলে এলেন।  তো একা একা এলেন তাও দেখল, মাথা কাটলেন আর তারপর বর্শার মাথায় নিয়ে চলে এটাও দেখল, কেউ কিছু করল না। যেহেতু আমাকে কেউ কিছু করতে বলেনি তাই আমি কিছু করিনি। আমি আবার কি করব। যুদ্ধ শেষ। যেহেতু প্রধানকে মেরে ফেলেছে। বাকি কমান্ড দেওয়ার লোক নেই।
কিন্তু সাহাবাদের জামাআত এরকম না। সত্তরজনের মধ্যে সাতষট্টিজন শেষ হয়ে গেলেন, যে তিনজন আছেন উনারা কোন আমীরও নয়, কিছুই নয়। নিজে নিজেই দায়িত্ব নিয়ে নিলেন। দ্বীনের ব্যাপারও এইরকম। খ্রিস্টানদের মধ্যে পাদ্রী যদি মরে যায় তো আরেকজন পাদ্রী হবে নাকি? আগে থেকেই প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। পাদ্রী যদি মরে যায় তো বাকি চার্চের মধ্যে যারা আছে তারা বলবে আজকে আর প্রেয়ার হল না। কেন কি ব্যাপার? পাদ্রী মরে গেছে। কিন্তু মুসলমানদের কোন জামাআতে ইমাম যদি মরে যায় তাহলে নামায থেমে যাবে নাকি? আরেকজন পড়াবে এবং নামাযের ভিতরেও এগিয়ে আসবে। উমর রাঃ যখন আঘাত পেলেন, যখন শহীদ হলেন ফজরের নামায পড়াচ্ছিলেন। উনি পড়ে গেলেন। আব্দুর রহমান রাঃ এগিয়ে এসে নামায পুরা করলেন। বড় জামাআত ছিল। উনি যে পড়ে গেলেন পিছনে যারা ছিল তারা টেরই পাননি কি হয়েছে, শুধু এইটুকু বুঝতে পেরেছেন যে কন্ঠস্বরের পরিবর্তন। নামায শেষ হয়ে গেছে। সংক্ষিপ্ত কিরাত দিয়ে নামায শেষ করে দিয়েছেন। কিন্তু নামায শেষ হয়ে গেছে। নামায শেষ হওয়ার পরে টের পেয়েছেন যে কত বড় ব্যাপার ঘটে গেছে। কিন্তু নামায ঠিকমত চলেছে।
অন্য ধর্মের মধ্যে, খ্রিস্টানদের মধ্যে, হিন্দুদের মধ্যে এটা সম্ভব না। ঐ ব্রাহ্মন যদি মরে যায় তো যে পূজা করত ওকে যদি বলা হয় নমশূদ্রকে ডাক তো বলবে যে ‘নমশূদ্রকে দিয়ে কি পূজা করা যায়’। ও দাড়াতে পারবে না। ঐ পাদ্রীর বদল কেউ হবে না। কিন্তু দ্বীনের মধ্যে প্রত্যেক ব্যাক্তি জিম্মাদার। কাউকে বলতে হবে না, বরং ও নিজেই চলে আসবে। যুদ্ধের ময়দানেও তাই। সেনাপতি মারা গেল তো ও থামবে না। (অস্পষ্ট) মাসঊদ ইবনে উমায়ের রাঃ, উনার হাতে ফ্লাগ ছিল। উনাকে কতল করে দিল যুদ্ধের ময়দানে, উনি পড়ে গেলেন। ফ্লাগ পড়তে পড়তে কাছের যে ছিল সে ফ্লাগ উঠিয়ে নিল। পতাকা পড়ল না, পতাকা উপরেই থাকল। কারণ এরা প্রশাসনের মেজাজের নয় যে আগে উপর থেকে অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার আসুক। অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার আবার এখন আসতে পারবে না কারণ জেনারেল নাই, আর তার সাইন ছাড়া অ্যাপয়েনমেন্ট লেটার আসতে পারবে না। উনি অ্যাপয়েনমেন্ট দিবেন, তারপর প্রমোশন হবে, তারপর উনি আসবেন ততক্ষনে সব শেষ। তো ঐটা হচ্ছে প্রশাসনিক মেজাজ। আর দ্বীনের মেজাজ হল প্রত্যেক ব্যাক্তি জিম্মাদার। আমাকে দেখতে হবে আর আমার বুঝ অনুযায়ি পদক্ষেপও নিতে হবে। পরিবারের ভিতর যেমন। পরিবারের ভিতর প্রশাসনিক মেজাজ নয়। যে কথা বললাম যে একজন রান্না করত সে কোন কারণে রান্না করতে পারছে না, সেক্ষেত্রে আরেকজন করবে। বাপ উপার্জন করত, বাপ উপার্জন করতে পারছে না, ছেলে করবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রশাসনিক মেজাজ হল বাকিরা বসে থাকুক।
তো আল্লাহতাআলা আমাদেরকে দ্বীন দিয়েছেন। দ্বীন যেন আমি নিজ ফিকিরে করনেওয়ালা হই। এটাই জিম্মাদারি বুঝায় আর এই ফিকির করনেওয়ালা যদি হতে পারে, নতুন নতুন পরিস্থিতি আসবে কিন্তু ও থামবে না। নিজে যেহেতু জিম্মাদারির সাথে করে, সেহেতু সে চলতে থাকবে। দ্বীনের কাজ করনেওয়ালা নার্স নয়, ডাক্তারের মত, মিস্ত্রির মত নয় বরং ইঞ্জিনিয়ারের মত। মিস্ত্রি আর ইঞ্জিনিয়ারের মধ্যে কি পার্থক্য? মিস্ত্রি একটা কাজ করছে। ওকে বলে দেওয়া হয়েছে তুমি এই কাঠের টুকরোটা কাট আর এটাকে পালিশ কর। ও ঐটাকে কাটছে আর পালিশ করছে। তাকে যদি কেউ জিজ্ঞাস করে ‘এটা দিয়ে তুমি কি করবে’? বলবে ‘আমি কি জানি’। ও করছে কিন্তু কি করছে জানে না। আমাকে এটা কাটতে বলেছে তাই আমি কাটছি। এর বেশি আমি জানি না। এর মোকাবিলায় ইঞ্জিনিয়ার তাকে বলা হয় তুলনামূলকভাবে যার সামনে সম্পূর্ণ কাজ আছে। ঐ কাজকে সামনে রেখে সে করবে। মাঝখানে যদি কেউ অনুপস্থিত থাকে বা একটা জিনিস নাই, সেইজন্য কাজ থেমে যাবে না, সে বিকল্প চিন্তা করবে। বিকল্প দিয়ে হোক আর যেভাবেই হোক তার কাজ চালিয়ে নিবে। আর এর মোকাবিলায় মিস্ত্রি যে ওর কাজ কি সে অত জানেই না। ওকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে এটা দিয়ে কি করা হবে তো বলবে যে আমি জানি না, আমাকে করতে বলা হয়েছে তাই করছি।
দ্বীনের কাজ ওরকম নয় যে আমাকে করতে বলেছে তাই করছি। বরং এটা একটা জিম্মাদারির কাজ। আমার সামনে একটা কাজ আছে আর তার ফিকির করা। আল্লাহতাআলা আমাদের তৌফিক নসীব করুন আমরা যেন সবাই দ্বীনের কাজের জিম্মাদার হই। মানতে তো হবে বটেই, কিন্তু ঐ মিস্ত্রী জাতীয় নয়, বরং যতবেশি পারা যায় আমি বুঝেশুনে যেন মানতে পারি। ঐ বুঝেশুনে মানতে পারতেন বলেই উমর রাঃ বিভিন্ন সময় নতুন নতুন অনেকগুলো প্রস্তাব এনেছেন। গতকাল যেমন আলোচনা হচ্ছিল যে কুরান শরীফ সংকলন। বলা হয়নি, কিন্তু উনি বুঝছেন যে করা দরকার। তো করেছেন। এরকম বহুত জিনিস আছে। পুরো উম্মতের ইতিহাস তাই। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জামানায় প্রচলিত মাদ্রাসা ছিল না। কিন্তু পরবর্তীতে প্রয়োজন মনে হয়েছে আর মাদ্রাসা বানানো হয়েছে। হাদীসের বই ছিল না, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলে যাননি, করে যাননি, কিন্তু মুহাদ্দীসিনরা প্রয়োজন মনে করেছেন, হাদীস সংকলন করেছেন। ওরকম মাওলানা ইলিয়াস রহঃ তবলীগের এই কাম আরম্ভ করেছেন, আগে থেকেই কেউ এই পদ্ধতিতে কাজ করতে বলেননি, কিন্তু প্রয়োজন মনে করেছেন, করেছেন। আর এইজন্য আল্লাহতাআলা ইলহামের পথকে খোলা রেখেছেন। আগে থেকে আদিষ্ট হয়ে কোন কিছু করার নাম ইলহাম নয়। ইলহাম হল অন্য কোন মানুষ আগে থেকে কোন আদেশ দেয়নি, সরাসরি আল্লাহর তরফ থেকে আসা। মানুষের আদেশ যেখানে আছে ওখানে ইলহামের প্রয়োজন নাই। গোটা উম্মত ইলহামের উপর বড় বেশি নির্ভরশীল। সব বড় বড় কাজ আল্লাহতাআলা তার নেক বান্দাদের ইলহামের মাধ্যমে করিয়েছেন। ইলহামের মাধ্যমে করার মানেই হল যে আগে থেকে কোন মানুষের কাছ থেকে প্রচলিত পদ্ধতিতে কোন আদেশ নেই। কিন্তু তার মনের মধ্যে আল্লাহতাআলা এই কথা সরাসরি ঢেলেছেন। একজন জিম্মাদার যে সে ইলহামের উপযুক্ত হয়, তাকে ইলহাম দেওয়া হয়। আর যে নিজে থেকে চিন্তাভাবনা করতে অভ্যস্তই নয়, শুধু আদেশ পালন করা জানে, ও ইলহাম বুঝতেও পারবে না আর ইলহাম বুঝার উপযুক্তও নয়। যে ফিকির করে, চিন্তাফিকির করে, আল্লাহতাআলা তাকে ইলহাম দান করেন। আল্লাহতাআলা আমাদেরকে ফিকিরের সাথে কাজ করার তৌফিক নসীব করুন।
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ
(মাজালিসে মুশফিক আহমাদ দাঃবাঃ, স্থানঃ জাহাংগীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) 
pdf ফাইল পেতে ক্লিক করুন
বয়ানের অডিও লিংক




أعوذ بالله من الشيطان الرجيمبسم الله الرحمن الرحيموَخَلَقَ كُلَّ شَيْءٍ فَقَدَّرَهُ تَقْدِيرًا
(সুরা ফুরকানঃ আয়াত ২)
আল্লাহতাআলা প্রত্যেক জিনিসকে মেপেছেন। শুধু মেপেছেন তা নয়, ভাল করে মেপেছেন, মাপার মত করে মেপেছেন। দুনিয়াতেও দেখা যায় যে মাপ জিনিসটা বড় গুরুত্বপূর্ণ। ঘি খুব ভাল জিনিস, কিন্তু অতিরিক্ত ঘি হয়ে গেলে খাবার নষ্ট হয়ে যাবে। ভাল জিনিস হলেই যে খুব বাড়ানো যায়, তা কিন্তু নয়। দ্বীনের মধ্যে এই মাপ নষ্ট হয়ে যাবার কারণে আগের ধর্মগুলো নষ্ট হয়েছে।
আল্লাহতাআলা ভাল আমাল দিয়েছেন, কিন্তু আমালগুলোর মধ্যে সীমা নির্ধারন করে দিয়েছেন। নামায সবচেয়ে বড় আমাল, কিন্তু প্রত্যেকদিনই কিছু সময় আছে যে সময় নামায নিষিদ্ধ। এটা এইকারণে যে, মাপের যে মৌলিক নিয়ম আছে, ঐটা সম্বন্ধে বান্দা যেন জ্ঞান রাখে। নামায ভাল, তাই বলে যে যখন তখন পড়বে তা কিন্তু নয়। রোযা রমযানে ফরয, অন্য সময় নফল, কিন্তু কয়েকদিন আবার হারাম। এটা সব আমালে প্রযোজ্য যে, তার একটা মাপ আছে। মাপ নষ্ট হয়ে গেলে দ্বীন নষ্ট।
রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইতাআ্ত দ্বীনের একটা মৌলিক জিনিস। আর সেই ইতাআতের সাথে মহব্বত আছে আর মহব্বতের স্বাভাবিক একটা বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে আদাব। বাস্তবতা হচ্ছে, মানুষ যাকে ভালবাসে তাকে সম্মান করে। কিন্তু ওখানে সীমা নির্ধারন করে দেওয়া হয়েছে। এক হচ্ছে যে সিজদা করতে পারবে না। অন্যান্য ধর্মে এই সীমা লঙ্ঘন করা হয়েছে। ঈসা আঃ কে খ্রিস্টানরা গডই বানিয়ে দিয়েছে। তো রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সিজদা করা যাবে না। বরং এর চেয়ে আরও কঠোর। মজলিসে কেউ এলে আমাদের অভ্যাস আছে দাঁড়িয়ে যাই এটাও শরআন জায়েজ নয়। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ক্ষেত্রেও জায়েজ নয়। এক মজলিসে গিয়েছিলেন আর তারা দাড়িয়েছিলেন, তো রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষেধ করে দিয়েছেন। তো এই সম্মান করবার ব্যাপারেও একটা সীমানা আছে যে এর চেয়ে বেশি না।
তিনজন সাহাবি একবার নিজেদের মধ্যে ঠিক করলেন যে তারা একেকজন একেক আমল করবেন। নামায পড়তে থাকব আর ঘুমাব না, সারারাত নামায পড়বো। রোযা রাখব আর খাব না। আর বিয়েসাদি করব না। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুনে বললেন,
“আমি নামাযও পড়ি আর ঘুমাই। আর রোযাও রাখি আর খাই। আর মেয়েলোককে বিবাহ করি। আর যে আমার সুন্নাত থেকে সরে যায় সে আমাদের মধ্যে নয়”।
তো কড়া নিষেধ করা হয়েছে। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে বহু ঘটনা আছে। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, আর সিদ্ধান্ত হয়ে যাবার পরে কেউ বলেছেন যে এরকম না ঐরকম করুন, তো আল্লাহর রসূল মেনে নিতেন। কথার গুরুত্ব অনেক সহজ হত যদি সিদ্ধান্তের আগে হত। কিন্তু ফায়সালা করে ফেলেছেন আর ফায়সালা করার পরে এসে বলছেন যে এরকম না করে ওরকম করলে ভাল হয়। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেনে নিতেন। বহুবার।
আমাদের কাছে এই অধিকাংশ জিনিসই, যেটা রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি সাহাবিদের আচরণ ছিল, সেটা বেয়াদবই মনে হবে। ব্যাক্তি বা আচরণের ব্যাপারেও ওরকম। (এক সাহাবি) রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে খাবারের দাওয়াত করলেন। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘শুধু আমি, নাকি আয়শাও’? ‘না, শুধু আপনি, একা’। ‘না, তাহলে যাব না’। উনিও আর বললেন না। কথাবার্তা একেবারে সাফ। কোন দুনম্বরি নাই। পরে আবার এসে দাওয়াত দিলেন। আবার রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি একা, নাকি আয়শাও?’ ‘না, আপনি একা’। ‘তাহলে আসব না’। তো গেলেন না। তৃতীয়বার আবার দাওয়াত দিলেন। আবার ঐ একই কথা রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন। উনি বললেন, ‘না, শুধু আপনি একা’।
