Monday, October 26, 2015

প্রচলিত ভুল : মাসিক আলকাউসার; গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মুখপত্র -part 1

যিলহজ্ব ১৪৩৩ . নভেম্বর ২০১২

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৮ . সংখ্যা: ১০

একটি ভুল দরূদ : দরূদে হাজারীর ফযীলত

এক এলাকার গোরস্থানে প্রবেশের মুখেই দেখলাম বড় করে সাইনবোর্ড তৈরি করে অতি যত্নের সাথে দরূদে হাজারী নামে একটি দরূদ লিখে রেখেছে।
নিচে ফযীলত হিসেবে লেখা আছে, ‘কবরের নিকট গিয়ে এই দরূদ তিনবার পাঠ করিলে ঐ কবর ওয়ালার চল্লিশ বছরের কবরের আযাব মাফ হইয়া যাইবে।’ 
এ ধরনের দরূদ ও ফযীলতের কোনো ভিত্তি নাই। এছাড়া এতে না আছে দরূদের নূর, না আছে সাহিত্যের মাধুর্য; বরং এর ভাষায়ই রয়েছে কিছু অসৌজন্যমূলক শব্দ।
আমাদের উচিত এ ধরনের ভিত্তিহীন কথা বিশ্বাস না করা এবং মানুষকে সঠিক বিষয় জানানো। গোরস্থানের পরিচালনা কমিটির সাথে যোগাযোগ করে ঐ স্থলে কবর যিয়ারতের দুআ, যিয়ারতের আদাব, মৃত্যুর স্মরণ-এ জাতীয় আয়াত ও হাদীস লিখে দেওয়া যায়।

আরেকটি ভুল ধারণা : ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন কি শুধু মৃত্যু সংবাদ শুনলে?

আল্লাহ তায়ালা কুরআন মাজিদে ধৈর্য্যশীল মুমিনের গুণাবলী বর্ণনা করে বলেন,
الذين اذا اصابتهم مصيبة قالوا انا لله وانا اليه راجعون.
 (অর্থ) তারা কোনো মুসিবতে অক্রান্ত হলে বলে,
انا لله وانا اليه راجعون
আমরা আল্লাহর এবং নিশ্চয় আল্লাহ্র কাছেই ফিরে যাব। -সূরা বাকারা : ১৫৬
এ আয়াত থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, একজন মুমিন যে কোন ধরনের মুসিবত সামনে আসলেই
انا لله وانا اليه راجعون
বলবে। আল্লাহর ফয়সালা সমর্পিত চিত্তে মেনে নিবে।
অথচ অনেক মানুষ  মনে করেন যে,
انا لله وانا اليه راجعون
শুধু মৃত্যুসংবাদ শুনলে বলতে হয় । এ ধারণা ঠিক নয়। হাদীস শরীফে  এসেছে হযরত উম্মে সালামা রা. বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, মুসলিম যখন কোনো মুসিবতে আক্রান্ত হয় এবং আল্লাহ তাকে যা বলতে বলেছেন তাই বলে, (অর্থাৎ)
اِنَّا ِللهِ وَاِنَّا اِلَيْهِ رَاجِعُوْنَ، اَللّهُمَّ اأْجُرْنِيْ فِيْ مُصِيْبَتِيْ وَاخْلُفْ لِيْ خَيْرًا مِنْهَا.
তখন আল্লাহ তাকে ঐ মুসিবতের উত্তম বদলা এবং আগের চেয়ে উত্তম বিকল্প দান করেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯১৮

একটি ভুল আমল : মসজিদে গিয়ে কি আগে বসতে হয় তারপর নামায পড়তে হয়?

অনেক মানুষকে দেখা যায় তারা মসজিদে এসে প্রথমে একটু বসেন তারপর নামায শুরু করেন। এটি ঠিক নয়। বরং মসজিদে গিয়ে প্রথম কাজ হবে নামায। হাদীস শরীফে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যখন কেউ মসজিদে প্রবেশ করবে তখন যেন দুই রাকাত নামায পড়া ছাড়া না বসে। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১১৬৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭১৪
মোটকথা মসজিদে প্রবেশ করে প্রথম কাজ হবে নামায, যদি তা নামাযের সময় হয়ে থাকে। মসজিদে প্রবেশের পর পর্যাপ্ত সময় থাকলে তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়বে, সে সময় না থাকলে নির্ধারিত ওয়াক্তের সুন্নত পড়বে সেটাই তাহিয়্যাতুল মসজিদ বলে গণ্য হবে।

একটি ভুল ধারণা : টাখনুর উপর কাপড় কি শুধু নামাযের সময়?

অনেক সময় দেখা যায় জামাত শুরু হওয়ার আগে মুসল্লীদের কেউ কেউ নিজেদের পাজামা, প্যান্ট ইত্যাদি টাখনু গিরার উপর তুলে নিচ্ছেন বা ইমাম সাহেব বলে দিচ্ছেন, কাপড় টাখনুর উপর তুলে নিন। এতে মনে হয় যেন শুধু নামাযের সময়ই কাপড় টাখনুর উপর তুলতে হবে; এ বিষয়টি শুধু নামাযের সাথে সম্পৃক্ত, আসলে বিষয়টি
এমন নয়।
নামাযের ভিতরে-বাইরে সর্বাবস্থায় কাপড় টাখনুর নিচে পরা কবীরা গুনাহ। এ বিষয়ে হাদীস শরীফে কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, লুঙ্গির (কাপড়ের) যে অংশ টাখনুর নিচে থাকবে তা জাহান্নামে যাবে। -সহীহ বুখারী, হাদাীস ৫৭৮৭
আরেক হাদীসে এসেছে, যে ব্যক্তি অহংকার বশত কাপড় টাখনুর নিচে ঝুলিয়ে পরবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দিকে ফিরেও তাকাবেন না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৭৯১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৮৫
সুতরাং এ বিষয়ে নিজেও সতর্ক থাকা এবং অন্যদেরও সঠিক বিষয়টি বুঝিয়ে দেয়া জরুরী।

যিলকদ ১৪৩৩ . অক্টোবর ২০১২

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৮ . সংখ্যা: ০৯

একটি ভুল আমল : ইমামকে রুকুতে পেলেও কি ‘ছানা’ পড়তে হবে?

‘ছানা’ পড়া সুন্নত। নামাযে নিয়ত বাঁধার পর প্রথম কাজ হল ছানা পড়া। কেউ একা নামায পড়ুক বা জামাতে উভয় অবস্থায় ছানা পড়তে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেকের যে ভুলটা হয়ে থাকে তা হল, ইমামকে যদি রুকুতে পায় তাহলে প্রথমে তাকবীর বলে হাত বাঁধে তারপর দ্রুত ছানা পড়ে রুকুতে যায়। অনেক সময় ছানা পড়তে পড়তে ইমামের রুকু শেষ হয়ে যায় ফলে ঐ রাকাত ছুটে যায়। এটা ঠিক নয়। এ অবস্থায় ছানা পড়তে হবে না হাতও বাঁধতে হবে না; বরং নিয়ম হল, প্রথমে দাড়ানো অবস্থায় দুহাত তুলে তাকবীরে তাহরীমা বলে হাত ছেড়ে দেবে, তারপর দাঁড়ানো থেকে তাকবীর বলে রুকুতে যাবে। এ ক্ষেত্রে অনেকে আরেকটি ভুল করে থাকে, ইমাম রুকুতে চলে গেছে, এখন দ্রুত রুকুতে শরীক হয়ে রাকাত ধরা দরকার,তা না করে এসময়ও আরবীতে উচ্চারণ করে নিয়ত পড়তে থাকে, ফলে ঐ রাকাত পায় না। এটা আরও বড় ভুল।
নিয়তের বিষয়ে আগেও বলা হয়েছে যে, নিয়ত অর্থ সংকল্প করা, যা দিলের কাজ। উচ্চারণ করে নিয়ত পড়ার কোনো প্রয়োজন নেই। বিষয়টি নিয়ে পূর্বে বিস্তারিত লেখা হয়েছে।

আরেকটি বলার ভুল : ষাট ষাট, বালাই ষাট...

গ্রামের অনেক মহিলা ছোট বাচ্চাদের বদনজর ইত্যাদি থেকে রক্ষার জন্য অনেক সময় বলে বসেন,‘ষাট ষাট বালাই ষাট’। আমাদের গল্প-উপন্যাসেও এ বাক্যটি ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। এটা হিন্দুদের থেকে আমাদের সমাজে প্রবেশ করেছে। বাংলা একাডেমী ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে ষাট শব্দের অধীনে লিখেছে, ষাট: উচ্চারিত কোন অশুভ কাজের প্রতিবিধান বা প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ষষ্ঠীদেবীর নাম উচ্চারণ (ষাট ষাট, বেঁচে থাকুক বালাই ষাট ও কথা বলতে নেই)
প্রথম কথা হল, এখানে ষাট বলে কোন মুসলিমই হয়তো হিন্দুদের ষষ্ঠীদেবী উদ্দেশ্য নেয় না। কিন্তু পৌত্তলিক সমাজের বিশ্বাসের বাহক বিশেষ শব্দগুলো পরিহার করাই ইসলামের শিক্ষা। তাছাড়া সহীহ আকীদা-বিশ্বাসের সাথে সাথে মুসলিমের উচ্চারণও সঠিক ও সুন্দর হওয়া জরুরী। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথা বলার ক্ষেত্রেও বাক্যের উত্তম-অনুত্তমের প্রতি লক্ষ্য রাখতেন এবং এক্ষেত্রে সাহাবীদের সামান্য ভুলও শুধরে দিতেন। সেখানে কোনো বাক্য যদি পৌত্তলিক সমাজের বিশ্বাসের বাহক হয় তাহলে তা যে বর্জনীয় একথা বলারই অপেক্ষা রাখে না। এক সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এলেন এবং প্রবেশের অনুমতি চেয়ে বললেন,আ আলিজু? (এ শব্দে অনুমতি চাওয়া শুনে) নবীজী খাদেমকে বললেন, সে সুন্দর করে অনুমতি চাইতে জানে না। যাও তাকে বল, সে যেন প্রথমে সালাম দেয় তারপর (আ আলিজু শব্দের পরিবর্তে) আ-দ্খুলু বলে অনুমতি চায়। তখন তিনি সালাম দিয়ে আ-দ্খুলু বলে অনুমতি চাইলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে প্রবেশের অনুমতি দিলেন...।-
মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২৩১২৭
এখানে ‘আ আলিজু’ ও ‘আ-দ্খুলু’ দুটি শব্দের অর্থই ‘আমি কি প্রবেশ করতে পারি?’ কিন্তু দ্বিতীয়টি প্রথমটির চেয়ে উত্তম ও সুন্দর। এ জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দ্বিতীয়টি বলতে শেখালেন।
আর সন্তানদের বদ নজর ইত্যাদি থেকে কীভাবে রক্ষা করতে হবে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা উম্মতকে শিখিয়েছেন। সহীহ বুখারীর এক হাদীসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হুসাইন রা. এর জন্য এই দোয়া পড়ে আল্লাহর আশ্রয় চাইতেন-
أُعِيْذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَهَامَّةٍ وَمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ
অর্থ : সকল শয়তান, কীটপতঙ্গ ও বদনজর হতে তোমাদেরকে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কালিমাসমূহের আশ্রয়ে দিচ্ছি।
দোয়াটি এক সন্তানের জন্য পড়লে ‘উয়ীযুকা’, দুইজনের জন্য ‘উয়ীযুকুমা’ আর দুইয়ের অধিক হলে ‘উয়ীযুকুম’ বলতে হবে। এর সাথে আয়াতুল কুরসী, তিন কুল ও হাদীসের অন্যান্য  দোয়া তো আছেই।

একটি বলার ভুল : আপনি আমার লক্ষ্মী!

সাধারণত ব্যবসায়ী-দোকানদারদের মুখে এমন কথা শোনা যায়। প্রথম খরিদ্দার বা  সারাদিন বেচাকেনা হচ্ছে না বা ভালো বেচাকেনা হচ্ছে না হঠাৎ একজন বড়সড় খরিদ্দার এল ও অনেক লাভ হল, তখন বলে, ভাই! আপনি আমার লক্ষ্মী! এমনকি খোদ কাস্টমারকেই লক্ষ্মী বলতে শোনা যায়।
এটিও একটি মারাত্মক ভুল ও শিরকী কথা, যা আকীদা-বিশ্বাসকে কলুষিত করে। হিন্দুদের থেকে এটা মুসলমানদের মাঝে প্রবেশ করেছে। লক্ষ্মী হল, যাকে হিন্দুরা ধন-ঐশ্বর্য ও সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী মনে করে।
ব্যবসা ভালো হওয়া, মন্দ হওয়া  আল্লাহর হাতে। এর সাথে লক্ষ্মীর কী সম্পর্ক?
আল্লাহ বলেন,(অর্থ) তারা কি জানে না, আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা রিযিক প্রশস্ত করেন যার জন্য ইচ্ছা সীমিত করেন। এতে রয়েছে মুমিনদের জন্য নিদর্শন।-সূরা যুমার, ৫২
মুমিনের কাজ হল ভালো হলে শুকরিয়া আদায় করা আর মন্দ হলে সবর করা। হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুমিনের বিষয় কতই না সুন্দর। তার সকল অবস্থা তার জন্য কল্যাণকর। আর এটা একমাত্র মুমিনেরই বৈশিষ্ট্য। যদি সে নেয়ামত ও সুখ লাভ করে তাহলে সে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে। ফলে তা তার জন্য কল্যাণকর হয়। আর যদি সে মুসিবতে আক্রান্ত হয় তাহলে সবর করে। ফলে এ অবস্থাও তার জন্য কল্যাণকর হয়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৯৯৯

একটি ভুল বিশ্বাস : কিয়ামতের আলামত : বেগুন গাছ তলায় হাট বসবে

কিছু লোককে বলতে শোনা যায় যে, কিয়ামতের একটি আলামত হল, মানুষ ছোট হতে হতে এত ছোট হবে যে, বেগুন গাছ তলায় হাট বসবে। এটি একটি ভুল বিশ্বাস, যা একেবারেই ভিত্তিহীন।
একটি ইসরায়িলী রেওয়ায়াতে ইয়াজুজ মাজুজ সম্বন্ধে এমন কথা পাওয়া যায় যে, তাদের কারো দৈর্ঘ্য এক বিঘত, কারো দুই বিঘত। আর তাদের যারা সবচেয়ে লম্বা তারা তিন বিঘত...। কিন্তু এ রেওয়ায়াতের কোনোই ভিত্তি নেই। (দেখুন, আল ইসরায়ীলিয়্যাত ওয়াল মাওযূআত পৃ.২৩৯)
বহু হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কিয়ামতের বিভিন্ন আলামতের কথা বলেছেন। কোথাও এমন কথা নেই। সুতরাং এ ধরনের ভিত্তিহীন কথা বলা বা বিশ্বাস করা কোনোটিই ঠিক নয়।

শাওয়াল ১৪৩৩ . সেপ্টেম্বর ২০১২

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৮ . সংখ্যা: ০৮

একটি ভুল মাসআলা : নাম বদলালে কি আকীকা দোহরাতে হয়?

কারো ভুল নাম রাখা হলে তা পরিবর্তন করে সঠিক নাম রাখা জরুরি। কিন্তু নাম বদলালে নতুন করে আকীকাও করতে হয়-এই ধারণা ঠিক নয়। এক্ষেত্রে প্রথম আকীকাই যথেষ্ট। নতুন আকীকা জরুরি নয়, মুস্তাহাবও নয়।

একটি ভুল রীতি : খতম কি বখশানো জরুরি?

ইতিপূর্বে লিখেছি কিনা মনে নেই। আমি গ্রামে দেখেছি এবং কেউ কেউ ফোন করেও জানিয়েছেন যে, সাধারণত মেয়েদের মাঝে এই রেওয়াজ আছে যে, রমযানে তাঁদের খতম সমাপ্ত হওয়ার পর মসজিদের ইমাম সাহেবকে তা জানানোর ইহতিমাম করা হয় যে, অমুক কুরআন খতম করেছে, তা বখশে দিন! কোথাও কোথাও এ কথা জানানোর সাথে সাথে বখশানেওয়ালার জন্য কিছু হাদিয়া পাঠানোরও রেওয়াজ আছে।
এই রেওয়াজের মধ্যে এমন অনেক বিষয় আছে, যা বর্জনীয়। যেমন
ক. কুরআন খতম করা একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ-ইবাদত। কেউ খতম করলে এটা জরুরি নয় বা এমন কোনো বিধান নেই যে, তা বখশাতেই হবে। হ্যাঁ, কেউ কোনো নেক আমল করে মৃত মুসলিমদের জন্য ছওয়াব রেসানী করতে চাইলে তার অনুমতি আছে। কিন্তু না এটা কুরআন-খতমের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ, না রমযান মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। তাছাড়া একটি মোবাহ কাজকে জরুরি কাজের মতো গুরুত্ব দেওয়াও সমীচীন নয়।
খ. ছওয়াব রেসানীর জন্য আমলের আগে বা পরে এই নিয়তই যথেষ্ট যে, আমলটি অমুকের পক্ষ থেকে করা হয়েছে। তদ্রূপ অন্তরের এই দুআই যথেষ্ট যে, আয় আল্লাহ! এই আমলের ছওয়াব অমুক অমুককে দান করুন বা সকল মৃত মুসলমানকে দান করুন। ছওয়াব রেসানীর জন্য এ-ই যথেষ্ট। ইমাম সাহেব, বা কোনো বুযুর্গের মাধ্যমে বখশানোর কোনো প্রয়োজন নেই। কোনো বুযুর্গের দ্বারা বখশানো ছাড়া ছওয়াব পৌঁছবে না এমন ধরণা একটি ভুল আকীদা, যা ত্যাগ করা জরুরি।
গ. বখশানোর জন্য হাদিয়া দেওয়া বা নেওয়ার বিষয়টিও বর্জনীয়। আমল বখশানো অর্থ দুআ করা। আর দুআ একটি খালিস ইবাদত, যার বিনিময়ে হাদিয়ার আদান-প্রদান জায়েয নয়।
এছাড়া এভাবে ইমাম সাহেবের দ্বারা আমল বখশানোর রীতির কারণে মেয়েদের নাম এবং তাদের খতম বা খতমের সংখ্যা ইত্যাদি গোপন বিষয় মানুষের সামনে আসে। কোনো প্রয়োজন ছাড়া এমনটি করার কী যুক্তি? তো সব বিচারেই এই রসম বর্জনীয়।

একটি ভুল ধারণা : দুরূদে ইবরাহীমী কি শুধু নামাযে পড়ার জন্য?

জনৈক খতীব সাহেব ফোনে বললেন, আলকাউসারের এই বিভাগে আমি যেন এ বিষয়ে লিখি। তিনি বললেন, আমি কয়েকজনকে দেখেছি, তারা দরূদে ইবরাহীম, যা নামাযের শেষ বৈঠকে পড়া হয়, শুধু নামাযে পড়ার দরূদ মনে করে। নামাযের বাইরে এই দরূদ পড়া বা তাকে অযীফা বানানো মুনাসিব মনে করে না।
খতীব সাহেবের আপত্তি সঠিক। কারণ এই দরূদ শুধু নামাযের মাঝে সীমাবদ্ধ নয়। একথা বিভিন্ন রেওয়ায়েতে আছে যে, নামাযে পড়ার জন্য এই দরূদ শেখানো হয়েছে। কিন্তু এর অর্থ কখনো এই নয় যে, ঐ কারণে দরূদটি নামাযের সাথে খাস হয়ে যাবে। নামাযে তো তিলাওয়াত, তাসবীহ, তাকবীর ইত্যাদি কত বিষয় আমরা আদায় করে থাকি। এই সব বিষয় কি শুধু নামাযের বিষয়? নামাযের বাইরে কি এগুলো করা যায় না? নামাযে আমরা কতবার ‘আল্লাহু-আকবার’ বলি। কিন্তু নামাযের বাইরেও তো ‘আল্লাহু-আকবার’ যিকির করে থাকি।
আহলে ইলম এবং আকাবির ও মাশাইখ এই দরূদ নিজেদের রচনা ও বক্তৃতায় ব্যাপকভাবে এনে থাকেন। সুতরাং নামাযের বাইরে তা পাঠ করা বা অযীফা বানানোতে কোনো অসুবিধা নেই।

শাবান-রমযান-১৪৩৩ . জুলাই-আগস্ট-২০১২

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৮ . সংখ্যা: ০৭

একটি মারাত্মক ভুল কর্মপন্থা : দলিল নয়, এমন বিষয়কে দলিল বানানো

শরীয়তের দলিল কী কী এবং কোন প্রকারের দলিল দ্বারা কী বিধান প্রমাণিত হয় তা দ্বীন ও শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কুরআন-সুন্নাহর আলোকে এর ফয়সালা হতে পারে এবং হয়ে আছে। শরীয়তের দলিল-প্রমাণ কয়টি ও কী কী-এ সম্পর্কে কমবেশি সকল মুসলমান অবগত আছেন। কিন্তু আহলে বিদআত ও আহলে বাতিল সব সময় নিজেদের পক্ষ থেকে নতুন নতুন দলিল উদ্ভাবন করতে থাকে। যেন নিজেদের বিদআত ও বাতিল বিষয়ের পক্ষে দলিল-প্রমাণ উপস্থাপনে বেগ পেতে না হয়। আজকাল অজ্ঞতার এত ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে যে, ভালো ভালো শিক্ষিত মানুষকে আশ্চর্য বিভ্রান্তির শিকার হতে দেখা যায়। যেমন কোনো রেওয়ায়েতকে হাদীস হিসেবে কিংবা কোনো নবীর ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করার জন্য শুধু এটুকুই যথেষ্ট মনে করা হয় যে, তা কোনো গল্পকারের মুখে শুনেছেন অথবা কোনো বইয়ে পেয়েছেন।  এতটুকু খোঁজখবর নেওয়ারও প্রয়োজন বোধ করেন না যে, ঐ রেওয়ায়েত বা ঘটনাটি ইলমে হাদীসের নির্ভরযোগ্য কোনো কিতাবে আছে কি না, তার কোনো সনদ আছে কি না; সনদ থাকলে তা গ্রহণযোগ্য কি না।
নিজে তাহকীক করতে না পারলে কমপক্ষে এতটুকু খোঁজ নেওয়া তো অতি জরুরি যে, ইলমে হাদীসের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ও নির্ভরযোগ্য মনে করা হয় এমন কোনো আলিম সেটাকে গ্রহণযোগ্য ও বর্ণনার উপযোগী বলেছেন কি না।
কোনো প্রকার তাহকীক ছাড়া শুধু কোনো কিতাব বা রিসালায় আছে বলেই তা প্রচারের চেষ্টা করা কোনো বিবেকবান ও দায়িত্বশীল মানুষের কাজ হওয়া উচিত নয়। 
শরীয়তের নিয়ম এই যে, কোনো রেওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য ইলমে রেওয়ায়েত-বিশেষজ্ঞদের নিকট তা স্বীকৃত ও সমাদৃত হওয়া জরুরি। কমপক্ষে নির্ভরযোগ্য কোনো কিতাবে গ্রহণযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হতে হবে। কেবল সাধারণ মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধি ও প্রচলনের কোনো গ্রহণযোগ্যতা নেই। তেমনি কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন লেখকের কিংবা  সিহহতের শর্ত করেননি এমন কোনো লেখকের উদ্ধৃতি ও সনদবিহীন বর্ণনাও নির্ভরযোগ্য নয়। অধিকাংশ মনগড়া ও মওযূ রেওয়ায়েত তো কোনো না কোনো বইয়েই লেখা থাকে শুধু এ কারণেই কি তা গ্রহণযোগ্য হয়ে যাবে? নাউযুবিল্লাহ।
মনে রাখা উচিত, কোনো বে-সনদ রেওয়ায়েত সনদহীন হওয়ার পাশাপাশি যদি মুনকারও হয় এবং তার মতনে শরীয়তের দৃষ্টিতে আপত্তিকর কিছু থাকে, কোনো মাসুম ব্যক্তির মাকাম ও মর্যাদা ক্ষুণ্ণকারী কোনো বিষয় তাতে থাকে তাহলে তা ওয়াজ-নসীহতে বর্ণনা করা কিংবা আমলের জন্য লিখিত কিতাবসমূহে লিখে দেওয়া আরো মারাত্মক গুনাহ।   
আলকাউসারের কোনো এক সংখ্যায় এ ধরনের বে-সনদ মনগড়া ও আপত্তিকর একটি রেওয়ায়েতকে বাতিল ও ভিত্তিহীন বলা হয়েছিল। আর মুনকার হওয়ার কারণে বলা হয়েছিল যে, এ ধরনের আকীদা পোষণ করা জায়েয নয়। এক ভাই ফোন করে বললেন, ‘ঐ রেওয়ায়েত বর্ণনা করা বা তার আকীদা পোষণ করা নাজায়েয হল কীভাবে এ তো অমুক অমুক ব্যক্তি উল্লেখ করেছেন!’ অথচ ঐ অমুক অমুক ব্যক্তি না ইলমে রেওয়ায়েতের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন, না নিজেদের কিতাবে প্রতিটি রেওয়ায়েত যাচাই-বাছাই করে শুধু গ্রহণযোগ্য রেওয়ায়েত উল্লেখ করার নীতি গ্রহণ করেছিলেন।
এজন্য ইলমে রেওয়ায়েতের বিশেষজ্ঞদের উদ্ধৃতিতে যদি কোনো রেওয়ায়েতকে ভিত্তিহীন লেখা হয় এবং এর বিপরীতে ইলমে রেওয়ায়েতের অন্য বিশেষজ্ঞ ব্যক্তির সিদ্ধান্ত না থাকে তবে অমুক অমুক ব্যক্তি তা লিখেছে-শুধু এ কথা বলে তা বর্জন করা ভুল।
হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. ‘আততাকাশশুফ’-এ বলেছেন, এই রেওয়ায়েত ভিত্তিহীন হওয়ার বিষয়টি যেহেতু অমুক অমুক ব্যক্তির জানা ছিল না তাই তারা মাজূর হবেন। কিন্তু আহলে ফনের উদ্ধৃতিতে সঠিক বিষয়টি তোমাদের সামনে আসার পর তোমরা আর মাজূর গণ্য হবে না। তোমাদের জন্য এখন এ বিষয়ে অমুক অমুকের অনুসরণ করা জায়েয নয়।

হাকীমুল উম্মতের এই কথা আমাদের সব সময় স্মরণ রাখা উচিত। আলকাউসারে যাকারিয়া আ.-এর যে ঘটনা সম্পর্কে লেখা হয়েছিল তা একটি ইসরাইলী রেওয়ায়েত। উপরন্তু কোনো কোনো কেচ্ছাকার তার সাথে এ কথাও যোগ করেছে যে,-নাউযুবিল্লাহ-যাকারিয়া আ. যেহেতু আল্লাহ তাআলার পরিবর্তে গাছের নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করেছিলেন এজন্য আল্লাহ তাআলা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়েছেন। এরপর করাত চলার সময় যখন তিনি উহ! বলতে লাগলেন তখন আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করলেন, যদি তুমি উহ বল নবুওয়তের তালিকা থেকে তোমার নাম বাদ দেওয়া হবে!! নাউযুবিল্লাহ।
এই বর্ধিত অংশটুকু কোনো ইসরাইলী রেওয়ায়েতে পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন হল, এই মনগড়া ও ভিত্তিহীন কথা বিশ্বাস করাকে (আকীদা পোষণ করা) যদি নাজায়েয বলা হয় তবে কি এতেও আপনি আপত্তি করবেন?
আফসোস যে, এক মুরববী চিঠি লিখেছেন, ‘‘পান্দে নামা’’র অমুক পংক্তিতে তো এই ঘটনার দিকে ইঙ্গিত আছে। আর বাংলা অনুবাদক এর টীকায় সে ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
আফসোসের বিষয় এই যে, তিনি পান্দেনামার ইশারাকেও সহীহ-যয়ীফ নির্ণয়ের মানদ  বানিয়ে নিয়েছেন। অথচ তিনি বা অনুবাদক কবির ইশারা যথার্থ অনুধাবন করতে পেরেছেন-এটাও তো অপরিহার্য নয়। এ কথা কার জানা নেই যে, আত্তার রাহ.-এর কিতাব থেকে উপদেশ-নসীহত গ্রহণ করা যায়, কিন্তু শুধু তাঁর কিতাবে উল্লেখ থাকার কারণে কোনো রেওয়ায়েতকে সহীহ বলা যায় না। এটা নির্ণয়ের জন্য ইলমে হাদীসের আলিমগণের নিকট জিজ্ঞাসা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমল করতে হবে। এ প্রসঙ্গে ‘তালীমুদ্দীন’ কিতাবে উল্লেখিত হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর সাবধান বাণী গুরুত্ব সহকারে লক্ষ্য রাখা উচিত।
আমরা যদি এই নির্দেশনা অনুযায়ী আমল না করি তাহলে আমাদের ও আহলে বিদআতের মাঝে কী পার্থক্য থাকবে?
শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রাহ.-এর এই কথাও সোনার হরফে লিখে রাখার মতো। একটি দীর্ঘ চিঠিতে তিনি লিখেছেন-মাসআলার ক্ষেত্রে ভক্তিকে স্থান দেওয়া উচিত নয়। ভালো করে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া উচিত।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আসলাফের পদাঙ্ক অনুসরণের তাওফীক দান করুন, যারা ছিলেন হেদায়েতপ্রাপ্ত, সুন্নাহর অনুসারী ও তাহকীকপ্রেমী।