আমাদের মেজাজ হল কাউকে দাওয়াত দিতে গেলাম আর সে যদি বলে যে আয়শাও থাকবে নাকি। আমরা হলে বলতাম, ‘আরে বলেন কি? উনি তো আসবেনই’। [মজমার হাসি]। বের হয়ে পরে মনে করবে ‘আরে কি ফ্যাসাদেই না পড়লাম’। আমাদের মেজাজের মধ্যে নেফাক ঢুকে আছে। অথচ সাহাবাদের সব কথা পরিস্কার, সাফ।
আর আমরা যেটাকে আদব বলি, ঐটা আদবের চেয়ে বেশি তোষামোদ। তোষামোদ হচ্ছে মুনাফিকি জিনিস। আর আদব, ঐটা ঈমানি জিনিস। পার্থক্য হল আদব ভিতর থেকে মহব্বতের বহিঃপ্রকাশ, কোন নকল নেই আর তোষামোদ হচ্ছে কাউকে পুশ করে অন্য কোন কিছু উসূল করে নেওয়ার নাম। তোষামদে যদি ভাল কিছু বলা হয় তবে সেটাও ভাল নয়। মুনাফিকরা এসে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললেন,
  إِذَا جَاءكَ الْمُنَافِقُونَ قَالُوا نَشْهَدُ إِنَّكَ لَرَسُولُ اللَّهِ وَاللَّهُ يَعْلَمُ إِنَّكَ لَرَسُولُهُ وَاللَّهُ يَشْهَدُ إِنَّ الْمُنَافِقِينَ لَكَاذِبُونَ
মুনাফিকরা আপনার কাছে এসে বলেঃ আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আপনি নিশ্চয়ই আল্লাহর রসূল। আল্লাহ জানেন যে, আপনি অবশ্যই আল্লাহর রসূল এবং আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, মুনাফিকরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী।
এখাণে মিথ্যা হল কেমন করে? তারা তো রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রসূলই বললেন। তাহলে মিথ্যা কেমন করে? মিথ্যা এই অর্থে যে তারা মন থেকে বলেনি, মুনাফিকি। আমরা যেটাকে সাধারণত আদাব বলি, ঐটা আদাব নয়, ঐটা চাপালুসি। উর্দুতে চাপালুসি বলে। দ্বীনের কারণে নয়, বরং তার পদের কারণে, তার অবস্থানের কারণে, তার পজিসনের কারণে,  এক কথায় তেল লাগানো। আর আরবীতে শব্দ হচ্ছে মুদাহিন। সুফিয়ান সওরী রহঃ এর কথা ‘যে সবার কাছে প্রিয়, বেশিরভাগ সম্ভাবনা সে মুদাহিন হবে’। মুদাহিন হল তোষামোদকারী। তো রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বদরের সময় এক জায়গা নির্ধারণ করলেন যে আমরা এখানে থাকব। ওকবা ইবনে মঞ্জুর রাদিয়াল্লাহ আনহু বললেন যে এখানে থাকাতে অসুবিধা হবে, চলুন আমরা ওখানে যাই, পায়ের নীচে মাটি থাকবে, পানি পাওয়া যাবে ইত্যাদি। তো রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহন করলেন। একটা ফায়সালা হয়ে যাবার পরে আবার অন্য কেউ গিয়ে এই যে কথা বলল, উনিও মনে করেননি যে এটা বেয়াদবি আর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উনাকে ধমক দেননি যে ফায়সালা হয়ে গেছে, আবার নতুন কথা কেন? বরং উনিও বললেন আর রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহন করলেন।
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহুকে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পাঠালেন জুতা মোবারক দিয়ে যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে, তাকে জান্নাতের সুসংবাদ দাও। উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু উনাকে ধাক্কা দিলেন আর বাধা দিলেন। এসে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন আপনি পাঠিয়েছেন নাকি। কথা সাফ হল যে উনিই পাঠিয়েছেন, কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু বললেন যে এরকম বলবেন না, এতে মানুষ আমাল করা ছেড়ে দিবে। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা মেনে নিলেন।
সফরে খাবার নাই। কায়েস ইবনে সাদ ইবনে ওবাদা রাদিয়াল্লাহ আনহু, উনি সফরের সাথিদের যে উট ছিল, সেই উট বাকিতে কিনে জবাই করে খাওয়াতেন। সাথে দাম নেই, কিন্তু মদীনায় গিয়ে দিয়ে দিবেন। উনার বাপও নামকরা দাতা ছিলেন, ছেলেও সেরকম। তো বাকিতে কিনে খাওয়াবেন। রওনা হয়েছেন উটকে জবাই করার জন্য, উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু দেখলেন আর বললেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ? ‘উট জবাই করতে’। কেন? ‘লোকের খাবার নাই, তাদেরকে উট জবাই করে খাওয়াব’। ‘না, তা হবে না’। ‘রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ইজাজত নিয়েছি’। ‘না, চল’।
রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অনুমতি নিয়ে এসে জবাই করতে যাচ্ছেন আর উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু ধরেছেন যে আবার চল। গিয়ে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে গিয়ে বললেন, ‘উট দিবেন না, উট খেয়ে ফেললে আমরা যাব কেমন করে’। অথচ উনি অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন সেটা উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু জানেন। তো সাহাবাদের মেজাজের মধ্যে একটা জিনিস ছিল যে দ্বীনি বিষয়ে একটা কথা বলার পরেও নিজের মতামতকে পেশ করতেন।
এক সাহাবী নামাযে লোকমা দিয়েছেন। একথা মনে করেননি যে উনি আল্লাহর রাসূল, সেহেতু উনি ভুল করলেও ঠিক। তা নয়। উবাই ইবনে কাব রাদিয়াল্লাহ আনহু লোকমা দিয়েছেন। আল্লাহর রাসূল চার রাকাআত নামায দুই রাকাআত পড়ে শেষ করে দিয়েছেন। আমরা বয়ানের মধ্যে বলি যে নামাযের মধ্যে কোন ধ্যান নাই, একজন দোকানদার, সে বলল যে তিন রাকাআত হয়েছে। কেন, তিন রাকাআত হয়েছে কেন? বলল, ‘আমার চার দোকানের হিসাব চার রাকাআতে শেষ করি, আর তিন দোকানের হিসাব শেষ হয়েছে, চার দোকান হয়নি। নামাযের মধ্যে রাকাআতের ভুল করা চুড়ান্ত গাফলতি। চুড়ান্ত গাফলতি। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাকাআতের মধ্যে ভুল করলেন। শুধু ভুল নয়, চার রাকাআত দুই রাকাআতে শেষ করে দিলেন। তিন রাকাআত হলে একটা কথা ছিল। নামাযের শেষে আব্দুল্লাহ ইবনে রাদিয়াল্লাহ আনহু বললেন, ‘ইয়া রসূলুল্লাহ, নামাযের নিয়ম বদলে গেল নাকি আপনি ভুল করলেন’। নিয়ম তো বদলায়নি। তাহলে কি ভুল? আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহ আনহু উনার সমর্থন করলেন আর বললেন যে দুই রাকাআতে নামায শেষ করে দিয়েছেন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মেনে নিলেন।
কিরাতে ভুল, নামাযে ভুল আল্লাহর নবীর এই ভুলগুলো হয় কেমন করে?
এই ভুলের ভিতর দিয়েও বড় একটা শিক্ষা আছে। সংশোধন কেমন করে করতে হয়, আর সংশোধনের প্রয়োজন সব জায়গায় আছে। আল্লাহর রাসূলের যদি সংশোধনের দরকার থাকে তাহলে বাদ থাকল কে? আর যদি সংশোধনের মেজাজের মধ্যে উম্মত না থাকে, তাহলে ঐ উম্মত অশুদ্ধ পথে ধ্বংস হবে।
মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহ আনহু, উনার খেলাফতের জমানায় জুমআ পড়ে ঘোষনা করলেন, ‘গণীমতের মালও আমার, জমিও আমার। গনীমত, যেটা আওয়ামের সম্পদ, আর উনি দাবি করছেন যে এইটা আমার। অথচ এটা শুদ্ধ না। কারণ এটা আওয়ামের। কেউ কিছু বলল না। দ্বিতীয় জুমআয় আবার এই এলান করলেন। কেউ কিছু বলল না। তৃতীয় জুমআয় আবার এলান করলেন, একজন আপত্তি করল। বলল এটা আপনার নয়, এটা আওয়ামের। উনাকে ডাকা হল। উপস্থিত যারা ছিল তারা ভেবেছে যে ও জিন্দা আর আসবে না। মুয়াবিয়া রাদিয়াল্লাহ আনহু তাকে ডেকে নিয়ে খুব শোকর আদায় করলেন, খুব কাঁদলেন আর বললেন তুমি আমাকে রক্ষা করলে। কেন? উনি বললেন, ‘রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে (হাদিসের হুবহু কথাগুলো ঠিক আমার ভালমত মনে নেই), একটা ভুল কথা বলে আমীর আর তার কেউ সংশোধন করে না, তাহলে ঐ আমীর ধ্বংস। এক জুমআতে আমি বললাম, কেউ সংশোধন করল না। আমার তো ভয় হল যাদের ব্যাপারে বলা হয়েছে যে ধ্বংস হোক, আমি তাদের মধ্যে পড়লাম কিনা। দ্বিতীয় জুমআতে যখন আবার এলান করলাম, আবার কেউ আমাকে আপত্তি করল না, তখন আমি নিশ্চিতই হয়ে গেলাম। তৃতীয় জুমআতে যখন এলান করলাম, তখন তুমিই আপত্তি করলে। আল্লাহর ফজলে আমি আশা করি যে আমি এখনো জাহান্নামির মধ্যে হইনি। উনি জেনেশুনে এলান করছেন। দেখতে চাচ্ছিলেন ঐ হাদীস অনুযায়ী যে কেউ আপত্তি করে কিনা। আর যদি আপত্তি না করে, তাহলে হাদিস অনুযায়ী সে জাহান্নামি। জাহান্নামি মেজাজ হল এই তোষামোদ করবে, সত্য হোক বা মিথ্যা নিজের জানের ভয়ে হোক বা অন্য কোন ভয়ে সে সেই কথা বলবে না। আর দ্বীনের মেজাজ হল এই যে আল্লাহর রাসূলেইর যদি ভুল ধরে তাহলে আর বাকি থাকল কে।
উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন বানিয়েছেন, তারমধ্যে একাধিকবার উনি সংশোধন করেছেন। বিবাহের যে দেনমোহর থাকে উনার সময় মানুষ বেশি বেশি দেনমোহর দিতে আরম্ভ করল। যেটা রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জমানায় ছিল না। কিন্তু আস্তে আস্তে প্রতিযোগীতা বাড়ল। কিছু বড়লোকই দেখানো। উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু নির্ধারন করে দিলেন যে দেনমোহর এত পরিমানের বেশি হবে না। একটা পরিমাণ নির্ধারণ করে দিলেন। মদীনার এক মহিলা বলল, ‘হে উমর, তোমার কথা মানব নাকি আল্লাহর কথা মানব, আল্লাহতাআলাই বলেছেন যে কিনতার পরিমাণ যদি দিয়ে থাক, তাও ফেরত নিও না। তার মানে কিনতার পরিমাণে দেওয়া যায়। আর তুমি বলছ, দেওয়া যাবে না। উমর রাদিয়াল্লাহ আনহু শোকর আদায় করলেন আর বললেন, ‘তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ’। আর এই কথাও বললেন, ‘দেখা যায় যে মদীনার মহিলারাও উমরের চেয়ে বেশি ইলম রাখে’।
এক হল যে সাধারণ মানুষের মধ্যে এই মেজাজ থাকা দরকার যে ভুল হতে পারে আর তার সংশোধন করা দরকার। অপরদিকে প্রধান যারা আছেন, তাদের এই মেজাজ থাকা দরকার যে ‘আমি ভুলের উর্ধ্বে না, আমিও জবাবদিহিতার মুখাপেক্ষী’। মাওলানা ইলিয়াস রহঃ খুব তাগিদ এনেছেন এই কথাটায় ‘আমি তোমাদের নিগ্রানির মুখাপেক্ষী’। হযরত উমর রাদিয়াল্লাহ আনহুও সাহাবাদের এই কথা খুব বলতেন, ‘আমি তোমাদের নজরদারির মুখাপেক্ষী। নজর রাখবে যে কোথায় কোন ভুল ত্রুটি হচ্ছে, সংশোধন করে দিবে’। উনি নিজে আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহ আনহু এর খুব ভুল ধরতেন। আবুবকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহ আনহু এর ভুল যদি উনিই ধরেন, তাহলে উনার ভুল ধরবে কে? আওয়ামকে বারবার প্রমাণ করেছেন যে তোমরা নজর রাখবে। শয়তান মানুষকে তার বিভিন্ন ফাঁদের মধ্যে ফেলে আর এইটাও একটা ফাঁদ যে নেতৃত্বাস্থানীয় যারা আছে, এদেরকে অধিক শ্রদ্ধার উপরে উঠায়। নাসারারা ঈসা আলাইহিস সালামকে এতই সম্মান, শ্রদ্ধা করতে আরম্ভ করলো যে করতে করতে একেবারে আল্লাহর পুত্রই বানিয়ে দিল। ঐ যে সীমা লংঘন করল। পরবর্তীতে দুনিয়াতে বিশেষ করে আমাদের দেশে বহুত বড় মুসীবত হচ্ছে বিদআত। আর বিদআতের মূল হচ্ছে ভন্ড পীরকে মহব্বত। তার মধ্যে কিছু গুন থাকে। কিন্তু এটাকে এমন সীমার উর্ধ্বে নিয়ে যায় যে এর পরে ওর ব্যাপারে এত বেশি আস্থা, এত বেশি শ্রদ্ধা তৈরি হয় যে, উনার ভুল ধরা যাবে না।