আবু আবদুর রশীদ মুহাম্মাদ আবদুল মালেক   

রজব-১৪৩৩ . জুন-২০১২

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৮ . সংখ্যা: ০৬

তালাক সম্পর্কিত কিছু ভুলত্রুটি

এ সংখ্যায় শুধু এ বিষয়ে আলোচনা করাই মুনাসিব মনে হল। একটি কথা তো বারবার লেখা হয়েছে, ওলামা-মাশায়েখও আলোচনা করে থাকেন যে, অতীব প্রয়োজন (যা শরীয়তে ওজর বলে গণ্য) ছাড়া স্বামীর জন্য যেমন তালাক দেওয়া জায়েয নয় তেমনি স্ত্রীর জন্যও তালাক চাওয়া দুরস্ত নয়। তালাকের পথ খোলা রাখা হয়েছে শুধু অতীব প্রয়োজনের ক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য। বর্তমান সমাজে, বিশেষ করে আমাদের এতদাঞ্চলে কোনো পরিবারে তালাকের ঘটনা যে কত ফাসাদ-বিশৃঙ্খলা, জুলুম-অত্যাচার এবং ঝগড়া-বিবাদের কারণ হয় তা আর বলে বোঝানোর প্রয়োজন নেই। তালাক প্রদানের ক্ষমতাকে শরীয়তের নির্ধারিত নীতিমালার বাইরে ব্যবহার করা নিঃসন্দেহে আল্লাহর বিধানের সাথে বালখিল্যতার শামিল।
এজন্য কেউ দাম্পত্য জীবনে পা রাখার চেষ্টা করলে তার অপরিহার্য কর্তব্য হবে, বিয়ের আগেই দাম্পত্য জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় মাসআলাগুলোর সাথে  তালাকের বিধানসমূহ জেনে নেওয়া।
তালাক অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি বিষয়। কেউ এই ক্ষমতার অপব্যবহার করলে কিংবা ভুল পন্থায় তা প্রয়োগ করলে সে একদিকে যেমন গুনাহগার হবে অন্যদিকে তালাকও কার্যকর হয়ে যাবে। তাই প্রতিটি বিবেচক স্বামীর দায়িত্ব হল, তালাকের শব্দ কিংবা এর সমার্থক কোনো শব্দ মুখে উচ্চারণ করা থেকে সতর্কতার সাথে বিরত থাকা।
অবশ্য অতীব প্রয়োজনে তালাক প্রদানে বাধ্য হলে স্ত্রীর পবিত্র অবস্থায় শুধু এক তালাক দিয়ে ক্ষান্ত হওয়া উচিত। এভাবে বলবে যে, ‘তোমাকে তালাক দিলাম।’ তালাকের সাথে ‘বায়েন’ শব্দ কিংবা ৩ সংখ্যা ব্যবহার করবে না। কেউ ‘বায়েন’ শব্দ বলে ফেললে (চাই তা এক বা দুই তালাক হোক না কেন) নতুন করে শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ দোহরানো ছাড়া স্ত্রীর সাথে পুনরায় মিলনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
অনুরূপভাবে তিন তালাক দিয়ে ফেললে-একই মজলিসে পৃথক পৃথকভাবে তিন তালাক দেওয়া হোক কিংবা একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া হোক- যেমন বলল, তোমাকে তিন তালাক দিলাম। অথবা আগে কখনো দুই তালাক দিয়েছিল আর এখন শুধু এক তালাক দিল। সর্বমোট তিন তালাক দেওয়া হল। যেকোনো উপায়ে তিন তালাক দেওয়া হলে বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়ে যায়। এ অবস্থায় শুধু মৌখিকভাবে স্ত্রীকে বিবাহে ফিরিয়ে আনার যেমন কোনো সুযোগ থাকে না তেমনি নতুন করে বিবাহ দোহরানোর মাধ্যমেও ফিরিয়ে নেওয়ার পথ খোলা থাকে না।
একসাথে তিন তালাক দেওয়া কিংবা বিভিন্ন সময় তালাক দিতে দিতে তিন পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া একটি জঘণ্য অপরাধ ও ঘৃণিত কাজ। আল্লাহ তাআলা এর শাস্তি হিসেবে এই বিধান দিয়েছেন যে, তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে পুনরায় একসাথে বসবাস করতে চাইলে স্ত্রীর ইদ্দত অতিবাহিত হওয়ার পর অন্যত্র তার বিয়ে হওয়া এবং সে স্বামীর সাথে তার মিলন হওয়া অপরিহার্য। এরপর কোনো কারণে সে তালাকপ্রাপ্তা হলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে ইদ্দত পালনের পর এরা দুজন পরস্পর সম্মত হলে নতুন করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে। 
এজন্য শরীয়ত আগেই সাবধান করে দিয়েছে যে, প্রথমত তালাকের কথা
চিন্তাও করবে না। তবে অতীব প্রয়োজনে কখনো তালাক প্রদানের প্রয়োজন হলে শুধু সাদামাটা তালাক দাও, শুধু এক তালাক। যেন উভয়ের জন্যই নতুন করে চিন্তা-ভাবনার সুযোগ থাকে এবং পুনরায় ফিরে আসার পথ খোলা থাকে। এরপর আবারো কোনো সমস্যা দেখা দিলে এভাবেই শুধু এক তালাক দিবে। এখনও ফিরে আসার পথ খোলা থাকবে।
কিন্তু এরপর যদি আবার কখনো শুধু এক তালাকই দেওয়া হয় এবং সব মিলে তিন তালাক হয়ে যায় এ অবস্থায় আর তাকে ফিরিয়ে আনারও সুযোগ থাকবে না, নতুন করে বিয়ে করার বৈধতাও বাকি থাকবে না।
আজকাল স্বামী-স্ত্রী তালাকের বিধান জানা ও সে অনুযায়ী আমল করার পরিবর্তে নিজেদের মনে এমনসব ভুল ও বানোয়াট মাসআলা স্থির করে রাখে যে, আল্লাহ মাফ করুন।
১. তিন তালাক ছাড়া কি তালাক হয় না
যেমন, কেউ মনে করে যে, শুধু এক বা দুই তালাক দেওয়ার দ্বারা তো তালাকই হয় না। তালাকের জন্য একসাথে তিন তালাক দেওয়াকে তারা অপরিহার্য মনে করে।
মনে রাখবেন, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। তালাক দেওয়ার সঠিক পদ্ধতি হল, শুধু এক তালাক দেওয়া। পরবর্তীতে আবারও প্রয়োজন হলে শুধু এক তালাকই দিবে। এরচেয়ে বেশি দিবে না। কিন্তু তিন তালাক দিয়ে ফেললে তাদের দাম্পত্য সম্পর্ক বহাল রাখার সকল পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
একই মজলিসে কিংবা একই শব্দে তিন তালাক দেওয়া হারাম ও কবীরা গুনাহ। কিন্তু কেউ এমনটি করলে তালাক কার্যকর হবে এবং তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়ে যাবে।
২. তালাকের সাথে কি বায়েন শব্দ ব্যবহার করা জরুরি
অনেকে মনে করে, শুধু তালাক বললে তালাক হয় না; বরং তালাকের সাথে ‘বায়েন’ শব্দও যোগ করা অত্যাবশ্যক।
এটিও ভুল ধারণা। শুধু তালাক শব্দ দ্বারাই তালাক হয়ে যায়। এর সাথে ‘বায়েন’ শব্দ যোগ করার কোনো প্রয়োজন নেই। উপরন্তু এ শব্দের সংযোজন নাজায়েয। তবে কেউ যদি এক তালাক বায়েন বা দুই তালাক বায়েন দেয় তবে সে মৌখিকভাবে রুজু করার (পুনরায় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করার) পথ বন্ধ করে দিল। এখন শুধু একটি পথই খোলা আছে। আর তা হল, নতুনভাবে শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ দোহরানো। অথচ শুধু তালাক বললে এক তালাক বা দুই তালাক পর্যন্ত মৌখিক রুজুর পথ খোলা থাকে। এজন্য স্বামীর উচিত, যত উত্তেজিতই হোক না কেন, কোনো অবস্থাতেই যেন তিন তালাক না দেয়। এমনকি তা কখনো মুখেও না আনে। অথচ অনেকে তো তিন তালাক দেওয়ার পরও পৃথকভাবে ‘বায়েন’ শব্দ যোগ করেন। যেন সব কটি তালাক দেওয়ার পরও তার মন ভরল না। না হলে তিন তালাক দেওয়ার পর আর কী বাকি থাকে যে, ‘বায়েন’ শব্দ বলতে হবে?!
মনে রাখবেন, তিন তালাক দেওয়াই এক গুনাহ, এরপর ‘বায়েন’ শব্দ যোগ করে সে আরো বেশি গুনাহগার হল।
৩. একসাথে তিন তালাক দিলে কি তালাক হয় না
অনেকে এই ভুল ধারণাও প্রচার করে রেখেছে যে, একসাথে তিন তালাক দেওয়া হলে তালাক হয় না কিংবা শুধু এক তালাক হয়।
এটিও একটি মারাত্মক ভুল। একসাথে তিন তালাক দেওয়া জায়েয না হলেও কেউ যদি এই নাজায়েয কাজ করে তাহলে তার স্ত্রীর উপর তিন তালাক ঠিকই পতিত হয়। এক্ষেত্রে তার মৌখিকভাবে রুজু করার অধিকার অবশিষ্ট থাকে না। এমনকি নতুন করে বিবাহ দোহরিয়ে নেওয়ার দ্বারাও তারা একে অপরের জন্য হালাল হতে পারে না। তাই সকল স্বামীরই কর্তব্য, প্রথম থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা। মুখ দিয়ে কখনো তিন তালাক কিংবা তালাক, তালাক, তালাক শব্দ উচ্চারণ না করা। আর আগেই দুই তালাক দিয়ে থাকলে এখন আর তৃতীয় তালাকের চিন্তাও না করা।
৪. গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক পতিত হয় না
অনেকে এই মাসআলা বানিয়ে রেখেছে যে, গর্ভাবস্থায় স্ত্রীকে তালাক দেওয়া হলে তা কার্যকর হয় না। এটিও সম্পূর্ণ অবাস্তব কথা। গর্ভাবস্থায় হোক বা অন্য যেকোনো অবস্থাই হোক তালাক দেওয়া হলে তা পতিত হয়ে যায়। এজন্য সঠিক মাসআলা শেখা সকলের দায়িত্ব। অজ্ঞতার ধোকায় থাকার কারণে হারাম কখনো হালাল হতে পারে না।
৫. তালাক পতিত হওয়ার জন্য কি সাক্ষীর উপস্থিতি জরুরি
অনেকের ধারণা, স্বামী তালাকের সময় কোনো সাক্ষী না রাখলে তালাক পতিত হয় না। আগেরটার মতো এটাও মানুষের মনগড়া মাসআলা। কোন মূর্খ এই কথা বলেছে জানা নেই। সাক্ষীর প্রয়োজন তো হয় বিবাহের সময়। তালাক পতিত হওয়ার জন্য এক বা একাধিক কোনো সাক্ষীরই প্রয়োজন নেই। স্বামী যদি রাতের অন্ধকারে একা একা বসে তালাক দেয় তাহলেও তালাক হয়ে যায়।
৬. রাগের অবস্থায় তালাক দিলে কি তালাক হয় না
তালাক তো দেওয়াই হয় রাগ হয়ে। কয়জন আছে, শান্তভাবে তালাক দেয়? আসলে তো এমনই হওয়া উচিত ছিল যে, যদি বাস্তবসম্মত ও অনিবার্য প্রয়োজনে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হয় তাহলে বড়দের সঙ্গে পরামর্শ করে একে অন্যের কল্যাণকামী হয়ে বুঝে-শুনে, সঠিক মাসআলা জেনে নিয়ে মাসআলা অনুযায়ী তালাক প্রদানের মাধ্যমে বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করবে।
 কিন্তু আফসোস! অধিকাংশ মানুষ মাসআলা জানার চেষ্টাও করে না, আর না তাদের মধ্যে এই সুবুদ্ধি আছে যে, বড়দের সাথে পরামর্শ করবে, চিন্তা-ভাবনা করবে। নিজের ইচ্ছাবিরোধী কোনো কিছু পেলেই রাগের বশে তালাক দিয়ে ফেলে। আর তা এক বা দুইটি নয়; এক নিঃশ্বাসে তিন তালাক।
যখন রাগ প্রশমিত হয় তখন অনুতপ্ত হয় এবং বিভিন্ন ধরনের কথা বানাতে থাকে। বলে, আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি, তালাক দেওয়ার ইচ্ছা ছিল না। এসব লোকের জেনে রাখা উচিত যে, তালাক পতিত হওয়ার জন্য নিয়তের কোনো প্রয়োজন নেই। এটা কোনো ইবাদত নয় যে, এর জন্য নিয়ত করতে হবে। নিয়ত থাক বা না থাক সর্বাবস্থায় তালাক শব্দ বলে ফেললে বা কাগজে লিখে দিলেই তালাক হয়ে যায়। তেমনিভাবে রাগের অবস্থায় তালাক দিলেও তালাক হয়ে যায়, এমনকি হাস্যরস বা ঠাট্টাচ্ছলে তালাক দিলেও তা পতিত হয়ে যায়।
অবশ্য কেউ যদি প্রচন্ড রেগে যায় ও রাগের ফলে বেহুঁশ হয়ে পড়ে আর এ অবস্থায় সে কী বলেছে তার কিছুই মনে না থাকে তাহলে ঐ অবস্থার তালাক কার্যকর হবে না।
শেষকথা এই যে, দাম্পত্য জীবন আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে অনেক বড় ও বিশেষ একটি নেয়ামত। স্বামী-স্ত্রী সকলের কর্তব্য, এই নেয়ামতের যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং একে অপরের সকল অধিকার আদায় করা। স্ত্রীর জন্য উচিত নয়, কথায় কথায় স্বামীর কাছে তালাক চাওয়া। আবার স্বামীর জন্যও জায়েয নয় আল্লাহ তাআলার দেওয়া ক্ষমতার অপব্যবহার করা।
বিয়ে, তালাক ও দাম্পত্য জীবনের সকল বিধান ও মাসআলা শিক্ষা করা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য জরুরি। বিশেষ করে স্বামীর কর্তব্য হল, তালাকের মাসআলা ও এর পরিণতি সম্পর্কে অবগত না হয়ে মুখে কখনো তালাক শব্দ উচ্চারণ না করা। আর যদি কোনো কারণে তালাক দেয় এবং এমনভাবে দেয় যে, এখন আর তাদের একসাথে থাকা শরীয়তে বৈধ নয় তাহলে তাদের আল্লাহকে ভয় করা উচিত। বিভিন্ন টাল-বাহানা, অজুহাতের আশ্রয় নিয়ে কিংবা ভুল কথার উপর ভিত্তি করে অথবা মূল ঘটনা গোপন রেখে একসাথে বাস না করা উচিত। বিয়ে শুধু একটি সময়ের বিষয় নয়, সারা জীবনের বিষয়।
বাস্তবেই যদি তালাক হয়ে যায় এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ হয়ে যায় এরপরও স্বামী-স্ত্রী হিসেবে একসাথে বাস করে তাহলে তা হবে কবীরা গুনাহ এবং উভয়েই যেন ব্যভিচারের গুনাহয় লিপ্ত।
আল্লাহ তাআলা সকলকে হেফাযত করুন এবং তাকওয়া ও পবিত্রতা দান করুন। আমীন। 

জুমাদাল উখরা-১৪৩৩ . মে-২০১২

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৮ . সংখ্যা: ০৫

একটি ভুল ধারণা : ইস্তিখারার জন্য কি দুআ পড়ে ঘুমাতেই হয়

ইস্তিখারার অর্থ কল্যাণ প্রার্থনা, কল্যাণ সম্পর্কে অবগত হওয়া নয়। তাই ইস্তিখারার হাকীকত এই যে, যে কাজের ইচ্ছা করা হয়েছে সে সম্পর্কে (চিন্তা-ভাবনা ও পরামর্শের পর) দুই রাকাত নফল নামায পড়ে হাদীসে শিখানো দুআ পাঠ করা। যার সারকথা হল, ইয়া আল্লাহ! এ কাজে যদি আমার কল্যাণ থাকে তবে তুমি তা সহজ করে দাও এবং তাতে বরকত দান কর। আর যদি তা আমার জন্য উপযোগী না হয় তবে তা থেকে আমাকে বিরত রাখ এবং যেখানে কল্যাণ আছে সেখানে নিয়ে যাও আর আমাকে তাতে সন্তুষ্ট থাকার তাওফীক দান কর।
সহীহ হাদীসের আলোকে এটাই হল ইস্তিখারার হাকীকত। কিন্তু কেউ কেউ মনে করে, ইস্তিখারার নামায ও দুআ শোয়ার আগে করতে হয়। আর ইস্তিখারার ফলাফল অর্থাৎ কাজটি করা উচিত কি উচিত না-তা স্বপ্নযোগে জানিয়ে দেওয়া হয়। এটি নিঃসন্দেহে ভিত্তিহীন ধারণা। ইস্তিখারার পর কেউ কোনো স্বপ্ন দেখতেও পারে। কিন্তু স্বপ্ন তো ইস্তিখারা ছাড়াও দেখা যায়। স্বপ্নে কোনো কিছু দেখলে তাকে বিচার করতে হবে স্বপ্নের বিষয়ে শরীয়তের যে বিধান আছে তারই ভিত্তিতে। এক্ষেত্রে করণীয় নির্ধারিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শরঈ বিধান অনুযায়ী। আর স্বপ্ন যে কোনো দলিল নয়-এ তো সবাই জানে।
ইস্তিখারা বিষয়ক আরেকটি ভুল হল, দুআ-ওযিফার কোনো কোনো অনির্ভরযোগ্য বইপত্রে ইস্তিখারার যে পদ্ধতি উল্লেখ রয়েছে তা পালন করা। অথচ ইস্তিখারার মাসনুন পদ্ধতি ছেড়ে কারো অভিজ্ঞতা বা উদ্ভাবন গ্রহণ করার কোনো অর্থ হতে পারে না।
ইস্তিখারার একটি নবউদ্ভাবিত ও বিদআতী পদ্ধতি হচ্ছে, কুরআন মজীদ থেকে কিংবা দেওয়ানে হাফেয, মাছনবী ইত্যাদি থেকে ইঙ্গিত গ্রহণ। এটি সম্পূর্ণ ভুল পদ্ধতি। আর কুরআন মজীদ থেকে এ জাতীয় ইঙ্গিত গ্রহণ মূলত কুরআনের সাথে বেআদবী।
আরেকটি ভুল হল, নিজে না করে অন্যকে দিয়ে ইস্তিখারা করানো। অনেকে মসজিদের ইমাম সাহেব অথবা পরিচিত কোনো আলিমের কাছে ইস্তিখারার আবেদন করে থাকেন। অথচ হাদীস শরীফে প্রয়োজনগ্রস্ত ব্যক্তিকেই ইস্তিখারা করতে বলা হয়েছে।
সবচেয়ে মারাত্মক ভ্রান্তি এই যে, কোনো কোনো মানুষ শুধু কাজের ইচ্ছার সময়ই নয়; বরং গায়েবের বিভিন্ন কথা জানার জন্য বে-শরা তদবিরকারীর কাছে যায় এবং এটাকেও  ইস্তিখারা বলে। এমনকি ঐ সকল কথা বিশ্বাসও করে। অথচ গায়েব জানার জন্য কারো কাছে যাওয়া এবং তার কথা বিশ্বাস করা এক প্রকারের শিরক।
আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরনের শিরক থেকে হেফাযত করুন। আমীন।
(বিস্তারিত জানার জন্য অধ্যয়ন করুন : আলমাদখাল, ইবনুল হাজ্ব ৪/৩৬-৪০; হায়াতুল হায়াওয়ান ৩/৩৮; ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন, মুরতাযা যাবী ২/২৮৫। উর্দু দায়েরায়ে মাআরিফে ইসলামিয়া, লাহোরের (২/৫৭১-৫৭৩) প্রবন্ধটিও ভালো।) 

জুমাদাল উলা-১৪৩৩ . এপ্রিল-২০১২

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৮ . সংখ্যা: ০৪
একটি ভিত্তিহীন ধারণা : মুত্তালিব নাম আসমায়ে হুসনা’র অন্তর্ভুক্ত নয়
আবদুল মুত্তালিব নাম রাখার বিধান   
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দাদার নাম ছিল শায়বা। তিনি ছোট থাকতেই তাঁর পিতা হাশিমের ইন্তেকাল হয়ে যায় এবং তিনি নানার বাড়িতে লালিত-পালিত হতে থাকেন। তিনি যখন বালেগ হওয়ার কাছাকাছি বয়সে উপনীত হলেন তখন তাঁর চাচা মুত্তালিব তাকে আনার জন্য মদীনায় গেলেন। ভাতিজাকে উটের পিছনে বসিয়ে তিনি যখন মক্কায় প্রবেশ করছিলেন, তখন যাদের জানা ছিল না তারা ভাবল যে, মুত্তালিব সফর থেকে একটি গোলাম খরিদ করে এনেছেন। তারা শাইবাকে ‘আবদুল মুত্তালিব’ (মুত্তালিবের গোলাম) বলে ডাকতে লাগল। তিনি মানুষকে যতই বললেন, সে আমার ভাতিজা, আমার ভাই হাশেমের পুত্র, কিন্তু শাইবা ‘আবদুল মুত্তালিব’ নামেই প্রসিদ্ধ হয়ে গেলেন।
যারা হাকীকত জানে না এবং আল্লাহ তাআলার আসমায়ে হুসনা সম্পর্কেও যাদের তেমন জানাশোনা নেই তারা কখনো কখনো নিজেদের সন্তানের নাম রাখেন আবদুল মুত্তালিব। তারা হয়তো মনে করে থাকবেন যে, মুত্তালিব আল্লাহ তাআলার কোনো গুণবাচক নাম। অতএব আবদুর রহমান, আবদুর রহীমের মতো আবদুল মুত্তালিবও কারো নাম হতে পারে!
এ ধারণা ঠিক নয়। মুত্তালিব আল্লাহ তাআলার আসমাউল হুসনার অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং এ নাম রাখা যাবে না। 
একটি ভিত্তিহীন ধারণা : দাফনের পর জুমআ বা রমযান এলে কি কিয়ামত পর্যন্ত আযাব মাফ হয়ে যায়
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কবরের আযাব থেকে রক্ষা করুন। আল্লাহ সকল মুমিন নর-নারীকে ক্ষমা করুন, সকলকে বরযখের আযাব থেকে মুক্তি দান করুন, আখিরাতের সকল মঞ্জিল সহজ ও নিরাপদে পার করিয়ে দিন।
কবরের আযাব সত্য। কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এই আযাব থেকে মুক্তির প্রথম শর্ত ঈমান। দ্বিতীয় শর্ত ঈমানের দাবি অনুযায়ী জীবন যাপন, বিশেষত যেসব গুনাহর কারণে কবরে আযাবের কথা বর্ণিত হয়েছে তা থেকে সর্বোতভাবে বেঁচে থাকা এবং যেসব আমলের দ্বারা কবরের আযাব থেকে মুক্তির প্রতিশ্রুতি বর্ণিত হয়েছে সেসব আমল গুরুত্বসহকারে করা।
এখানে আমি যে কথাটি বলতে চাচ্ছি তা এই যে, কাউকে বলতে শোনা যায়, কৃত গুনাহর কারণে যার কবরে আযাব হওয়ার কথা তার দাফনের পর যখনই কোনো জুমআ বা রমযান আসে তখন থেকে কিয়ামত পর্যন্ত তার আযাব বন্ধ হয়ে যায়।
অনেকে এ কথার পক্ষে আহসানুল ফাতাওয়ার উদ্ধৃতিও দিয়ে থাকেন।
বাস্তবে এ ধারণা ভিত্তিহীন। এ ধরনের কথা কোনো সহীহ হাদীস বা শরীয়তের কোনো দলীল দ্বারা প্রমাণিত নয়। আহসানুল ফাতাওয়ায় (৪/২০৮) যদিও এমন কথা আছে, কিন্তু আহসানুল ফাতাওয়ার তাতিম্মা (পরিশিষ্ট) অর্থাৎ আহসানুল ফাতাওয়ার দশম খন্ডে (পৃষ্ঠা : ৪৩৩-৪৩৫)-এ দলিল-প্রমাণসহ এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে এবং আগের কথাটিকে ভিত্তিহীন বলা হয়েছে।
সুতরাং এই ভিত্তিহীন কথা বিশ্বাস করা ও বলা থেকে বিরত থাকা উচিত। আর কবর ও আখিরাতকে সর্বোচ্চ সুন্দর বানানোর চেষ্টায় সর্বদা নিয়োজিত থাকা উচিত। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন। 
http://www.alkawsar.com/article/595


একটি ভুল মাসআলা : মা ভিন্ন হওয়ার কারণে সন্তানরা কি পিতার মীরাছ থেকে অংশ পায় না?
কয়েক দিন আগে এক ভদ্রলোক মাসআলাটি জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, আমরা পিতার মীরাছ বণ্টন করতে চাচ্ছি। আমাদের আরো কয়েকজন ভাইবোন আছে যাদের মা ভিন্ন। তারাও কি এই মীরাছের অংশীদার হবে? একজন বলেছেন, তারাও অংশ পাবে। তার এ কথা কি সঠিক?
আমি তাকে বললাম, কথাটি সঠিক না হলে আপনিইবা কেন অংশ পাবেন! কারণ মৃতের ঐ স্ত্রীর সন্তানরাও  তো বলতে পারে যে, আমাদের পিতার মীরাছ বণ্টন করা হচ্ছে। এতে আমাদের ঐ ভাইবোনেরাও কি অংশ পাবে, যাদের মা ভিন্ন?
এ বিষয়েও কীভাবে কারো বিভ্রান্তি হয়-এটা সত্যি বোধগম্য নয়। যেহেতু পিতার মীরাছ বণ্টন করা হচ্ছে তাই পিতার সকল সন্তান তাতে অংশীদার হবে।
ইন্তেকালের সময় মৃতের যত পুত্র ও কন্যা জীবিত ছিল তাদের প্রত্যেকেই শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত হারে মীরাছ পাবে। সকল সন্তান একই স্ত্রীর হোক বা একাধিক স্ত্রীর, এতে কোনো ফরক হবে না। মৃতের
ইন্তেকালের সময় সকল স্ত্রী জীবিত থাকুক অথবা কেউ মৃত্যুবরণ করুক; বিবাহ বন্ধন অটুট থাকুক বা ছিন্ন হয়ে যাক, সর্বাবস্থায় তার ঔরসজাত সকল সন্তান মীরাছের অংশীদার হবে।
للذكر مثل حظ الأنثيين
নীতিতে সবাই সমান। সে অনুযায়ী সকল সন্তান মীরাছের অংশ পাবে।
পিতা ভিন্ন হওয়ার কারণে কি সন্তানরা মায়ের মীরাছ থেকে বঞ্চিত হয়
উপরের ধারণার মতো কেউ এমন ধারণাও করতে পারে যে, মায়ের মৃত্যুর পর তার শেষ স্বামীর ঔরসজাত সন্তানরাই শুধু মীরাছ পাবে। এটিও সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। মায়ের মীরাছে তার সকল স্বামীর সন্তানরাই সমানভাবে অংশীদার। এতে প্রথম স্বামী বা শেষ স্বামীর সন্তানদের মাঝে কোনো পার্থক্য হবে না। এ সম্পর্কে কুরআন মজীদের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-
يوصيكم الله فى اولادكم للذكر مثل حظ الانثيين، فان كن نساء فوق اثنتين فلهن ثلثا ما ترك، وان كانت واحدة فلها النصف.
 (তরজমা) আল্লাহ তোমাদের সন্তান সম্পর্কে নির্দেশ করছেন : এক পুত্রের অংশ দুই কন্যার অংশের সমান। কিন্তু কেবল কন্যা দুয়ের অধিক হলে তাদের জন্য পরিত্যক্ত সম্পত্তির দুই-তৃতীয়াংশ, কেবল এক কন্যা থাকলে তার জন্য অর্ধাংশ।-সূরা নিসা (৪) : ১১