ধরা যাক আমার পীর সাহেব। আমার অমুক পীর সাহেবের কাছে মহিলাও আসে, পুরুষও আসে। তো মহিলাদের প্রথম প্রথম মাথায় হাত দেয়। তারপর আস্তে আস্তে পিঠেও হাত দেয়। মুরিদ দেখেও। কখনো কখনো মুরিদের স্ত্রী, কখনো তার নিজের মেয়েও থাকে। কিন্তু আশেপাশে অন্যরা দোয়া পড়তে থাকে আর পীরও ভাবে দেখি কতদুর যাওয়া যায়। সুযোগসন্ধানে সে নিজেও থাকে। আর শয়তান তাকে বুঝায় যে ‘হুযুর’ এইসব ব্যাপারে কত পাক, তুমি ধারনাও করতে পারবে না। নাউযুবিল্লাহ। নাউযুবিল্লাহ। তার দিল পাক, তোমার দিল নাপাক। সেজন্য তুমি খারাপ ধারনা করছ। নাউযুবিল্লাহ। নাউযুবিল্লাহ। তুমি তওবা কর। এভাবে ধীরে ধীরে হয়।
আমি শুনেছি, নিজে কাউকে ওরকম দেখিনি। রাজশাহী অঞ্চলে নাকি এখনো ওরকম পীর আছে যাদের বিশেষ বিশেষ কিছু মুরিদ তার বউকে, তার মেয়েকে পীরের কাছে রাতে পাঠায়। এটা হল কেমন করে? শয়তান এই সম্মান, শ্রদ্ধাকে এত উপরে উঠিয়েছে যে পীরদের ক্যাপিটালই ওটা।
এই প্রসংগে একটা ঘটনা মনে পড়ল। একবার একজন এক ঘটনা বলছিল যে মুরিদ তার পীরের কাছে গিয়ে বলল যে আমি স্বপ্ন দেখলাম দুইটা পাত্র। এক পাত্রে মধু আর আরেক পাত্রে ময়লা। আমার হাত ময়লা পাত্রে আর আপনার হাত মধুর পাত্রে। পীর বলল যে তোমার দিল নাপাক, তুমি যেহেতু দুনিয়ার মধ্যে, তাই ময়লা পাত্রে হাত। মুরিদ বলল আমি এখনো শেষ করিনি। স্বপ্নে আরো দেখলাম আপনার মধুমাখা হাত আমি চেটে খাচ্ছি আর আমার ময়লা মাখা হাত আপনি চেটে খাচ্ছেন। [মজমার হাসি]। পীর তখন আর কি বলবে। বলল যে শয়তান তোমাকে ঐ স্বপ্ন দেখিয়েছে।
যে মুরিদ, ও তো দেখছে যে পীর জায়গা নিচ্ছে, হারাম খাচ্ছে, ধোকা দিচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, ও নিজেই তো টাকা দিচ্ছে। ওর তো বুঝা উচিত যে পীর যদি হয় আল্লাহওয়ালা, তাহলে তো মালের মহব্বত থাকার কথা না। কিন্তু শয়তান ওকে বুঝিয়েছে যে আমার পীরের ব্যাপার আলাদা। ঐটার উপরেই দুনিয়ার সব বিদআতি। এই একটা কথাতেই সব নষ্ট। জানে যে আল্লাহ ছাড়া কাউকে সিজদা করা যাবে না, কিন্তু পীরকে সিজদা করে। একেবারে সিজদাই করে। ওকে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে সিজদা করা কি ঠিক। ও বলবে না। তাহলে তুমি যে করলে। তখন বলবে ঐটা আলাদা।
সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালবাসা, আদাব সবকিছুর একটা মাপ আছে। মাপের বাইরে চলে যাবে, ঐটা আর দ্বীন থাকবে না। অন্যান্য বেদ্বীনিরা এইটাকেই বাড়াতে চায় তাদের নিজেদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য। এরা চায় তাদের টাকা-পয়সা, সম্পদ ইত্যাদির ব্যাপারে যেন কেউ প্রশ্ন করতে না পারে তা নিশ্চিত করা। মুরিদের নামে মহিলাদের সাথে যা ইচ্ছা তারা যেন করতে পারে আর তাদের এই দোষ যেন কেউ না ধরে। এইজন্য বলা হয় যে দ্বীল থেকে শ্রদ্ধা কর, তোমার চোখের দেখা ভুল। এই কথাগুলো যে বলছি, এগুলো বানানো কথা নয়। বাস্তবে এইসব কথা দিয়েই চালানো হয়। বছরের পর বছর চালানো হয়। আর কোন সীমা নাই। মহিলাদেরকে নিয়ে কতদুর পর্যন্ত যায়, ওটার কোন সীমা নাই। আরো না জানি কত কি আছে। অথচ এরা সব মেনে নেয়। সমর্থন করে। অন্য কায়দায় উদ্বুদ্ধ করে আর বলে যে তোমার বউকে পাঠাও। বউকে পাঠাতে বলে আর এও বলে যে তুমি কি খারাপ ধারনা করছ নাকি। তোমার দিল নাপাক, তাই তুমি খারাপ ধারনা করছ। বলে, সরাসরি এই ভাষায় হয়ত বলে না, কিন্তু ঘুরেফিরে এগুলোই বলে।
আল্লাহতাআলা আমাদের দ্বীন দিয়েছেন, ওটা বড়ই সুন্দর। থানভী রহঃ মসজিদের মধ্যে দশ টাকার নোট দিয়ে দুইটা পাঁচ টাকার নোট নিলেন। আমরা জানি মসজিদের ভিতর বিকিকিনি জায়েজ নয়। আর নোট ভাঙ্গানো বিকিকিনির মাসআলার মধ্যেই পড়ে। কারণ একটা দশ টাকার নোট দিয়ে দুইটা পাঁচ টাকার নোট কিনা হল। (থানভী রহঃ এর) মুরিদ উপস্থিত ছিল। মুরিদ বলে দিল যে বিকিকিনির মধ্যে মাসআলা। আমার দেশের মুরিদ হলে বলত ‘বহুত সওয়াব হবে’, বিকিকিনি ঐটাতো আলাদা জিনিস। [মজমার হাসি]। অথচ এই ব্যাপারে পীর-মুরিদান শুদ্ধ হওয়া উচিত। আমাদের দেশের মেজাজ ভিন্ন। শুদ্ধ-অশুদ্ধ পার্থক্যই করতে পারে না, গোটা দেশের উল্লেখযোগ্য মানুষ বিদআতে লিপ্ত।
এক মুরিদ থানভী রহঃ এর কাছে গিয়েছেন। উনি তখন শুয়ে ছিলেন। তো গিয়ে পা টিপতে আরম্ভ করেছেন। উনি বললেন পা টিপার দরকার নাই। তবুও টিপছে। উনি নিষেধ করেই যাচ্ছেন। আর উনি পা টিপছেন আর বলছেন ‘আমার মন চাই’। আবার পা টিপছেন। পায়ের কাছেই মুরিদ ছিল, থানভী রহঃ পা তুলে জোরসে দিয়েছেন এক লাথি। মুরিদ আশ্চর্য হয়ে গেছে। পা টিপা আপাতত বন্ধ হয়েছে। মুরিদকে কাছে ডাকলেন আর বললেন, ‘আমাকে জিজ্ঞাসা করলেনা যে কেন মারলাম?’। মুরিদ বলল, ‘কেন?’। উনি বললেন, ‘আমার মন চাই’ [মজমার হাসি]। তো তরবিয়ত করেছেন আর যেভাবে করা দরকার সেইভাবে।
মাওলানা ইলিয়াস রহঃ ট্রেনে যাচ্ছিলেন। থার্ড ক্লাসের টিকিট কিনে ভিড়ের কারণে বাধ্য হয়ে উঠেছেন সেকেন্ড ক্লাসে। টিটি এসেছে আর এসে বকাবকি করেছে। উনিও পাল্টা জবাব দিয়েছেন আর বললেন যে টিকিটের অতিরিক্ত ভাড়া তো দেওয়ায় হচ্ছে। খাদিম ছিলেন মাওলানা ইনামুল হাসান রহঃ, ছোট বাচ্চা। উনি হাদিস শুনিয়ে দিলেন।
‘ইন্না লিসাহিবিল হাক্কি মাকালা’ ’ হক্ব যার আছে, তার কথা বলার অধিকার আছে’।
অর্থাৎ টিটির কথা বলার অধিকার আছে, আপনার নাই। অত ব্যাখ্যা করেননি, শুধু এই কথা বলে তাই বুঝিয়েছেন। মাওলানা ইলিয়াস রহঃ বুঝতে পারলেন আর পরের স্টেশনে গিয়ে টিটির কাছে মাফ চেয়ে নিলেন। কোথায় মাওলানা ইলিয়াস রহঃ আর কোথায় মাওলানা ইনামুল হাসান রহঃ। বয়সের কত পার্থক্য। কিন্তু বুঝতে পেরেছেন যে এই জায়গায় মাওলানা ইলিয়াস রহঃ এর কাজ অশুদ্ধ, তো ছোট হওয়া সত্ত্বেও সাথে সাথে সংশোধন করে দিয়েছেন। এমন না যে এটা বেয়াদবি।
আমাদের সমঝ এত নিম্নমানের। রাজশাহীর একজন ডাক্তার, ও আমার পরিচিত, কাকরাইলে এসে বসেছেন। তো উনি, আব্দুল মুকিত সাব, ডাক্তার ইবরাহীম সাব ছিলেন। অনেক আগের কথা। কি প্রসঙ্গে যেন কথা হচ্ছে। তো আব্দুল মুকিত সাব রহঃ বললেন যে, ‘মধুতে ডায়াবেটিক্স রোগীর ক্ষতি হয় না’। ডাক্তার ইবরাহীম প্রচলিত চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী বললেন যে ‘ডায়াবেটিক্স রোগীর মধুতে ক্ষতি হয়’। আব্দুল মুকিত সাব রহঃ বললেন, ‘আপনি ইডিয়টের মত কথা বলছেন’। রাজশাহীর যে ডাক্তার, ডাক্তার হওয়ার কারণে ডাক্তার ইবরাহীম সাহেবের পরিচিতি, সমাজে তার মান-সম্মান ইত্যাদির ব্যাপারে ভাল করে জানেন। কথা ওখানেই শেষ হল।
এর বেশ কিছুদিন পরে টংগীতে ছাত্রদের ইজতেমা ছিল। আগে ছাত্রদের ইজতেমা হত। তো সেই ছাত্র ইজতেমার সময় একজন বিশিষ্ট মেহমান আমার পাশেই ছিলেন। তো আমি সেই রাজশাহীর ডাক্তার, তাকে পুরাতন সাথী হিসেবে কিছু কথা, কথা মানে দ্বীনি কথা বলার জন্য বললাম। তো উনি কথা প্রসংগে বললেন যে ডাক্তার ইবরাহীম সাব আব্দুল মুকিত সাবের রুমে এসেছিলেন আর বললেন যে ডায়াবেটিক্সের রোগীদের ক্ষতি হয় মধু খেলে, তো আব্দুল মুকিত সাব বলেছিলেন যে ‘আপনি ইডিয়টের মত কথা বলছেন’, আল্লাহতাআলা তরতীবের জিম্মাদার হিসেবে, পুরানো জিম্মাদার হিসেবে আব্দুল মুকিত সাবকে কত মর্যাদা দিয়েছেন যে ডাক্তার ইবরাহীম সাবকে ইডিয়ট বলতে পারে। আমি এই কথা শুনে থ হয়ে গেলাম।
একজন মানুষ কত আহাম্মক হতে পারে যে চিন্তাসীমার বাইরে। আব্দুল মুকিত সাবকে আমি দোষ দিই না। এইজন্য দোষ দিইনা যেহেতু ভুল মানুষের হতেই পারে। বেফাস কথা ভুল করে বের হয়ে যেতেই পারে। আদবওয়ালা মানুষও চুড়ান্ত বেয়াদবি করে ফেলতে পারে। একজন সবার কাছে সম্মানি ব্যাক্তি এসেছেন, উনার কাছেই এসেছেন, মেহমান হিসেবে মাথায় তুলে রাখা আখলাকের দাবি। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদেশ ‘তোমার কাছে যখন কোন সম্মানিত ব্যাক্তি আসে, তখন তাকে সম্মান কর’।
এইসব নিয়ম ভংগ করেছেন যখন এই কথা বলেছেন যে ‘আপনি ইডিয়টের মত কথা বলছেন’। আবার বলছি যে আব্দুল মুকিত সাবের দোষ দিই না। ভুল মানুষের হতেই পারে। দোষ হল ঐ আহাম্মকের যে এইটাকে গুন মনে করছে। আমি অবাক হয়ে গেলাম যে মানুষ কত আহাম্মক হতে পারে। যেখানে একজন মেহমান, সম্মানিত ব্যাক্তি এসেছেন তার সামনে অভদ্র, নিম্নমানের ভাষা ব্যাবহার করে তাকে অপমান করছে আর সে বলছে, ‘মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ, আল্লাহতাআলা উনাকে কত মর্তবা দিয়েছেন’।
এটা এজন্য যে গোটা পরিবেশ এমন গলদের প্রতি শয়তান আমাদের ভাল লাগার জন্য এমন সব কথা শিখিয়েছে যে আমার মুরব্বী যা বলেন, আমার শাইখ যা করেন, আমার পীর যা করেন ঐটাই ঠিক। তাতে সে চোরই হোক, ডাকাতী হোক, বদ আখলাকি হোক, যেটাই হোক। আর শয়তান এইভাবেই চালায়।
এজন্য ভাই, মেহেরবানী করে আল্লাহতাআলা আমাদের দ্বীন দিয়েছেন, দ্বীনের মধ্যে বড় জরুরী হল, যেটা দুনিয়াবি কাজের মধ্যেও জরুরী যে সীমানা বুঝি। দুনিয়ার কাজেও সীমানা যদি না খুজে, তাহলে দুনিয়ার কাজও করতে পারবে না। রান্নাতে ডিম ভাজল আর ওটাতে খুব ঝাল। তো নষ্ট হয়ে গেল। প্রত্যেক জিনিসের তার সীমা আছে। দ্বীনের মধ্যে বড় একটা অংশ হচ্ছে যে তার মহব্বতের, আদবের প্রতি বিশেষ লক্ষ্য রাখা। একটা ছোট বাচ্চাকে যদি অধিক আদর করা হয়, নষ্ট হয়ে যাবে। আবার একেবারেই না করা হয়, শুধু শাসনই করতে থাকি, তাও নষ্ট হয়ে যাবে। একটা মাপ আছে। শাসনও করতে হবে, স্নেহও করতে হবে। বড়দের ক্ষেত্রেও তাই। যে বড় তার সাথে ভালবাসা, আদব এগুলোও রক্ষা করতে হবে, তবে তার সীমানার মধ্যে।
পীরকে সংশোধন মুরীদরা করবে। পীরের তো আর পীর নাই। বয়স হয়ে গেছে, ইন্তেকাল করেছেন। একজন মুরীদ পীরের কথা শুনবে। কিন্তু পীর স্বাধীন নাকি? মোটেই না। পীরকে মুরিদদের সাথে পরামর্শ করে চলতে হয়। মাওলানা ইনামুল হাসান রহঃ কে দেখেছি যে নিজের চালচলন কোন ব্যাপারেই একেবারেই স্বাধীন ছিলেন না। পুরো পাবন্দ ছিলেন। কার পাবন্দ ছিলেন? সাথী যারা আছেন তাদের পাবন্দ ছিলেন। তারা যেভাবে বলে। তো সব জিনিসেরই নিয়ম আছে।
ইতাআত বা মুরব্বীদেরকে মানা, তাদেরকে সম্মান, শ্রদ্ধা করা এগুলো যেন শরীয়তসম্মত হয়। নমশুদ্ররা যেরকম ব্রাহ্মনদেরকে মানে, ওরকম নয়। মানলেই যদি জান্নাত পাওয়া যায়, তাহলে নমশুদ্ররা আগে জান্নাত পেত। ওরা যেরকম ব্রাহ্মনদেরকে মানে, দুনিয়ারে ইতিহাসে এরকম মানা পাওয়া যায় না। কিন্তু ঐ মানা দিয়ে জাহান্নামেই যাবে।