রবিউস সানী-১৪৩৩ . মার্চ-২০১২

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৮ . সংখ্যা: ০৩
এটি হাদীস নয় : আবু বকর রা.-এর কাছে জিবরীল আ. কি নিজের সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন
একটি ঘটনা সম্পর্কে কিছুদিন আগে এক ভাই ফোনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। একই ঘটনা সম্পর্কে আজ একজন সরাসরি প্রশ্ন করলেন। ঘটনাটি হল, একবার আবু বকর রা. চট পরিধান করেন। হয়ত অভাবের কারণে কিংবা সাধনা-মুজাহাদার জন্য। তখন জিবরীল আ. মানুষের আকৃতিতে তার নিকট এসে জিজ্ঞাসা করলেন, বলুন তো জিবরীল এখন কোথায় আছেন।
সিদ্দীকে আকবর রা. মুরাকাবার মাধ্যমে জিবরীল আ.কে খুঁজতে লাগলেন। আসমান-যমীনে কোথাও না পেয়ে তিনি বললেন, আপনিই জিবরীল! তখন তিনি বললেন, আমি আপনাকে এই পয়গাম শোনাতে এসেছি যে, আপনার এই আমল এত মাকবুল হয়েছে, আপনার অনুকরণে আজ সকল ফেরেশতা চট পরিধান করেছে!! (নাউযুবিল্লাহ)
মনে রাখবেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা হাদীস, সীরাত ও ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য ও প্রসিদ্ধ কোনো কিতাবে আমরা পাইনি। আর আমাদের জানা মতে তাসাওউফের নির্ভরযোগ্য ও সনদযুক্ত কোনো কিতাবেও তা সহীহ সনদে পাওয়া যায় না। আল্লাহ তাআলা যাদেরকে রেওয়াত যাচাই-বাছাইয়ের যোগ্যতা ও রুচি দান করেছেন তারা শোনামাত্র বুঝবেন, এই ঘটনা সম্পূর্ণ বানোয়াট।
আল্লাহ তাআলা মিথ্যুকদের বিনাশ করুন। তারা সিদ্দীকে আকবরকেও রেহাই দেয়নি। নবীকেও না, এমনকি আল্লাহকেও ছাড়েনি। প্রত্যেকের সম্পর্কেই তারা মিথ্যাচার করেছে। 
একটি ভুল মাসআলা : কিরাতে লোকমা হলে কি সাহু সিজদা করা জরুরি
নামাযের কিরাতে কোথাও ইমামের সন্দেহ হলে এবং সামনে অগ্রসর হতে না পারলে মুকতাদীর তাকে সহযোগিতা করা উত্তম। সহযোগিতার পদ্ধতি এই যে, মুকতাদী উচ্চস্বরে শুদ্ধভাবে পাঠ করবেন। এটাকে পরিভাষায় ‘লোকমা দেওয়া’ বলে। অনেক সময় কিরাত ছাড়াও উঠা-বসার ক্ষেত্রে কোথাও ইমামের ভুল হলে তাকে সতর্ক করাকেও লোকমা দেওয়া বলে। এই লোকমা দেওয়া ও নেওয়ার আদব ও বিধান রয়েছে। যেগুলো জানা ও মেনে চলা অপরিহার্য।
আম মানুষের মাঝে এই মাসআলাগুলোর আলোচনা কম হয়। সম্ভবত এরই প্রভাব যে, আমার এক সাথী একটা ঘটনা শোনালেন। তিনি নানা বাড়ি গিয়েছিলেন। নামাযে তাকে ইমাম বানানো হল। কিরাতে তার লোকমা লাগল। সালাম ফেরানোর পর মুসল্লিদের কেউ কেউ বলল, আপনি লোকমা নিয়েছেন কিন্তু সাহু সিজদা করেননি। তাই এখন নামায দোহরানো উচিত!!
অথচ সাহু সিজদার বিষয়টি নামাযের কোনো ওয়াজিবে ভুল করার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিরাতের লোকমার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। কিরাআতের যেসব ভুলের কারণে নামায ভেঙ্গে যায় এমন কোনো ভুল যদি কারো নামাযে হয় তাহলে সাহু সিজদার দ্বারা নামায শুদ্ধ হবে না; পুনরায় নামায আদায় করতে হবে। পক্ষান্তরে কিরাতে যদি কোনো সাধারণ ভুল হয় কিংবা বড় ভুল হলেও লোকমা দেওয়ার পর ইমাম তা শুধরে নেন তাহলে নামাযের ক্ষতি হবে না। এক্ষেত্রে নামাযও পুনরায় পড়তে হবে না, সাহু সিজদাও ওয়াজিব হবে না। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিলে পরবর্তী কোনো সংখ্যায় সিজদায়ে সাহুর মাসাইল সম্পর্কে আলাদা নিবন্ধ প্রকাশের ইচ্ছা রইল।   
একটি গর্হিত বিদআত ও মারাত্মক বিকৃতি : ইসলামে কি তৃতীয় কোনো ঈদ আছে
অনেক সময় সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতির দিকে লক্ষ্য করে কিংবা কোনো বাস্তবতা বোঝানো কঠিন মনে হলে অনেকে চুপ থাকার পথ বেছে নেন। অথবা দু’ একবার বলে চুপ হয়ে যান। এটা এ কারণে অনুচিত যে, এতে প্রকৃত বিষয় মানুষের অজানা থেকে যাবে এবং ভুল কথা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।
ঈদ ইসলামের শাখাগত বিষয় নয়। এটি দ্বীনের ‘শিআর’ তথা প্রতীকের অন্তর্ভুক্ত এবং এমন একটি বিষয়, যা সম্পূর্ণরূপে শরীয়তের নির্ধারণ ও নির্দেশনার উপর নির্ভরশীল
 (أمر تعبدي وتوقيفي )। অর্থাৎ এটি শুধু বিবেকবুদ্ধি ও কিয়াস দ্বারা অনুধাবন করা যায় না। সরাসরি শরীয়তদাতার পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট আদেশ দ্বারাই বিধিত হয়। এজন্য সুন্নতে মুতাওয়ারাসা, স্পষ্ট হাদীস ও ইজমায়ে উম্মতের বিপরীতে তৃতীয় ঈদ আবিষ্কার করা বিদআতই হবে।
আর এখন তো বিষয়টি শুধু এই নয় যে, একটি বিদআতকে সুন্নতের চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সম্মিলিতভাবে উদযাপন করা হচ্ছে; বরং এটিকে বানানো হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মহববতের মাপকাঠি ও প্রতীক। অথচ শরীয়ত বলে সুন্নাহর অনুসরণ, উসওয়ায়ে হাসানাহ অনুযায়ী জীবনযাপন, সুন্নতকে যিন্দা করা ও বিদআত নির্মূল করার মেহনত হচ্ছে মুহববতের মাপকাঠি ও নিদর্শন।
সাদাচোখে এটি কারো কাছে সামান্য বিষয় মনে হলেও বাস্তবে তা একটি মারাত্মক চিন্তাগত বিকৃতি। আর এই নবআবিষ্কৃত ‘ঈদ’কে জশনে জুলুস আকারে পালন করতে গিয়ে যেসব গর্হিত কাজ, আচরণ ও ভিত্তিহীন বর্ণনার আশ্রয় নেওয়া হয় সে বিষয় তো রইলই।
মনে রাখা উচিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হকসমূহ আদায় করা থেকে উদাসীন হয়ে অন্যায় পন্থায় হক আদায়ের বাহানার দ্বারা নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া নিজের প্রতি ও গোটা উম্মতের প্রতি মারাত্মক জুলুম। আল্লাহ তাআলার নিকট দাবি নয়, আমল গ্রহণযোগ্য। বাহ্যিক চাকচিক্য নয়, অন্তরের তাকওয়াই তাঁর নিকট পৌঁছে। বিদআত নয়, শুধু সুন্নতই তাঁর নিকট বরণীয়।
একটু ভেবে দেখুন, যে নাসারাদের পথ থেকে আমরা সূরায়ে ফাতিহায় প্রতিদিন কমপক্ষে বিশবার আল্লাহ তাআলার নিকট ولا الضالين   বলে আশ্রয় প্রার্থনা করি তাদের থেকে নেওয়া রসম-রেওয়াজে কি উম্মতের কোনো কল্যাণ থাকতে পারে?
اهدنا الصراط المستقيم، صراط الذين انعمت عليهم غير المغضوب عليهم ولا الضالين

রবিউল আওয়াল-১৪৩৩ . ফেব্রুয়ারি-২০১২

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৮ . সংখ্যা: ০২
দুটি ভুল প্রচলন
১. মুসাফাহার সময় ঝুঁকা
সাক্ষাতের সময় নিজ মুসলিম ভাইকে সালাম করা তো সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ ও ইসলামের শিআর। আগে আগে সালাম দেওয়ার চেষ্টা করা, পরিচিত-অপরিচিত সকলকে সালাম দেওয়া, শুদ্ধ ও পরিষ্কার উচ্চারণে সালাম বলা-কমপক্ষে ‘আসসালামু আলাইকুম’ পর্যন্ত অবশ্যই বলা-সুন্নত।
সালামের পর আরেকটি আমল হল মুসাফাহা, যা মুস্তাহাব পর্যায়ের আমল। তবে সালামের মতো মুসাফাহার আদেশ এতটা তাকিদপূর্ণ নয় যে, পরিচিত-অপরিচিত সকলের সাথে মুসাফাহা করতে হবে। আর আজকাল তো মুসাফাহার আদবের আলোচনাও কম হয় এবং এসবের প্রতি লক্ষ্যও কম করা হয়। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিলে এ বিষয়ে আলাদা প্রবন্ধ প্রকাশের ইচ্ছা আছে।
মুসাফাহার আদব রক্ষা না করার কারণে অনেক সময় মানুষের কষ্ট হয়। এটা নাজায়েয।
এই মুহূর্তে যে রসম সম্পর্কে আলোচনা করতে চাই তা এই যে, অনেককে দেখা যায় কোনো বুযুর্গ বা বড় ব্যক্তির সাথে মুসাফাহা করার সময় কিছুটা ঝুঁকে যান। অথচ কারো সম্মানার্থে মাথা বা ঘাড় ঝুঁকানোর অনুমতি নেই। ‘কোনো ভাইয়ের সাথে সাক্ষাত হলে কি মুসাফাহা করব’-এ প্রশ্নের উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, হ্যাঁ, মুসাফাহা কর। এরপর জিজ্ঞাসা করা হল, তার সামনে কি ঝুঁকতে পারি? ইরশাদ করলেন, না। ঝুঁকা যাবে না। (জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৭২৮; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩৭০৩
 ২. মুসাফাহার পর বুকে হাত লাগানো
অনেক ভাইকে দেখা যায়, মুসাফাহার পর বিশেষ করে কোনো বুযুর্গের সাথে
মুসাফাহার পর ডান হাত নিজের বুকে  মুছে নেন।  কী নিয়তে এমনটি করেন-তা আমার জানা নেই। সম্ভবত এই নিয়ত হতে পারে যে, মুসাফাহার দ্বারা যে বরকত হল তা নিজ শরীরে মুছে নেওয়া।
এই প্রচলনের যেমন কোনো ভিত্তি নেই তেমনি এই নিয়তেরও। এই ছোট ছোট বিষয়গুলো সম্পর্কে সচেতনতা এজন্য জরুরি যে, ধীরে ধীরে তা রসম-রেওয়াজে পরিণত হয়ে যায়। এ নিয়ে পরস্পর দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হয়। এমনকি মূর্খতাপ্রসূত এই রেওয়াজ একপর্যায়ে বিদআত পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অন্যথায় কেউ যদি এমনিতেই বুকে নিজের হাত মুছে নেয় তাহলে এতে ক্ষতির কী আছে!
একটি ভুল মাসআলা : হাঁটু খুলে গেলে কি অযু ভেঙ্গে যায়
অনেককে বলতে শোনা যায়, অযু করার পর কোনোভাবে হাঁটু খুলে গেলে অযু ভেঙ্গে যায়। তেমনি পা ধৌত করার সময় যদি হাঁটু খুলে যায় তাহলেও যতটুকু অযু করা হয়েছে তা ভেঙ্গে যায়। তাই আবার শুরু থেকে অযু করতে হবে। এ কারণে অনেককে নতুন করে অযু করতেও দেখা যায়।
এ ধারণা ঠিক নয়। হাঁটু সতরের অন্তর্ভুক্ত এবং তা ঢেকে রাখা অপরিহার্য। পা ধোয়ার সময় সতর্কতার সাথে ধোয়া উচিত যেন হাঁটু খুলে না যায়। কিন্তু এ কথা ঠিক নয় যে, হাঁটু খুলে গেলে অযু ভেঙ্গে যায় কিংবা অযুর মাঝে এমনটি হলে নতুন করে অযু করা জরুরি!! অযু ভঙ্গের কারণগুলো তো মাশাআল্লাহ মকতবের ছোট ছোট শিশুরাও জানে। তাতে  সতর খুলে যাওয়ার কথা নেই। 
এটি হাদীস নয় : জুমআর রাত কি কদরের রাত থেকেও উত্তম!
‘‘শবে জুমআ শবে কদর থেকেও উত্তম। কেননা শবে জুমআয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতৃগর্ভে আগমন করেছিলেন’’ এটি হাদীস কিনা-এই প্রশ্ন বার বার করা হয়।
এই রেওয়ায়েতটি কোথায় পড়েছেন বা কার কাছে শোনেছেন-জিজ্ঞাসা করা হলে কেউ কেউ একটি কিতাবের কথা বলেছেন। বললাম, সেখানে কি এর কোনো হাওয়ালা আছে? তারা দেখে বললেন, মুসনাদে আহমদের হাওয়ালা দেওয়া হয়েছে। মূল কিতাব খুলে দেখা গেল, সেখানে এই বিষয়টিকে হাদীস হিসেবে উল্লেখই করা হয়নি। বরং ‘আশিআতুল লামাআত’ (মিশকাতের ফার্সী শরহ)-এর উদ্ধৃতিতে ইমাম আহমদের বরাতে এই উক্তি উল্লেখ করা হয়েছে যে, কয়েকটি কারণে জুমআর রাত কদরের রাত থেকেও উত্তম। কেননা জুমআর রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মা আমিনার গর্ভে আগমন করেন।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, কোথাকার বিষয় কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে। ইমাম আহমদের নাম দেখেই মুসনাদে আহমদের উদ্ধৃতি অবতারণা করা হয়েছে। আবার একটি উক্তিকে হাদীস বানিয়ে দেওয়া হয়েছে!! অথচ এ বিষয়টিও তাহকীক করা প্রয়োজন ছিল যে, ইমাম আহমদ  থেকে কথাটি প্রমাণিত কি না? আর এ রাতেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাতৃগর্ভে আগমন করেছিলেন-এ কথারও সনদ খোঁজার প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া এটি প্রমাণিত হলেও এটা কীভাবে আবশ্যক হয় যে, এ কারণে রাতটি কদরের রাত থেকে উত্তম? ‘আশিআআতুল লামাআত’ গ্রন্থে এ প্রশ্নগুলোর কোনো উত্তর নেই, অন্য কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবেও নেই।
সারকথা এই যে, উপরোক্ত উক্তিটি হাদীস নয় এবং এটি অন্য কোনো দলিল দ্বারাও প্রমাণিত নয়।
উপরের ঘটনা থেকে এই বাস্তবতা আবারো ফুটে উঠল যে, শুধু অনুবাদসর্বস্ব জ্ঞান খুবই ভয়ঙ্কর। যারা শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে কোনো আরবী কিতাবের জ্ঞান লাভ করেন, মূল কিতাব থেকে সরাসরি জ্ঞান লাভের প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও আবশ্যকীয় ইলম যাদের নেই-তারা অনুবাদের সহায়তায় যতটুকু অর্জন করেন তা ঝুঁকিপূর্ণ। এ পন্থায় অর্জিত জ্ঞান যেমন তাদেরকে গবেষণার যোগ্য প্রমাণ করে না তেমনি এটাকে পুঁজি করে কোনো আহলে ইলমের সাথে ইলমী আলোচনা ও পর্যালোচনার অধিকারও সৃষ্টি হয় না।
হায়! আমাদের বন্ধুরা যদি এই বাস্তবতাটুকু অনুভব করতেন তাহলে সমাজের অনেক বিবাদ দূর হয়ে যেত।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

সফর-১৪৩৩ . জানুয়ারি-২০১২

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৮ . সংখ্যা: ০১
একটি ভুল রেওয়ায়েত : أنْتَ يَا صِدِّيْقُ عَاصٍ تُبْ إِلَى الْمَوْلَى الْجَلِيْلِ
অনেকে দুআ ও মুনাজাতসম্বলিত এই কবিতাটিকে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. রচিত মুনাজাত মনে করে থাকে। অথচ এর কোনো সনদ বা নির্ভরযোগ্য কোনো হাওয়ালা পাওয়া যায় না। তাছাড়া ফাসাহাত-বালাগাত তথা সাহিত্যের বিচারেও এর মান এত নিচু যে, এটাকে আবু বকর রা. রচিত পংক্তি মনে করাই আরবী সম্পর্কে অজ্ঞতা ও সিদ্দীকে আকবর রা.-এর মর্যাদা সম্পর্কে জ্ঞানহীনতার প্রমাণ।
ইমদাদুল ফাতাওয়ায় (৪/৯০) হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.ও স্পষ্ট বলেছেন যে, এটিকে সিদ্দীকে আকবার রা.-এর মুনাজাত মনে করা ভুল। এমনকি জনাব আহমদ রেযা খানও তার ‘‘মালফুযাতে’’ এ কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ শিরক ও বেদআতের সমর্থনের জন্য তিনি অনেক মুনকার ও ভিত্তিহীন রেওয়ায়েতকেও জোরপূর্বক প্রমাণ করার অপচেষ্টা করেছেন।  
অবশ্য এই পংক্তিগুলোতে শিরকী কিছু নেই, শুধু এতটুকুই যে, এটি সিদ্দীকে আকবার রা.-এর রচিত মুনাজাত নয়।
একটি ভুল ধারণা : তাকাববুরের নিয়ত না থাকলে কি টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলিয়ে পরা যায়
যেসব কাপড় দেহের নিম্নাংশে ঝুলন্ত থাকে যেমন-লুঙ্গি, সালোয়ার, প্যান্ট, জুববা, কামিজ, আবা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিধান হল, পুরুষের জন্য এসব কাপড় টাখনুর রাখতে হবে, টাখনু ঢাকা যাবে না ও টাখনুর নিচে ঝুলানো যাবে না। এটি একটি সাধারণ ও ব্যাপক বিধান। টাখনুর নিচে কাপড় ঝুলানো কবীরা গুনাহ। কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন, তাকাববুরের নিয়তে করলে হারাম। যদি তাকাববুরের নিয়ত না থাকে তাহলে কোনো অসুবিধা নেই।
মনে রাখবেন, এই ধারণা ঠিক নয়। তাকাববুরের নিয়ত না থাকলেও এটা নাজায়েয। আর তাকাববুরের নিয়তে করা তো আরো মারাত্মক গুনাহ। হাদীস শরীফে এ কাজটিকেই তাকাববুরের আলামত বলা হয়েছে। সুতরাং এ থেকে বিরত থাকা জরুরি। 
আর শার্ট-প্যান্ট তো মূলত মুসলমানের পোশাক নয়। এটা এসেছে বাইরে থেকে। তাই তা থেকে এমনিতেই বিরত থাকা উচিত। তারপরও যাদের প্যান্ট  পড়তেই হয় তাদের উচিত প্যান্টের পা টাখনুর উপর বানিয়ে নেওয়া।  
মাশাআল্লাহ দ্বীনের প্রতি আগ্রহী অনেক ইংরেজি শিক্ষিত ভাইকেও টাখনুর উপর প্যান্ট পড়তে দেখা যায়। এটি দৃষ্টিকটুও নয়, আবার কেউ তাকে মন্দও বলে না।
এটা ভুল ধারণা যে, পশ্চিমা ফ্যাশনের দ্বারা ব্যক্তির সম্মান বৃদ্ধি পায়। বাস্তবতা এই যে, মুসলমান যদি নিজেদের সভ্যতা-সংস্কৃতি ছেড়ে অন্যদের সংস্কৃতি ধারণ করে তবে এটাই তার লাঞ্ছনার কারণ। নিজেদের মাঝেও সে লাঞ্ছিত হবে এবং অন্যদের কাছেও।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিক উপলব্ধি দান করুন এবং ইসলামী লেবাস-পোশাক খুশিমনে গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন। 
একটি ভুল মাসআলা : আযানের আগে কি সুন্নত পড়া নিষেধ
যেসব ফরয নামাযের আগে দুই বা চার রাকাত সুন্নত পড়তে হয় সেসব সুন্নতের সময় শুরু হয় ঐ ফরযের সময়ের শুরু থেকেই। তাই ফরযের ওয়াক্ত হওয়ার পর আযান না দেওয়া হলেও সুন্নত নামায আদায় করা যায়। অনেকে মসজিদে এসেও শুধু এই মনে করে বসে থাকেন যে, এখনো তো আযান হয়নি, নামায কীভাবে পড়ব? অথচ নামাযের ওয়াক্ত হওয়ার পর আযান না হলেও সুন্নত পড়তে কোনো অসুবিধা নেই।
তাছাড়া নির্দিষ্ট কয়েকটি সময় ছাড়া অন্য সব সময় নফল নামায পড়া যায়। সুতরাং মসজিদে প্রবেশের পর হাদীসের নির্দেশনা অনুযায়ী বসার আগে দুই রাকাত (তাহিয়্যাতুল মসজিদ) পড়ে নেওয়া উচিত বা সরাসরি সুন্নত নামায পড়ে নেওয়া উচিত তাহলে তা তাহিয়্যাতুল মসজিদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যাবে।  
মোটকথা ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ার পর শুধু আযান হয়নি-এ অজুহাতে নফল কিংবা সুন্নত পড়া থেকে বিরত থাকা ঠিক নয়। আযানের সাথে যুক্ত হচ্ছে ফরযের জামাত। এ জামাতের দিকে আহবান  করার জন্যই আযান হল ওয়াজিব পর্যায়ের একটি সুন্নতে মুয়াক্কাদাহ আমল। সুতরাং সুন্নত বা নফলকে এর সাথে যুক্ত মনে করা ঠিক নয়। 
এমনিভাবে কোনো কোনো মহিলাকে দেখা যায়, তারা ঘরে আযানের অপেক্ষায় বসে থাকেন। যদিও তারা জানেন যে, নামাযের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। এটিও ভুল প্রচলন।
কারো কারো মাঝে এমনও প্রচলন আছে যে, সূর্যাস্তের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার পরও শুধু আযান শোনা না যাওয়ার কারণে ইফতারে বিলম্ব করে। এটাও ভুল, যার সংশোধন অপরিহার্য। এসবের কোনো কোনোটি সম্পর্কে আগেও এ বিভাগে আলোচনা করা হয়েছে। তবু সবগুলো একশ্রেণীর হওয়ায় আগেরগুলোও পুনরোল্লেখ করা হল।
একটি ভুল দরূদ : দরূদে হাজারী সঠিক দরূদ নয়
অযিফার অনির্ভরযোগ্য কোনো কোনো পুস্তিকায় বা পৃথক আকারে প্রকাশিত লিফলেটে দরূদে হাজারী নামের একটি দরূদ কোনো কোনো হলকায় প্রচার করা হয়। এই দরূদ কোনো সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়নি এবং তা কোনো আল্লাহওয়ালা বুযুর্গেরও রচিত দরূদ নয়। এতে না আছে দরূদের নূর, না আছে সাহিত্যের মাধুর্য। বরং এর ভাষায় রয়েছে অসৌজন্যতা। তাই এই দরূদ পাঠ থেকে বিরত থাকা জরুরি। আর এটিকে কুরআন-হাদীসের মাছুর দরূদ মনে করা সম্পূর্ণ নাজায়েয।

মুহাররম-১৪৩৩ . ডিসেম্বর-২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৭ . সংখ্যা: ১১
বাস্তবেই কি তাঁরা শিয়াদের ইমাম
যে সকল ফিরকা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবি করে তাদের মধ্যে শিয়া অতি প্রাচীন ফির্কা। খোদ শিয়ারাও অনেক দল-উপদলে বিভক্ত। বর্তমানে ইসনা আশারিয়্যাহ শিয়া সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। তাদের জনসংখ্যাও সবচেয়ে বেশি। এদেরকে ইমামিয়্যাহ শিয়াও বলা হয়।
তাদের একটি গলত আকীদা হচ্ছে, আকিদায়ে ইমামত। তাদের মতে, হযরত আলী রা. থেকে হযরত হাসান আসকারী রাহ. ও তাঁর পুত্র পর্যন্ত  মোট বারজন সম্পর্কে তাদের দাবি এই যে, এঁরা আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষিত ইমাম। তারা শুধু নবীগণের মতো মাসুমই নন; বরং এমন মাকাম ও মর্যাদার অধিকারী, যে পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত কোনো ফেরেশতা এবং কোনো নবী-রাসূলও পৌঁছতে পারে না ...!
এ কথা স্বয়ং রুহুল্লাহ খোমেনীর কিতাব ‘আলহুকুমাতুল ইসলামিয়্যাহ’ তেই আছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এটা সরাসরি কুফরি আকীদা। কোনো মুসলমান এ বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করে না।
আমি এখানে যে কথাটি বলতে চাই তা হল, হাসান আসকারী রাহ.-এর পুত্রের অন্তর্ধানের যে ঘটনা, তা সম্পূর্ণ বানোয়াট একটি কাহিনী।
আর আলী রা. থেকে হাসান আসকারী রাহ. পর্যন্ত এগারজন সম্পর্কে শিয়াদের প্রপাগান্ডায় প্রভাবিত হয়ে অনেকেই তাঁদেরকে সত্যি সত্যি শিয়াদের ইমাম ও নেতা মনে করেন। এটা ঠিক এ রকম, যেমন অনেক লোক ঈসা আ.কে বর্তমান খৃস্টান সম্প্রদায়ের আদর্শ মনে করে।
অথচ বাস্তবতা হল, না খৃস্টানরা হযরত ঈসা আ.-এর আদর্শ গ্রহণ করেছে, না শিয়ারা উপরোক্ত ইমামদের আদর্শের অনুসরণ করেছে; বরং তারা তো নিজেদের আবিষ্কৃত ভ্রান্ত বিশ্বাস ও আচারের অনুসারী। শুধু মানুষকে প্রতারিত করার জন্য ঐ সকল ইমামগণের নাম তারা ব্যবহার করে থাকে। তাদের আদর্শ ও শিক্ষার সাথে শিয়াদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁরা তো শিয়াদের বিশ্বাস ও কর্মকান্ড এবং তাদের রুসূম-রেওয়াজ থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র ছিলেন। নিচে ঐ এগারজন মহান ব্যক্তির সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হল।
১. আলী ইবনে আবী তালিব রা. (হিজরতপূর্ব ২৩-৪০ হিজরী)
২. হাসান ইবনে আলী রা. (৩-৪৯ হি.)
৩.  হুসাইন ইবনে আলী রা.
(৪ হি.-৬১ হি.)
৪. যাইনুল আবেদীন আলী ইবনুল হুসাইন রাহ. (৩৮-৯৪ হি.)
৫. মুহাম্মাদ ইবনে আলী আলবাকের  রাহ. (৫৬-১১৪ হি.)
৬. জাফর ইবনে মুহাম্মাদ আসসাদিক রাহ. (৮০-১৪৮ হি.)
৭. মুসা ইবনে জাফর আল কাযেম রাহ. (১২৮-১৮৩ হি.)
৮. হযরত আলী মুসা আররেজা রাহ. (১৪৮-২০৩ হি.)
৯. মুহাম্মাদ ইবনে আলী আলজাওয়াদ রাহ. (১৯৫-২২০ হি.)
১০. আলী ইবনে মুহাম্মাদ আলহাদী রাহ. (২১৪-২৫৪ হি.)
১১. হাসান ইবনে আলী আলআসকারী রাহ. (২৩২-২৬০ হি.)
এঁদের মধ্যে প্রথমজন তো খোলাফায়ে রাশেদীনের চতুর্থ খলিফা ছিলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর বিশিষ্ট সাহাবী ও আশারায়ে মুবাশশারার অন্যতম ছিলেন। পরের দুজনও সাহাবী ও আল্লাহর রাসূলের দৌহিত্র ছিলেন। কোনো সাহাবী কখনোই কোনো বাতিল ফেরকার ইমাম হতে পারেন না।
কোনো বাতিল ফেরকা যদি তাঁদের কারো অনুসারী হওয়ার দাবি করে তাহলে সেটা হবে নির্জলা মিথ্যা।
হযরত যাইনুল আবেদীন, বাকের ও জাফর সাদেক এই তিনজন তাবেয়ী ছিলেন। মুসা কাজেম তাবে তাবেয়ী ছিলেন। বাকি পাঁচজন তাবে তাবেয়ীগণের শাগরেদদের তবকার ছিলেন।
এঁরা সকলেই ছিলেন আহলুস সুন্নাহ ওয়ালা জামাআতের আদর্শের অনুসারী। শিয়াদের আবিষ্কৃত বাতিল আকীদা-বিশ্বাসের সাথে সামান্যতম সম্পর্কও তাঁদের ছিল না।
এছাড়া তাঁদের মধ্যে অনেকেই শিয়াদের বাতিল মতবাদ ও কর্মকান্ড থেকে সম্পর্কহীনতার কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন। তাদের এ বিষয়ক কিছু বক্তব্য খোদ শিয়াদের কিতাবেও রয়েছে।
সুতরাং ভালো করে বুঝে নেওয়া দরকার যে, না শিয়ারা ঐ সকল ব্যক্তিবর্গের অনুসারী, না তাঁরা-আল্লাহ মাফ করুন- শিয়াদের মিথ্যা ও বাতিল আকীদাকে সহীহ মনে করতেন। সুতরাং ঐ সকল বিষয় তাদের সাথে সম্পৃক্ত করার কোনো অবকাশ নেই।
আল্লাহ আমাদেরকে হক বোঝার ও হককে গ্রহণ করার তাওফীক দান করুন। 
কুরবানীর শরীক সংখ্যা কি বেজোড় হওয়া জরুরি
কিছু লোককে বলতে শোনা গেছে, যে পশুতে সাতজন শরীক হতে পারে তাতে শরীকের সংখ্যা বেজোড় হওয়া জরুরি। সুতরাং একটি গরুতে এক, তিন, পাঁচ বা সাতজন শরীক হতে পারবে। দুই, চার বা ছয়জন শরীক হতে পারবে না।
এটা বিলকুল গলত কথা। একটি গরু যেমন এক ব্যক্তি একা কুরবানী করতে পারে তেমনি দুই থেকে সাত পর্যন্ত যে কোনো সংখ্যক শরীক একত্র হয়েও কুরবানী করতে পারে। এতে কোনো বাধা নেই। তেমনি শরীকের সংখ্যা জোড় না হয়ে বেজোড় হওয়ার মাঝেও এমন আলাদা কোনো ফযীলত নেই, যার কারণে পাঁচ শরীকের স্থলে ছয় শরীক বা ছয় শরীকের স্থলে সাত শরীক একত্র হয়ে কুরবানী করতে উৎসাহ দেওয়া যায়। 