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক জামাআত পাঠালেন। সেই জামাআতের আমীর এক কুন্ডলি আগুন করে মামুরদের বললেন যে আগুনে ঝাঁপ দাও। তারা কেউ মানল না। ফিরে এসে কারগুজারী শুনালেন। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘ঐ আগুনে যদি তোমরা ঝাঁপ দিতে, তাহলে ওখান থেকে আর কোন দিন বের হতে না’। অর্থাৎ এই আগুন তাদের জাহান্নামের আগুনই হত। উনাদেরকে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আগে থেকেই সাবধান করে দেননি। এরকম যদি হত যে জামাআত পাঠানোর আগে মামুরদের আগেই বলে দিয়েছেন যে এই আমীর কিন্তু একটু পাগলা। কিন্তু কোন ধরনের সাবধান করেননি। আমীর আমীরই। আমীরের ব্যাপারে, মানার ব্যাপারে, ইতাআতের ব্যাপারে যত কথা আছে সব এই আমীরের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কিন্তু ঐ মামুরদের আমীরকে মানার ব্যাপারে সীমানা কি এইটা দেখানোর জন্য আল্লাহতাআলা রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিয়ে এটা করালেন। আমরা যদি সাধারণ মানুষ হতাম, তাহলে হয়ত বুঝতাম যে আমীর নির্বাচনই ভুল হয়েছে। বলতাম এই আমীরকে আমীর বানানোই ঠিক হয়নি। কিন্তু এই নির্বাচন রসূলই করেছেন। আল্লাহতাআলা এই ঘটনার মাধ্যমে এই উম্মতকে জানাতে চান যে যেরকম মানা শিখতে হবে, তেমনি না মানাও শিখতে হবে।
মাওলানা সাঈদ আহমদ খান সাব এই মিছাল দিতেন আর তারপর এই কথা বলতেন যে মাশাআল্লাহ তোমাদের দেশের লোক বহুত মানলেওয়ালা। বহুত মানলেওয়ালা বলার সময় লম্বা টান দিয়ে খোঁচা দিয়ে বলতেন। আর মিছাল দিয়েছিলেন শীতের কালে এক আমীর মামুরকে বলেছিলেন যে পুকুরের মধ্যে ডুবে থাক, তো ঠিকই সারারাত্রি ডুবে ছিলেন। এই কথা বলে বলতেন, বহুত মানলেওয়ালা। অথচ উচিত ছিল অমান্য করা। অমান্য করারও হুকুম আছে। তো ঐটা দেখানোর জন্য আল্লাহতাআলা রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দিয়ে এই ঘটনা ঘটালেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে তৌফিক নসীব করুন। দ্বীন যেন দ্বীন হিসেবে সীমানা বুঝে মানতে পারি। নামায যত বড়ই আমলই হোক না কেন, কিছু কিছু সময় আছে যখন নামায পড়া যাবে না। কিছু কিছু দিন আছে রোযা রাখা যাবে না। তো আমলের ব্যাপারেও ওরকম, মানার ব্যাপারেও ওরকম। এজন্য মেহনত করে নিজেকে হুশিয়ার বানায়।
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ
মাজালিসে মুশফিক আহমাদ দাঃ বাঃ স্থানঃ বাসাবো স্কুল মসজিদ ৩-৩-১৫, বাদ ইশা মোজাকারা
pdf ফাইল পেতে ক্লিক করুন
অডিও লিংক



الحَمدَ لِلَّهِ ، نَسْتَعِينُهُ وَنَسْتَغفِرُهُ ، وَنَعُوذُ بِهِ مِن شُرُورِ أَنفُسِنَا ، مَن يَهدِهِ اللَّهُ فَلا مُضِلَّ لَهُ ، وَمَن يُضلِل فَلا هَادِيَ لَه ، وَأَشهَدُ أَن لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَأَشهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبدُهُ وَرَسُولُه ف أعوذ بالله من الشيطان الرجيم
بسم الله الرحمن الرحيم
آمِنُواْ كَمَا آمَنَ النَّاسُ
و قال تاعالي
وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُوْلَئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ
و قال رسول اللہ صلی اللہ علیہ وسلم ذَاقَ طَعْمَ الإِيمَانِ مَنْ رَضِيَ بِاللَّهِ رَبًّا وَبِالإِسْلاَمِ دِينًا وَبِمُحَمَّدٍ رَسُولاً
اوكم قال  عليه الصلاة و السلام  
দুনিয়াতে মানুষ মেহেনত করে। মেহেনতের মধ্যে দুটো মেহেনত বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এক নম্বরে আসল মেহেনত, যেটা আম্বিয়া (আ) নিয়ে এসেছেন। আল্লাহ তাআ’লা রসূল (স) কে পাঠিয়েছেন, এর আগের নবীদেরকে (আ) পাঠিয়েছেন একটা মেহেনত দিয়ে, যে মেহেনতের লক্ষ্য মানুষকে মানুষ বানানো। আরেক মেহেনত- দুনিয়ার মানুষ যেটা করে থাকে, ইতিহাসে বইয়ে ইত্যাদির মধ্যে যেগুলোর আলোচনা থাকে; সভ্যতার ইতিহাস, সভ্যতার মেহেনত, সভ্যতা গড়ে তোলা। বিভিন্ন অঞ্চলে, বিভিন্ন যামানায় বড় বড় সভ্যতার উত্থান হয়েছে, পতন হয়েছে। সভ্যতার নামে একটা মেহেনত, যেটা দুনিয়ার রাজা বাদশাহরা করে থাকেন, বৈজ্ঞানিক দার্শনিকরা করে থাকেন; তাদের মেহেনত দুনিয়া বানানো।
তো মানুষ বানানোই বা কি আর দুনিয়া বানানোই বা কি? দুনিয়া বানানো তো সহজে বোঝা যায়। উন্নত জিনিস, বড় শহর, রাস্তা-ঘাট, ঘর-বাড়ি থাকা, বিলাসিতা এসব জিনিস। মানুষ বানানো? জন্মই তো হয়েছে মানুষ হিসেবে। সে আবার মানুষ হবে কি?- আর এটাই মেহেনত। এই কথা, আরম্ভ থেকেই বুঝা একটু মুশকিল; করা তো আরও মুশকিল হবে। কেউ যদি বলে যে, ওকে মানুষ বানাও। স্বাভাবিক ভাবে বলবে যে, কি বানাতে হবে আমি বুঝতে পাচ্ছি না। একেক ধরণের মানুষ ‘মানুষের’ একেক ধরণের অর্থ বা সংজ্ঞা দেয়। একজনের পাঁচ ছেলে। চার ছেলে তো লেখাপড়া করেছে, বড় ডিগ্রীধারী হয়েছে। আরেক ছেলে হয়েছে বখাটে। তো অনেক সময় লোকে বলে যে, ওনার পাঁচ ছেলে; চারজন তো মানুষ হয়েছে, একজনকে মানুষ বানাতে পারে নি। তো ও কি হয়েছে? মুরগী হয়েছে না হাঁস হয়েছে? [মজমার হাসি]। বোঝা যায় মোটামুটি যে সে কি বলতে চায়। কিন্তু যদি বিশ্লেষণ করতে চায় তো খুব সহজ নয়। আল্লাহ তাআ’লা আম্বিয়া (আ) কে পাঠিয়েছেন মানুষকে মানুষ বানাতে।
آمِنُواْ كَمَا آمَنَ النَّاسُ
“ঈমান আনো, যেরকম মানুষ ঈমান এনেছে”
এই জায়গায় ওলামারা বলেন যে এখানে ‘মানুষ’ শব্দের অর্থ সাহাবীরা (রা)। সাহাবীরা (রা) যেভাবে ঈমান এনেছেন। ‘সাহাবা’ তো আল্লাহ তাআ’লাই বলতে পারতেন। তা না বলে বললেন- মানুষের মত। আল্লাহ তাআ’লা মানুষের জন্যে কুরআন শরীফকে কি খামোখাই কঠিন বানাতে চান নাকি? যাতে পবলিক সহজে বুঝতে না পারে।
একটা কথা প্রচলিত আছে যে, মানুষের মত মানুষ হও। ঐ জাতীয় একটা অর্থ বহন করে; মানুষের মত মানুষ। এখন মানুষ জিনিসটা কি? বা তার কাছে কি চাওয়া হচ্ছে? প্রধানত তিনটা মাত্রা নিয়ে একজন মানুষ। এক, তার দেহ। হাত-পা কাজকর্ম করে, চোখ দিয়ে দেখে, কান দিয়ে শোনে, পা দিয়ে চলে, হাত দিয়ে ধরে ইত্যাদি। দুই, তার মস্তিষ্ক; যেটা দিয়ে সে চিন্তা করে। আর তিন, তার ক্বলব; যেটা দিয়ে অনুভব করে।
তার দেহের মাত্রায় মানুষ বড় দূর্বল।
خُلِقَ الإِنسَانُ ضَعِيفًا
মানুষকে আল্লাহ তাআ’লা দূর্বল করে সৃষ্টি করেছেন।
মানুষের নাকের শক্তি পিঁপড়ার ধারে কাছেও নেই। বাটিতে একটাতে চিনি আরেকটাতে লবণ এনে দিয়ে যদি বলে গন্ধ নিয়ে বল কোনটিতে চিনি আর কোনটিতে লবণ? বলবে- লবণ, চিনি কোনটারই গন্ধ নেই, বুঝব কেমন করে? বুঝার কোন উপায় নেই। বুঝতেই পারবে না। অথচ মাত্র একদানা চিনি পড়েছে আর পিঁপড়া, আল্লাহই জানেন তার বাড়ি কোথায়; সে ওখান থেকে খবর পেয়ে সেই একদানা চিনি এসে নিয়ে যাবে। শকুন কত দূর থেকে দেখে। গরু শুয়ে আছে; জীবিত না মৃত, সে ওখান থেকে দেখে বুঝতে পারে। মানুষ কাছে থেকে দেখেও অনেক সময় বুঝেনা। এরকম দৃষ্টান্তের কোন অভাব নেই। তো দৈহিক শক্তির ব্যাপারে মানুষ দূর্বল।
বাকি হল চিন্তা। নিঃসন্দেহে গরু, ভেড়া, ছাগলের চেয়ে মানুষ বেশি চিন্তা করতে পারে। কিন্তু এটাও মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য নয়। আজকাল নানান ধরণের কম্পিউটার খেলা আছে। তার মধ্যে দাবা খেলাও আছে। আর ওগুলোর বিভিন্ন লেভেল আছে। উপরের লেভেলে যদি কেউ খেলতে চায়, তো বড় বড় দাবারুরাও পারবে না। আর দাবা খেলা মানেই হচ্ছে তার ভাবতে হয়, চিন্তা করতে হয়। এই জাতীয় যদি চাল হয়, তাহলে পরবর্তীটা কোনটা হবে? সেই হিসেবে চিন্তা ফিকির করে তাকে একটা চাল চালতে হয়। প্রথমত সে হয়তো ১ ঘন্টা চিন্তা-টিন্তা করে তারপর একটা চাল দিল। আর কম্পিউটার তার উত্তরে সেকেন্ডের মধ্যে চাল দিয়ে দিবে। আর ও কম্পিউটারের সাথে পারেও না। আর এই চাল দেওয়ার আগে কম্পিউটার বিভিন্ন সম্ভাবনা ভেবেছে। দাবা খেলার মধ্যে অনেক alternatives অর্থাৎ বিকল্প; এটা হলে কি হবে, ওটা হলে কি হবে, বিভিন্ন পর্যায় চিন্তা করতে হয়। মানুষ এগুলো চিন্তা করতে করতে প্রায় ঘণ্টা খানেক লেগে যায়। এক ঘণ্টা সে চিন্তা করল যে এই চাল দিলে কি হতে পারে, এটার কি হতে পারে, ওটার কি হতে পারে। আর ওর উত্তরে কম্পিটার চিন্তা করলো ১ সেকেন্ড; আর ওর চেয়ে অনেক বেশি চিন্তা করলো। মানুষ কম্পিউটারের সাথে চিন্তা করে কুলাতে পারবে না। তাহলে কি কম্পিউটার মানুষের চেয়ে ভালো? পার্থক্যটা কোথায়?
আল্লাহ তাআ’লা মানুষকে এমন একটা জিনিস দিয়েছেন, যেটা গরু, ছাগলের মধ্যেও নেই, কম্পিউটারের মধ্যেও নেই; গড়তেও পারবে না- ঐটা হচ্ছে অনুভূতি। যেটাকে আরবিতে হয়তো বলা যেতে পারে শু’ঊর। বাংলায় অনেক গুলো শব্দ ব্যবহার করে; চেতনা, চৈতন্য। ভাল লাগা, খারাপ লাগা, ভাল লাগছে, খারাপ লাগছে, আনন্দ, রাগ ইত্যাদি যে জায়গা থেকে জন্ম হয়, ঐ জায়গা হচ্ছে মানুষের গভীরতম জিনিস।
আর হাত-পা খুব শক্তিশালী, শক্তিশালী দেহ; কিন্তু পাগল বা বোকা- মানুষ হিসেবে সে বড়ই দূর্বল, নিম্নমানের। দৈহিক শক্তিতে খুব প্রসিদ্ধ, চোখে খুব ভালো দেখে, কানে খুব ভালো শোনে কিন্তু বুদ্ধি কাজ করেনা। ভালো মন্দ বুঝেনা, অনুভূতিহীন। তো সে মানুষ হিসেবে ব্যর্থ মানুষ।
(একইভাবে) খুব চিন্তা করতে পারে, অত্যন্ত মেধাবী, কিন্তু তার কোন অনুভূতি বা ইংরেজীতে Feeling এগুলো নেই। তো বড় বৈজ্ঞানিক, বড় দার্শনিক; তার বুদ্ধির কোন সীমা নেই, কিন্তু বউ ওকে ছেড়ে চলে গেছে।
– কেন?
-বলে যে ওর কোন Feeling-ই নেই।
সে (স্ত্রী) একটা মানুষ চায়।
ছেলে তার বাপকে পাত্তাই দেয় না।
-এত বড় বৈজ্ঞানিক; পাত্তা দাও না কেন?
– ধেত! মানুষই নয়।
-কি মানুষ নয়?
স্ত্রীর ভাষা হয়তো অনেক উগ্র হবে। ছেলের ভাষা, যদি আদব জানে হয়তো অত উগ্র হবে না। যদি দৃষ্টান্ত চায়, তুমি যে এভাবে বলছ।
-তোমার বাপের ব্যাপারে তোমার অভিযোগটা কি? তোমাকে মারে, ধরে, গাল দেয়, না কি করে?
-বলে যে কিচ্ছু না।
-তাহলে কি?
-বলে যে আমার এক্সিডেন্ট হয়েছে, মুমূর্ষু অবস্থা। আব্বাকে খবর দেওয়া হল। আব্বা তার থিওরি, তার বিজ্ঞানের অংক করছিল। ওখান থেকে উঠলও না, খোঁজও নিল না। পরে আবার তাকে বলা হল যে, তোমার ছেলে যে হাসপাতালে? উনি বললেন, “ও হ্যাঁ। তাইতো তাইতো”। আবার অংক করতে লেগে গেল। ওতো একটা অংক, ওতো বাপ নয়। আমি বাপ চাই।
আর স্ত্রী হলে বলবে,
-আমি একজন স্বামী চাই। একটা স্বামী, একজন মানুষ। ও মানুষ নয়।
-ও কি খারাপ?
-না, তাও নয়।
-ও কি ভালো?
-না, তাও নয়। খারাপ, ভালো এই শব্দগুলো মানুষের জন্য প্রযোজ্য। মানুষই যদি না হয়, তাহলে খারাপই কি আবার ভালোই বা কি?