যিলহজ্ব-১৪৩২ . নভেম্বর-২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৭ . সংখ্যা: ১০
নাম সঠিকভাবে বলা ও লিখা
কারো নাম হুবহু বলা ও লিখা উচিত। এটি ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ আদব। নাম সংক্ষিপ্ত করতে হলে এর জন্যও স্বতন্ত্র্য নীতি ও আদব রয়েছে, যেগুলো জেনে সে অনুযায়ী আমল করা উচিত।
আজকাল অনেককে বলতে শোনা যায় যে, তারা আহসানুল ফাতাওয়ার মুসান্নিফকে মুফতী আবদুর রশীদ বলেন। অথচ তাঁর নাম রশীদ আহমদ। আবার কেউ হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.-এর নামের সাথে মুফতী শব্দ যোগ করে সুপরিচিত এই ফকীহকে অপরিচিত বানিয়ে দেয়। তারা জানে না যে, হযরতের নামের সাথে মুফতী শব্দ ব্যবহৃত হয় না। কেননা, তিনি মুফতী নন, উস্তাযুল মুফতীন ওয়াল ফুকাহা (মুফতী ও ফকীহগণের
উস্তাদ) ছিলেন।
তেমনিভাবে অনেককে হযরত শায়খুল হিন্দ রাহ.-এর নাম মাহমুদুল হাসান লিখতে দেখা যায়। অথচ তাঁর নাম মাহমুদ হাসান। আলিফ-লাম ছাড়া।
এদিকে কিছু লোককে দেখলাম, তারা আমাদের উস্তাদ হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রশীদ নুমানী (১৩৩৩ হি.-১৪২০ হি.) ও আহসানুল ফাতাওয়ার গ্রন্থকার মুফতী রশীদ আহমদ লুধিয়ানভী রাহ. (১৩৪১ হি.-১৪২২ হি.) দুজনকে একই ব্যক্তি মনে করেন। এটি সম্পূর্ণ অবাস্তব।
একটি ভিত্তিহীন ঘটনা
জনৈক কাহিনীকার ওয়ায়েযকে বলতে শুনেছি, নূহ আ. তাঁর সঙ্গীদেরকে নিয়ে কিশতী থেকে অবতরণ করার কিছুদিন পর আল্লাহ তাআলা আদেশ করলেন, হে নূহ! এখন তো এই কিশতীর প্রয়োজন নেই। তাই এটি ভেঙ্গে ফেল। তখন তিনি বললেন, হে আল্লাহ! এটিকে তো আমি নিজ হাতে বানিয়েছি। এখন কীভাবে ভেঙ্গে ফেলব। আমার তো কষ্ট হবে। আল্লাহ তাআলা বললেন, তোমার বদ দুআর কারণে তো আমি আমার সৃষ্টিকে পানিতে ডুবিয়ে মেরেছি। তাহলে ভেবে দেখ, আমার কতটা কষ্ট হয়েছে? তারা তো আমারই হাতে গড়া সৃষ্টি ছিল!!
অসার ও ভিত্তিহীন এই ঘটনা শুনিয়ে সে লোকদেরকে বোঝাতে চেষ্টা করছিল যে, আল্লাহর কোনো সৃষ্টি কাফের-মুশরিক হলেও আল্লাহ তাআলা তাকে ভালবাসেন, তার প্রতি দয়া করেন।
মনে রাখবেন, আগেই বলা হয়েছে এই ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এর কোনো সহীহ সূত্র ও নির্ভরযোগ্য কোনো উদ্ধৃতিও নেই। এটি সম্পূর্ণ মনগড়া একটি ইসরাইলী বর্ণনামাত্র।
সৃষ্টির প্রতি দয়াপরবশ হয়েই তো আল্লাহ তাআলা নবী ও রাসূল প্রেরণ করেছেন। এমনকি শেষ নবী সাইয়্যেদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মাধ্যমে এই ধারার সমাপ্তি ঘটিয়ে তাঁকে কিয়ামত পর্যন্ত নবী বানিয়েছেন। তার প্রতি নাযিলকৃত আসমানী কিতাব আলকুরআনুল কারীম ও এর কার্যত ও ব্যবহারিক ব্যাখ্যা হাদীস-সুন্নাহ এবং তাকে প্রদত্ত শেষ শরীয়ত সবকিছুর হেফাযতের দায়িত্ব তিনি নিজেই নিয়েছেন। কিন্তু যে ব্যক্তি হঠকারিতা অবলম্বন করে এবং আল্লাহর এ সকল দূতের উপহাস করে, তাদের দাওয়াত কবুল করে না এবং কুফুরিতে লিপ্ত থাকে আল্লাহ তাআলার প্রতি তার কোনো ভালবাসা থাকে না। বরং সে আল্লাহর নিকট সবচেয়ে ক্রোধের পাত্র। কুরআন সাক্ষী যে, কাফেরদেরকে নূহ আ.-এর বদদুআ করা আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ীই ছিল। বিষয়টি এমনও নয় যে, আল্লাহ তাআলা তাদেরকে ধ্বংস করতে চাননি, শুধু নূহ আ.-এর খাতিরে ধ্বংস করে দিয়েছেন। (নাউযুবিল্লাহ)
আবার এমনও নয় যে, নূহ আ. ওই কাফেরদের অতিষ্ঠ হয়ে বদ দুআ করেছিলেন। তিনি তো সাড়ে নয়শ বছর তাদেরকে দিন-রাত, সকাল-সন্ধ্যা সম্ভাব্য সকল পন্থায় দাওয়াত দিয়ে এসেছেন। কিন্তু হঠকারিতার কোনো প্রতিষেধক তো কারো কাছেই নেই! নূহ আ. সম্পর্কে কুরআন মজীদের আয়াতসমূহ কেউ মনোযোগ দিয়ে তিলাওয়াত করলেও সহজেই বুঝতে পারবে যে, তাদের বিরুদ্ধে নূহ আ.-এর বদ দুআ আল্লাহ তাআলার ইচ্ছানুরূপই ছিল। আর সেসব কাফেরদেরকে আল্লাহ তাআলা তাদের হঠকারিতা, অহংকার, আল্লাহ ও তাঁর আয়াতসমূহ এবং তাঁর রাসূলের সঙ্গে উপহাসের কারণে ধ্বংস করেছেন।
وقد أشار الذهبي إلى قصة كسر السفينة في ميزان الاعتدال، وأنها منكرة باطلة وليراجع الطلاب كتاب إرشاد القاري إلى صحيح البخاري للمفتي رشيد أحمد اللدهيانوي
  পৃষ্ঠা : ৪২২-৪২৩
আরেকটি ভুল মাসআলা : প্রত্যেক মুসল্লির জন্য কি ছানার পর আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ পড়তে হয়
অনেককে দেখা যায়, তারা প্রত্যেক মুসল্লির জন্য ছানার পর আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ পড়াকে সুন্নত মনে করেন। অথচ এই ধারণা ঠিক নয়। আউযুবিল্লাহ ও বিসমিল্লাহ শুধু ঐসব মুসল্লির জন্য সুন্নত, যারা সূরা ফাতিহা পাঠ করেন। যেমন-ইমাম ও মুনফারিদ (একাকী নামায আদায়কারী)। ইমামের পিছনে ইকতিদা করার কারণে যেহেতু মুক্তাদিকে সূরা ফাতিহা পড়তে হয় না তাই সে আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহও পড়বে না।
একটি ভুল মাসআলা : আততাহিয়্যাতুর শুরুতে কি আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ পড়তে হয়
কিছুদিন আগে এক দ্বীনী ভাইয়ের সাথে আলোচনা হচ্ছিল। তিনি বললেন, আমি তো মনে করতাম যে, আততাহিয়্যাতু, দরূদ শরীফ ইত্যাদির শুরুতেও আউযুবিল্লাহ, বিসমিল্লাহ পড়া মুস্তাহাব!! তার মতো অন্য কেউ হয়ত এই ভ্রান্তির শিকার হয়ে থাকবেন তাই এ বিষয়ে লিখছি।
মনে রাখা উচিত যে, আততাহিয়্যাত, দরূদ শরীফ কিংবা দুআর শুরুতে চাই তা নামাযের ভিতর হোক বা বাইরে, আউযুবিল্লাহ অথবা বিসমিল্লাহ পড়া মুস্তাহাব নয়; বরং এসব ক্ষেত্রে আউযুবিল্লাহ বা বিসমিল্লাহ পড়তেই হয় না। এই দুটি জিনিস তো তাকবীরে তাহরীমার পর ছানা শেষ করে পড়তে হয়। (যার জন্য তা পাঠের বিধান আছে)


যিলকদ-১৪৩২ . অক্টোবর-২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৭ . সংখ্যা: ০৯
এটি হাদীস নয় : تَعَامَلُوْا كَالْأَجَانِبِ وَتَعَاشَرُوْا كَالْإِخْوَانِ
বিভিন্ন হাদীসের শিক্ষার আলোকে কথাটি কোনো বিজ্ঞজন বলেছেন। তার
অর্থ হল, লেনদেন কর অপরিচিতের মতো। আর তোমাদের পারস্পরিক আচরণ যেন হয় ভাইদের মতো। 
কথাটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লেনদেনের ক্ষেত্রে তার সাধারণ নিয়ম-কানূন যথাযথ পালন করা উচিত। নতুবা বিভিন্ন সময় পেরেশানিতে পড়তে হয়। আর লেনদেনের সকল বিধিবিধান ও পারস্পরিক হকগুলোর ব্যাপারে যত্নবান হওয়া তো মাসআলার দিক থেকেই জরুরি। বন্ধুত্ব বা অন্য কোনো সম্পর্কের কারণে এতে শীথিলতা কোনো ভাবেই  
বাঞ্চনীয় নয়।
তবে যাই হোক, উপরোক্ত উক্তিটি কারো মুখে হাদীস হিসেবে শোনা গেলেও তা মূলত হাদীস নয়। কোনো মনীষীর বাণীমাত্র। আরবী প্রবাদ বাক্যসমূহের একাধিক সংকলনে তা উল্লেখ আছে। যেমন-মাজমাউল আমছাল, মায়দানী পৃষ্ঠা ৭৭০
একটি ভুল ধারণা :যফর আহমদ উছমানী রাহ. কি শাববীর আহমদ উছমানী রাহ.-এর ভাই?
প্রথমে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিইনি। পরে বেশ কিছু মানুষকেই এরকম বলতে শুনেছি, হযরত মাওলানা যফর আহমদ উছমানী রাহ. (১৩১০ হি.-১৩৯৪ হি.) আল্লামা শাববীর আহমদ উছমানী রাহ. (১৩০৫ হি.-১৩৬৯ হি.)-এর সহোদর ভাই। কথাটি ঠিক নয়।
প্রথমজন হলেন হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর ভাগ্নে। যাঁর আববা মাওলানা লতীফ আহমদ। তাঁর বাড়ি থানাভবন। আর দ্বিতীয়জনের আববা হলেন মাওলানা ফজলুর রহমান। তাঁর বাড়ি দেওবন্দ। থানভী রাহ.-এর সঙ্গে তাঁর এ জাতীয় কোনো সম্পর্ক ছিল না।
একটি ভুল তথ্য :মুনাজাতে মাকবুল-এ যা কিছু ছাপা হচ্ছে সবই কি থানভী রাহ.-এর সংকলন?
মুনাজাতে মাকবুল হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর একটি সুন্দর সংকলন। এতে হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন জামে’ তথা ব্যাপক অর্থবহ দুআসমূহ একত্রিত করা হয়েছে। এতে হযরতের মূল অবলম্বন ছিল ইমাম ইবনুল জাযারী-এর ‘আলহিসনুল হাসীন’ এবং মোল্লা আলী কারী রাহ.-এর ‘আলহিযবুল আ’যম’।
সংকলনটি ব্যাপকভাবে মাকবুল হওয়ায় অনেক প্রকাশক তা প্রকাশ করে থাকে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হল, কোনো কোনো প্রকাশক এতে এমন অনেক অযীফা যোগ করে দিয়েছে, যা হাদীসে বর্ণিত নয়। এমনকি অর্থ ও মর্মের দিক থেকেও আপত্তিকর।
অনেকে ধারণা করে মুনাজাতে মাকবুলের সাথে যত কিছুই ছাপা হয়ে থাকে সব কিছুই থানভী রাহ.-এর সংকলন বা তার পক্ষ থেকে অনুমোদিত। মনে রাখবেন, বিষয়টি এমন নয়। মুনাজাতে মাকবুল সমষ্টিতে শুধু নিম্নোক্ত বিষয়গুলো হযরতের সংকলন বা তার পক্ষ থেকে অনুমোদিত।
১. সাত মনযিলের আরবী মুনাজাতে মাকবুল।
২. উর্দু কাব্যে সাত মনযিলে তার অনুবাদ।
৩. মাসনবী থেকে নির্বাচিত ফার্সী কাব্যের দুআসমূহের সাত মনযিল।
৪. হিযবুল বাহার।
তবে হিযবুল বাহার-এর শুরুতে বলে দেওয়া হয়েছে যে, তা মা’ছূর বা বর্ণিত নয় এবং তার আমলের সীমারেখাও চিহ্নিত করে দেওয়া হয়েছে।
এ চারটি বিষয় ছাড়া অন্য যা কিছু
বিভিন্ন প্রকাশনায় এ সমষ্টির সাথে যুক্ত করা হয়েছে তা থানবী রাহ.-এর সংকলন নয়। ঐগুলোর যথার্থতা আলেমদের কাছে জেনে নেওয়া জরুরি।
একটি ভুল ধারণা : রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় কি দর্জি ছিল না?
কয়েকদিন পূর্বে এক ভাই ফোনে জিজ্ঞাসা করলেন, আমরা তো জানতাম সাহাবীগণ কাপড় কোনো রকম শরীরে বেঁধেই পোশাকের কাজ সারতেন। হঠাৎ ওই দিন একজন বললেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাকি একটি জুববা ছিল। আমার কাছে বড় আশ্চর্য মনে হল যে, সে যামানায় আবার দর্জি কোথায় ছিল? জুববাই বা কীভাবে তৈরি হবে!
তাকে উত্তরে বলা হল, এ ধারণা ঠিক নয়। দর্জি পেশা অনেক আগ থেকেই আছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায়ও ছিল। এটি একটি বাস্তব ইতিহাস। তাছাড়া বিভিন্ন সহীহ হাদীসেও বিষয়টি উদ্ধৃত আছে। বুখারী শরীফ, বুয়ূ’ অধ্যায়ে হাদীস নং : ২০৯২ এ সে যুগের এক দর্জির আলোচনা রয়েছে। 

শাওয়াল-১৪৩২ . সেপ্টেম্বর-২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৭ . সংখ্যা: ০৮
একটি ভুল তথ্য : সুরমা কি তুর এর তাজাল্লী থেকে সৃষ্টি?
সুরমার বিষয়ে কোনো কোনো লোককে বলতে শোনা যায় যে, হযরত মুসা আ. যখন তুর পাহাড়ে আল্লাহকে স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছিলেন তখন আল্লাহর তাজাল্লীতে পাহাড় ভস্ম হয়ে গিয়েছিল। সেই ভস্মিভূত পাহাড় থেকেই সুরমার উৎপত্তি ও ব্যবহার।
এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সুরমা একটি খণিজ দ্রব্য। এর সাথে তুর পাহাড়ের কোনো সম্পর্ক নেই। মুসা আ.-এর আল্লাহকে দেখার ইচ্ছা ও তুর পাহাড়ের মূল ঘটনাটি সত্য। কুরআন মজীদে এর পূর্ণ বিবরণ রয়েছে। (সূরা আ‘রাফ : ১৪৩ দ্রষ্টব্য) কিন্তু কোথাও এই ঘটনার সাথে সুরমাকে জড়িয়ে দেওয়ার কথাটির সামান্যতমও উল্লেখ নেই। অতএব এই ধরনের কথা পরিহার করা জরুরি। 
একটি ভুল চিন্তা : কবরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা কি নিষেধ
অনেকে মনে করে, কবরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা ঠিক নয়। এতে নাকি আঙ্গুল পঁচে যায়। এটি একটি ভিত্তিহীন কথা। জীবিত মানুষের দিকে যদি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করা যায় তাহলে কবরের দিকে ইশারা করলে দোষ হবে কেন? আর শরীয়তের দৃষ্টিতেও এতে কোনো বাধা নেই। আর এই কারণে কারো আঙ্গুল পঁচে গেছে-এমন কোনো নজিরও নেই। অতএব এই ধরনের ভিত্তিহীন কথা বলা ও বিশ্বাস রাখা থেকে বিরত থাকতে হবে।
এটি হাদীস নয় : একটি জনপদের উপর পবিত্রতা যখন পাখা বিস্তার করে আকাশ তখন শহীদের রক্ত ধারণ করে
বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখকের লেখায় এমন কথা পড়েছি। তিনি লিখেছেন, ‘ইফতারির সময় রোযাদারদের কাছে আকাশ আজ অন্যান্য সন্ধ্যার তুলনায় অনেক বেশি লাল বলে মনে হয়, গাঢ় এবং গম্ভীর সেই রঙ দেখে কারো কারো মনে পড়ে যায়, হ্যাঁ, এ রকম তাঁরা শুনেছে, একটি জনপদের ওপর পবিত্রতা যখন পাখা বিস্তার করে উড়ে যায়, তখন শহীদের রক্ত আকাশ ধারণ করে।’  
কিন্তু এই ধরনের কোনো রেওয়ায়েত আমরা পাইনি যে, কোনো জনপদের ওপর পবিত্রতার আলামত স্বরূপ আকাশ শহীদের রক্ত ধারণ করে; বরং এই ধরনের কথার কোনো যৌক্তিকতাও নেই।  
অতএব যে কোনো দায়িত্বশীল লেখকের উচিত, কোনো কিছু লিখা বা বলার আগে তার শুদ্ধাশুদ্ধি যাচাই করে নেওয়া। কারো থেকে শোনে, কোনো বাজারি বইয়ে পড়ে কিংবা কোনো কিছু কল্পনা করে তাকে রেওয়ায়েতের মতো করে লিখে দেওয়া কোনো দায়িত্বশীল লোকের কাজ হতে পারে না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুমতি দান করুন। আমীন।
একটি ভুল ধারণা : কষ্টের সংবাদ দিয়ে না গেলে কবরে বৃক্ষ জন্মায় না
একজন সাহিত্যিক একটি বইয়ে লিখেছেন, ‘আমরা উত্তর বিনা মৃত্যুর দিকে অগ্রসর হতে চাই না, কি তোমার কষ্ট, তুমি আমাদের বল সাহেবচান্দ, আমরা শুনেছি, মানুষের কষ্টের সংবাদ না দিয়ে যারা কবরে যায় তাদের কবরে কোনো বৃক্ষ কোনোদিন হয় না।’
উক্ত শোনা কথাটি ভিত্তিহীন। কুরআন-হাদীসে এমন কোনো কথা নেই। তাছাড়া এটা স্বাভাবিকও নয়।
মানুষের মনে নানা দুঃখ-কষ্ট থাকে। মৃত্যুর আগে কাউকে না কাউকে এই সব দুঃখ-কষ্টের কথা বলতেই হবে তা অপরিহার্য নয়। শরীয়তও এমন কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি। বরং এমন সব কথা, যা অন্যের মনোকষ্টের কারণ হতে পারে কিংবা ঝগড়া-বিবাদ সৃষ্টি করতে পারে তা না বলাই ভালো।
অতএব কারো মনে এই ধরনের অলীক কথা ও ভিত্তিহীন বিশ্বাস থাকলে তা পরিহার করা চাই। 

শাবান-রমযান ১৪৩২ . জুলাই-আগস্ট ২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৭ . সংখ্যা: ০৭

রজব ১৪৩২ . জুন ২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৭ . সংখ্যা: ০৬
এটি হাদীস নয় : মেরাজে নবীজীর সাতাশ বছর সময় লেগেছিল
মেরাজ সম্পর্কে এক ওয়ায়েজকে বলতে শুনেছি যে, তাতে নাকি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাতাশ বছর সময় ব্যয় হয়েছিল। আরেক ওয়ায়েজ এই কথাটি বললেন আরো চটকদার করে। তার ভাষায়, ইন্তেকালের সময় যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জিবরীল ও মালাকুল মাওত হাজির হল, তখন তিনি মালাকুল মাওতকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি এত তাড়াতাড়ি কেন এলে? আল্লাহ তো আমাকে নববই বছর হায়াত দিয়েছিলেন। তখন জিবরীল বললেন, আপনার জীবনের সাতাশ বছর তো মেরাজের রাতেই অতিবাহিত হয়ে গেছে!
উপরোক্ত বর্ণনার কোনো ভিত্তি আমরা পাইনি। মেরাজের সহীহ ও নির্ভরযোগ্য রেওয়ায়েতগুলোর কোথাও বলা হয়নি যে, মেরাজে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কত সময় অতিবাহিত হয়েছিল। কুরআন মজীদ এবং সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসে বলা হয়েছে যে, এই ঘটনাটি একটি রাতে সংঘটিত হয়েছিল। তাতে পুরো রাত লেগেছিল নাকি রাতের কিছু অংশ, না চোখের পলকেই ঘটে গিয়েছিল তা সহীহ হাদীসে নেই। হাদীসে এই কথাও নেই যে, আল্লাহ তাআলা তখন সময় ও সৃষ্টিজগতকে স্থির রেখেছিলেন কি না। 
অতএব মিরাজের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ এবং তার রহস্য ও তাৎপর্য আলোচনার সময় এই সব অমূলক কথাবার্তার আশ্রয় নেওয়া খুবই নিন্দনীয় ও সর্বোতভাবে পরিত্যাজ্য।  কোনো দায়িত্বশীল ও আমানতদার ব্যক্তি এ ধরনের কথা বলতে পারেন না। আল্লাহ তাআলার পরিষ্কার আদেশ- 
ولا تقف ما ليس لك به علم
‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই এর পিছনে পড়ো না।’ এরপরও শুধু অনুমান ও ধারণার উপর ভিত্তি করে বলা, বিশেষত মানুষের সামনে বর্ণনা করা বড়ই অন্যায়। উপরন্তু তা যখন হয় আল্লাহ ও রাসূলের সাথে সম্পর্কিত তখন তো এর ভয়াবহতা বলার অপেক্ষা রাখে না। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন। আমীন।
তওবার জন্য কি অযু জরুরি
একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি কলামে লেখা হয়েছে, ‘গ্রামের প্রচলিত বিশ্বাস, তওবা পড়ানো হলে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। তওবা পড়ানোর জন্য মুন্সী আনা হল। সাফিয়া বিবি বললেন, না গো! আমি তওবার মধ্যে নাই। তওবা করতে হইলে অযু করা লাগবে। শইল্যে পানিই ছোঁয়াতে পারি না, অযু ক্যামনে করব।
সাফিয়া বিবির মনে হয়তো ভয় ঢুকে গিয়েছিল, তওবা মানেই মৃত্যু। তিনি মৃত্যু চান না ...।
কলামটির উদ্ধৃত অংশে কয়েকটি ধারণার উল্লেখ রয়েছে। এক. তাওবা করলে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ধারণা। ইতিপূর্বে এ বিভাগে এ সম্পর্কে লেখা হয়েছে। ঐ লেখায় বলা হয়েছিল যে, তওবা মানে জীবনের অবসান নয়; বরং তওবা মানে গোনাহমুক্ত নতুন জীবন লাভ।
দুই. তওবার জন্য অযু লাগে। এটিও ভুল ধারণা।
তিন. তওবা নিজে করার বিষয় নয়; বরং এর জন্য মুন্সী ডাকতে হয়। এই ভুল ধারণাগুলোর মূল কারণ অজ্ঞতা ও জাহালত। তওবা কাকে বলে তা জানা থাকলে এইসব ভিত্তিহীন ধারণা সৃষ্টি হয় না। এখানে তওবা সম্পর্কে কিছু কথা বলা হল।
তওবা মানে গোনাহ ত্যাগ করে আল্লাহর আনুগত্যের দিকে ফিরে আসা এবং অন্তর থেকে তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। তওবা হল আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন।
বান্দার যখন গোনাহ হয়ে যায় তখন তার কর্তব্য, আল্লাহর কাছে তওবা-ইস্তিগফার করা। অপরাধটি হক্কুল্লাহ বা আল্লাহর হক সম্পর্কিত হলে চারটি কাজ করতে হবে। তাহলে তওবা পূর্ণাঙ্গ হবে। ১. গোনাহ ছেড়ে দেওয়া। ২. লজ্জিত ও অনুতপ্ত হওয়া। ৩. ভবিষ্যতে এই ধরনের গোনাহ না করার দৃঢ় সংকল্প করা। ৪. কোনো ফরয-ওয়াজিব ছুটে গিয়ে থাকলে মাসআলা অনুযায়ী তার কাযা-কাফফারা আদায় করা।
আর অপরাধটি যদি হয় হক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক সংক্রান্ত তাহলে আরো একটি কাজ করতে হবে। যার হক্ব নষ্ট করা হয়েছে তার হক্ব আদায় করে কিংবা ক্ষমাগ্রহণ করে দায়মুক্ত হওয়া। এভাবে আল্লাহর কাছে নিজের কৃতকর্মের জন্য কান্নাকাটি ও অনুতাপের অশ্রু ফেলার নামই তওবা।
আল্লাহর দরবারে রোনাজারি ও ক্ষমাপ্রার্থনা নিজের ভাষায়ও করা যায়। তেমনি হাদীস শরীফে তাওবা-ইস্তিগফারের যে দুআগুলো আছে সেগুলো পড়েও তওবা-ইস্তিগফার করা যায়।
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা থেকে যে কথাগুলো বোঝা যায়, তা এই -
এক. তওবা করা তারই দায়িত্ব, যে গোনাহ করেছে। নিজের গোনাহর জন্য নিজেকেই অনুতপ্ত হতে হবে এবং আল্লাহর কাছে মাফ চাইতে হবে। যদিও আল্লাহর কোনো নেক বান্দার কাছ থেকে তওবা-ইস্তিগফারের নিয়ম জেনে নিয়ে তার বলে দেওয়া শব্দ উচ্চারণ করেও তওবা করা যায়, কিন্তু তওবার জন্য এটা জরুরি নয়। তাই তওবা নিজে করা যাবে না, কারো মাধ্যমেই করাতে হবে এই ধারণা ঠিক নয়। তদ্রূপ তওবার ক্ষেত্রে উল্লেখিত শর্তগুলো পালন না করে শুধু কারও বলে দেওয়া তওবার বাক্যগুলো উচ্চারণ করলেই তওবা হয়ে যায় না। তওবা হল মুমিন-জীবনের সার্বক্ষণিক আমল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও দিনে সত্তর থেকে একশত বার ইস্তিগফার করতেন বলে হাদীসে এসেছে।
দুই. আরো বুঝা গেল যে, তওবার জন্য অযু অপরিহার্য নয়। তবে কেউ যদি সালাতুত তাওবা বা তওবার নামার আদায় করতে চায়, তাহলে অন্যান্য নামাযের মতোই তাকে অযু করতে হবে। এ প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যদি কেউ কোনো গুনাহ করে ফেলে অতপর পূর্ণ পবিত্রতা অর্জন করে নামাযে দাঁড়ায় এবং আল্লাহর কাছে গোনাহ মাফ চায় তাহলে আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করে দিবেন। অতপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআন মজীদের আয়াত তিলাওয়াত করলেন, (তরজমা) ‘এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনো কোনো মন্দ কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং নিজেদের গোনাহর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আর কে আছে আল্লাহ ছাড়া, যে গোনাহ ক্ষমা করতে পারে? আর তারা জেনেশুনে তাঁদের কৃত-কর্মের উপর অবিচল থাকে না।’-সূরা আলইমরান : ১৩৫; জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩০০৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৫২১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ১৩৯৫
তবে সাধারণ তওবার জন্য অযু জরুরি নয়।
অতএব তওবাকে মৃত্যু মনে করা, অযু ছাড়া তওবা হয় না কিংবা অন্যের সহযোগিতা অপরিহার্য ইত্যাদি হচ্ছে কিছু ভ্রান্ত ও ভিত্তিহীন ধারণা। তওবা কী তা জানা থাকলে এ জাতীয় ভুল ধারণা সৃষ্টি হবে না ইনশাআল্লাহ।