গরু হাঁটতে হাঁটতে আমার সামনে দিয়ে চলে গেল। আমি যে একজন মুরুব্বি, একটু থামবে, একটু সালাম দিবে, [মজমার হাসি] কিছুই করলো না। বড় বদ আখলাক। [আবার হাসি]। তো গরুকে যদি বদ আখলাক বলে; যে বলছে বদ আখলাক- ওর হুঁশ, বুদ্ধি ঠিক আছে কি না, একটু দেখা দরকার। [হাসি চলছে]। মানুষ যদি হয় তবেই না আখলাকের প্রশ্ন। ওতো গরু।
মানুষ কি? হাত দিয়ে ধরতে পারা; এটা মানুষের প্রধান জিনিস নয়। এরচেয়ে মেশিনের শক্তি অনেক বেশি। একটা কুকুরের কামড় অনেক শক্তিশালী। চিন্তা করতে পারা; বর্তমানে কম্পিউটার গুলো অনেক বেশি চিন্তা করতে পারে। যদিও চিন্তা করার শক্তি আগে থেকেই তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে হয়, শিখাতে হয়। সেটাও কোন আশ্চর্য কথা নয়। মানুষকেও তো চিন্তা শিখাতে হয়। ও ১০-২০ বছর কি পড়েছে? ঐ সফটওয়্যার তাকে লোড করা হয়েছে। কম্পিউটারের মধ্যে যে সফটওয়্যার লোড দেওয়া হয়, আধা ঘণ্টার মধ্যে সে নিয়ে নেয়। আর মানুষকে ২০ বছর ধরে শিখাতে হয়। তো সেই হিসেবে মানুষের চেয়ে কম্পিউটার ভালো। কিন্তু অনুভব করতে পারা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা এইটা হচ্ছে মানুষের প্রধান বৈশিষ্ট্য বা একমাত্র বৈশিষ্ট্য, যে বৈশিষ্ট্য দিয়ে আল্লাহ তাআ’লা মানুষকে গোটা সৃষ্টি জগতের মধ্যে আলাদা করেছেন। শু’ঊর- চেতনা, অনুভব করতে পারা, ভালো লাগা।
একবার ব্যাভিচার সম্বন্ধে একটা কথা উঠেছে, মাসআলা – কেউ যদি দেখে তার স্ত্রী অন্য কোন পুরুষের সাথে; তার জন্য কি সাক্ষী আনতে হবে? সাক্ষী ছাড়া তো বিচার হবে না। সম্ভবত আব্দুল্লাহ ইবনে জারীর (রা) ছিলেন  [আমার তাহক্বিকে এখানে সাহাবীর রাঃ নাম ভুল পেয়েছি, সঠিক হবে সা’দ ইবনে উবাদা রাঃ]। উনি বললেন যে, এই অবস্থায় দেখে তারপর আমি সাক্ষী খোঁজ করতে যাব! আমি প্রথমে তলোয়ার দিয়ে দুই টুকরা করব। তারপর বাকী কথা।
রসূল (স) ওনার ওনার এই উত্তরকে পছন্দ করলেন। ‘নিশ্চয় তার আত্নসম্মানবোধ আছে’। আর এটা আল্লাহর একটা সিফত।
إنَّ الله تَعَالَى يَغَارُ নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআ’লা গায়রত ওয়ালা; আত্নসম্মানবোধের অধিকারী।
আল্লাহ তাআ’লা গায়রত ওয়ালাকে পছন্দ করেন। যার আত্নসম্মানবোধ আছে, তাকে আল্লাহ তাআ’লা পছন্দ করেন। যার কোন আত্নসম্মানবোধই নেই, গরুর মত; তো এটা কোন ভালো মানুষের লক্ষণ নয়।
আধুনিক দুনিয়াতে একটা প্রচলিত কথা আছে, পশ্চিমা জগত সম্বন্ধে অনেক সময় বলা হয়- ওরা মেশিন, মেশিনের মত চলে। কেউ যদি বিশ্লেষণ চায়, কি বলছ? অর্থটা কি? বিস্তারিত বুঝানো মুশকিল। কথার হয়তোবা কিছু অর্থ আছে। একটা দৃষ্টান্ত; যদিও কথাটা অসুন্দর, সুন্দর নয়; আগে থেকেই আপনাদের কাছে মাফ চাইছি বদ আখলাকির জন্যে। কিন্তু বুঝতে সহজ হবে, যদিও কথাটা খারাপ।
আমরা যখন ছাত্র। ঐ বয়সের কথা, এখন তো আরো এগিয়ে গেছে। এগিয়ে গেছে, নাকি পিছিয়ে গেছে বুঝা মুশকিল [মজমার হাসি]। আজ থেকে ৩০-৪০ বছর আগে বা তার চেয়েও বেশি আগে। তখন করাচি ছিল পাকিস্তানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আধুনিক। আর ওখানে ইংরেজী শিক্ষা টিক্ষার প্রচলন ছিল অনেক বেশি। করাচির একটা স্কুলে এক ছেলে; ঐ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল; তখন খুব বেশি ছিলনা, ২-১ টা ছিল। তো করাচির স্কুলে এক ছেলে আরেক ছেলেকে গাল দিয়েছে। গালটা হল ঐ যে খারাপ গাল- বাস্টার্ড (হারাম জাদা)। উত্তরে সে রাগ করলো না, বিরক্ত হলো না, কিছুই করলো না; খুবই ঠাণ্ডা ভাবে বলল- That’s not my fault.[মজমার হাসি]। ওটা আমার দোষ নয়। মা-বাপ কি করেছে ওটা ওদের ব্যাপার। [হাসি চলছে]।
ওর এই না রেগে যাওয়া, এটা কোন ভদ্রতা নয়। ও মানুষই নয়। মানুষ হিসেবে তার একটা প্রতিক্রিয়া থাকা উচিত। ঐটা নেই। তো আব্দুল্লাহ ইবনে জারীর (রা) ; উনিই কি না একটু সন্দেহ আছে; যাই হোক, ধারণা যে উনিই ছিলেন [স্যারের আশংকা সঠিক, আমার তাহক্বিকে এখানে সাহাবীর রাঃ নাম ভুল পেয়েছি, সঠিক হবে সা’দ ইবনে উবাদা রাঃ]। উনি যখন এই কথা বললেন যে, আমি তাকে প্রথমে কতল করব, যদি আমি অন্য পুরুষকে আমার স্ত্রীর সাথে দেখি। রসূল (স) ওনার এই কথাকে পছন্দ করলেন। এটাই মানুষের মত আচরণ। ভালো হোক মন্দ হোক পরে দেখা যাবে। কিন্তু তার একটা অনুভূতি আছে। অনুভূতিহীন নয়। প্রথমত একজন মানুষের তো চেতনা থাকা উচিত। চেতনাবিহীন, সে কোন মানুষ নয়।
একজন রোগী; প্যারালাইসিস। তার পায়ে বোধই নেই। পিন দিয়ে খোঁচা দেয়, কিছু অনুভব করে না। চিকিৎসা চলছে ভালো করবার জন্য। একদিন সে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল যে সে পায়ে ব্যাথা অনুভব করছে। প্রচণ্ড ব্যাথা। চিৎকার করে কাঁদছে। পায়ে ব্যাথা অনুভব করছে- এই কথাতে তার ডাক্তার, তার পরিবারের সব লোক, এমনকি সে নিজেও অত্যন্ত আনন্দিত। হোক ব্যাথা, কিন্তু অনুভূতি তো পাচ্ছি। তো যে প্যারালাইসড, কিছু অনুভবই করে না, তার তুলনায় যত প্রচণ্ড ব্যাথাই হোক না কেন, ব্যাথা থাকাটাই ভালো। প্রথম কথা তো হল- হ্যাঁ আমার অনুভূতি আছে। একজন মানুষের তার অনুভূতি থাকতে হবে।
আধুনিক দুনিয়াতে এত মেহেনত, যে মেহেনত মানুষকে দুনিয়ার দিকে এত বেশি ধাবিত করেছে যে, ভিতরে আস্তে আস্তে, ধীরে ধীরে সে ভিতর থেকে একেবারে ফাঁকা হয়ে গেছে। তার অনুভূতি নষ্ট হয়ে গেছে। মা-বাপ কোথায় গেল কোন পাত্তা নাই, ছেলে মেয়ে কোথায় গেল কোন পাত্তা নাই। ছেলে হোক মেয়ে হোক কোন ধরা বাঁধা নাই। বড় মেয়ে, সন্ধ্যা বেলা বের হয়েছে; ছেলেদের সাথে। ভোর বেলাও ফেরে নি। ওর বাপ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আমার মেয়েটা যে কার সাথে গেল, কোথায় গেল, কি করছে, সারা রাত কোথায় গেল, এ ব্যাপারে তার একটা চিন্তা থাকবে বা দুশ্চিন্তা থাকবে; কিচ্ছু না। তো ঐ যে কোন চিন্তাই না থাকা; কারণ মানুষের ভিতরের যে একটা মানুষ থাকে, ওটা নষ্ট হয়ে গেছে।
এর মোকাবিলায় আল্লাহ তাআ’লা আম্বিয়া (আ) কে পাঠিয়েছেন, প্রথম তো একজন মানুষকে মানুষ বানানো যে সে যেন অনুভব করে। তারপর তার সেই অনুভূতিকে শুদ্ধ করা। সাহাবারা (রা) বড় সতেজ, বড় তীক্ষ্ণ অনুভূতির অধিকারী ছিলেন। অনুভব করতে পারা- এটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় কামাল। এমনকি আল্লাহর কথা, আল্লাহর রসূল (স) এর কথা অনুভূতির সাথে মিলিয়ে দেখতেন।
রসূল করীম (স) একবার বললেন,
انْصُرْ أَخَاكَ ظَالِمًا أَوْ مَظْلُومًا ، قَالُوا : يَا رَسُولَ اللَّهِ ، هَذَا نَنْصُرُهُ مَظْلُومًا
“তোমার ভাইকে সাহায্য কর; যালিম হোক বা মজলুম হোক”
সাহাবারা (রা) রসূল (স) কে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার ভাই যদি মজলুম হয়, আমি তাকে সাহায্য করব; আমার ভাই যদি যালিম হয়, তাহলে কেমন করে আমি তাকে সাহায্য করব?” এক যে অনুভূতি, মন তার শুদ্ধ চায়, ন্যায় চায়- আমি অন্যায়ের পথে কেমন করে যাব?
এই জায়গায় একটা কুকুর যদি হয়, তো কুকুর এই প্রশ্ন করবে না। তার মালিক তাকে লেলিয়ে দিল, সেও গিয়ে কামড় মেরে দিল। একটুও ভেবে দেখবে না যে একে আমি কামড় যে মারছি, সে অন্যায় করেছে না ন্যায় করেছে। কোন কিচ্ছু নয়। গিয়ে মেরে দিল। কুকুরের জন্য এটা কোন দোষের কথা নয়। আল্লাহ তাকে জিজ্ঞেস করবে না যে তুমি কেন কামড় মেরে দিলে। যদিও বা জিজ্ঞেস করে, তো বলবে যে আল্লাহ তুমি তো আমাকে মানুষ বানাও নি যে আমি আমার বিবেচনা দিয়ে দেখব; কুকুর বানিয়েছ। কুকুরের কোন বিবেচনার দায়িত্ব নেই। পার পেয়ে গেল।
কিন্তু মানুষ যদি হয়, তাকে উত্তর দিতে হবে। ভাড়া করে তাকে পাঠাল, ওকে গিয়ে মার; গিয়ে সে ঠিকই মারলো। আমার মালিক বলেছে বা আমার পীর বলেছে বা আমার শায়খ বলেছে বা আমার মুরুব্বী বলেছে; আল্লাহর কাছে কোন উত্তর টিকবে না। তুমি কুকুর না যে পীর বলেছে বা মুরুব্বী বলেছে তারপর তোমার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে। প্রত্যেক জিনিসের জন্য তুমি নিজেই দায়ী থাকবে।
وَلاَ تَزِرُ وَازِرَةٌ وِزْرَ أُ
“কোন বোঝা বহনকারী অন্যের বোঝা বহন করবে না”
কোন পীর তার মুরিদের বোঝা বহন করবে না। কোন মুরুব্বী তার অধিনস্ত লোকের বোঝা বহন করবে না। তাকেই তার উত্তর দিতে হবে। কারণ সে মানুষ। তো সাহাবারা (রা) রসূল (স) কে বলছেন। এর চেয়ে বেশি মানার জায়গা আর কোথায় হতে পারে।
مَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانتَهُوا
“রসূল তোমাদেরকে যা দিয়েছেন তা গ্রহণ কর, যা তিনি নিষেধ করেছেন, ওটা থেকে দূরে থাক”
আল্লাহর কথা! কিন্তু এটাকেও নিজের বিবেচনার সাথে, অনুভূতির সাথে মিলিয়ে দেখেছেন। তো বললেন যে, “আমার ভাই যদি যালিম হয় তবে আমি কেমন করে সাহায্য করব?” তো রসূল করীম (স) ওটা বুঝিয়ে দিলেন, “যদি যালিম হয়, তবে তাকে সাহায্য করা মানে হল তাকে জুলুম থেকে বিরত রাখা”। সাহাবারা (রা) কথা গ্রহণ করলেন, “হ্যাঁ, এইটা ঠিক আছে”। আল্লাহর কথা, আল্লাহর রসূলের কথা নিজের বুদ্ধি বিবেচনার সাথে দেখেছেন, ওটাকে শুদ্ধ করেছে, শুদ্ধ ভাবে বুঝেছেন। আল্লাহর কথা তো ভুল নয়, যদি মিল না থাকে তো নিজের অনুভূতি আর বিবেচনা শুদ্ধ করতে হবে।
তো আমার মন যেন শুদ্ধ কথা চায়। ঐটা ছিল সাহাবাদের (রা) কামাল। ঘটনা আমরা জানি। নির্জন জায়গায় ওমর (রা) রাতের বেলা গিয়ে এক মহিলাকে পেলেন বাচ্চারা সহ। পাতিলে কিছু আগুন দিয়ে রেখেছেন, পাতিলে শুধু পানি, অন্য কিছু নেই। আর বাচ্চারা ক্ষুধায় কান্নাকাটি করছে। ফিরে বায়তুল মালে এলেন। এসে বস্তা ভরে আটা আর চর্বি জাতীয় কিছু নিলেন। নিয়ে আবার ওখানে যাচ্ছেন। ভরা বস্তা নিয়ে যাওয়ার সময় ওনার সাথে ওনার খাদেম ছিলেন আসলাম। আসলামকে বললেন যে এই বস্তা আমার পিঠে তুলে দাও। পিঠে বা কোমরে তুলে দাও। আসলাম বললেন যে আমিই বহন করি। ওমর (রা) বয়স্কও আর মালিকও। বিভিন্ন কারণে আসলাম বললেন আমিই বহন করি। ওমর (রা) যখন বললেন আমার পিঠেই দাও, আসলামও পীড়াপীড়ি করলেন বেশ কয়েকবার। ওমর (রা) রাজি হলেন না-“হাশরের ময়দানে তুমি আমার বোঝা বহন করবে নাকি?” এটা আমিই বহন করব।
তো আসলাম ওমর (রা) এর পিঠে তুলে দিলেন। আর ওমর (রা) ঐ বোঝা পিঠে নিয়ে ওখানে গেলেন। আমীরুল মু’মিনীন হিসেবে বা খলিফা হিসেবে বা উম্মতের দায়িত্বপ্রাপ্ত হিসেবে এই জিনিস পৌঁছানো, ঐ মহিলা ও বাচ্চাদেরকে দেওয়া এইটা ওনার দায়িত্ব। নিজের পিঠে করে নিয়ে যেতে হবে এটা কোন আইনে ওনার দায়িত্বের মধ্যে নয়। ওটা করলেই হল। নিজে করুক বা অন্য কেউ করুক, তার কাছে খাদ্য পৌছানো হচ্ছে কাজ। কিন্তু উনি নিজে ওটা করলেন। উনি যে জিনিসটা পৌঁছালেন, এইটা নিশ্চয়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। কিন্তু ওমর (রা) এর এরচেয়ে অনেক বড় কামাল হচ্ছে, ওনার মন চাওয়া যে এটা আমিই করব। মন চাচ্ছে; এটা কোন আইন দাবি করে না। কোন দায়িত্ব দাবি করে না। তারপর রান্নাবান্না করে তাদের খাওয়ালেন। খাওয়ানোর পরে, তখন বাচ্চারা খেয়ে খুব ফূর্তিতে খেলাধূলা করছে, হাসছে। কিছু দূরে একটা জায়গায় ওমর (রা) এসে বসে গেলেন আর ঐ বাচ্চাদের দিকে তাকালেন। আর আসলামকে বললেন যে, এদেরকে আমি কাঁদতে দেখেছি, আমার মন চায় কিছুক্ষণ হাসতে দেখি। এইটা হচ্ছে রসূল (স) এর আসল তালীম আর আসল কামাল।
ওনাকে যে এই দায়িত্ব পালন করতে শিখিয়েছেন, যে একজন গরীব মানুষ খেতে পারে না, তার খাবার দাও, এগুলো আমরাও অনেক করি। আমাদের দেশে তো অনেক হাজী সাহেব আছেন, রমজান মাসে বিশেষ করে, অনেক সদকা খয়রাত করেন। লুঙ্গী বিতরণ করেন, শাড়ি বিতরণ করেন। কিন্তু ওগুলো কে করে? তার জন্য ম্যানেজার আছে; তারা করে। দান তো হয়ে যাবে। কোন মুফতি বলবেন না যে অন্যের হাত দিয়ে দেওয়ালে যাকাত আদায় হয় না। যাকাত আদায় হয়ে যাবে। ঐটা তো সবাই (যাদেরকে আমরা দ্বীনদার মনে করি) করেন। ওমর (রা) এর কামাল হল ওনার এই মনের চাওয়াটা- “এদেরকে আমি কাঁদতে দেখেছি, আমার মন চায় এদেরকে আমি হাসতে দেখি”। এইটা হচ্ছে উনার কামাল। আর রসূল (স) তাদেরকে এই দায়িত্ব পালন শুধু শিখান নাই, তাদেরকে শুদ্ধ, উন্নত অনুভূতি শিখিয়েছেন। এই মনের চাওয়া, আনন্দ লাগা।
আল্লাহ তাআ’লা সাহাবাদের (রা) গুণগান গেয়েছেন, প্রশংসা করেছেন একথা বলে,
“وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُوْلَئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ”
কিন্তু আল্লাহ তাআ’লা তোমাদের মনে, তোমাদের অন্তরে ঈমানকে প্রিয় বানিয়েছেন আর কুফর এবং নাফরমানী তোমাদের কাছে অপ্রিয় বানিয়েছেন
মাহাবুব বানিয়েছেন। একটা জিনিস ভালো লাগা। ঐ উন্নত অন্তর, ঐটা হল তার কামাল। আর এই জায়গায় আসলে একজন উন্নত মানুষ আর একজন নিম্নমানের মানুষের পার্থক্য।
একগুলো গরু ছাগলের মধ্য থেকে একটা গরু হেঁটে যাচ্ছে। রাস্তার পাশে বিড়ালের বাচ্চা ছিল। গরুর পা বিড়ালের বাচ্চার ওপর পড়ে গেল। ঐ বাচ্চা পিষে গেল এবং একটা চিৎকার দিয়ে মরে গেল। ঐ গরু ওর দিকে ফিরে একটু তাকালও না। একটু যে থামবে, একটু তাকাবে, মূহুর্তের জন্য হলেও থেমে যাবে, বা গরুটা বলবে আহ! কি করলাম! [হাসি]। কোন কিচ্ছুই নয়। কেন? সব কথার উত্তর একটাই, ও গরু। ঐ যে দিল, যে দিল থাকলে সে ‘আহ’ করত, ঐটাই আল্লাহ তাআ’লা তাকে দেন নাই। ও কি দিয়ে ‘আহ’ করবে?
মানুষকে আল্লাহ তাআ’লা অনুভূতি দিয়েছেন। মানুষ যদি তার অনুভূতি হারায়, ঐটা তার সবচেয়ে বড় হারানো। কারও কাছে শুনেছিলাম একজন পেশাদার খুনির কথা। কাউকে খুন করবার জন্য তাকে নিয়োগ করা হয়েছে। সে খুন করে এসেছে। এসে বাথরুমের মধ্যে জামা কাপর পরিবর্তন করেছে। যে রক্ত টক্ত লেগেছিল, সেগুলো ধুয়েছে। তারপর মুছে টুছে বিছানায় শুয়ে দিব্বি ঘুমিয়ে গেল। ঘুমোতে বেশিক্ষণ লাগেনি; গভীর নিদ্রা। তো ও যে খুন করলো, একটা অন্যায় খুন; নিঃসন্দেহে একটা জঘন্য অপরাধ। কিন্তু এর চেয়ে অনেক বেশি জঘন্য; যেটা কোন এই দেশীয় আইনের আওতার মধ্যে পড়ে না, ওর ঘুমাতে পারা। ওর ঘুমাতে পারা এটা এই দেশের সরকারি আইনে কোন অপরাধ নয়। শরীয়তের আইনেও এটা ধরবে না। ওর হত্যা করাকে ধরবে। কিন্তু ওর একজন নিরপরাধ মানুষকে সামান্য কয়টা টাকার জন্য অথবা যেকোন কারণে হত্যা করা আর ফিরে এসে তার ঘুমের কোন ক্ষতি হলনা, পেট ভরে খেতে পারলো আর আরামসে ঘুমিয়ে গেল; এটা হত্যা করার চেয়ে অনেক বড় অপরাধ। এটা ওর সবচেয়ে বড় জিনিস হারানো। ওর ভিতর থেকে, একটা মানুষ যে ছিল, একেবারেই নিঃশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তার কোন চিহ্নই বাকি নেই।
একটা মহিলার গলা থেকে হার ছিনতাই করার সময় ঐ মহিলা বাঁধা দিয়েছে। তো ছুরি মেরে দিয়েছে। সে মহিলাটা মরে গেছে। পত্রিকাতে খবর এসেছে, তার তিনটা ছোটছোট বাচ্চা। তারমধ্যে সব ছোটটা দুধ খায়। এই কথা গুলো ঐ ছিনতাইকারীকে কেউ বলল। ও হেসে উড়িয়ে দিল। ওর ছিনতাই করা, হত্যা করা যত বড় অপরাধ, এরচেয়ে অনেক বেশি অপরাধ হল ওর এই ব্যাপারে কোন অনুভূতিই না থাকা; এটা যদিও কোন আইনের আওতার মধ্যেই আসে না। এটা ওর সবচেয়ে বড় হারানো যে ওর কোন অনুভূতিই নেই। এর মোকাবিলায় একজন ‘মানুষ’, আল্লাহ তাআ’লা তাকে উন্নত অনুভূতি দিয়েছেন।
একবার আমরা জামাতে ছিলাম। আমাদের একজন সাথী; একজন শিল্পপতি। ধনী মানুষের পিস্তল টিস্তল সাথে রাখতে হয়। ওনার নেই কিন্তু ওনার ছেলের আছে। গ্রামের বাড়িতে গেছে। একটা কুকুর এসে ওদের বাড়ির একটা মুরগি নিয়ে গেছে। ওর তো পিস্তল আছে ঠিকই, জোয়ান ছেলে, লাইসেন্সওয়ালা পিস্তল ঠিকই, কিন্তু ব্যবহার তো করে না। ব্যবহার করার জন্য তার হাত চুলকায়। যখন ঐ কুকুর মুরগি নিয়ে যাচ্ছিল, বাড়ির লোক চিল্লাচিল্লি করছে যে, এই এই কুকুর মুরগি নিয়ে গেল। ও ব্যাস এই সুযোগে ওর পিস্তল বের করে ঠাস ঠাস করে কুকুরকে মেরে ফেলল। ঐ কুকুরের আবার ছোট ছোট বাচ্চা ছিল। আর ঐ সময়ই এগুলো বেশি খাই খাই করে। বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে হয়। সে বেচারা অবশ্য তখন জানত না। তার যজবার মধ্যে এসেছে মেরেছে। যখন জামাতে ছিলাম তখন তার বাপ এই কথা বলছিল। উনি বলার সময় ওনার দুই চোখ ভরে পানি পড়ছে। দুধ খাওয়া বাচ্চাগুলোর মাকে আমার বাচ্চা মেরে ফেলল।[স্যারের ভারী কন্ঠ]। কুকুর; না জেনে মেরেছে, সবই সত্য। নির্দিষ্টভাবে জানতও না। আর সেই কুকুর দোষও করেছে; মুরগি নিয়ে গেছে। অতএব সেই হিসেবে তার মারা একেবারে অন্যায়ও নয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হল এটাই যে ওর ছোট বাচ্চারা আছে; উপবাসে মরবে। এইটাই স্বাভাবিক। শুধু ওনার নয় একজন স্বাভাবিক মানুষের এইটাই হওয়া উচিত।
আল্লাহ তাআ’লা সাহাবাদেরকে (রা) এই উন্নত অনুভূতি দান করেছিলেন। ওইটা যদি শুদ্ধ হয়ে যায়, তার অনুভূতি যদি শুদ্ধ হয়ে যায়, তবেই আসলে একজন মানুষ শুদ্ধ। আর তার অনুভূতিই যদি নষ্ট হয়ে যায় বা বিকৃত হয়ে যায়, তাহলে তার ঐ ক্ষতি বড় ধরণের ক্ষতি; সে তো কিছু বুঝবেই না।
আমার নানা শ্বশুড় যাকে আমি দেখিনি, শুনেছি; শেষ জীবনে অসুস্থ হয়েছিলেন। কি রোগ হয়েছিল ভাল করে জানিনা। তার মধ্যে এটাও একটা সমস্যা ছিল যে রুচি নষ্ট হয়েছিল। উনি নাকি, খাবার যেটাই দেয়, উনি বলেন- লবণ বেশি। ডাল হোক আর তরকারি হোক যেটাই হোক বলেন লবণ বেশি, তিতা লাগে। পরের দিন লবণের মাত্রা আরও কমালো, প্রয়োজনে আলাদা রান্না করে; শেষ পর্যন্ত কমাতে কমাতে বিনা লবণে রান্না করেছে; তাও বলে লবণ বেশি। আসলে লবণের সমস্যা নয়, ওনার অসুখের কারণে ওনার রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ যে দুনিয়াতে চলে, আসলে রুচি দিয়েই চলে। প্রত্যেকদিন বাড়িতে রান্না বান্না করে; সাদা সিধা ডাল-ডুল যাই রান্না বারি করে, ও কি পাল্লা দিয়ে যেয়ে মাপে নাকি যে কত গ্রাম লবণ হবে, কত গ্রাম চিনি হবে, কত গ্রাম মরিচ হবে; কিচ্ছু না। এটাকেই আন্দাজ বলে; চোখের আন্দাজ, জিবের আন্দাজ। প্রথমে চোখের আন্দাজে রান্না করে; তার পরও যদি প্রয়োজন পড়ে একটু জিবে লাগিয়ে দেখে।
মানুষের ঐ আন্দাজ গুলো যদি নষ্ট হয়ে যায়, তবে কোন আইন দিয়ে তাকে চালান যাবে না। মানুষের সবচেয়ে গভীর জিনিস হল তার মনের আন্দাজ। এটাই তার শুদ্ধ রুচি। তার মন যেন বলে যে এটাই ঠিক। আল্লাহ তাআ’লা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামকে এবং সবশেষে রসূল কারীর (স) কে পাঠিয়েছেন আর রসূল (স) এসে একটা মেহেনত করেছেন; মানুষের এই মনকে গড়ে তুলবার জন্যে যে প্রত্যেক অবস্থায় মন তাকে শুদ্ধ পথে পরিচালনা করে। যারা তাদের মনকে শুদ্ধ করতে পেরেছে, রসূল (স) তাদের ব্যাপারে বলেছেন- استفت نفس তোমার মনকে জিজ্ঞাসা কর“। মন যদি শুদ্ধ হয়ে যায়, তো ওটা নিয়মের উর্ধে।
ধনী একটি পরিবার ট্রেনে তার ছোট বাচ্চাকে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের পোষাক আশাক, হাবভাবে বুঝা যায় যে তারা বড়লোক। তাদের কাছেই একজন প্যাসেঞ্জার গ্রামের গরীব মানুষ। সে কাচু মাচু হয়ে বসে আছে। এত বড়লোকের পাশে সে বসে আছে, গায়ে ছেড়া জামা, গরীব লোক। আর  ঐ দিকে তারা খাবার টাবার এনেছিল, কোন কারণে সেগুলো নষ্ট হয়ে গেছে আর বাচ্চার ক্ষুধা পেয়েছে। বড়দের তো কোন সমস্যা নয়, বাচ্চার ক্ষুধা পেয়েছে। তারা তো পেরেশান এখন, কি করে, অস্থির। ঐ যে গ্রামের লোকটা; তার গাট্টিতে তার বাড়ির করা তাল পিঠা আছে। কিন্তু তা একেবারেই একটা গ্রামীন জিনিস। তার গ্রামে তৈরি করা, ঐ বড়লোককে দিবে; সাহস পাচ্ছে না, ইতস্তত করছে। আবার এটাও ভাবছে দেওয়াও তো উচিত, বাচ্চাটার ক্ষুধা পেয়েছে।
অনেকক্ষণ অনেক ইতস্তত করে, তারপর বলল- “আমার কাছে তাল পিঠা ছিল!” [মজমার হাসি]
আছে বলল না, ছিল; যেটা ব্যাকরণের দিক থেকে অতীত কালের। তারা খুব আগ্রহের সাথে নিল- হ্যাঁ হ্যাঁ। কথা হল যে ও অতীত কালের বলল কেন, এটা তো বর্তমানের, আছে। ও অত ব্যাকরণ জানে না, বোঝাতেও পারে না।
তো ব্যাকরণ ওয়ালারা, ব্যাকরণ বিশারদরা যারা আছে, (তাদের) ওর কাছ থেকে ব্যাকরণ শিখতে হবে; )কারণ) ওর বলা শুদ্ধ। যদিও অতীত কালের বলছে, কিন্তু ওর বলার উদ্দেশ্য, বিনয়, সন্দেহ; ঐ সব কিছু একটা অতীত কাল দিয়ে প্রকাশ করে দিয়েছে। যদি তার কাছে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চাওয়া হয় যে বর্তমানেরটা তুমি অতীত কালের কেন বললে, আর বলার উদ্দেশ্যই বা কি; সে নিজেও জানে না। ব্যাকরণ বই যারা লিখে তারা এখান থেকে দৃষ্টান্ত নিয়ে যদি না উল্লেখ থাকে তাহলে ব্যাকরণ সংশোধন করতে হবে। ওর বলা শুদ্ধ, (বরং) ব্যাকরণে ভুল আছে। কুরআন শরীফ দিয়ে আরবী ব্যাকরণ ওয়ালারা তাদের ব্যাকরণ শুদ্ধ করে। কুরআন শরীফের মধ্যে এই জাতীয় আয়াত আছে-

“وَكَانَ اللّهُ غَفُورًا رَّحِيمً”

 সরাসরি যদি অর্থ অনুবাদ করা হয় তাহলে অর্থ দাঁড়ায়- “আল্লাহ তাআলা গফূরুর রহীম ছিলেন”।  
কিন্তু যারা তাফসীর করে তারাই বুঝাবে যে এখানে অতীত কাল বলতে কি বুঝাচ্ছে।  যে তার ভাষার উপর দখল রাখে, যে এটাকে ভাল করে শিখেছে, ভাল করে ব্যাবহার করতে পারে সে ব্যাকরণের দিকে তাকায় না, যেইটা মুখে আসে ঐটাই বলে আর ঐটাই শুদ্ধ।
মানুষ ঐ ব্যাক্তি ওর মন যেটা বলে ঐটাই করে আর ঐটাই শুদ্ধ। তবে তাকে তার এই মনটাকে শুদ্ধ করতে হবে। সাহাবারা (রা) তাদের মনকে এতই শুদ্ধ করেছেন; কোন ধরণের কোন আইন ছাড়াই নিজে কাজ করেছেন আর কাজ গুলোও শুদ্ধ করেছেন। আর কাজ করেছেন ঐটাই যেটা মন বলছে। কিন্তু ঐটা শুদ্ধ।
ফেকাহ এর ব্যাপারে যেখানে কুরআন শরীফের আয়াত পাওয়া যায় কুরআন শরীফের আয়াত দেওয়া হয়, হাদীস পাওয়া যায় হাদীসই দেওয়া হয়, (কিন্তু) যেখানে এগুলো পাওয়া যায় না- কোন সাহাবার (রা) কোন কথা বা কোন কাজ; ঐটাই ফেকাহ এর বুনিয়াদ। ঐটা কেন বুনিয়াদ হয়? এই জন্য যে সাহাবাদের (রা) মন এত শুদ্ধ ছিল যে, তাদের মন যেটা বলেছে ঐটা আসলে আল্লাহর পছন্দেরই; তাদের মন শুদ্ধ হওয়ার কারণে। ঐ জন্য সাহাবারা (রা) যেটা করেছেন ঐটা ফেকাহ এবং যেটা বলেছেন ঐটা হাদীসের মতই মূল্য রাখে। কারণ তার মন শুদ্ধ। আল্লাহ তাআ’লা বড় মেহেরবানী করে আমাদের দ্বীন দিয়েছেন, আমার মন যেন শুদ্ধ হয়ে যায়। মন যদি শুদ্ধ হয়, তাহলে সে কোন অশুদ্ধ জিনিসকে গ্রহণ করবে না।
বিদেশে নামকরা বড় হোটেলে গিয়েছে। আর সে বিদেশে গিয়েছেও প্রথমবার। প্রথম যখন বিদেশে গিয়েছে, বড় ধাঁধার মধ্যে আছে; আল্লাহই জানে কি জিনিস! তার ওপর আবার ফাইভ স্টার হোটেলেও প্রথমবার। ওখানে ওকে (খেতে) দিয়েছে মাছ। ফাইভ স্টার হোটেলে ওটা তো মাছ না, ওটা তো ফিশ। [মজমার হাসি]
তো ওকে দিয়েছে ফিশ, কিন্তু পঁচা মাছ। তো পঁচা মাছ যদি হয়, যার তার নিজের ওপর আস্থা আছে, যত বিদেশ হোক, যতবড় ফাইভ স্টার হোক, লন্ডন হোক আর প্যারিস হোক মাছ কিন্তু পঁচাই। কেমন করে পঁচা? আমার জিহ্বা বলছে পঁচা। নিজের ওপর এই আস্থা তার থাকা উচিত। যদি এইটা বলে যে এটা ফাইভ স্টার হোটেল, তোমাদের গ্রামের পঁচা এখানে চলবে না; এখানকার পঁচা অন্য ধরণের। তো সে মানবে না; পঁচা তো পঁচাই। একথা কে বলতে পারবে? যার তার নিজের ওপর আস্থা আছে। আর যে ধাঁধায় পড়ে যায়, কি জানি ভাই, বড়লোকদের পঁচা আর আমাদের গ্রামের পঁচা; সে পারবে না। মানুষ যেন তার বোধকে শুদ্ধ রাখে। আর এইটার ওপর তার যেন বিশ্বাসও থাকে।
আমেরিকার ঘটনা আমি শুনেছি। এক লোক দোকান থেকে কিনেছে শ্যাম্পু, মানে ঐ সাবান লিকুইড জাতীয়। কিন্তু ওটার ট্রেড ছবি যেটা, ঐটা একটা আধা কাটা লেবু। লেবু দেখে ও শরবত ভেবেছে। আর শরবত ভেবে ও কিনেছে। এটুকো তো বোঝা গেল; যদিও অফিসিয়ালি সবাই শিক্ষিত, কিন্তু সবাই যে জিনিসের নাম পড়তে পারে তা কিন্তু নয়। একেবারে উপর পর্যন্ত যাওয়া যায় টিক মেরে মেরে। সেজন্যে অফিসিয়ালি শিক্ষিত, কিন্তু পড়ালেখা সে জানেও না আর জানলেও অত কষ্ট করে পড়তে যায়ও না। তো সাবান কিনেছে লেবু মনে করে। তারপর ওটাকে বাড়ি নিয়ে গেছে। তারপর ওটাকে খেয়েছে। গিলেছে সাবান কিন্তু লেবু মনে করে। লেবু মনে করে কিনে ফেলল, ঐটা পর্যন্ত তো মানা যায়। কিন্তু মুখে দিল, গিলল। সে কি সাবান আর লেবুর শরবতের পার্থক্যও করতে পারে না। কেন পারে না? তার নিজের ওপর কোন আস্থা নেই। মুখে লাগছে, সাবান সাবান লাগছে; লাগুক সাবান সাবান, তো কি হয়েছে। আস্থা নেই। [মজমার হাসি]