জুমাদাল উখরা-১৪৩২ . মে-২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: 07 . সংখ্যা: 05
দুটি ভুল ধারণা
ক) খাওয়ার পর বরতন ধুয়ে খাওয়া কি সুন্নত?
কেউ কেউ মনে করে যে, খাওয়ার পর বরতন ধোয়া পানি পান করা সুন্নত। এই ধারণা সঠিক নয়। হাদীস ও সুন্নাহর কিতাবে এমন কোনো সুন্নতের কথা নেই। সুন্নত হল, খাওয়ার পর হাত, হাতের আঙ্গুল চেটে খাওয়া এবং বরতন ভালোভাবে মুছে খাওয়া। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এভাবে আঙ্গুল ও বরতন ভালোভাবে পরিষ্কার করে খাওয়ার আদেশ করেছেন। (সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২০২২)
সুতরাং আঙ্গুল ও প্লেট ভালোভাবে পরিষ্কার করে খাওয়া সুন্নত, ধুয়ে পানি পান করা সুন্নত নয়। তবে সুন্নত ও     মুস্তাহাব মনে না করে কেউ যদি প্লেট ধুয়ে পানি পান করে তাহলে এতে কোনো অসুবিধা নেই; বরং তা মুবাহ। কিন্তু একে সুন্নত বলা সঠিক নয়।
খ) খাওয়ার পর মুখমন্ডলে ও পায়ের তালুতে হাত মোছা কি সুন্নত?
কোনো মজলিসে দেখলাম, এক ব্যক্তি খাবারের পর অতি গুরুত্বের সাথে পায়ের তালুতে হাত মুছলেন এবং সঙ্গীকেও সুন্নত বলে এতে উৎসাহিত করলেন।
আসলে এটিও সুন্নত নয়। একে সুন্নত বলা ভুল; বরং চর্বিযুক্ত খাবারের ক্ষেত্রে হাত সাবান বা গরম পানি দ্বারা উত্তমভাবে পরিষ্কার করে রুমাল বা তোয়ালে জাতীয় কিছুতে মুছে নেওয়া উচিত। হাদীসে আছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যখন আহার করে, তখন সে যেন আঙ্গুল চেটে খাওয়ার আগে রুমালে হাত না মোছে। (মুসনাদে আহমদ ১/৩৪৬, হাদীস : ৩২৩৪)
যাই হোক, খাওয়ার পর পায়ের তালুতে হাত মোছা বা বরতন ধুয়ে পানি পান করা না-জায়েয নয়, কিন্তু একে সুন্নত বলা ভুল। কোনো কাজ বৈধ হওয়া আর সুন্নত হওয়া এক কথা নয়।
একটি কু-রসম : শ্বশুর বাড়ি প্রবেশের আগে নববধুর পা ধোয়ানো
কোনো কোনো এলাকায় প্রথা আছে,  শ্বশুরবাড়িতে প্রথম প্রবেশের সময় ঘরের বাইরে নববধুর পা ধোয়ার আয়োজন করা হয় এবং যারা তার পা ধুয়ে দেয় তাদেরকে বখশিশ দেওয়া হয়। মনে করা হয়, এই আচার পালন ছাড়া নববধুকে ঘরে তোলা অনুচিত। এটি একটি         কু-রসম। ইসলামে যার কোনো ভিত্তি নেই।
পায়ে ময়লা বা ধুলা-বালি লাগলে তা পরিষ্কার করা যায়, কিন্তু বিনা প্রয়োজনে পা ধোয়ানোর আয়োজন সমর্থনযোগ্য নয়। উপরন্তু এতে রয়েছে নববধুর প্রতি এক ধরনের মানসিক পীড়ন, যা একজন সচেতন নারী সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন। আর কোনো মুসলমানকে কষ্ট দেওয়া, সে পুরুষ হোক বা নারী, সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম। সাধারণ কোনো অতিথির সাথেও এমন আচরণ করা হলে নিঃসন্দেহে তিনি অপমানবোধ করবেন। তাহলে বাড়ির বধু হিসেবে যাকে গ্রহণ করা হচ্ছে তার সাথে এই আচরণের কী অর্থ?!
কোনো মানুষকে শুধু শুধু অশূচি ও অপবিত্র মনে করার ধারণা হিন্দু-সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু ইসলাম মানব ও মানবতাকে অনেক উঁচু মর্যাদা দিয়েছে। সত্ত্বাগতভাবে কোনো মুমিনকে অশুচি ও অপবিত্র মনে করার সুযোগ ইসলামে নেই। অতএব কোনো কুসংস্কার বা ভ্রান্ত বিশ্বাসের শিকার হয়ে নববধুর পা ধোয়ার আয়োজনও ইসলাম সমর্থন করে না। তাছাড়া শ্বশুরবাড়ির এমন কোনো আলাদা মর্যাদা বা বৈশিষ্ট্য নেই যে, সেখানে প্রবেশ করতে হলে পা ধুয়েই প্রবেশ করতে হবে।
ইসলামের পরিচ্ছন্ন আকীদায় যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে তাদের উচিত এই জাতীয় কু রসম পরিত্যাগ করা। 

জুমাদাল উলা-১৪৩২ . এপ্রিল-২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৭ . সংখ্যা: ০৪
একটি ভুল পদ্ধতি : নামাযে তাকবীরে তাহরীমা না বলে রুকুতে চলে যাওয়া
জামাতের নামাযে ইমাম যখন রুকুতে যান, তখন অনেককে দেখা যায়, রাকাত পাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া করে একটি তাকবীর বলতে বলতে রুকুতে চলে যান। এ পদ্ধতি সঠিক নয়। কারণ যে তাকবীরটি বলতে বলতে মুসল্লী রুকুতে যাচ্ছে, সেটাকে রুকুর তাকবীর বলা যায়। তাহলে তার তাকবীরে তাহরীমা তো আদায় হয়নি। অথচ তাকবীরে তাহরীমা ফরয। 
অতএব ইমামকে রুকুতে পেতে হলে কয়েকটি কাজ করা জরুরি। প্রথমে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে একবার আল্লাহু আকবার উচ্চারণ করবে। তারপর হাত না বেঁধে সোজা ছেড়ে দিবে। অতপর আরেকটি তাকবীর বলতে বলতে রুকুতে যাবে।
সারকথা এই যে, এখানে তাকবীর দুটি। প্রথমটি তাকবীরে তাহরীমা, যা নামাযের প্রথম কাজ। এই তাকবীর না বললে নামাযই হবে না। আর দ্বিতীয়টি রুকুর তাকবীর। এই তাকবীর বলা সুন্নত। কেউ যদি রুকুতে ইমামের সাথে শামিল হতে চায় তাহলে তার জন্য নিয়মমাফিক এই দুটি তাকবীর আদায় করা উচিত। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে রুকুর তাকবীর তো ছাড়া যেতে পারে, কিন্তু স্থির দাঁড়ানো অবস্থায় তাকবীরে তাহরীমা অবশ্যই বলতে হবে। এ বিষয়ে অধিক তাড়াহুড়া বা অবহেলা করলে নামায শুদ্ধ না হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। 
একটি রসম : ফাতেহায়ে ইয়াজদহম পালন
রবিউস সানীর এগার তারিখে অনেককে ফাতেহায়ে ইয়াজদহম (এগার তারিখের ফাতেহা) বা শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাহ.-এর ওফাত দিবস পালন করতে দেখা যায়। এ উপলক্ষে মসজিদে আলোকসজ্জা করা হয় এবং মাহফিল-মজলিসের আয়োজন করা হয়।  
এটা একটা কু-রসম। ইসলামী শরীয়তে জন্মদিবস ও মৃত্যুদিবস পালনের নিয়ম নেই। নবী-রাসূল, খোলাফায়ে রাশেদীন ও   সাহাবায়ে কেরাম আমাদের জন্য আদর্শ। তাঁদের কারোরই জন্মদিবস-মৃত্যুদিবস পালন করার কথা শরীয়তে নেই। তাদের জন্ম বা মৃত্যুদিবস পালন করতে হলে তো বছরের প্রতিদিনই পালন করতে হবে। অথচ নবী-রাসূল ও সাহাবায়ে কেরাম তো সকল ওলি-বুযুর্গেরও আদর্শ। আর এজন্যই বুযুর্গানে দ্বীন নিজেদের জন্মদিবস পালন করেননি বা অনুসারীদেরকে জন্মদিবস ও মৃত্যুদিবস পালনের আদেশ করেননি। পরবর্তী যুগের লোকেরা তা উদ্ভাবন করেছে।
ফাতিহায়ে ইয়াজদাহম সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে তারিখে ‘ফাতেহায়ে ইয়াজদাহম’ পালন করা হয় অর্থাৎ এগার রবিউস সানী তা ঐতিহাসিকভাবে শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাহ.-এর মৃত্যুদিবস হিসেবে প্রমাণিতও নয়।
কারণ তাঁর মৃত্যুর তারিখ নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে মতভেদ রয়েছে।
তাঁর জীবনীগ্রন্থ ‘তাফরীহুল খাতির ফী মানাকিবিশ শায়খ আবদুল কাদির’-এ এ সম্পর্কে কয়েকটি মত উল্লেখ করা হয়েছে : রবিউস সানীর নয় তারিখ, দশ তারিখ, সতের তারিখ, আঠার তারিখ, তের তারিখ, সাত তারিখ ও এগার তারিখ। আবার কারো কারো মতে রবিউল আউয়ালের দশ তারিখ। এই আটটি মত উল্লেখ করার পর গ্রন্থকার দশই রবিউস সানীকে প্রাধান্য দিয়েছেন। (দেখুন : ফাতাওয়া রহীমিয়া ২/৭৬-৭৭)
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আল্লামা হাফেয যাহাবী রাহ. (৭৪৮ হি.)ও বলেছেন-
توفي في عاشر ربيع الآخر سنة إحدى وستين، وله تسعون سنة
 ‘তিনি নববই বছর বয়সে ৫৬১ হিজরীর রবিউস সানীর দশ তারিখে ইন্তেকাল করেন।’ (তারীখুল ইসলাম ২৯/৬০)
এছাড়া ইতিহাস ও আসমাউর রিজালের অন্যান্য কিতাবেও আট, নয় ও দশ তারিখের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, এগার তারিখ নয়।
আর মৃত্যুর তারিখ নিয়ে মতবিরোধ না থাকলেও ‘মৃত্যুদিবস’ পালন করা শরীয়ত কর্তৃক অনুমোদিত নয়; বরং বছরের যেকোনো দিন নেককার বুযুর্গদের জীবনী আলোচনা করা যায় এবং তাঁদের জন্য ঈসালে ছওয়াব করা যায়। তা না করে নির্দিষ্ট একটি দিনে জায়েয-নাজায়েয বিভিন্ন রকমের কাজকর্মের মাধ্যমে দিবস উৎযাপন করা রসম ও বিদআত ছাড়া আর কিছু নয়।
এই ধরনের বিদআত ও রসম পালনের মাধ্যমে খোদ শায়খ আবদুল কাদের জীলানী রাহ.-এর মতো বুযুর্গ ওলিদের অবমাননাই করা হয়। আর আল্লাহ তাআলার অসন্তুষ্টিসহ বিদআতের অন্যান্য শাস্তি তো রয়েছেই।
এটি হাদীস নয় : আজানের জবাবে পুরুষ পাবে এক লক্ষ নেকী, মহিলা দুই লক্ষ নেকী
বছরখানেক আগে একজন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে, উপরের কথাটা হাদীস কি না। কিন্তু অনেক তালাশের পরও সহীহ হাদীসের কিতাবে তো নয়ই মওযূ ও জাল রেওয়ায়েতের কিতাবাদিতেও তার সন্ধান পাইনি। অথচ সহীহ হাদীসে আজানের জবাব দেওয়ার অনেক ফযীলত আছে। কোথাও ফযীলতের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের পার্থক্য ও আলাদা আলাদা ছওয়াবের কথা চোখে পড়েনি। অতএব সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই ধরনের ফযীলত বর্ণনা করা উচিত নয়।  

রবিউস সানী-১৪৩২ . মার্চ-২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: 07 . সংখ্যা: 03
একটি ভুল ঘটনা : হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের দিন কাবা শরীফে আযান শুরু
প্রচলিত আছে যে, হযরত ওমর রা. যেদিন ইসলাম গ্রহণ করেন, সেই দিন থেকে কাবাঘরে প্রথম আযান শুরু হয়।
রাহাতুল কুলুব জাতীয় কিছু বাজারী অনির্ভরযোগ্য বইয়েও এটিকে আরেকটু চটকদার করে উত্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যতদিন পর্যন্ত হযরত আমীরুল মুমিনীন ওমর ইবনে খাত্তাব রা. ইসলাম আনেননি ততদিন পর্যন্ত নামাযের আযান গুহায় গহবরে দেওয়া হত। কিন্তু যেদিন হযরত আমীরুল মুমিনীন হযরত ওমর ফারুক রা. ঈমান আনলেন সেদিন তিনি তলোয়ারমুক্ত করে দাঁড়িয়ে হযরত বেলাল রা.কে বললেন, কাবাঘরের মিম্বরে উঠে আযান দাও। হযরত বেলাল রা. তাঁর নির্দেশমতো কাজ করলেন।
বহুল প্রচলিত হলেও এই ঘটনাটি ভুল। কারণ বিশুদ্ধ রেওয়ায়েত ও নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক সূত্র মতে, আযানের আদেশ এসেছিল মদীনায়, নবীজীর হিজরতের পর। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬০৪; ফাতহুল বারী ২/৯৩-৯৪)
অথচ হযরত ওমর রা. ইসলাম গ্রহণের ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল মক্কায়, ইসলামের প্রাথমিক যুগে। অতএব তাঁর ইসলাম গ্রহণের দিন কাবা শরীফে আযান শুরুর কথা অযৌক্তিক।
তবে এই কথা সত্য, হযরত ওমর রা. ইসলাম কবুলের পর ইসলামের শান-শওকত অনেক বুলন্দ হয়। ইসলামের প্রকাশ্য কার্যক্রম শুরু হয়। হযরত ইবনে মাসউদ রা. বলেন, আমরা ওমরের ইসলাম গ্রহণের ফলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছি। আমরা পূর্বে কাবা শরীফে নামায আদায় করতে পারতাম না। যখন ওমর ইসলাম কবুল করলেন তাদের সাথে যুদ্ধ করলেন, ফলে তারা আমাদেরকে বাইতুল্লাহয় নামায পড়তে দিতে বাধ্য হল। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৬৮৪; ফাতহুল বারী ৭/৫৯; তবাকাতে ইবনে সাদ ৩/২৭০)
হয়ত বাইতুল্লায় প্রকাশ্য নামায আদায়ের রেওয়ায়েতটিকেই ভুলভাবে উপস্থাপন করে আযান দেওয়ার শব্দে বলা হয়েছে। অথচ সহীহ রেওয়ায়েতে আযানের কোনো উল্লেখ নেই।
একটি ভুল কথা : হাত চুলকালে টাকা আসে
কারো হাত বা হাতের তালু চুলকালে বলা হয় যে, তার হাতে টাকা বা অর্থ-কড়ি আসছে!
বাস্তবে এটি একটি ভিত্তিহীন কথা। হাত বা হাতের তালু চুলকানোর সাথে টাকা-পয়সা আসা-যাওয়ার কোনোই সম্পর্ক নেই। অতএব এই ধরনের অবাস্তব ও অযৌক্তিক কথা পরিহার করা উচিত।  
একটি ভুল মাসআলা : দাফনের পূর্বে ঈসালে সওয়াব ও দুআ-ইস্তিগফার নিষেধ
পাকিস্তানের বহুল প্রচারিত একটি দৈনিকে মাসআলাটি পড়ে বিস্মিত না হয়ে পারিনি। কোনো এক প্রসঙ্গে সেখানকার এক পার্লামেন্ট সদস্য পার্লামেন্টে এ মাসআলা বয়ান করেছেন যে, মৃত ব্যক্তির দাফনের পূর্বে তার জন্য ফাতেহাখানি ও ঈসালে সওয়াব করা   যায় না।
এই বক্তব্য সঠিক নয়; বরং যাকে আমরা জানাযার নামায বলি, সেটাও মূলত মাইয়িতের জন্য মাগফিরাতেরই দুআ। বলা বাহুল্য, তা মাইয়িতের দাফনের পূর্বেই করা হয়।
জানাযা ও দুআয়ে মাগফিরাত হওয়ার কারণেই ওলামায়ে কেরাম জানাযার পর পুনরায় হাত উঠিয়ে মুনাজাত করাকে বিদআত বলেছেন। আর তা শরীয়ত কর্তৃকও প্রমাণিত নয়। হয়তোবা এখান থেকেই কেউ কেউ ঐ ভুল ধারণার শিকার হয়েছেন যে, দাফনের পূর্বে ঈসালে সওয়াব ও দুআয়ে মাগফিরাত করা যায় না।
কিন্তু সঠিক মাসআলা হল, শরয়ীভাবে কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকলে মৃত্যুর পর হতে মৃত ব্যক্তির উপকারে আসে-এমন যে কোনো আমল দ্বারা সাধারণ শরীয়ত সম্মত পন্থায় ঈসালে সওয়াব করা যায়।
এক্ষেত্রে দাফনের পূর্ব ও পরের কোনো পার্থক্য নেই।
এটি হাদীস নয় : من عمل بما علم ورثه الله علم مالم يعلم
যে ব্যক্তি ইলম অনুযায়ী আমল করে আল্লাহ তাকে না জানা বিষয়ের ইলম দান করেন
লোকমুখে এটি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস হিসেবে প্রসিদ্ধ। কিন্তু হাদীস বিশারদদের মত হল, এটি হাদীস নয়। কারণ নবীজী পর্যন্ত এর নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র নেই। যে সূত্রে এটি বর্ণিত হয়েছে-তাকে জাল সাব্যস্ত করে হাফেয আবু নুআইম রাহ. স্পষ্ট ভাষায় বলেন,
ذكر أحمد بن حنبل هذا الكلام عن بعض التابعينعن عيسى بن مريم عليه السلام فوهم بعض الرواة أنه ذكره عن النبي صلى الله عليه وسلم فوضع هذا الإسناد عليه لسهولته وقربه وهذا الحديث لا يحتمل بهذا الإسناد عن أحمد.
(হিলয়াতুল আওলিয়া ১০/১৫; রিসাতুল মুসতারশিদীন পৃ. ১৫৫)
এই কারণে অন্যান্য মুহাদ্দিসগণও তাদের মাওযূআত বিষয়ক কিতাবাদিতে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। (দেখুন : আলফাওয়াইদুল মাজমুআ ২/৩৬৭; আলআসরারুল মারফূআ ২৩৫; তাযকিরাতুল মাওযূআত ২০)
অতএব উল্লেখিত কথাটিকে হাদীস হিসেবে উদ্ধৃত করা ঠিক নয়।

রবিউল আউয়াল ১৪৩২ . ফেব্রুয়ারী ২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৭ . সংখ্যা: ২
একটি ভুল চিন্তা : তওবা করলে বা করালে কি মওত এসে যায়?
যতই তাজ্জবের বিষয় মনে হোক, দ্বীনের সহজ-সরল বিষয়গুলো নিয়ে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সীমা-পরিসীমা নেই। কোনো কোনো এলাকার মানুষের ধারণা, তাওবা করলে কিংবা তাওবা করানো হলে মওত এসে যায়। তারা মনে করে, তাওবা মৃত্যুর পূর্বে করার বিষয়, এর পূর্বে নয়। নাউযুবিল্লাহ মিন যালিকা।
এ ধারণা সম্পূর্ণ অজ্ঞতাপ্রসূত; বরং তাওবা ও ইস্তিগফার মুমিন জীবনের সার্বক্ষণিক ওযীফা। হাদীসে এসেছে, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনে সত্তর থেকে এক শতবার তাওবা-ইস্তিগফার করতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস :  ৬৩০৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২৭০২)
কেয়ামতের পূর্ব পর্যন্ত তাওবার দরজা খোলা থাকবে।
তওবাতে বিলম্ব করা গুনাহ। এরপরও আল্লাহ তাআলা সব সময়ের জন্যই তওবার দরজা খোলা রেখেছেন। বান্দা যখন চায় তখনই তওবা করে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে পারে। যখন মৃত্যু উপস্থিত হবে সে সময়ের তওবা কবুল হওয়ার প্রতিশ্রুতি নেই তাই তওবাতে বিলম্ব করা বড় ক্ষতির বিষয়। কারণ আমাদের কারো জানা নেই, কখন মৃত্যু উপস্থিত হবে। তওবা মৃত্যু নয়; বরং তা হল মুমিন বান্দার জীবন।
যে কোনো ধরনের গুনাহ ও আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন-এমন কাজ থেকে তাওবা করা মানে হল, ঐ গুনাহ ছেড়ে দেওয়া। কৃত গুনাহর কারণে অনুতপ্ত হওয়া এবং ভবিষ্যতে তা না করার সুদৃঢ় সংকল্প করা। আর গুনাহ বান্দার হক সংক্রান্ত হয় তাহলে তা থেকে দায়মুক্ত হওয়া।
তাওবার ব্যাখ্যা থেকেও বোঝা যায় যে, এটি প্রত্যেক মুমিনের জন্য সব সময়ের আমল।
একটি ভুল কথা: হাঁচি এল মানে কেউ স্মরণ করছে!
কারো হাঁচি এলে বা খাওয়ার সময় গলায় কিছু আটকে গেল বলা হয় যে, কেউ তাকে স্মরণ করছে।
বাস্তবে এটি একটি ভিত্তিহীন কথা। হাঁচি আসা ও গলায় খাবার আটকে যাওয়ার সাথে কারো স্মরণ করার কোনো সম্পর্ক  নেই। অতএব এই ধরনের ভিত্তিহীন কথা না বলা উচিত।
একটি বানোয়াট কিসসা
একজন বেদআতী ওয়ায়েজ হযরত আবদুল কাদের জিলানী রাহ.-এর ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে এই কিসসার অবতারণা করেছেন যে, নাউযুবিল্লাহ-আল্লাহ তাআলার নাকি একবার মানুষের গোস্ত খাওয়ার ইচ্ছা হল। তখন তিনি হযরত মুসা আ.কে আদেশ দিলেন, যাও, মনুষের গোশত নিয়ে এস। হযরত মুসা আ. অনেকের কাছে চাইলেন। কিন্তু কেউ নিজের শরীরের গোশত কেটে দিতে রাজি হল না। আশাহত হয়ে তিনি একটি পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি পাহাড় থেকে ডাক দিল, হে মুসা! এদিকে আস। আমার কাছ থেকে গোশত নিয়ে যাও। অতপর ঐ ব্যক্তি নিজের শরীর কেটে গোশতের একটি টুকরা দিয়ে দিলেন। ঐ টুকরা নিয়ে হযরত মুসা আ. আল্লাহর কাছে পেশ করলেন। তখন আল্লাহ বললেন, হে মুসা! তুমিও তো একজন মানুষ। তুমি তো দিতে পারনি। যে দিয়েছে সে কে জান? সে আমার আবদুল কাদের জিলানী!!!
পুরো কিসসাটির আগাগোড়া নির্জলা মিথ্যা। এটি এতই মারাত্মক কথা যে, কোনো মুসলিম তা উচ্চারণ করতে পারে না। অথচ কিছু বিকৃত    চিন্তার মানুষ এ জাতীয় কিছু বর্ণনা করে দুর্বল বোধ-বুদ্ধির অধিকারী মুসলমানদের পথভ্রষ্ট করে চলেছে। অথচ এ জাতীয় কথাবার্তা শোনামাত্রই বলা উচিত-
سبحانك، هذا بهتان عظيم سبحانك، هذا بهتان عظيم

হে আল্লাহ! তুমি পবিত্র সত্ত্বা। এটি সুস্পষ্ট অপবাদ।
এটি হাদীস নয়
عند عند ذكر الصالحين تتنزل الرحمة
নেককারদের আলোচনাকালে রহমত নাযিল হয়
নেককার-বুযুর্গদের আলোচনার সময় অনেককে উপরোক্ত কথাটি হাদীস হিসেবে বলতে শোনা যায়। মুহাদ্দিসীনে কেরামের সিদ্ধান্ত হল, এটি হাদীস নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত-এর কোনো সনদ নেই; বরং এটি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস সুফিয়ান ইবনে উয়াইনা রাহ. (১০৭ হি.-১৯৮ হি.)-এর উক্তি। (হিলয়াতুল আউলিয়া ৭/৩৩৫; আততামহীদ ১৭/৪২৯)
এই কারণে মুহাদ্দিস ও হাফেযে হাদীস আল্লামা ইরাকী রাহ. বলেন-
ليس له ليس له أصل مرفوع، وإنما هو قول سفيان بن عيينة.