তো এক হল তার অনুভূতিঅ নেই; আর দ্বিতীয়ত যদিও বা অল্পস্বল্প থেকে থাকে ঐটার ওপর তার আস্থাও নেই। আস্থা না থাকার কারণে যা গেলাচ্ছে, তাই গিলছে। একজন মানুষের তার নিজের বোধ শুদ্ধ থাকা উচিত। আমি যেন বিচার করতে পারি কোনটা শুদ্ধ আর কোনটা আশুদ্ধ। আর এইটার ওপর যেন আমার আস্থাও থাকে। বলছি আশুদ্ধ, অশুদ্ধই। আর এইটার ওপর নিশ্চিন্তও থাকা। জানা শুধু জানাই নয়, জানা এবং নিশ্চিন্তভাবে জানা।
মৌখিক পরীক্ষাগুলোয় যারা খারাপ ছাত্র ওদেরকে অনেক সময় টেনে টুনে পাশ করিয়ে দেয়। আর পাশ করাবার জন্য হাজার যুক্তি আছে। নামকরা ঘটনা আছে ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফিজিক্সের প্রফেসর মতিন চৌধুরীর। পরীক্ষায় এক ছেলে এসেছে কিচ্ছু উত্তর দেয় নি। নাম জিজ্ঞেস করলেন তাও বলেনি। বার বার নাম জানতে চাইলেন- নাম বল। এক শব্দও উচ্চারণ করল না। ভাইভাতে তাকে তো আলাদা করে পাশ করতে হবে। ফেল করলে ফেল। প্রফেসর মতিন চৌধুরী বললেন- ভুল উত্তর তো দেয় নি। অতএব পাশ। [মজমার হাসি]
ভাল ছাত্র যখন আসে তখন আবার তাদেরকে নানান প্যাঁচের মধ্যে ফেলে দেখবার জন্যে যে কতদুর যায়। শুদ্ধ উত্তর দিলে অনেক সময় হঠাৎ ধমক দিয়ে বলে কি বললে? তারপরেও সে যদি ঐটাই আবার বলে,  স্যাররা তর্ক করেন এইটা কেমন করে হল। ছাত্রও মোকাবিলা করে তর্ক করে তখন বুঝে হ্যাঁ সে জানে এবং এব্যাপারে নিশ্চিত। তাকে ভাল নাম্বার দেয়। আর ধমক দেওয়ার পরে যদি উত্তর বদলায়, শিক্ষকরা তখন বুঝে যে সে জানে ঠিকই কিন্তু কিছুটা চান্সের উপরে আছে। [মজমার হাসি]
আল্লাহ তাআ’লা আমাদেরকে পাঠিয়েছেন, আমরা যেন শুদ্ধ জানি আর এর উপর যেন আস্থা থাকে। সাহাবারা (রা) নিশ্চিত ভাবে জেনেছেন। বিভিন্ন ঘটনা আছে যেখানে আগে থেকে নিয়ম জানা ছিলনা; নিজেরাই একটা জিনিস করেছেন। পরবর্তীতে রসূল (স) বলেছেন- ঠিক করেছ। প্রশংসা করেছেন।
একজন সাহাবী (রা) নামায পড়াতেন, সম্ভবত জামাতের আমির ছিলেন। প্রত্যেক রাকাতে সূরা ফাতিহা, তারপর অন্য এক সূরা, তারপর আবার সূরা ইখলাসও পড়তেন। ফিরে আসার পর, মামূর যারা ছিলেন তারা রসূল (স) কে বললেন যে উনি তো এরকম করেন। এই বলাতে বুঝা যায় উনি এটা নিয়ম বহির্ভুত করেছেন। রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন ওকে জিজ্ঞেস কর সে কেন করেছে। জিজ্ঞেস করা হল এবং এতে আরও প্রমাণিত হল যে এটা সুন্নতের বাহিরে। নাহলে রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন যে এটা তো ঠিক আছে করুক। তা তো বলেন নি। জিজ্ঞেস করলেন কেন। শোকজ কখন করা হয়? যখন আইন বহির্ভুত কিছু করা হয় তখনই না শোকজ করা হয়। জিজ্ঞেস করলেন। উনি উত্তরে বললেন যে আমি সূরা ইখলাস কে ভালবাসি। একথা যখন রসূলসল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলা হল, রসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন যে ওকে বলে দাও- সূরা ইখলাসের মুহাব্বতে আল্লাহ তাআ’লাও তাকে মুহাব্বত করেন। [সুবহানাল্লাহ]
কাজটা করেছেন কিন্তু বিলকুল বেআইনি; কিন্তু ওনার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। মুহাব্বতের একটা দাবি আছে। মুহাব্বতের দাবি যদি যথেষ্ট থাকে তো সে অনেক কিছু করতে পারে। তার আস্থা থাকা চাই। আমি আমার মাহবুবের সামনে করি, তোমার আবার কি? তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। আল্লাহ তাআ’লা আমাদেরকে দ্বীন দিয়েছেন, আমার অন্তর কে এত শুদ্ধ করতে হবে যে এর ব্যাপারে আমি যেন সন্দিহানও না থাকি। ঐটাই তো আমাকে চালাবে।
আমরা যে কথা বলছি, বাংলায় কথা বলছি; ব্যাকরণ দেখে দেখে কথা বলি নাকি। ব্যাকরণ দেখে দেখে কি বাক্য বলা সম্ভব? বাস্তব কথা, ঢাকারই কোন এক কলেজে বিদেশি কেউ একজন এসেছে। এসে কোন একজন প্রফেসরকে কি একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছে। সেই প্রফেসর উত্তর দেয়নি, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কোন উত্তর না পেয়ে সে চলে গেছে। যাওয়ার পরে তার কোন এক সহকর্মী তাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি উত্তর দিলেনা কেন? ঐ প্রফেসর উত্তরে বলল, থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার এর শেষে এস লাগাতে হয়, আমি ঐ এস খুঁজতে খুঁজতে সে চলে গেছে। [মজমার হাসি]
ব্যাকরণ দিয়েই যদি কথা বলতে হয়, তো কারও আর ধৈর্য থাকবে না ঐ কথায়। কিন্তু যে কথা বলে ঐ ব্যাকরণ দিয়ে কথা বলে না; কথা বলে ব্যাস। আমার জীবন ওরকম। আইন দিয়ে জীবন চলে না। ফেকাহ মাসয়ালা দিয়ে জীবন চলে না; আমার মন দিয়ে চলে। মন যদি শুদ্ধ হয়, জীবন শুদ্ধ হবে। আর মন যদি শুদ্ধ না হয় তো জীবন শুদ্ধ হবে না। এই মনকে শুদ্ধ করতে হবে।
অশুদ্ধ একটা জিনিস; যতবড় পীরই হোক না কেন, যতবড় মৌলভীই হোক না কেন, আমাকে যতই মানতে বলুক না কেন, ওটা অশুদ্ধই; মানব না। শুধু যে আমি শুনব না আর মানব না তা নয়, আমার আস্থা থাকতে হবে। তবেই সে শুদ্ধভাবে চলতে পারবে। নইলে দোদুল্যমান হবে। নিশ্চয়তাও থাকতে হবে।
আল্লাহ তাআ’লা আমাদেরকে বড় মেহেরবানি করে দ্বীন দিয়েছেন, আল্লাহর পথে বের হয়ে আমি আমার অন্তরকে শুদ্ধ করি আর এটাকে নিশ্চিতও করি। আমার মন আমাকে যেন শুদ্ধ পথে পরিচালিত করে আর এ ব্যাপারে আমার মন  যেন সন্দেহের মধ্যে না থাকে, দোদুল্যমান না থাকে। ঠিক না ভাই ইনশাআল্লাহ? [ইনশাআল্লাহ]
কেউ যদি আমাকে অশুদ্ধকে শুদ্ধ দেখায়- মানব না। গ্রামের একজন লোক; বই পুস্তক কিচ্ছু যানে না, তাকে বিরাট একটা আরবি লেখা বই এনে অনেক আরবি লেখা দেখাল, এটা এই আয়াত, এটা এই হাদিস; ইত্যাদি অনেক কিছু দেখিয়ে টেখিয়ে তাকে বলল, বর্তমান যামানায় শুকরের গোশত খাওয়া হালাল। আর ওখান থেকে একেবারে ইবারত পড়ে শুনিয়ে দিল। কিন্তু একজন মুসলমানকে যতই ইবারত শুনাক আর যতই তাকে আরবিতে বলুক, শেষ পর্যন্ত সে বলবে আমি শুকরের গোশত খাব না। কেন? মন মানছে না; আর ঐটাই শুদ্ধ।
আর মন যদি দুর্বল হয়, যেকোন কাউকে যেকোন ধাঁধায় ফেলে দেওয়া যাবে; ও মোকাবিলা করতে পারবে না। কিন্তু মন যদি শুদ্ধ হয় তাহলে তাকে কেউ ঠকাতে পারবে না। আল্লাহ তাআ’লা সাহাবাদের (রা) মনকে শুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। – ওরকম ঈমান আনো, যেরকম সাহাবারা এনেছে। কোন যুক্তি দিয়ে কোন অশুদ্ধ কথা তাকে মানাতে পারবে না। কারণ তার মন শুদ্ধ।
এই জন্য আল্লাহর পথে বের হয়ে মেহেনত করতে হবে। ঠিক আছে না ইনশাআল্লাহ। নিয়্যত করি ইনশাআল্লাহ। বেশি থেকে বেশি মেহেনত করব, দুয়া করব; আল্লাহ তাআ’লা যেন মেহেরবানি করে আমাদের দিলকে পাক পবিত্র করে দেন। ঈমানের স্বাদ যেন গ্রহণ করতে পারি।
ذَاقَ طَعْمَ الإِيمَانِ-“ঈমানের স্বাদ গ্রহণ কর।”
আমার জিহ্বা যদি শুদ্ধ হয়ে যায়, কোন যুক্তিতে একটা পঁচা জিনিসকে বলবো না ভাল; পঁচা পঁচাই। আমার জিহ্বা বলছে পঁচা। এর পরে আর কোন কথা চলবে না। যত বড় সার্টিফিকেটই হোক আর যত বড় হোটেলই হোক এটা পঁচাই। দিল যদি শুদ্ধ হয়ে যায় তো শুদ্ধকে শুদ্ধ বলবে আর অশুদ্ধকে অশুদ্ধ বলবে। দিল গ্রহণ করবে না। আল্লাহ তাআ’লা সাহাবাদেরকে (রা) এই গুণ দান করেছিলেন।
এমনি থেকেই দেন নাই, বহুত মেহেনত করার পর দিয়েছেন। আমরা ঐরকম মেহেনত করতে থাকি, দুয়া করতে থাকি। আল্লাহপাক তৌফিক নসিব করুক। আমীন।
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينََ
(মাজালিসে মুশফিক আহমেদ দাঃ বাঃ)
অডিও ডাউনলোড লিংক
https://www.dropbox.com/s/jftll2qa7ok9rtd/4.diler%20onuvuti%20%26%20shuddhota-24-04-15.3gpp?dl=0

أعوذ بالله من الشيطان الرجيم
بسم الله الرحمن الرحيم
আল্লাহ তাআ’লার বহুত বড় মেহেরবানী যে আল্লাহতাআ’লা আমাদেরকে দ্বীনের এই মেহেনত দান করেছেন, যেটা আমরা তাবলীগ নামে চিনি। আর এটাও আমরা জানি যে আল্লাহর ফজলে পুরা দুনিয়াতে এই কাজ ছড়িয়ে পড়েছে। আর এর দ্বারা আল্লাহর ফজলে বহুত মানুষের ফায়দা হচ্ছে। তবুও একটা জিনিস জানা অপেক্ষা চোখের সামনে দেখা বেশি ভাল লাগে। সেই হিসেবে বলছি, ফ্রান্সে আল্লাহর ফজলে তাবলীগের ভাল কাজ। কোন কোন ব্যাপারে আমাদের তুলনায় অনেক ভাল। পরিমাণে তো তুলনাই করা যায় না; ওখানে মুসলমান আমাদের দেশের তুলনায় নেই। আমাদের এখানে কত কোটি মুসলমান আর ওখানে লাখের হিসেবে হবে। কিন্তু কাজ আমাদের দেশের তুলনায় অনেক পরে আরম্ভ আর মুসলমানের সংখ্যা আমাদের দেশের তুলনায় অনেক হওয়া সত্ত্বেও ফ্রান্সের মাধ্যমে আল্লাহর ফজলে ২৩ টাদেশে (কয়েক বছর আগের পরিসংখ্যান) তাবলীগের কাজ আরম্ভ হয়েছে। [সুবহানাল্লাহ]
এইটা আমরা বাংলাদেশ দাবি করতে পারব না। একটা দেশেও দাবি করা মুশকিল যেখানে বাংলাদেশের জামাত গিয়ে কাজ উঠিয়েছে। পুরা দুনিয়াতে জামাত তো আল্লাহর ফজলে যায়। কিন্তু একটা বাগান পরিচর্যা করা; গেলাম চাষ করলাম,পানি দিলাম পরে আর খবর নাই। আর একটা হল নিজে থেকে জমি চাষ করা, বীজ বপন করা, পানি দেওয়া, সার দেওয়া, ঔষধ দেওয়া একেবারে শেষ পর্যন্ত। ফ্রান্স কমপক্ষে ২৩ টা দেশেরকাজ আরম্ভ করেছে, আর এগুলোর পরিচর্যা করে। নিয়মিত জামাত পাঠায়, খোঁজ খবর করে। সেইজন্য আল্লাহর কাছে শুকুর আদায় করা। [আলহামদুলিল্লাহ]
আর এইটাও বহুত বড় নিয়ামতের কথা, ফ্রান্সের এই কাজের পেছনে প্রধানত ব্যক্তি ডঃ সানাউল্লাহ; আলীগড় ইউনিভার্সিটি থেকে গিয়ে যিনি কাজ আরম্ভ করেছিলেন। আল্লাহ তাআ’লা তৌফিক দিয়েছিলেন, ওনার সাথে হাঁটতাম। তখনই আমারও তাবলীগের সাথে পরিচিতি; সানাউল্লাহর মাধ্যমে। তো ফ্রান্সের কাজ আরম্ভ হওয়া আর আমার তাবলীগে লাগাও একই সাথে বলা চলে। যদিও আমি তখন তাবলীগি ছিলাম না কিন্তু সানাউল্লাহর সাথে সাথে গাস্তে যেতাম। পরবর্তীতে ফ্রান্সে তাবলীগের কাজ উঠানোর ব্যাপারে যার গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে, উনি হচ্ছেন আমাদের দেশের মাওলানা লুতফর রহমান সাহেব রহঃ। ওনার কথা ওরা খুউব ইয়াদ করে; আর উনি খুব মেহেনত করেছেন।
এখন যে কথা গুলো বললাম ওগুলো ১৯৬৭-৬৮ সালের দিকের কথা। আমি ছাত্র হিসেবে ছিলাম ওখানে, সানাউল্লাহও ছাত্র হিসেবে ছিলেন। তারপরে তো চলে এলাম। এরপরে জামাতে গেলাম ওখানে ১৯৭৬ সালে। জামাতে গিয়ে দেখলাম নতুন মসজিদ হয়েছে ওখানে; যেখানে আমরা আগে দাওয়াতের কাজ করতাম। কথা যখন আরম্ভই হল, আগ্রহ হচ্ছে একটু ইতিহাস বলি।
ফ্রান্সে তখন বড় একটা মসজিদ ছিল। ঐ মসজিদ এখনও আছে। বলা যেতে পারে ঐ মসজিদ মোটামুটি ছিল দেখার মত মসজিদ। ওই রকম মসজিদ আমাদের দেশেও নাই। এর চেয়ে বড় আছে, কিন্তু এর চেয়ে ব্যয় বহুল, দেয়ালের মধ্যে এত বেশি নকশা-টকশা ইত্যাদি এবং যথেষ্ট বড়ও। ঐ একটাই মসজিদ ছিল, তবে ঐ মসজিদে ঢোকার জন্য টিকিট কিনতে হত। আর ট্যুরিস্টরা টিকিট কিনে ওখানে ঢুকত। তবে আল্লাহর মেহেরবানী নামায ফ্রী ছিল! [মজমার হাসি] ওখানে মসজিদের খাদেম ছিলেন কিছু; কিন্তু খাদেমা ছিলেন বেশি। [মজমা আবার হেসে ফেলে] কারণ ট্যুরিস্টদের ব্যাপার। আর যেখানে ট্যুরিস্টদের ব্যাপার আছে, ওখানে খাদেমের চেয়ে খাদেমার কদরই বেশি থাকে। তো ট্যুরিস্টদেরকে খাদেমারা মসজিদ দেখাতেন আর ট্যুরিস্টরা এসে দেখতেন।
সব নামাযের সময় মসজিদ খোলা হতনা; অফিসিয়াল টাইম অনুযায়ী খোলা হত। নামায যদি অফিস টাইম এর মধ্যে পড়ে যেত ভাল কথা আর তা নাহলে ঐ সময় অনেক ক্ষেত্রে দরজা বন্ধ থাকত। ঈমাম-মুয়াজ্জিন ছিলেন। ঈমাম সাহেব তো নামায পড়াতেন, মুয়াজ্জিন সাহেব আযান দিতেন। মুয়াজ্জিন সাহেব সাধারণত নামায পড়তেন; কিন্তু যেহেতু নামায পড়া ওনার ডিউটি বহির্ভুত তাই কখনও কখনও আযান দিয়ে চলে যেতেন। ঈমামের কাজ নামায পড়ানো। এই ছিল মসজিদ, ঐ একটাই।
তারপরে এই দাওয়াতের কাজেরই মাধ্যমে আল্লাহ তাআ’লা আরেকটা জায়গা করে দিলেন যেটা একটা পাড়ার মধ্যে ছিল; পুরানো প্যারিসে যেমন পুরানো ঢাকা। বলা যেতে পারে ঐটা প্যারিসের সদর ঘাট; পুরানো প্যারিসের কেন্দ্র। ওখানে কাছেই বেলভিল নামে একটা ঘন বসতির মহল্লা। ওখানে একটা মসজিদ পাওয়া গেল। (এই) মসজিদের ইতিহাস হল এরকম যে ঐ পুরানো বাড়ি টারি যেগুলো আছে, নতুন প্ল্যানের অধীনে সেগুলো ভেঙ্গে ফেলবে, আবার নতুন করে বানাবে। ভেঙ্গে ফেলার আদেশ তো হয়ে গেছে, কিন্তু কার্যকরী এখনও হয়নি। ঐ বাড়িগুলি অফিসিয়ালি পরিত্যাক্ত। আর বসবাসের উপযোগী নয়; অফিসিয়ালি। কিন্তু বাস্তবে লোক আবার আছে; সেগুলোর আবার আন অফিসিয়াল দখলদারও আছে, ভাড়া টারা দেয়। ঐ আন অফিসিয়াল ধরণের একজন দখলদার নামাযের জন্য একটা রুম ছেড়ে দিলেন। তো ঐটা হয়ে গেল মসজিদ
ঘরটা কিসের ছিল আমি ঠিক জানিনা। ছাদ বেশ উঁচু ছিল। বসবাসের জন্য ছিলনা, কোন গুদাম টুদাম জাতীয় কিছু ছিল হয়তো। যেহেতু ছাদটা বেশ উঁচু ছিল সেহেতু আমরা সাথীরা মিলে তক্তা দিয়ে দোতলা বানিয়ে ফেললাম। কারণ ওখানে ঘন বসতি আর গাস্ত করলে লোক পাওয়া যায়। আর কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল যে বেশ মুসুল্লিরা আসে। আর তাই জায়গার প্রয়োজন হওয়ায় তক্তা দিয়ে ঐটাকে দোতলা করা হল। কিন্তু দোতলা বানাবার জন্য অল্প স্বল্প হলেও নিয়ম কানুন তো কিছু আছে; কিন্তু ওগুলোও মানা হয়নি। বাঁশ, কাঠ টাট দিয়ে হাতুরি বাটাল দিয়ে দোতলা বানানো হয়েছে। একদিন গাস্ত হয়ে গেছে বোধহয় একটু বেশি। তার ফলে মানুষও এসেছে একটু বেশি, আর দোতলায় উঠে সবাই ধড়াস করে পরে গেছে। [মজমার হাসি] দোতলা ভেঙ্গে পরে গেছে, কিন্তু আল্লাহর মেহেরবানি কেউ আহত হয়নি। [হাসতে হাসতে সুবহানাল্লাহ]
ঐটা ছিল প্রথম মসজিদ। ওখান দিয়েই আমরা গাস্তে যেতাম। কিছু কাছেই আরেকটা জায়গা ছিল, যেখানে অনেক শ্রমিকরা থাকত। বিদেশি শ্রমিক বেশি, বিশেষ করে আফ্রিকান। শ্রমিকরা থাকত একা, পরিবারসহ নয়। ওগুলোকে ফোরিয়ার বলে; যেখানে খুব ঘন ভাবে থাকে আর দুই তিন তাক। শুধু শোয়ার জায়গা, বসার সুবিধা ওখানে নেই। এই ফোরিয়ার গুলোর কম ভাড়া, বেশি লোক একসঙ্গে থাকে। আর সাধারণত ওই মালিকেরই ধারে কাছে একটা বারও থাকত; মদের দোকান। কারণ বসবার জায়গা ওখানে নেই, বসতে হলে ঐ বারে যেতে হত। আর ওখানে গেলে তার ঐ বিজনেসও চলে। একসাথে দুই লাভ হল। এদিকে জায়গায় বেশি লোকের ঘর বানালো যেন বেশি ভাড়া পায়, আর এদিকে বসার সুবিধা না থাকায় বাধ্য হয়ে বারে গিয়ে বসবে, তো বারের ব্যাবসাও চলে।
ওখানে কফিশপ, বার ওগুলো একই জিনিস। যেখানে কফি থাকবে ওখানে মদও থাকবে; যেখানে মদ থাকবে ওখানে কফিও থাকবে। আমাদের একজন সাথি ছিলেন যিনি এখনও আল্লাহর ফজলে আছেন; বয়স হয়ে গেছে, ডায়াবেটিসের কারণে ভাল চোখে দেখেন না, প্রায় অন্ধ হয়ে গেছেন; ভাই আদম। ওনার কাছে গাস্তে যেতাম। উনি আমাকে কাছে বারে নিয়ে যেতেন; মদ খাওয়াবার জন্য নয়, কফি, কেক খাওয়াতেন। [মজমার হাসি] ওখানে মদের দোকানে বসে কফি খাওয়াকে আয়ব বা দোষের কিছু মনে করা হয় না। উনি একরাম করতেন, দাম দিতেন ঠিকই কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে ভাষা না জানার কারণে কথা বেশি হত না। আমি ফ্রেঞ্চ অল্প স্বল্প বলতে পারতাম, সেটাও বেশি নয়। গাস্তে যেতাম ঠিকই কিন্তু কথা বার্তা বেশি হত না, তারপর উনি কফি-চা খাওয়াতেন এবং আমি চলে আসতাম। কথা বার্তা না হলেও আমি নিয়মিত গাস্তে যেতাম, সপ্তাহে একবার।
আল্লাহর মেহেরবানীতে পরবর্তিতে এখান থেকে জামাতে গেলাম ১৯৭৬ সালে। আমি ওখান থেকে ফিরে এসেছি ৭০-৭১ সালের দিকে। গিয়ে দেখি ঐ বেলভিলের যে জায়গা ছিল ঐটা আর নেই; ভাঙ্গা টাঙ্গা হয়ে গেছে। কাকরাইল থেকে নতুন মার্কাযের ঠিকানা নিয়ে গিয়েছিলাম। ঠিকানা দেখে আমার কাছে পরিচিতর মত মনে হল, কিন্তু ভাল মত মনে করতে পারছি না। নতুন মার্কাযে যেয়ে যখন উঠলাম তখন দেখি যে আদম যে বারে নিয়ে যেতেন কফি খাওয়াবার জন্য নিয়ে যেতেন, ঐ বারই এখন মার্কায। [সুবহানাল্লাহ] আস্তে আস্তে মুসলমানদের এবং নামাযীর সংখ্যা বাড়ার কারণে মদের ব্যাবসায় ঘাটতি পড়ে গেছে। একসময় যারা ওখানে মদ খেত, তারাই পরে ঐটা কিনে নিয়ে বানিয়েছে মসজিদ আর ঐ মসজিদই এখন মার্কায। [সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ] এইভাবে আল্লাহর মেহেরবানীতে কাজ আরম্ভ হয়।
ঐ দ্বিতীয় বার যখন জামাতে গেলাম ১৯৭৬ সালে, এখন আমার পাসে বসা ভাই আব্দুর নূর; মুসলমান নাম, (কিন্তু) আগে অন্য নাম ছিল; উনার সাথে দেখা হল ক্লেমোফেরা নামক একটি শহরে। ফ্রেঞ্চ তাবলীগি যারা আছেন, তাদের অধিকাংশই এই ক্লেমোফেরা শহরের। ক্লেমোফেরা আবার প্রাচীন ইউরোপের এক ধরণের বিশেষ মার্কাযও। বলা যেতে পারে প্রাচীন ইউরোপের রুহানী মার্কায। খ্রীস্টান ধর্মের প্রাচীন রুহানী মার্কায ক্লেমোফেরা। পুরানো পুরানো গীর্জা আছে, জাদু টাদুর প্রাণকেন্দ্র; এখনও ওগুলো আছে। গীর্জার ভিতরে নকশা টকশা ইত্যাদি দেখে বোঝা যায় এগুলো স্বাভাবিক নকশা নয়; জাদু টাদু জাতীয় জিনিস এগুলোর সাথে জড়িত। ওখানে একজন আল্লাহ ওয়ালা সাথী আছেন যিনি আগে ওসব জাদুর সাথে জড়িত ছিলেন; ওনার সাথে ২ বছর আগে কথা বলার সময় ঊনি বলেন এইটা একসময় যেমন জাদুর মার্কায ছিল, এখনও এইটা জাদুর মার্কায।
ক্লেমোফেরা থেকেই প্রথম ক্রুসেডের জামাত বের হয়। বহু আগে মুসলমানদের এবং খ্রিস্টানদের মধ্যে বায়তুল মুকাদ্দিস এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অনেক লম্বা যুদ্ধ হয়েছিল। তখন ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে খ্রিস্টানরা একত্রিত হয়ে ঐ বায়তুল মুকাদ্দিসের জন্য যুদ্ধ করেছে। ঐ যুদ্ধের আরম্ভ ছিল এই ক্লেমোফেরা থেকে। ঐটা মুটামুটি ছিল ১০৯২ সালের দিকে। ঐখানে যে বড় গীর্জা ছিল ঐ গীর্জার প্রধান পাদ্রী ছিল ২য় ঊগবেন। ওর নেতৃত্বে ওই ক্রুসেডের জামাত ওখানে বানানো হয়েছিল, যুদ্ধ হয়েছিল। ঐ যুদ্ধ দীর্ঘ হয়ে অনেক দিন চলার পরে সালাউদ্দিন আইয়ুবীর হাতে শেষ পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দিস  উদ্ধার হল। ঐ যুদ্ধের শুরু হয়েছিল ক্লেমোফেরা থেকে।
আল্লাহর কি শান, ইসরাইলে প্রথম তাবলীগের জামাত গেল এই ক্লেমোফেরা থেকে। ক্লেমোফেরা থেকেই প্রথম জামাত গেল; কোন মুসলমান দেশ থেকে ওখানে জামাত যেতে পারে না। ফ্রান্স থেকেই গেল। ওখানে আমাদের একজন সাথী আছে আব্দুল করীম; ও আমাদের দেশেও সময় লাগিয়েছিল। আব্দুল করীম পয়লা জামাত নিয়ে গিয়েছিল। [সুবহানাল্লাহ] প্রথম গিয়ে যখন তারা তেল-আবিব (ইসরাইলের রাজধানী) এয়ারপোর্টে নামল; ওদেরকে দেখেই ইমিগ্রাশনে বুঝতে পেরেছে যে এরা তাবলীগের জামাত। কিন্তু জামাত এসেছে ফ্রান্স থেকে, ফ্রেঞ্চ পাসপোর্ট। আর শুধু ফ্রেঞ্চ পাসপোর্ট নয়, পাসপোর্টে যে নাম সেটাও ফ্রেঞ্চ নাম। আর শুধু তাই নয়; ওদের চুলও কালো নয় আর চোখও কালো নয়, নীল চোখ ওয়ালা। ধরবার কোন উপায় নাই; পুরোপুরি ফ্রেঞ্চ বংশোদ্ভুত, ১০০% ফ্রেঞ্চ। ওরা গিয়ে প্রথম ইসরাইলে তাবলীগের কাজ করে এসেছে। এটা হল ১৯৯৩ সালে।
১০৯২ এ প্রথম জামা বছর আগে যে শহর থেকে ক্রুসেডের জামাত গিয়েছিল, এক হাজার বছর পরে ঐ শহর থেকেই প্রথম ইসরাইলে তাবলীগের জামাত গেল। [সুবহানাল্লাহ] এখন আল্লাহর ফজলে তবলীগের কাজ আছে, (আর) দুই দেশের মধ্যে খুব আনাগোনা। যখনই ফ্রান্সে যাই; প্রত্যেক বারই ইসরাইলের জামাত কিছু না কিছু দেখা যায়। ওরা ওখানে সময় লাগাতে আসে, ওদের ভিসার প্রয়োজনও নাই আর ফ্রান্সের জামাত যায় ওখানে। তো আল্লাহর মেহেরবানীতে ওখান থেকেই প্রথম জামাত গিয়েছে আর ঐ যে বললাম ২৩ টা দেশে কাজ উঠিয়েছে তার মধ্যে একটা হল ইসরাইল। আল্লাহর মেহেরবাণীতে এখন কাজ হচ্ছে।
ঐ সময় যখন জামাতে গিয়েছিলাম, জামাত ক্লেমোফেরাতেও গিয়েছিল; আর ঐ ক্লেমোফেরাতেই আব্দুর নূরের সংগে প্রথম দেখা হয়েছিল (স্যারের সঙ্গে বসে আছেন)। তখন উনি ছাত্র; ছাত্র ছিলেন ফাইন আর্টসের। ফ্রান্স হচ্ছে ফাইন আর্টসের দেশ, শিল্পকলার দেশ। উনি শিল্পকলা ছাত্র ছিলেন, তার এক বছর পর ১৯৭৭ সালে আমাদের দেশে সময় লাগাতে এসেছিলেন। তখন গ্রামাঞ্চলে গিয়ে গাস্ত করেছিলেন; আমাদের দেখাও হয়েছিল। মাঝখানে আরও এসেছিলেন। আল্লাহর মেহেরবানি এখন আবার এসেছেন। আমাদের ফাযায়েলে আ’মাল এর ফ্রেঞ্চ যে অনুবাদ আছে, সেটা এই আব্দুর নূর আর রবীয়া নামের আরেক সাথি, এই দুইজন মিলে করেছেন। হযরতজী রহঃ এর সরাসরি আদেশে। আলীগড়ে অনেকদিন থাকার সুবাদে হযরতজী রহঃ এর পরিবারের সাথেও খুব ভাল সম্পর্ক ছিল। হযরতজী এনামুল হাসান রহঃ খুব স্নেহের নজরে এনাদেরকে দেখতেন, আর খুব ঘনিষ্টতাও ছিল। হযরতজী এনামুল হাসান রহঃ ই এনাদেরকে বলেছেন অনুবাদ করতে। আল্লাহর ফজলে হয়েওছে এবং তালীমও হয়।
আল্লাহর মেহেরবানি; আমাদের কাছে উনাকে এনেছেন; আমরা উনার মুখ থেকে কিছু কথা শুনব ইনশাআল্লাহ।
سُبْحَانَ اللّهِ وَ بِحَمْدِهَ سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ أَشْهَدُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنْتَ أَسْتَغْفِرُكَ وَأَتُوبُ إِلَيْك  سُبْحَانَ رَبِّكَ رَبِّ الْعِزَّةِ عَمَّا يَصِفُون وَسَلَامٌ عَلَى الْمُرْسَلِينَ وَالْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ      

Link -01     Link-02        Link-03

No comments:

Post a Comment