‘মারফূ’ (সরাসরি নবীজী থেকে বর্ণিত) হাদীস হিসেবে এর কোনো ভিত্তি নেই; বরং এটি সুফিয়ান ইবনে উয়াইনাহ রাহ.-এর একটি উক্তিমাত্র।’ (তাখরীজে ইরাকী-ইহয়াউ উলূমিদ্দীন ৩/৩২৯; ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাকীন (৬/৩৫০-৩৫১)
হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসও একই সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। (আলমাকাসিদুল হাসানা ৪৬৭; আল ফাওয়াইদুল মাজমুআ ২/৬২২) আরো দেখুন : মোল্লা আলী কারী, আল মাওযূআতুল কুবরা ৮৩, তাহের পাটনী, তাযকিরাতুল মাওযূআত ১৯৩
তবে মূল কথাটি যেহেতু অভিজ্ঞতার দ্বারা প্রমাণিত। তাই হাদীস হিসেবে বর্ণনা না করে বুযুর্গদের উক্তি হিসেবেই বর্ণনা করা উচিত। নির্ভরযোগ্য সূত্রে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত না হলে তা হাদীস হিসেবে বলার কোনো সুযোগ নেই।

সফর ১৪৩২ . জানুয়ারী ২০১১

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৭ . সংখ্যা: ১
নামাযে কয়েকটি ভুল
নামাযে মনে মনে কুরআন পড়া
যে সমস্ত নামাযে আস্তে কেরাত পড়া হয়, সে সকল নামাযে অনেককে দেখা যায়, মুখ-ঠোঁট না নেড়ে মনে মনে সূরা কেরাত পড়েন। হয়তো তারা এই ভুল ধারণা করে আছেন যে, আস্তে আস্তে কেরাত পড়া মানে মনে মনে পড়া।
এটি ঠিক নয়। কারণ যে সকল নামাযে কেরাত আস্তে পড়তে বলা হয়েছে, তার অর্থ হল, নিচু স্বরে তিলাওয়াত করা। আর এতো খুবই সহজ কথা যে, মনে মনে পড়া কোনোক্রমেই নিচু স্বরে পড়া নয়।
ফিকহ-ফাতাওয়ার কিতাবাদি থেকেও বোঝা যায় যে, আস্তে কেরাত পড়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি হল এমনভাবে পড়া, যেন সে নিজে শুনতে পায়। আর সর্বনিম্ন এতটুকু তো অবশ্যই জরুরি যে, সহীহ-শুদ্ধভাবে হরফ উচ্চারণ করা হবে এবং ঠোঁট-জিহবার নড়াচড়া  দেখা যাবে। একটি হাদীসে আছে যে, যোহর ও আসর নামাযে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কুরআন পড়তেন, তখন কোনো কোনো আয়াত সাহাবায়ে কেরামও কখনো কখনো শুনতে পেতেন। হযরত আবু মামার বলেন, আমরা হযরত খাববাব রা.কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি যোহর ও আসর নামাযে কুরআন পড়তেন? তিনি বললেন, হ্যাঁ। আমরা প্রশ্ন করলাম, আপনারা কীভাবে বুঝতেন? তিনি বললেন, ‘বিজতিরাবি লিহয়াতিহী’-তাঁর দাঁড়ি মোবারক নড়াচড়া দ্বারা। (সহীহ বুখারী-ফাতহুল বারী ২/২৮৪-২৮৭)
অতএব কেরাত পড়ার সময় জিহবা ও ঠোঁট ব্যবহার করে মাখরাজ থেকে সহীহ-শুদ্ধভাবে হরফ উচ্চারণ করতে হবে। অন্যথায় শুধু মনে মনে পড়ার দ্বারা কেরাত আদায় হবে না।
তাকবীরে তাহরীমা মনে মনে বলা
এটি আরেকটি ভুল। ইমামের পিছনে নামায পড়ার সময় এই ভুলটি ব্যাপকভাবে দেখা যায়। কান পর্যন্ত হাত উঠিয়ে বাঁধাকেই অনেকে যথেষ্ট মনে করে। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, নামাযের শুরুতে তিনটি কাজ করতে হয়। প্রথমে মনে মনে কোন নামায পড়ছি-এর সংকল্প করতে হবে। এর নাম নিয়ত, যা নামায সহীহ হওয়ার জন্য জরুরি। উল্লেখ্য, মনে মনে সংকল্প করে নিলেই নিয়ত হয়ে যাবে, মুখে উচ্চারণ করতে হবে না।
দ্বিতীয় কাজটি হল, তাকবীরে তাহরীমা। অর্থাৎ স্পষ্ট উচ্চারণে ‘আল্লাহু আকবার’ বলা। যেহেতু এই তাকবীরের মাধ্যমে নামায বহির্ভূত সকল কাজ হারাম হয়ে যায় তাই একে ‘তাকবীরে তাহরীমা’ বলে। এই তাকবীর বলা ফরয। যা স্পষ্টভাবে মুখে উচ্চারণ করতে হবে।
তৃতীয় কাজ হল, কান পর্যন্ত দুই হাত উঠিয়ে ডান হাত দিয়ে বাম হাত ধরে নাভির নিচে বাঁধা। এই কাজটি সুন্নত।
প্রচলিত পরিভাষায় ‘নামাযের নিয়ত বাঁধা’ এই তিন আমলের সমষ্টিকেই বোঝায়।
এখন কেউ যদি শুধু হাত উঠিয়ে তা বেঁধে নিল কিন্তু আল্লাহু আকবার বলল না বা মনে মনে বলল তাহলে নামাযের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ ওয়াজিবটিই আদায় হয়নি। ফলে তার নামায আদায় হবে না।
অতএব এখানেও তাকবীর স্পষ্টভাবে মুখে উচ্চারণ করা অপরিহার্য। শুধু মনে মনে বলা যথেষ্ট নয়।
 আমীন মনে মনে বলা
এটিও আরেকটি ভুল। নিয়ম হল, জামাতে নামায পড়ার সময় ইমাম সূরা ফাতিহা সমাপ্ত করার পর মুকতাদী ‘আমীন’ বলবে। আমীন আস্তে বলা ও জোরে বলা দুটোই শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত। যদিও অধিকাংশ সাহাবী ও তাবেয়ীর আমল আস্তে বলাই ছিল, তাই অনেক ফকীহ আস্তে বলাকেই উত্তম বলেছেন। কিন্তু এর অর্থ কোনোভাবেই মনে মনে বলা নয়। ‘আস্তে বলা’ কিংবা ‘অনুচ্চস্বরে’ বলা আর মনে মনে বলা এক কথা নয়।
আমীন বলার ফযীলতপূর্ণ সুন্নতটি আদায় করার সময়ও তা স্পষ্টভাবে মুখে উচ্চারণ করা উচিত।
উদাহরণস্বরূপ এই তিনটি আমলের কথা বলা হল, অন্যথায় তাকবীর, তাসবীহ, তাশাহহুদ ও দুআর ক্ষেত্রেও একই ধরনের ভুল পরিলক্ষিত হয়। অথচ এই আমলগুলিও মুখে উচ্চারণের মাধ্যমে আদায় করতে হয়।  
অতএব উদাসীনতা বা অবহেলার কারণে হোক কিংবা না-জানার কারণে, সর্বাবস্থায় উল্লেখিত সকল ক্ষেত্রে মনে মনে বলার ভুল পদ্ধতি সংশোধনযোগ্য।

মুহাররাম ১৪৩২ . ডিসেম্বর ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৬ . সংখ্যা: ১২



যীকা'দাহ - ১৪৩১ . নভেম্বর - ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৬ . সংখ্যা: ১১
একটি শব্দের অর্থহীন প্রয়োগ: ‘রূহ’ বা ‘বিদেহী আত্মা’র মাগফিরাত কামনা
মৃত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাতের দুআর ক্ষেত্রে ‘মরহুমের রূহ কিংবা বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা’ জাতীয় শব্দ ব্যবহারের প্রচলন আছে।
মরহুমের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা একটি নেক আমল। হাদীস শরীফে এ আমলের তারগীব দেওয়া হয়েছে এবং এ প্রসঙ্গে অনেক মাসনূন দুআও হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে। অতএব মরহুমের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা উচিত। কিন্তু বিষয়টিকে মরহুমের রূহ বা ‘বিদেহী আত্মা’র সাথে যুক্ত করার কী অর্থ?
মাগফিরাত কামনার অর্থ হল, আল্লাহ যেন তার ‘গুনাহখাতা’ মাফ করে দেন, এই দুআ করা। গুনাহ যেমন মানুষের আভ্যন-রীণ ‘নফস’ দ্বারা হয় তেমনি বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাও হয়। তদ্রূপ আল্লাহ তাআলা না করুন-দুনিয়ার এইসব গুনাহখাতার জন্য যদি আখিরাতের আযাব ভোগ করতে হয় তাহলে রূহ যেমন তা ভোগ করবে তেমনি দেহও যে অবস্থায়ই থাকুক না কেন, তা ভোগ করবে। এটিই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আকীদা। একইভাবে নেয়ামত, সুখ-শান্তি ও দেহ-আত্মা উভয়ই ভোগ করবে। তাই দেহকে বাদ দিয়ে শুধু রূহের জন্য মাগফিরাত প্রার্থনার কোনো অর্থ হয় না। 
একটি রসম: দিনের প্রথম উপার্জনকে ভক্তি জানানো
সকালবেলা রাস্তায় চলাচল করলে অনেক সময় দেখা যায় যে, রিকশা, সিএনজি চালকরা দিনের প্রথম উপার্জন হাতে পাওয়ার পর তাতে চুমো দেয়, গাড়ির স্টিয়ারিং, হাতল বা কোনো অংশে ছোঁয়ানোর পরে বুকে ও চোখে লাগায়। অনেককে কপালে ঠেকাতেও দেখা যায়। তদ্রূপ কোনো কোনো ব্যবসায়ীও দিনের প্রথম উপার্জনকে এভাবে ভক্তি জানিয়ে থাকে।

নিজের কষ্টার্জিত অর্থের উপর মানুষের মায়া থাকা স্বাভাবিক। ‘দ্বীনে ফিতরাত’ ইসলামে এই স্বাভাবিক আকর্ষণ দোষণীয় নয়, কিন্তু উপরোক্ত ছোঁয়াছুয়ি ও কপালে ঠেকানোর মতো ভক্তিমূলক আচরণ অবশ্যই পরিত্যাজ্য। প্রথম উপার্জনকে ভক্তি জানালে পরবর্তী উপার্জনের পথ সুগম হবে-এমন ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।  
এসব আচরণের সবচেয়ে নিন্দিত দিকটি হল, উপার্জনের মাধ্যমকে অর্থাৎ গাড়ি, পণ্য বা ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানকে উপার্জনদাতা মনে করা, এমনকি কারো কারো কথাবার্তা থেকে তো পৌত্তলিকতারও আভাস পাওয়া যায়।
বাস্তব কথা এই যে, এই মাধ্যমগুলো উপলক্ষ মাত্র। তাই সবকিছু ঠিক থাকার পরও সবার উপার্জন এবং সব সময়ের উপার্জন সমান হয় না। উপার্জন ও রিযিক একমাত্র আল্লাহ তাআলার হাতে। তিনি কখন কাকে কিভাবে রিযিক দিবেন এবং কোন উপায়ে দিবেন তা একমাত্র তিনিই জানেন। মানুষের কাজ হল হালাল উপার্জনের চেষ্টায় আল্লাহর দেওয়া মেধা ও শক্তি ব্যবহার করা এবং আল্লাহর কাছে রিযিক প্রার্থনা করা। অতপর মাওলা দয়া করে বান্দাকে যা কিছু দান করেন তার উপর সন্তুষ্ট থাকা ও তাঁর শোকর গোযারী করা। সর্বোপরি এই অটল বিশ্বাস রাখা যে, উপার্জন আল্লাহর নেয়ামত। আর নেয়ামতের শেকার গোযারী  করলে আল্লাহ তাআলা তা বাড়িয়ে দেন। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
لئن شكرتم لازيدنكم
‘তোমরা যদি শোকর কর তাহলে অবশ্যই তোমাদেরকে আরো বেশি দান করব।’
উপার্জন হাতে আসার পর এই হল একজন মুমিনের কর্তব্য। তা না করে উপার্জনের মাধ্যম এবং উপার্জিত অর্থ-কড়িকে ভক্তি জানিয়ে মাথায় ও কপালে ঠেকানো সম্পূর্ণ অর্থহীন আচরণ। এর সাথে যদি কোনো ভ্রান্ত বিশ্বাস যুক্ত হয় তাহলে তা যে একটি গর্হিত কাজে পরিণত হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। 
একটি ভুল কথা: বিয়েতে ‘কালেমা’ পড়ানো
তাবলীগের একজন সাথী আমাকে বলেছেন যে, একদিন গাশতে তিনি  এক ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ভাই কালেমা পড়তে জানেন? লোকটি অবাক করে দিয়ে অত্যন্ত আশ্চর্য স্বরে বলল, নাহ! আমি তো এখনও বিয়ে করিনি!!
বিয়ের আক্বদ পড়ানোকে অনেকে ‘কালেমা’ পড়ানো বলে। কিন্তু এই তাবলীগী সাথীর ঘটনা শুনে বুঝলাম, ‘কালেমা পড়ানোর আরো অর্থ আছে।
সাধারণত কালেমা বলতে ‘কালেমা তাইয়েবা’ অর্থাৎ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ বা ইসলামের বুনিয়াদী আক্বীদা সম্বলিত কয়েকটি কালেমাকেই বুঝায়। বিয়ের আক্বদের সময় এই ধরনের কোনো কালেমা পড়া বা পড়ানোর নিয়ম নেই। মাসনুন খুতবার পর স্বাক্ষীদের উপসি'তিতে মেয়ে পক্ষের সম্মতিক্রমে খতীব ঈজাব বা প্রস্তাব দেন। ছেলে ‘কাবিলতু’ কিংবা কবুল করলাম শব্দ বলার সাথে আক্বদ পূর্ণ হয়ে ছেলেমেয়ে উভয়ে স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হয়ে যায়।
এখানে কালেমা পড়ানোর কোনো বিষয় নেই। তবে কাবিলতু বা কবুল করলাম শব্দটিকে যদি আরবী আভিধানিক অর্থে কালিমা বলা হয় তবুও তো এখানে পড়ানোর কিছু নেই। যেহেতু বিভ্রান্তির অবকাশ থাকে তাই বিয়ের আক্বদকে কালেমা পড়ানো না বলাই ভালো।
সবচেয়ে বড় কথা হল, দ্বীন সম্পর্কে কী পরিমাণ অজ্ঞতা ও উদাসীনতা থাকলে একজন মুসলমান কালেমা পড়াকে বিয়ের সময়ের বিষয় বলে মনে করতে পারে তা ভেবে দেখা উচিত এবং এ বিষয়ে আমাদের কোনো করণীয় আছে কি না তাও ভেবে দেখা কর্তব্য। 

শাওয়াল ১৪৩১ . অক্টোবর ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৬ . সংখ্যা: ১০
এটি হাদীস নয়: ‘মাদরাসা রাসূলের ঘর’
কোনো কোনো ওয়াজমাহফিলে এই ধরনের কথা শোনা যায় যে, ‘মসজিদ আল্লাহর ঘর আর মাদরাসা রাসূলের ঘর।’ আবার কোনো কোনো দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তা আরেকটু আগে বেড়ে এটাকে হাদীস হিসেবে এভাবেও বর্ণনা করেন যে,
المسجد بيت الله والمدرسة بيتي
‘মসজিদ আল্লাহর ঘর আর মাদরাসা আমার ঘর।’
এখানে লক্ষণীয় যে, উপরোক্ত কথায় দু’টি বাক্য রয়েছে। প্রথম বাক্যটি হল, ‘মসজিদ আল্লাহর ঘর’। এটি কুরআন ও হাদীস দ্বারা সমর্থিত । প্রায় এর কাছাকাছি শব্দ বিভিন্ন হাদীসেও বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু দ্বিতীয় বাক্য অর্থাৎ ‘মাদরাসা রাসূলের ঘর’ এটি কোনো হাদীস নয়। কেউ এটাকে হাদীস হিসেবে বললে ঠিক হবে না। তবে একথা বলাই বাহুল্য যে, ‘মাদরাসা’ যেখানে দ্বীনি তালীম-তরবিয়ত হয়, কুরআন-হাদীসের শিক্ষা দেওয়া হয়, আল্লাহ ও রাসূলের কথা আলোচনা হয় তা নিঃসন্দেহে মুবারক স্থান। এ সকল স্থান ফেরেশতারা ঘিরে রাখেন এবং সেখানে আল্লাহর রহমত ও সাকীনা নাযিল হয়। অতএব ঐসব ঘরও আল্লাহ ও রাসূলেরই ঘর। কিন' তাই বলে ‘মাদরাসা রাসূলের ঘর’ বাক্যটিকে হাদীস হিসেবে বলার সুযোগ নেই। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কথাটি বলেছেন তার কোনো প্রমাণ নেই। আর মসজিদ-মাদরাসার মধ্যে এভাবে বিভাজনও অনুচিত।
একটি ভুল বিশ্বাস: আলোচনা চলাকালে উপস্থিত হলে হায়াত দীর্ঘ হয়!
অনুপস্থিত কোনো  ব্যক্তিকে নিয়ে কথা চলছে এমন সময় সে উপস্তিত হলে অনেককে বলতে শোনা যায় যে, তুমি লম্বা হায়াত পাবে, আমরা তো তোমার কথাই আলোচনা করছিলাম!
এই ধরনের কথা এত বেশি প্রচলিত যে, শুনে মনে হতে পারে, তা একটি স্বতঃসিদ্ধ বিষয়। কিন্তু সামান্য চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, এর সাথে হায়াত বাড়া-কমার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বিশ্বাস। শরীয়তে যেমন এর কোনো ভিত্তি নেই তেমনি বিবেক-বুদ্ধিও এই ধরনের অলীক ধারণা সমর্থন করে না। অতএব এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
একটি ভুল ধারণা: বিধর্মীদের ‘ঈয়াদাত’ ও তাদের সুস্থতার জন্য দুআ করা যাবে কি না
অমুসলিম প্রতিবেশী বা পরিচিত কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া যাবে না-এমন একটি ধারণা অনেকের রয়েছে। আবার অনেকে মনে করে যে, মানবিক কারণে ‘ঈয়াদাত’ করা গেলেও সুস্থতার জন্য দুআ করা যাবে না। 
দু’টো ধারণাই ভুল; বরং প্রতিবেশী, আত্মীয় বা পরিচিত কেউ অমুসলিম হলেও অসুস্থ হলে তার ‘ঈয়াদাত’ করা উচিত। সেক্ষেত্রে একজন মুসলমানের তাকে দেখতে যাওয়া, খোঁজ-খবর নেওয়া এবং সম্ভাব্য সকল সেবা-শুশ্রূষা করা, উপরন' তাদের সুস্থতা ও হেদায়েতের জন্য আল্লাহর কাছে দুআ করাতে অসুবিধার কিছু নেই; বরং পারিপার্শ্বিক অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে এমনটি করাই উত্তম। কোনো বিধর্মী আত্মীয় বা প্রতিবেশী অসুস্থ হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের দেখতে যেতেন এবং দ্বীনের দওয়াত দিতেন। 
সহীহ বুখারীতে আছে, এক ইহুদী কিশোর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমত করত। সে অসুস্থ হয়ে পড়লে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দেখতে গেলেন এবং তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তখন সে মুসলমান হয়ে গেল। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৩৫৬, ৫৬৫৭)
সুতরাং কোনো পরিচিত অমুসলিম ব্যক্তি অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যাওয়া ও তার সুস্থতার জন্য দুআ করার অবকাশ আছে। সম্ভব হলে তার সামনে দ্বীনের দাওয়াতও পেশ করা উচিত। হতে পারে আল্লাহ তাআলা তাকে হক কবুল করার তাওফীক দিবেন এবং জাহান্নাম থেকে নাজাত দান করবেন।
একটি ভুল মাসআলা: বছরের শুরু-শেষের মধ্যে সম্পদের সর্বনিম্ন পরিমাণের যাকাত দেওয়া
কানাডা-প্রবাসী এক ভাই জানালেন, সে দেশের কিছু ইসলামী সংগঠনের পক্ষ হতে সরবরাহকৃত যাকাতের হিসাব সহজে বের করার নকশাসম্বলিত কাগজে লেখা আছে যে, যাকাত দেওয়ার ক্ষেত্রে বছরের শুরু ও শেষ উভয় সময়ের মধ্যে সম্পদের যে পরিমাণ সর্বনিম্ন সে হিসাবে যাকাত ওয়াজিব হয়। অতএব যাকাতদাতাকে এই সর্বনিম্ন পরিমাণ সম্পদের যাকাত দিতে হবে। বছরের শেষে এই পরিমাণের চেয়ে সম্পদ বেশি থাকলেও।
এটি সঠিক মাসআলা নয়; সঠিক মাসআলা হল, যাকাত-বর্ষ পূর্ণ হওয়ার সময় যে পরিমাণ সম্পদ থাকবে তার যাকাত আদায় করতে হবে। বছরের শুরুতে ও মাঝে সম্পদ কম থাকুক বা বেশি। যেমন বছরের শুরুতে মুহাম্মাদ আলী সাহেবের কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকার সম্পদ ছিল। বছরশেষে দেখা গেল, তার সম্পদের পরিমাণ পঞ্চান্ন হাজার টাকা। তাহলে এখন তাকে পঞ্চান্ন হাজার টাকার যাকাত আদায় করতে হবে। বছরের শুরু কিংবা শুরু-শেষের মাঝে সর্বনিম্ন পরিমাণের হিসাবে নয়।
এই মাসআলা হাদীস, আছার ও ফিকহে ইসলামীতে স্পষ্টভাবে বলা আছে। অতএব মাসআলা দেওয়া ও প্রচার করাসহ দ্বীনী যেকোনো কাজে সকলের সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি।

শাবান-রমজান ১৪৩১ . আগস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৬ . সংখ্যা: ৮-৯

রজব ১৪৩১ . জুলাই ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৬ . সংখ্যা: ৭
প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ, শ্রদ্ধা নিবেদন
আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আ. হতে যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর সকল মানুষ এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত-বন্দেগী করত। তাদের মধ্যে কুফর ও শিরক ছিল না। পরবর্তীতে কুফর-শিরকের মতো মারাত্মক ব্যাধির বিস্তার ঘটার পেছনে মূল কারণ ছিল ছবি ও প্রতিকৃতি। একটি সহীহ হাদীস থেকেও বোঝা যায় যে, পূর্ববর্তী যুগের স্মরণীয় বরণীয় নেককার লোকের মৃত্যু হলে তাদের ছবি ও প্রতিকৃতি বানানো হত। ছবি থেকে সম্মান প্রদর্শন, তা থেকে শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ানো, তা থেকে সিজদা করাসহ ধীরে ধীরে এসব প্রতিকৃতির ইবাদত-বন্দেগী শুরু হল। আল্লাহর সাথে তাদেরও কিছু অংশীদারিত্ব জুড়ে দিয়ে তারা মুশরিক জাতিতে পরিণত হল। ইসলামে শিরকের এই উৎসমুখ কঠোরভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে প্রতিকৃতি নির্মাণ বড় ধরনের গুনাহ, সেখানে নানা উপলক্ষে বিভিন্ন মনীষী ও ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতির সামনে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ এবং এ জাতীয় বিভিন্ন উপায়ে শ্রদ্ধা নিবেদন যে কত জঘন্য অপরাধ তা সহজেই অনুমেয়। এ সকল কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণরূপে কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী, যা একদিকে মানুষকে শিরকের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে এইসব মরহুম মানুষের (আল্লাহ সকল বিচ্যুতি ক্ষমা করে তাদের সাথে রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মুআমালা করুন) সকল অবদান ও কীর্তিকে কলুষিত করা হচ্ছে। অতএব শরীয়ত নির্দেশিত পন্থাতেই স্মরণীয়-বরণীয় মরহুম মানুষকে স্মরণ ও বরণ করা উচিত। এ পথেই দুনিয়া ও আখেরাত উভয় জাহানের মুক্তি ও সফলতা। অন্য কোনো পথে নয়।
দুটি বিদআত: ‘লাইলাতুর রাগাইব ও শবে ইস্তেফতাহ পালন
কিছুদিন আগে একটি মসজিদে ‘ইসলামী পবিত্র দিনসমূহ’ শিরোনামের একটি তালিকা নজরে পড়ল। সযত্নে লেখা এই তালিকাটিতে দেখলাম, রজব মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার ‘লাইলাতুর রাগাইব’ আর রজবের পনেরো তারিখ ‘শবে ইস্তেফতাহ’। আসলে রজব মাস নিয়ে কোনো কোনো মহলে বিভিন্ন কল্পিত বিদআত ও রসমের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এর সমর্থনে ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও জালকৃত বিভিন্ন বর্ণনাও ‘মাকছুদুল মুমিনীন’ ও ‘বার চাঁদের ফযীলত ও আমল’ জাতীয় কিছু অনির্ভরযোগ্য বইয়ে পাওয়া যায়। যেমন একটি জাল বর্ণনা হল, ‘যারা রজব মাসে রোযা রাখে তাদের গুনামাফীর জন্য ফেরেশতাকুল রজবের প্রথম জুমআর রাতের শেষ তৃতীয়াংশে দোয়ায় মগ্ন থাকেন।’ এরকম আরেকটি ভিত্তিহীন বর্ণনা হল, ‘যে ব্যক্তি রজবের প্রথম বৃহস্পতিবার রোযা রাখে অতঃপর মাগরিব ও ইশার মাঝখানে দু’রাকাত করে (বিশেষ পদ্ধতিতে) বার রাকাত নামায আদায় করে তার সকল প্রয়োজন পূরণ করা হয় এবং তার সকল গুনাহ মাফ করা হয়, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা, বালুকণা, পাহাড়ের ওজন এবং বৃক্ষের পাতার সমপরিমাণ হয়। আর কিয়ামতের দিন সে তার পরিবারের সাত শত গুনাহগার জাহান্নামের উপযোগী মানুষকে জান্নাতে নিয়ে যাবে।’ প্রয়োজন পূরণের কথিত এই রাতটির নামও রাখা হয়েছে ‘লাইলাতুর রাগাইব’। আর বিশেষ পদ্ধতির উল্লেখিত নামাযের নাম ‘সালাতুর রাগাইব’। এমনিভাবে পনের রজবের রাত সম্পর্কিত একটি জাল বর্ণনা হল, ‘এ রাতে চার রাকাত নামায বিশেষ নিয়মে আদায় করে নির্দিষ্ট পরিমাণ দুরূদ, তাসবীহ-তাহমীদ ও তাহলীল আদায় করলে আল্লাহর পক্ষ হতে তার নিকট এক হাজার ফেরেশতা পাঠানো হয়। যারা ঐ ব্যক্তির জন্য নেকী লিখতে থাকেন এবং ঐ রাত পর্যন্ত যত গুনাহ সে করেছে সব ক্ষমা করে দেন। অবশেষে তার কাঁধে হাত রেখে একজন ফেরেশতা বলে, তুমি নতুন করে আমল শুরু কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমার পূর্ববর্তী সকল গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন ...।’ গুনাহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে নতুন করে আমল শুরু করার এই বানোয়াট বর্ণনার কারণেই সম্ভবত এই রাতের নাম রাখা হয়েছে ‘শবে ইস্তেফতাহ’। উল্লেখিত বর্ণনা ছাড়াও এই দুই রাত সম্পর্কে এই ধরনের আরো প্রচুর পরিমাণ ভিত্তিহীন বর্ণনা রয়েছে। কিন্তু আসল কথা হল, শরীয়তে ‘লাইলাতুর রাগাইব’ ও ‘শবে ইস্তেফতাহ’ নামে বিশেষ মহিমান্বিত কোনো রাতের অস্তিত্বই নেই। নামে-বেনামে রজব মাসে এই বিশেষ রাত উদযাপন হচ্ছে নবউদ্ভাবিত বিদআত। কুরআন ও সুন্নাহ্‌য় যার কোনো প্রমাণ নেই। তেমনিভাবে ঐ রাত বা দিনগুলোতে কোনো নির্দিষ্ট নামায-রোযা বা অন্য কোনো বিশেষ আমলের কথাও ইসলামে নেই। এ সম্পর্কিত সকল বর্ণনা ও রেওয়ায়েত সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও জাল। অতএব ‘লাইলাতুর রাগাইব’ হোক কিংবা ‘শবে ইস্তেফতাহ’ এগুলো উদযাপন করা কিংবা কল্পিত ও ভিত্তিহীন বর্ণনার উপর নির্ভর করে বিশেষ ধরনের আমল করা সবই পরিত্যাজ্য। এগুলো থেকে দূরে থাকাই একজন মুমিনের একান্ত কর্তব্য।

জুমাদাল উখরা ১৪৩১ . জুন ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৬ . সংখ্যা: ৬
একটি ভুল মাসআলা :রিকশা বা যানবাহনে বসে কুরআন তেলাওয়াত করা কি নিষেধ?
আমাদের একজন বড় বুযুর্গ ব্যক্তির মুখে তাঁর নিজের এই ঘটনা কয়েকবার শুনেছি যে, একবার তিনি রিকশায় চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। চালক তাঁর আখলাকে অত্যন্ত প্রভাবিত হয়েছিল। রিকশা থেকে নেমে বিদায়ের সময় চালক বলল, আপনার ব্যবহার আমার কাছে খুব ভালো লেগেছে। তবে একটি কাজ আপনি ঠিক করেননি। তা হচ্ছে, আপনি রিকশায় বসে বসে কুরআন শরীফ পড়েছেন। এটা ঠিক না! বলাবাহুল্য, এটা ঐ বেচারার ভুল ধারণা। কারণ চলাফেরা, ওঠা-বসা, শয়ন-জাগরণ সর্বাবস্থায় যিকর করতে কুরআন মজীদে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আর সর্বোত্তম যিকর হচ্ছে, কুরআন মজীদ তেলাওয়াত।
এটি হাদীস নয়: আঠারো হাজার মাখলুকাত
উপরের কথাটি লোকমুখে এতই প্রসিদ্ধ যে, অনেকের কাছে তা কুরআন-হাদীসের বাণীর মতো স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু মাখলুকাতের এই নির্দিষ্ট সংখ্যা না কুরআনে আছে, না কোনো সহীহ হাদীসে। বাস্তবতা হল, আল্লাহ তাআলা অগণিত মাখলুক পয়দা করেছেন। জলে ও স্থলে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন প্রজাতির মাখলুক আল্লাহর অসীম কুদরতের প্রমাণ। মানুষের জানার বাইরেও রয়েছে অসংখ্য মাখলুক। আল্লাহ তাআলা কত ধরনের মাখলুক সৃষ্টি করেছেন তার নির্দিষ্ট সংখ্যা সহীহ হাদীসে বলা হয়নি। একটি ‘মুনকার’ বর্ণনায় এর সংখ্যা ‘এক হাজার’ বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক মুহাদ্দিস বর্ণনাটিকে মাওযূ বা জাল বলে আখ্যা দিয়েছেন। (আলমাওযূআত, ইবনুল জাওযী ২/২১৬; আলফাওয়াইদুল মাজমুআ পৃ. ৪৫৮-৪৫৯) এছাড়া এই সংখ্যা সম্পর্কে কিছু মনীষীর উক্তিও রয়েছে। যেমন মারওয়ান ইবনুল হাকামের কথামতে সতের হাজার জগত রয়েছে। আর আবুল আলিয়ার অনুমান অনুযায়ী চৌদ্দ হাজার কিংবা আঠারো হাজার মাখলুকাত আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। এই বিভিন্ন সংখ্যা কিছু মনীষীর উক্তিমাত্র, হাদীস নয়। দ্বিতীয়ত তাদের বক্তব্য থেকেও অনুমিত হয় যে, নির্দিষ্ট কোনো সংখ্যা বোঝাতে নয়; বরং আধিক্য বোঝাতেই তারা এ সব কথা বলেছেন। তাও আবার অনুমান করে। এই কারণে এর কোনোটিকেই প্রমাণিত সত্য মনে করার কোনো কারণ নেই; বরং এ বিষয়ে ইবনে কাসীর রাহ.-এর কথাটিই মূল কথা, যা তিনি আবুল আলিয়ার পূর্বোক্ত কথাটি পূর্ণভাবে উদ্ধৃত করার পর বলেছেন। আর তা হল, هذا كلام غريب يحتاج مثل هذا إلى دليل صحيح অর্থাৎ এটি এমন একটি আজব কথা, যার জন্য বিশুদ্ধ দলীলের প্রয়োজন রয়েছে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/২৬) অতএব আঠারো হাজার নয়; বরং বলা উচিত যে, আল্লাহ তাআলা অসংখ্য অগণিত মাখলুক পয়দা করেছেন, যা আমরা গুণে ও হিসাব করে শেষ করতে পারব না।
একটি ভুল ধারণা :ইস্তেখারার জন্য কি ঘুমাতে হয়?
কোনো কাজ করার ইরাদা করলে কিংবা অত্যাসন্ন কোনো বিষয়ে আল্লাহর সাহায্য কামনা করতে তাঁরই দরবারে কায়মনোবাক্যে বিশেষ পদ্ধতিতে প্রার্থনা করার নাম ইস্তেখারা। অর্থাৎ ইস্তেখারার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করে যে, আমি যা করতে চাই তাতে যদি আমার কল্যাণ থাকে তাহলে তা আমার জন্য সহজ করে দিন এবং বরকত দান করুন। আর যদি তাতে কল্যাণ না থাকে তাহলে তা থেকে আমাকে বিরত রাখুন এবং যাতে আমার কল্যাণ তা-ই আমাকে দান করুন। এটিই হল ইস্তেখারার হাকীকত। ইস্তেখারার জন্য দুটি কাজ করণীয় বলে সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে। দু’ রাকাত নামায আদায় করা এবং ইস্তেখারার প্রসিদ্ধ মাসনূন দুআটি মনোযোগের সাথে পড়া। সময়ের স্বল্পতা বা অন্য কোনো কারণে এই দু’টি কাজ সম্ভব না হলে তিনবার বা সাতবার এই দুআ পড়েও ইস্তেখারা করা যায়, اللهم خر لي واخترلي (ইবনুস সুন্নী, হাদীস : ৫৯৭, ৫৯৮) অতঃপর যে দিকে কলবের ইতমিনান হবে আল্লাহর উপর ভরসা করে সেই কাজ আরম্ভ করবে। এভাবে আমল করলে ইস্তেখারা হয়ে যাবে। উল্লেখ্য যে, এই আমল করার জন্য শরীয়তে নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। রাত বা দিনের যেকোনো সময় তা করা যায়। কিন্তু অনেকে মনে করে, ইস্তেখারার জন্য ঘুমাতে হয় কিংবা রাত্রি বেলায় ঘুমানোর আগেই শুধু ইস্তেখারা করা যায়। আবার অনেকে মনে করে, স্বপ্ন দেখলেই ইস্তেখারা পূর্ণ হবে। আসলে এর কোনোটিই ইস্তেখারার জরুরি কোনো বিষয় নয়; বরং রাত-দিনের যে সময় নামায পড়া যায় তখনই দুই রাকাত নামায ও নির্দিষ্ট দুআটি পড়ে ইস্তেখারা করে নেওয়া যায়।
http://www.alkawsar.com/article/225

জুমাদাল উলা ১৪৩১ . মে ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৬ . সংখ্যা: ৫
একটি ভুল শব্দঃ অকাল মৃত্যু
কম বয়সে কারো মৃত্যু হলে অকাল মৃত্যু শব্দটি ব্যবহার করতে দেখা যায়। এই প্রয়োগ এড়িয়ে চলা কর্তব্য। কারণ প্রত্যেক প্রাণীর জন্য ‘মৃত্যু’ যেমন অনিবার্য তেমনি তার দিন-ক্ষণও নির্ধারিত। সেই নির্ধারিত সময়েই তার মৃত্যু হবে। এতে সামান্য এদিক-সেদিক হবে না। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, وما كان لنفس ان تموت الا باذن الله كتابا موجلا তরজমা : আল্লাহর হুকুম ব্যতীত কারো মৃত্যু হতে পারে না। কেননা, তা সুনির্ধারিত।-সূরা আলইমরান : ১৪৫ আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, لو يواخذ الله الناس بظلمهم ما ترك عليها من دابة ولكن يوخرهم الى اجل مسمى فاذا جاء اجلهم لا يستأخرون ساعة ولا يستقدمون তরজমা : আর যদি আল্লাহ মানুষকে তাদের জুলুমের কারণে শাস্তি দিতেন তবে ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণকারী কোনো প্রাণীকেই রেহাই দিতেন না, কিন' তিনি এক নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দিয়ে থাকেন। অতঃপর যখন তাদের নির্ধারিত সময় উপস্থিত হয় তখন তারা মুহূর্তকাল বিলম্ব অথবা ত্বরা করতে পারে না।-সূরা নাহল : ৬১ আল্লাহ তাআলা আরো বলেন, قل فادرؤا عن انفسكم الموت ان كنتم صدقين তরজমা : আপনি বলে দিন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে নিজেদেরকে মৃত্যু থেকে রক্ষা কর।-সূরা আল ইমরান : ১৬৮ হায়াত-মওতের মালিক আল্লাহ তাআলা এবং পৃথিবীতে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেক প্রাণীর জীবনকাল আল্লাহ তাআলার নিকট সুনির্ধারিত। অতএব কেউ যদি মায়ের পেট থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পর মারা যায়, তবে এইটুকুই তার হায়াত। তদ্রূপ কেউ যদি পঁচিশ-ত্রিশ বছরের যৌবনকালে মৃত্যুবরণ করে তবে এই পঁচিশ-ত্রিশ বছরই তার হায়াত। তার মৃত্যু সেই সময় মতোই হয়েছে, আল্লাহ তাআলা যা তার জন্য নির্ধারিত করেছেন। এমনিভাবে একশ বছর বয়সে কারো মৃত্যু হওয়ার মানে এই নয় যে, সে তার জন্য নির্ধারিত সময়কালের অধিক হায়াত পেয়েছে। এটি অতি সহজ একটি কথা। সুতরাং কম বয়সে কারো মৃত্যু হলে সমবেদনা জানাব, মরহুমের মাগফিরাতের জন্য দুআ করব, বড় জোর বলব যে, তার তাকদীরে কত কম হায়াত লিখিত ছিল! কিন্তু এটাকে আবেগের বশে অকাল মৃত্যু শব্দে ব্যক্ত করব না।
একটি ভুল শ্লোগানঃ ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার
এই মুখরোচক শ্লোগানটি ইদানীং খুব শোনা যায়। একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী তোতাপাখির মতো তা আওড়ে থাকেন। সম্ভবত তারা বলতে চান, ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয়। অতএব সমাজ-ব্যবস্থা, বিচার-ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র-ব্যবস্থার সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এই সেক্যুলার ধ্যান-ধারণা হয়তো মানবরচিত ধর্মের ক্ষেত্রে সত্য, কিন্তু আসমান-জমিনের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ প্রদত্ত ধর্ম ইসলামের বেলায় তা সম্পূর্ণ অবাস্তব। এতে অনুপরিমাণ সন্দেহ নেই। এই বিষয়ে প্রত্যেক মুসলিমের পরিষ্কার ধারণা ও অটল ঈমান থাকা অপরিহার্য কর্তব্য। পূর্ণ কুরআন মজীদ এবং হাদীস ও সুন্নাহর মৌলিক গ্রন্থাবলী অধ্যয়ন করা সম্ভব না হলে বিষয়ভিত্তিক কুরআনের আয়াতের উপর লিখিত কোনো গ্রন্থ কিংবা সুন্নাহয় আলোচিত বিষয়াবলির উপর খৃষ্টান প্রাচ্যবিদ ড. এ.জে. উইংসিং রচিত (মিফতাহ কুনুযিস সুন্নাহ) র শিরোনামগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে নিতে পারেন। ইসলামী খেলাফত থাকা অবস্থায় সকল মুসলিম জনপদ ছিল একই কেন্দ্রের অধীন। তখন ইসলামী শাসন-ব্যবস্থা, বিচার-ব্যবস্থাসহ ইসলামের জীবন-ব্যবস্থার বাস্তব কাঠামো ছিল প্রত্যেক মানুষের সামনে দৃশ্যমান। কিন্তু একসময় আমাদের কৃতকর্মের কারণে ইসলামী খেলাফতের দুর্বলতার সুযোগে আল্লাহর দুশমনরা বিশাল মুসলিম সালতানাতকে টুকরা টুকরা করে ফেলে। মুসলিম জনপদগুলো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত হয়ে গেলে মুসলমানরা আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দেওয়া খেলাফত-ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। দুঃখজনকভাবে বর্তমান সময়ে পৃথিবীর কোনো ভূ-খণ্ডেই পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামী খেলাফত-ব্যবস্থা চালু নেই। আর এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে মানুষের মন থেকে চিরতরে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ জীবন-ব্যবস্থার চিত্র মুছে দিতে আল্লাহর দুশমনরা এই সব অর্থহীন শ্লোগানের কৌশলী ব্যবহারে উদ্যোগী হয়েছে। অতএব এই পরিবর্তিত পরিসি'তিতে সকল মুমিন-মুসলমানের মনে অনুশোচনা থাকতে হবে এবং জীবনের সকল অঙ্গনে ইসলামী জীবন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় শরীয়তসম্মত উপায়ে চেষ্টা-প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। সর্বোপরি অটল বিশ্বাস রাখতে হবে যে, যদিও আমরা সাময়িকভাবে ইসলামী খেলাফতের রহমত থেকে বঞ্চিত, কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামেরও সুষ্ঠু, সুষম ও প্রতিযুগে কার্যকর একটি আদর্শ ব্যবস্থা রয়েছে, যা সর্বযুগে অশান্ত পৃথিবীর জন্য শান্তির একমাত্র চাবিকাঠি। আল্লাহ সকলকে হেফাযত করুন এবং পূর্ণাঙ্গভাবে ইসলামে দাখিল হওয়ার তাওফীক দান করুন। আমীন।

রবিউস সানী ১৪৩১ . এপ্রিল ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৬ . সংখ্যা: ০৪
এটি হাদীস নয়
কোনো কোনো বক্তাকে এই ধরনের ঘটনা বলতে শোনা যায় যে, হযরত ঈসা আ.কে বাল্যকালে তাঁর মা মারইয়াম আ. যখন মকতবে পাঠিয়েছিলেন তখন মকতবের শিক্ষক তাঁকে বললেন, বল, আলিফ, বা ...। ঈসা. প্রশ্ন করলেন, আলিফ অর্থ কী? শিক্ষক ছোট ছেলের অনাকাঙ্খিত প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারলেন না। তখন ঈসা আ. নিজেই শিক্ষকের চেয়ারে বসে আলিফ থেকে শুরু করে ইয়া পর্যন্ত প্রতিটি বর্ণের ব্যাখ্যা করলেন এবং প্রত্যেকটি বর্ণ থেকে আল্লাহর বিভিন্ন মহিমার বর্ণনা দিলেন। আবার অনেক বক্তার মুখে বিসল্লিাহির রাহমানির রাহীমের প্রতিটি বর্ণের আলাদা আলাদা ব্যাখ্যা দেওয়ার কথাও শোনা যায়। কিন্তু বাস্তবতা হল, এই সংক্রান্ত ঘটনা ও বর্ণনা কোনোটিই প্রমাণিত নয়। যে সকল বর্ণনায় এই ধরনের ঘটনা রয়েছে তাকে হাদীস-বিশারদরা প্রমাণিত নয় বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লামা ইবনুল জাওযী রাহ. বলেছেন, ما يصنع مثل هذا إلا ملحد يريد شين الأسلام أو جاهل في غاية الجهل وقلة المبالاة بالدين (আলমাওযূআত ১/৩২৮-৩৩০) হাফেয সুয়ূতী রাহ.সহ অন্যান্য মুহাদ্দিসও তার সাথে একমত। আল্লামা শাওকানী রাহ. বলেছেন, هو موضوع كما قال ابن الجوزي وفي اسناده اسماعيل بن يحي كذاب আলফাওয়াইদুল মাজমূআহ পৃ. ৪৯৭। আরো দেখা যেতে পারে : আলকামিল ১/৩০৩; মিযানুল ইতিদাল ১/২৬৯-২৭০; লিসানুল মিযান ২/১৮১-১৮২; তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/১৯; আললাআলী ১/১৭২; তানযীহুশ শরীয়াহ ১/২৩১) এছাড়া সেই সময় ঐ এলাকার ভাষাও আরবী ছিল না যে, মকতবে আরবী বর্ণমালার পাঠদান চলবে। আর বাল্যকাল থেকে হযরত ঈসা আ. থেকে প্রমাণিত ও সত্য আশ্চর্যজনক ঘটনাবলি বা মুজিযা অনেক রয়েছে, সেগুলোই বয়ান করা উচিত। অতএব এ ধরনের ভিত্তিহীন বর্ণনার বয়ান একেবারেই পরিহার করা উচিত।

http://www.alkawsar.com/article/179

একটি নতুন রসমঃ প্রবল বৃষ্টি বন্ধের জন্য আযান

গত সংখ্যার প্রচলিত ভুল বিভাগে অনাবৃষ্টির দিনে বৃষ্টির অবতরণ কামনা করে প্রচলিত একটি কু-সংস্কারের কথা লিখেছিলাম। সেদিন একজন লেখকের একটি লেখায় আরেকটি নতুন রসমের কথা পড়লাম। তবে তা বৃষ্টি অবতরণের জন্য নয়; বৃষ্টি বন্ধের জন্য। তিনি লিখেছেন , ‘বৃষ্টিপাত প্রবল থেকে প্রবলতর হয়, ... কেউ কেউ ব্যাকুল হয়ে ইমাম সাহেবকে অনুরোধ করে আযান দেওয়ার জন্য, যিনি বৃষ্টি দেন সেই আল্লাহ আযান শুনে হয়তবা অনুভব করবেন তাঁর বান্দার অসহায়ত্ব, রহমত করবেন এবং ফিরিয়ে নেবেন বজ্র, বৃষ্টি, বাতাস।’ জানি না, বজ্র-বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাসের সমূহ ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ‘আযান দেওয়ার’ এই আমল লেখকের স্রেফ কল্পনা না বাস্তবেও কোনো এলাকায় এর প্রচলন রয়েছে। হয়তো বা দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেতে মহান আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাওয়ার চিন্তা থেকেই এই নতুন আমল। এখানে উল্লেখ্য, সুদিনে আল্লাহর শোকর আদায় করা, দুর্দিনে সবর করা এবং তাঁর দেয়া আযাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাঁরই আশ্রয় প্রার্থনা করা অবশ্যই প্রশংসনীয়। তবে এই কথাও মনে রাখতে হবে যে, এই শোকর, সবর ও আশ্রয় প্রার্থনার ক্ষেত্রে একজন মুমিনকে প্রথমত ঐ আমলগুলিই করা উচিত, যা নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ, অনাবৃষ্টি ও অতি বৃষ্টি দু’টোই বান্দার কষ্টের কারণ। এ থেকে রক্ষা পেতে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করতে হবে। অনাবৃষ্টির সময় আল্লাহর কাছে বৃষ্টি চাওয়ার সুন্দর নিয়ম যেমন ইসলামে রয়েছে তেমনি অতি বৃষ্টির ক্ষতি থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে আশ্রয় নেওয়ার সুন্দর শিক্ষাও নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে দিয়েছেন। একজন মুমিনকে তাঁর শিক্ষা দেওয়া আমলের মাধ্যমেই আল্লাহর আশ্রয় কামনা করা উচিত। সহীহ হাদীসে এসেছে, একবার মদীনায় এক সপ্তাহ একাধারে প্রবল বৃষ্টিপাত হল। অবিরাম বৃষ্টির সমূহ ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে সাহাবীগণ প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহর দরবারে দুআ করার জন্য অনুরোধ করেন। তখন নবীজী এভাবে দুআ করেন, اللهم حوالينا ولا علينا، الله على الآكام والظراب وبطون الأودية و منابت الأشجار নবীজীর দুআর ফলে মুহূর্তে মদীনার আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। -সহীহ বুখারী, হাদীস : ১০১৪ এমনিভাবে ঝড়-তুফানের সময় নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই দুআ করতেন, اللهم اني اسئلك خير ما آمرت به وأوعوذبك من شر ما آمرت به আর বাতাস কমে বৃষ্টি নেমে এলে তাঁর চেহারা উজ্জ্বল দেখাত। তখন তিনি আল্লাহর ‘হামদ’ করতেন, বলতেন, এটি ‘রহমত’। আরও বলতেন, اللهم صيبا نافعا -ফাতহুল বারী ২/৬০৪, ৬০৮ অতএব হাদীসে বর্ণিত এসব দুআ, এছাড়া অন্যান্য দুআ-ইস্তিগফার বা ‘সালাতুল হাজত’ পড়ে আল্লাহর কাছে এ সকল বালা-মুসিবত থেকে পানাহ চাওয়া উচিত। কিন্তু আযান তো ইসলামের অন্যতম শিআর। যার জায়গা ও ক্ষেত্রগুলো শরীয়ত কর্তৃক সুনির্ধারিত। তাই সেই নির্ধারিত জায়গাতেই এই আমল সীমাবদ্ধ রাখা উচিত।

রবিউল আউয়াল ১৪৩১ . মার্চ ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৬ . সংখ্যা: ০৩
এটি হাদীস নয় - দুনিয়ার কাছে আল্লাহ ওহী প্রেরণ করেছেন, (দুনিয়া!) যে আমার সেবা করে, তুমি তার সেবা কর আর যে তোমার সেবা করে তাকে কষ্ট দাও।
أوحى الله إلى الدنيا أخدمي من خدمك، واتعى من خدمك
দুনিয়ার কাছে আল্লাহ ওহী প্রেরণ করেছেন, (দুনিয়া!) যে আমার সেবা করে, তুমি তার সেবা কর আর যে তোমার সেবা করে তাকে কষ্ট দাও। দুনিয়া-বিমুখতা ও আখিরাতের জীবনের প্রতি উদ্ধুদ্ধ করতে গিয়ে কোনো কোনো মানুষ এই কথা বলে থাকেন যে, হাদীসে কুদসীতে আছে, নবীজী বলেন, আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার কাছে এই মর্মে বার্তা প্রেরণ করেছেন যে, হে দুনিয়া! যে ব্যক্তি আমার সেবা করে, তুমিও তার সেবা কর। আর যে ব্যক্তি তোমার সেবা করে (অর্থাৎ দুনিয়ার পেছনে পড়ে থাকে) তুমি তাকে কষ্ট দাও।’ এটি হাদীস নয়। কারণ এর সূত্রের মধ্যে ‘হুসাইন বিন দাউদ বালাখী’ নামক একজন রাবী রয়েছে, যে হাদীস জাল-করণের অভিযোগে অভিযুক্ত। ( দেখুন : আলমুগনী ১/২৫৩; তানযীহুশ শরীয়াহ ১/৫২) তাই খতীবে বাগদাদী রাহ. ‘‘তারীখে বাগদাদ’’ গ্রন্থে (৮/৪৪) এই রেওয়ায়েত সম্পর্কে বলেন, تفرد بروايته الحسين ع ن الفضيل وهو موضوع অন্যান্য হাদীস বিশারদও তার সঙ্গে একমত। দেখুন, ইবনুল জাওযী, আল-মাওযূআত ২/৩২৩; শাওকানী, আল-ফাওয়াইদুল মাজমূআ ২৩৮ আরো দেখা যায় : আল-লাআলী ২/৩২১; তানযীহুশ শরীয়াহ ২/৩০৩ তবে উল্লেখ্য যে, দুনিয়ার আসক্তি ও ভালবাসা ত্যাগ করা, দুনিয়ায় বসবাস করেও দুনিয়া-বিমুখতা আর আখেরাতের অফুরন্ত জীবনের ভালবাসা ও তার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণের উপর উদ্বুদ্ধকারী কুরআন মজীদের অজস্র আয়াত আর অসংখ্য সহীহ হাদীস তো রয়েছেই, যা একজন মুমিনের জন্য যথেষ্ট। এরপরও এমন ভিত্তিহীন কোনো বর্ণনার পেছনে পড়ে থাকার কোনো অর্থ হয় না। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সকল বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
একটি ভুল ধারণাঃ চাশতের নামায কি বার রাকাতই পড়তে হবে?
সেদিন একজনকে খুব আফসোসের সাথে বলতে শুনলাম, সময়ে কুলোয় না, তাই চাশতের নামায পড়তে পারি না। অযু করে বার রাকাত নামায পড়তে তো আর কম সময় লাগে না! বললাম, বার রাকাতই পড়তে হবে কেন? সে আশ্চর্য সুরে বলল, এর কমে কি চাশত হয়? আসলে এটি একটি ভুল ধারণা। বার রাকাতের কমেও চাশত পড়া যায়।
সহীহ হাদীসে হযরত আয়েশা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। অতঃপর আট রাকাত চাশতের নামায আদায় করলেন।’-সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস : ২৫৩১
আরেকটি হাদীসে হযরত আয়েশা রা. বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চার রাকাত চাশত পড়তেন। আল্লাহ চান তো, এর চাইতে বেশিও পড়তেন।’-সহীহ মুসলিম হাদীস : ৭১৯
হযরত আবু যর রা. হতে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমাদের প্রত্যেকের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জোড়া-গ্রন্থির উপর সদকা রয়েছে। অতএব (এর জন্য) প্রত্যেক তাসবীহ সদকা হবে। প্রত্যেকটি তাহমীদ (আলহামদুলিল্লাহ বলা) সদকা হবে, প্রত্যেকটি তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা) সদকা হবে, প্রত্যেকটি তাকবীর সদকা হবে, আমর বিল মারূফ সদকা হবে, নাহি আনিল মুনকার সদকা হবে। (অর্থাৎ এর প্রত্যেকটি দ্বারা ঐ সদকা আদায় করা যাবে।) আর এর প্রত্যেকটির জন্য চাশতের দু’রাকাত নামাযই যথেষ্ট হবে।’-সহীহ মুসলিম হাদীস : ৭২০
অতএব চাশতের নামায কমপক্ষে দু’রাকাতও পড়া যাবে। বেশি তো পড়া যাবেই।


একটি কুসংস্কারঃ বৃষ্টির জন্য ব্যাঙের বিয়ে
জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই যুগকে যেখানে সচেতনতার যুগ বলে দাবি করা হয়, সেই সময় এই ধরনের মারাত্মক কুসংস্কারের কথা যখন পত্রিকার পাতায় দেখি তখন বড়ই অবাক হতে হয়। বৃষ্টির জন্য পুরো দেশজুড়ে হাহাকার উঠলে দেশের উত্তর-দক্ষিণবঙ্গে এই ধরনের একটি প্রথার কথা আমি বেশ ক’বার পত্রিকার পাতায় দেখেছি। অনাবৃষ্টির কারণে এক গ্রামের লোকেরা মিলে একটি ব্যাঙ ধরে অত্যন্ত ঢাকঢোল পিটিয়ে আরেক গ্রামের একটি ব্যাঙের সাথে বিশেষ কায়দায় বিয়ে দেয়। এতে উভয় গ্রামের লোকেরা বিয়ের মতো হৈ-হুল্লোড় করে আনন্দ উদযাপন করে! তাদের ধারণা, এতে করে বৃষ্টি নেমে আসে!! নাউযুবিল্লাহ। বৃষ্টির সাথে ব্যাঙের কী সম্পর্ক? আর তাদের বিয়েরই বা কী তাআল্লুক? এমন হিন্দুয়ানী কুসংস্কার আদি যুগের অনেক কুসংস্কারকেও হার মানায়। আর কেউ যদি বৃষ্টি বর্ষণকে ব্যাঙের সাথে সম্পৃক্ত করে দেয় তবে তা তো সুস্পষ্ট ঈমান বিধ্বংসী বিশ্বাস। আল্লাহ তাআলা বলেন, هو الذى انزل من السماء ماء ‘তিনিই সেই সত্ত্বা, যিনি আসমান থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন।’ অনাবৃষ্টি হলে কী করতে হবে, তার সুন্দর নির্দেশনা ইসলামেই বিদ্যমান। ইস্তিগফার করা, উন্মুক্ত মাঠে ‘সালাতুল ইসতিস্কা’ আদায় করা, সম্মিলিতভাবে দুআ করার কথা হাদীসে এসেছে। প্রত্যেকটি হাদীসের ও ফিকহের কিতাবে এই সংক্রান্ত স্বতন্ত্র অধ্যায় রয়েছে। অতএব সে নিয়ম অনুযায়ী আল্লাহর কাছেই বৃষ্টি চাওয়া উচিত।

সফর ১৪৩১ . ফেব্রুয়ারী ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৬ . সংখ্যা: ০২
একটি আশ্চর্য অপবাদ: কাফের মারা গেলে কি ‘ফী নারি জাহান্নামা’ বলতে হয়?
একজন ধর্ম-বিদ্বেষী ব্যক্তি সম্পর্কে শুনেছি যে, সে দ্বীনী মাদরাসা সম্পর্কে সমালোচনা করে লিখেছে, এসব প্রতিষ্ঠানে শিশুদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়, কোনো বিধর্মীর মৃত্যুর সংবাদ পেলে ‘ফী নারি জাহান্নাম খালিদীনা ফীহা’ বলতে হয়! আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মিথ্যাচার ত্যাগ করার তাওফীক দান করুন। উপরোক্ত বক্তব্য শরীয়ত ও দ্বীনী মাদরাসা উভয়ের সম্পর্কেই মিথ্যাচার। না মাদরাসায় এই শিক্ষা দেওয়া হয় আর না শরীয়তে কোথাও এই আদেশ দেওয়া হয়েছে। একজন ব্যক্তি জীবদ্দশায় কাফির হলেও তার মৃত্যু কোন হালতে হয়েছে তা তো গায়েবী বিষয়, যা একমাত্র আল্লাহ তাআলাই জানেন। যাদের কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণের সংবাদ শরীয়তের দলীল দ্বারা প্রমাণিত, তাদের বিষয় আলাদা। এছাড়া সাধারণভাবে কারো সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে বলা যায় না যে, সে কাফের অবস্থাতেই মৃত্যু বরণ করেছে। অতএব তার মৃত্যুতে ‘ফী নারি জাহান্নামা’ কীভাবে বলা যায়? উপরন্তু কাফের অবস্থায় মারা গেলেও এই বাক্য পড়তে হয়-এই বিধান কোথায় আছে? কারো সম্পর্কে কিছু বলার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা শুধু শরীয়তেরই বিধান নয়, সভ্যতা ও শরাফতেরও অপরিহার্য দাবি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই শরাফত দান করুন। আমীন।
একটি ভুল চিন্তা: ইসলাহে নফস এবং যিকর ও অযীফা কি শুধু বাইয়াত হওয়া মুরিদের কাজ?
আমাদের মাঝে কত মানুষ যে জেনে বুঝে বা নিজের অজানে- উপরোক্ত ভুল ধারণার শিকার, তার ইয়ত্তা নেই। মনে করা হয় যে, ইসলাহে নফস তো ওই ব্যক্তির কাজ যে কোনো পীরের হাতে মুরিদ হয়েছে। অথচ কে তাকে বোঝাবে যে, এটা প্রত্যেক মুসলমানের কর্তব্য? বাইয়াত হওয়া বা মুরিদ হওয়া তো এর অনুশীলনের জন্য। অর্থাৎ এই দায়িত্ব মুরিদ হওয়ার কারণে অর্পিত হয় না; বরং তা সাধারণভাবে সকল মুসলমানের কর্তব্য। বাইয়াত হওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সে কর্তব্য সম্পাদনে সহায়তা পাওয়া। চিন্তা করলে দেখা যাবে যে, প্রত্যেক মুসলমান কালিমা পাঠের মাধ্যমেই বাইয়াত হয়েছে এবং আখিরাতের ইরাদা রাখার কারণে সে মুরীদও বটে। প্রথাগত বাইয়াত তো ‌উপরোক্ত বাইয়াত ও ইরাদারই নবায়নমাত্র। অতএব মুসলিমমাত্রই মুরীদ ও সালিক। একজন মুমিনের চিন্তার স্তর পরিমাণ উন্নত অবশ্যই হওয়া চাই যে, নফস ও শয়তানের এসব স্পষ্ট প্রতারণা তাকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। এজন্য আমি নিজেকে ও আমার সুহৃদয় বন্ধুদেরকে বিনীত অনুরোধ করছি, তারা যেন মাওলানা মুহাম্মাদ মানযুর নুমানী রাহ.-এর পুস্তিকা ‘তাসাওফ ক্যায়া হ্যায়’ (তাসাওউফ কী ও কেন) বা তাঁর কিতাব ‘দ্বীন ও শরীয়ত’-এ উপস্থাপিত ইসলাহী কর্মসূচি মোতাবেক কাজ শুরু করেন এবং যিকির ও দুআর ইহতিমাম করেন। আল্লাহ তাআলা আমাদের তাওফীক দান করুন। আমীন।
একটি ভুল ধারণা: শাহজালাল রাহ. ও শাহজালালের মাযার কি এক বিষয়
বর্তমান অজ্ঞতার যুগে মানুষের বিচার-বিবেচনা এতই হ্রাস পেয়েছে যে, অশ্রুতপূর্ব কথা-বার্তা এবং অভাবিতপূর্ব ধ্যান-ধারণা কর্ণগোচর হওয়া স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কবর ও মাযারের গর্হিত কার্যকলাপ এবং শিরক ও বিদআত সম্পর্কে যখন কাউকে সাবধান করা হয়, যেমন কবরে মেলা বসানো, ওরস করা, আলোকসজ্জা করা, ফুল দেওয়া, কবরের উপর ছাদ বা ইমারত নির্মাণ করা, কবরের তাওয়াফ করা, সেজদা করা, কবর কিংবা তার উপর নির্মিত দেয়াল বা ইমারতে হাত বুলানো বা চুম্বন করা, কবরওয়ালার নিকটে প্রার্থনা, মাযারের নামে মান্নত, মাযারের উদ্দেশে সফর, নারীদের মাযারে গমন, পর্দাহীনতা, পুরুষের সঙ্গে মেলামেশা ইত্যাদি শিরক, বিদআত ও গর্হিত কার্যকলাপ সম্পর্কে যখন সাবধান করা হয় তখন কিছু মানুষ বোকার মতো বলতে থাকে যে, ভাই! এই সব কাজ তো শাহজালাল রাহ. এবং অমুক অমুক বুযুর্গের মাযারে হয়ে থাকে। তাহলে তা না-জায়েয কীভাবে হয়? এমনিভাবে অনেকে মাযারের গর্হিত কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করাকে বুযুর্গদের সঙ্গে বেআদবী বলে মনে করে! তাহলে কি তারা বুযুর্গের মাযারকেই বুযুর্গ মনে করে কিংবা মনে করে যে, মাযারে শায়িত বুযুর্গেরা এইসব মাযার ও মাযার-পুজার সূচনা করে গেছেন? অথবা মাযার-ব্যবসায়ী ভণ্ড এবং মাযার-পুজারী ভক্তদেরকেও বুযুর্গানে দ্বীন মনে করে?! শাহজালালের দরগায় গর্হিত কার্যকলাপে লিপ্ত লোকেরাও কি শাহজালাল?! একথা তো বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন হয় না যে, কোনো ব্যক্তি নিজের কবরকে মাযারে পরিণত করতে পারে না। কবরে শায়িত ব্যক্তি কীভাবে ওই কবরের উপর মাযার নির্মাণ করবে? অতএব বুযুর্গানে দ্বীনের কবরকে মাযারে পরিণত করা এবং তাতে বিভিন্ন গর্হিত কর্মকাণ্ড আরম্ভ করা নিশ্চয়ই পরবর্তী কারো কাজ হবে। শাহজালাল রাহ.-এর কবরে এইসব কাজ কারা শুরু করেছে? তাঁর কোনো শীষ্য, খলীফা, সুন্নতের অনুসারী কোনো বুযুর্গ? কক্ষনো না; বরং এসব তাঁর ইন্তেকালের বহু বছর পর একশ্রেণীর মাযার-ব্যবসায়ী এবং সুফী-সাধনার নামে অবাধ যৌনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার পৃষ্ঠপোষক বিদআতী ও মুলহিদ গোষ্ঠীর উদ্ভাবন। এজন্য কেউ যদি এইসব গর্হিত কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করেন এবং মাযারের পাণ্ডা ও দর্শনার্থীদের সম্পর্কে (যারা ভ্রান- উদ্দেশ্যে বা ভুল পন্থায় যিয়ারত করে থাকে) আপত্তি করেন তা হবে ঈমানের দাবি পূরণ, যা মাযারে শায়িত ওইসব বুযুর্গরাও প্রচার করে গেছেন, তাকে বুযুর্গানে দ্বীনের মর্যাদা নষ্টকারী বা বিদ্বেষ পোষণকারী আখ্যা দেওয়া চরম মূর্খতা। তাঁরা বুযুর্গানে দ্বীনের অবমাননাকারী নয়; বরং তাঁদের ঈমানী ও কুরআনী শিক্ষারই ধারক-বাহক। অতএব সাবধান; মাযার ও মাযারে শায়িত বুযুর্গদের এক মনে করবেন না। অন্যথায় আপনিই হবেন বুযুর্গানে দ্বীনের অবমাননাকারী।

মহাররম ১৪৩১ . জানুয়ারী ২০১০

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৬ . সংখ্যা: ০১
একটি ভুল ধারণা: মসজিদে নববীতে চল্লিশ ওয়াক্ত নামায জরুরি মনে করা
মসজিদে জামাতে নামায পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি মসজিদে নববীতে জামাতে শামিল হওয়ার সুযোগ হয়ে যায় তাহলে তো নূরুন আলা নূর। কেননা, এখানে এক নামায (কমপক্ষে) হাজার নামাযের সমতুল্য। হজ্বের সময় মসজিদে নববীতে উপস্থিত হওয়ার এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মুবারকে গিয়ে সরাসরি সালাম আরজ করার সৌভাগ্য অর্জনের জন্য মদীনা মুনাওয়ারার উদ্দেশে সফরের ধারা হাজী ছাহেবানদের মধ্যে রয়েছে, যা অতি উত্তম আমল। কিন্তু সেখানে অবস্থানের জন্য শরীয়তের পক্ষ থেকে কোনো মেয়াদ নির্ধারিত নেই। অর্থাৎ এটা অপরিহার্য নয় যে, সেখানে কমপক্ষে আট দিনই থাকতে হবে। কোনো কোনো মানুষ আট দিন অবস্থানকে এত জরুরি মনে করে যে, এর জন্য নিজেকে, সফরসঙ্গীদেরকে এবং কাফেলার আমীরকে কষ্টে ফেলে দিতেও দ্বিধা বোধ করে না। অথচ তা শরীয়তের পক্ষ হতে নির্ধারিত কোনো মেয়াদ নয় যে, তা পূরণ করা এত জরুরি মনে করতে হবে। এ প্রসঙ্গে মুসনাদে আহমদ (৩/১৫৫) ও তবারানীতে (৫৪৪) একটি রেওয়ায়েত আছে যে, কেউ যদি এই মসজিদে (অর্থাৎ মসজিদে নববীতে) ধারাবাহিকভাবে চল্লিশ নামায আদায় করে তাহলে সে জাহান্নামের আযাব ও নিফাক থেকে মুক্তি পাবে। এই রেওয়ায়েতের কারণে লোকেরা আট দিন অবস্থান করা জরুরি মনে করে নিয়েছে। অথচ সনদের বিচারে তা জয়ীফ। উপরন্তু এই হাদীসের প্রসিদ্ধ মতন সেটি যা তিরমিযীতে রয়েছে-যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য চল্লিশ দিন জামাতে তাকবীরে উলার সঙ্গে নামায আদায় করে তার জন্য দুটি পরোয়ানা লেখা হয় : জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরওয়ানা ও নিফাক থেকে মুক্তির পরওয়ানা। (জামে তিরমিযী হাদীস : ২৪১) অতএব স্পষ্টত বোঝা যায় যে, এই ফযীলত যে কোনো মসজিদে জামাতে শামিল হওয়া দ্বারা হাসিল হতে পারে। প্রসঙ্গত ভুল না বোঝার অনুরোধ করব। ফযীলতের ক্ষেত্রে জয়ীফ রেওয়ায়েত গ্রহণযোগ্য, তা আমার জানা আছে। কিন্তু একই সাথে এটাও সত্য যে, জয়ীফ দ্বারা শরীয়তের কোনো বিধান প্রমাণ হয় না এবং কোনো মেয়াদ বা পরিমাণ নির্ধারিত হয় না। এজন্য সহজভাবে সেখানে আট দিন থাকার সুযোগ হয়ে গেলে ভালো, কিন্তু একে জরুরি মনে করা বা জরুরি বিধানের মতো এত বেশি গুরুত্ব দেওয়া যে, কষ্ট ও পেরেশানিতে পড়ে যেতে হয় কিংবা পরস্পর মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়, ঠিক নয়। প্রকৃত করণীয় হচ্ছে, হারামাইনে যতদিন থাকার সুযোগ হয় চেষ্টা করবে যেন মসজিদে হারাম ও মসজিদে নববীতে জামাতের সঙ্গে নামায আদায় করা হয়।http://www.alkawsar.com/article/96
একটি ভুল মাসআলা: শিশুর জন্য তার বোনের দুধ পান করা কি নিষেধ?
এই পাতার লেখাগুলি যখন তৈরি করছি তখন এক ভাইয়ের ফোন এল যে, একটি শিশুর জন্মের সময় তার মা ইন্তেকাল করেন। (আল্লাহ তাআলা তাঁর মাগফিরাত করুন এবং তাঁকে জান্নাত নসীব করুন এবং তাঁর সন্তানের উত্তম প্রতিপালনের ব্যবস্থা করে দিন। আমীন।) এখন তাকে দুধ পান করানোর মতো কেউ নেই। শুধু বড় বোন তাকে দুধ পান করাতে পারে কিন্তু এটা তো সম্ভবত জায়েয না? এখন তার জন্য কী করা যায়? আমি আরজ করলাম, শিশু তার বোনের দুধ পান করতে পারে না, তা আপনাকে কে বলেছে? তিনি বললেন, সবাই তো এমনই মনে করে। আমি আরজ করলাম, সবাই যদি এমন মনে করে থাকে তবে তা প্রচলিত ভুলের অন্তর্ভুক্ত। সঠিক বিষয় এই যে, দুধ পানের মেয়াদের ভিতরে শিশুকে যে কোনো মহিলার দুধ পান করানো যায়, তিনি শিশুর মাহরাম হোন অথবা গায়র মাহরাম। তবে এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ যে, শিশুর দুধ-মা হিসেবে দ্বীনদার মহিলা নির্বাচন করা আবশ্যক, ফাসিক-ফাজির নারীর দুধ পান না করানো উচিত। কেননা, শিশুর স্বভাব-চরিত্র তৈরির পিছনে দুধেরও ভূমিকা থাকে।
একটি উদাসীনতা: হিজরী বর্ষ ও চান্দ্রমাসের তারিখ ব্যবহারে উদাসীনতা
এ প্রসঙ্গে আলকাউসারে একাধিকবার লেখা হয়েছে। দুঃখের বিষয় এই যে, আজকাল দ্বীনদারদের মধ্যেও এ বিষয়ে ব্যাপক উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। কাউকে তারিখ জিজ্ঞাসা করলেই নিঃসঙ্কোচে ও কোনো ভূমিকা ছাড়াই ইংরেজি ক্যালেণ্ডারের তারিখ বলে থাকেন। যেন এটাই একমাত্র ক্যালেণ্ডার। কোনো চিঠি বা লেখায় তারিখ লিখতে হলে ইংরেজি তারিখ লেখা হয়, কোনো ঘটনার তারিখ বলতে হলেও তা-ই বলা হয়, এমনকি অধিকাংশ তালিবে ইলম তাদের শিক্ষাজীবনের তারিখও যদি মনে রাখে তাহলে ইংরেজি ক্যালেণ্ডারের হিসাবেই মনে রাখে। গত বছর মদীনা মুনাওয়ারায় শায়খ মুহাম্মাদ আওয়ামা (হাফিযাহুল্লাহ্‌)-এর এক প্রশ্নের উত্তরে চন্দ্র তারিখের পর ইংরেজি তারিখ উল্লেখ করেছিলাম। তিনি তখন বলেছিলেন,
(আরবী)
এই ক্যালেণ্ডারের সঙ্গে তো আমাদের পরিচয় নেই। পক্ষান্তরে অন্য এক ব্যক্তির কোনো প্রশ্নের উত্তরে আমি যখন চন্দ্র তারিখ বলেছি তখন তিনি কিছুটা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, ইংরেজি তারিখ বলুন! কোনো সন্দেহ নেই যে, হিজরী সন-তারিখ ব্যবহারের বিষয়ে এই উদাসীনতা এখন আর সাধারণ মানুষের ভুল-ত্রুটির মাঝে সীমাবদ্ধ নেই। এটি এখন (খাওয়াছের) বিশিষ্ট-ব্যক্তিদের মাঝেও সংক্রমিত হয়েছে। এটি খুবই দুঃখজনক। এই উদাসীনতা বাহ্যত ছোট মনে হলেও তা অনেক বড় কিছু বিষয়ের ফলাফল। তদ্রূপ এর পরিণতিও অত্যন্ত মারাত্মক। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন। আমীন।
এটি হাদীস নয়: জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে চীন দেশে যাও
আরবীতে বলা হয়- (আরবী) বাক্যটি ব্যাপকভাবে হাদীস হিসাবে বলা হয়ে থাকে। প্রকৃত পক্ষে এটি পরবর্তী কারো বাণী। তবে সন্দেহ নেই যে, বক্তব্যটি সঠিক ও বাস্তবসম্মত। ইলমে দ্বীন হাসিলের জন্য যত দূরের সফরই হোক, তাওফীক হলে করা উচিত। ইলম অন্বেষণে কখনো মেহনত-মুজাহাদকে ভয় পাওয়া উচিত নয়। তদ্রূপ পার্থিব জীবনে প্রয়োজনীয় শিল্প ও বিদ্যা শিক্ষার জন্যও দূর দূরান্তে সফর করা জায়েয; বরং তা একটি পর্যায় পর্যন্ত কাম্যও বটে। এই সকল কিছু স্বস্থানে বিদ্যমান আছে এবং শরীয়তের বিভিন্ন দলীল দ্বারা তা প্রমাণিত। কিন্তু আমাদের আলোচ্য বাক্যটি হাদীস নয়। যদিও তা হাদীস হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে, কিন্তু সনদে আবু ‘আতিবা তরীফ ইবনে সুলায়মান নামক একজন রাবী আছে যে হাদীস শাস্ত্রের ইমামগণের দৃষ্টিতে মতারূক (পরিত্যক্ত)। তাকে হাদীস জাল করার অভিযোগেও অভিযুক্ত করা হয়েছে। রিজাল ও রেওয়ায়েত-শাস্ত্রের বিখ্যাত ইমাম আবু জা’ফর উকাইলী লেখেন- (আরবী) -আয-যুআফাউল কাবীর, উকাইলী ২/২৩০; কিতাবুল মাজরূহীন, ইবনে হিব্বান ১/৩৮২; মিযানুল ইতিদাল ২/২৫৮; আলমুনতাখাব মিনাল ইলাল লিল-খাল্লাল ইবনে কুদামাহ পৃ. ১২৯-১৩০; আলমাকাসিদুল হাসানাহ, সাখাভী পৃ. ১২১

যিলহজ্জ্ব ১৪৩০ . ডিসেম্বর ২০০৯

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৫ . সংখ্যা: ১২

যিলক্বদ ১৪৩০ . নভেম্বর ২০০৯

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৫ . সংখ্যা: ১১
হিযবুল বাহর মাছূর দুআ নয়
হিযবুল বাহর নামে যে অযীফাটি প্রসিদ্ধ তাতে বিক্ষিপ্তভাবে কুরআন-হাদীসের বিভিন্ন দুআ বিদ্যমান থাকলেও সব দুআ কুরআন-হাদীসের নয়। তদ্রূপ পূর্ণ অযীফা এইভাবে তো কুরআন-হাদীসে অবশ্যই নেই। এটি আবুল হাসান শাযিলী রাহ. তদ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় ইলহামের মাধ্যমে লাভ করেছেন। একে কুরআন-হাদীসের মাছূর দুআর মতো গুরুত্ব দেওয়া কিংবা তার চেয়ে প্রাধান্য দেওয়া ঠিক নয়। তবে যেহেতু এই অযীফায় কোনো ভুল কথা নেই এবং এর অধিকাংশ শব্দ বিক্ষিপ্তভাবে কুরআন-হাদীসে রয়েছে এজন্য ব্যক্তিগতভাবে কেউ আমল হিসেবে পড়লে তা না-জায়েযও নয়। তবে ছওয়াব ও বরকত অবশ্যই মাছূর দুআতেই বেশি। যদিও দুনিয়াতে কখনো কোনো গায়রে মাছূর দুআর ক্রিয়া দ্রুত দেখা যাক। কেননা, এটি ভিন্ন বিষয়। আল্লাহর খাস বান্দারা সর্বদা বাহ্যিক ক্রিয়ার চেয়ে ছওয়াব, বরকত ও নূরানিয়াতের প্রতি লক্ষ করে থাকেন। কিন' আফসোসের বিষয় এই যে, আজকাল আমাদের মাঝে যিকির ও দুআর বিষয়ে অত্যন- শৈথিল্য লক্ষ করা যায়। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সব ধরনের উদাসীনতা থেকে রক্ষা করুন। আমীন।
ইহরামের চাদরকেই ইহরাম মনে করা
হজ্ব বা উমরার সূচনা হয় ‘ইহরাম’ দ্বারা। হজ্ব বা ওমরার নিয়তে তালবিয়া পাঠ করলে ‘ইহরাম’ সম্পন্ন হয়। ইহরামের মাধ্যমে হজ্ব শুরু হয় এবং নির্ধারিত সময়ে চুল মুণ্ডন বা ছোট করার দ্বারা ‘হালাল’ হওয়া পর্যন- ইহরামের হালত বাকী থাকে। ইহরাম গ্রহণকারী ব্যক্তিকে ‘মুহরিম’ বলে। ইহরামের হালতে পুরুষের জন্য পোষাকের বিধান এই যে, শরীরের কোনো অঙ্গের আকারে প্রস'তকৃত বা সেলাইকৃত পোষাক পরিধান করা যাবে না। টুপি, মোজা, জামা, কোর্তা, সদরিয়া, গেঞ্জি, পাজামা, সেলোয়ার, শার্ট, প্যান্ট, আন্ডারওয়্যার এবং এ ধরনের সকল পোষাক ইহরামের হালতে পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ। এজন্য তারা ইহরামের হালতে শুধু চাদর ব্যবহার করবেন। একটি চাদর পাজামার স্থলে অপরটি পাঞ্জাবির স'লে। ইহরামের হালতে লুঙ্গি পড়ার অনুমতি থাকলেও উত্তম হল চাদর পরিধান করা। পুরুষের জন্য ইহরামের হালতে মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করাও জায়েয নয়। এজন্য চাদর পরিধান করা যাবে, কিন' এর দ্বারা মাথা ও মুখমণ্ডল আবৃত করা যাবে না। এই দুই চাদর পাক-সাফ হওয়া চাই। সাদা হলে ভালো। তবে নতুন হওয়া জরুরি নয়।
এই চাদর যেহেতু ইহরামের হালতের পোষাক তাই অনেক সময় একে ‘ইহরাম’ বলা হয়। কিন' এর অর্থ এই নয় যে, নিয়ত ও তালবিয়া পাঠ ছাড়া শুধু এই কাপড় পরলেই কেউ ‘মুহরিম’ হয়ে যাবে। কেননা নিয়ত ও তালবিয়া পাঠ ছাড়া শুধু দু’টি সাদা কাপড় পরার দ্বারা ‘ইহরাম’ সম্পন্ন হয় না এবং হজ্বও শুরু হয় না।
তদ্রূপ ইহরামের চাদরকে ইহরাম মনে করার কারণে কেউ কেউ মনে করেন, ইহরামের কাপড় পরিবর্তন করা যায় না কিংবা তা নাপাক হয়ে গেলে যেন ইহরামই নষ্ট হয়ে গেল! অথচ তা নয়। ইহরামের চাদর পরিবর্তন করার, ধোয়ার পূর্ণ সুযোগ রয়েছে। তদ্রূপ তা নাপাক হয়ে গেলেও ইহরামের কোনো ক্ষতি হয় না। চাদরটি ধুয়ে পাক করে নিলেই হল কিংবা তা বদলে নিলেই হল।
এই বিষয়টি এত লম্বা করে বলার কারণ এই যে, আমি নিজে অনেক ভাইকে এই সব ভুল ধারণা পোষণ করতে দেখেছি, যার মূল কথা এই যে, তারা ইহরামের পোষাককেই ‘ইহরাম’ মনে করেছেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এই মাসআলাও পরিষ্কার হয়ে যায় যে, যদি কোনো ব্যক্তি ভুলক্রমে ইহরামের চাদর ব্যাগে রেখে দেয় এবং তা অন্যান্য জিনিসপত্রের সঙ্গে ভিতরে চলে যায়, যার কারণে জিদ্দা পৌঁছার আগে ওই কাপড় পাওয়ার কোনো সুযোগ থাকে না, অন্যদিকে বিমান বন্দরে ইহরামের হালতে পরা যায় এমন কোনো কাপড়ের ব্যবস্থা করাও সম্ভব না হয় তখন এই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাওয়ার কারণ নেই যে, ‘ইহরাম’ কীভাবে সম্পন্ন হবে? বরং কর্তব্য হল বিমান জিদ্দায় পৌঁছার ঘন্টাখানেক আগে সাধারণ কাপড় পরিহিত থাকলেও নিয়ত ও তালবিয়ার মাধ্যমে ‘ইহরাম’ সম্পন্ন করবে। জিদ্দা পৌঁছার পর লাগেজপত্র পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পোষাক পরিবর্তন করে চাদর পরিধান করবে। আর ইহরামের হালতে দু-আড়াই ঘন্টা বা তার বেশি সময় জামা-পাজামা ইত্যাদি পরিহিত থাকার কারণে যে কাফফারা আসে তা আদায় করবে।
তো যাদের এই বিভ্রানি- আছে যে, ইহরামের চাদরই ইহরাম তারা সেই চাদর পরা ছাড়া নিয়ত ও তালবিয়া পাঠ করলেও ইহরাম হবে না মনে করে বিনা ইহরামে জিদ্দায় পৌছে যায়, যার কারণে বিনা ইহরামে মীকাত অতিক্রম করার গুনাহ যেমন হয় তেমনি দমও ওয়াজিব হয়ে যায়। এজন্য কর্তব্য হল, হজ্বের পূর্বে হজ্বের মাসাইল পরিষ্কারভাবে জেনে নেওয়া যেন বিভ্রানি- বা ভুল প্রচারণার শিকার হয়ে অযথা কষ্ট পোহাতে না হয় এবং অসচেতনভাবে হজ্ব অসম্পূর্ণ বা বিনষ্ট হওয়ারও আশঙ্কা না থাকে।
হরম ও মসজিদে হরম কি এক?
বাইতুল্লাহর চারপাশে যে মসজিদ তার নাম ‘আলমাসজিদুল হারাম’, যাতে এক রাকাত নামাযের ছওয়াব লক্ষ রাকাতের সমান। পক্ষান-রে ‘হরম’ হচ্ছে মক্কা মুকাররমার ওই বিস্তীর্ণ এলাকা, যার কিছু বিশেষ আহকাম ও আদাব রয়েছে। যাকে কুরআন মজীদে ‘হারামান আমিনা’ বলা হয়েছে। এটা বাইতুল্লাহর পূর্ব দিকে আরাফা পর্যন-, পশ্চিমে হুদাইবিয়া (শুমাইছী) পর্যন-, উত্তরে জি’রানা ও ওয়াদীয়ে নাখলা পর্যন- এবং দক্ষিণে শুবাইকা পর্যন- বিস্তৃত। চতুর্দিকের সীমানায় চিহ্ন ও ফলক লাগানো আছে।
হরমের বাইরের অংশকে ‘হিল্ল’ বলে। বাইতুল্লাহ থেকে হিল্ল-এর নিকটতম স'ান হচ্ছে তানয়ীম, যেখানে মসজিদে আ’য়েশা অবসি'ত। অনেক সময় মসজিদে হারামকে সংক্ষেপে ‘হরম’ বা ‘হেরেম শরীফ’ বলা হয়। এতে অনেকের মনে এই ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে, মসজিদে হারামের অপর নাম ‘হরম’। তদ্রূপ কেউ কেউ মনে করেছেন, হরমের গোটা এলাকাই মসজিদে হারাম। এই উভয় ধারণা ভুল। মসজিদে হারাম হচ্ছে বাইতুল্লাহর চারপাশের মসজিদের নাম, যার চতুর্সীমানা সবার চোখের সামনে। পক্ষান-রে হরমে (মক্কী) মক্কার ওই বিস্তৃত অংশকে বলে যার সীমানা উপরে বলা হয়েছে। বাইতুল্লাহ ও মসজিদে হারাম ছাড়াও সাফা-মারওয়া, মিনা, মুযদালিফা ইত্যাদিও হরমের সীমানার ভিতরে অবসি'ত।
এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ যে, ছওয়াবের দিক থেকে হরমের কোনো অংশে কৃত নেক আমলের ছওয়াব মসজিদে হারামে কৃত নেক আমলের সমান কি না। কোনো কোনো সালাফ গোটা হরমের এলাকাকে মসজিদে হারামের মতো মনে করেন, কিন্তু একথারও অর্থ এই নয় যে, হরমের অন্তর্ভুক্ত গোটা এলাকা মসজিদ। অন্যথায় যেসব কাজ মসজিদে করা না-জায়েয বা খেলাফে আদব তা গোটা হরমের মধ্যেও না-জায়েয ও খেলাফে আদব হত।
মনে রাখা উচিত যে, যারা গোটা হরমের এলাকাকে মসজিদে হারাম মনে করে মসজিদে হারামের জামাতে শামিল হয় না তারা নিতান- ক্ষতিগ্রস-। যদি ধরেও নেওয়া হয় যে, হরমের কোনো স্থানে এক রাকাতে লক্ষ রাকাতের ছওয়াব পাওয়া যায় (অথচ এর উপর কোনো স্পষ্ট ও শক্তিশালী দলীল বিদ্যমান নেই) তবুও মসজিদে হারামের বরকত ও নূরানিয়াত, বাইতুল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার উত্তম প্রভাব, আল্লাহর নেক বান্দাদের এত বড় জামাতে শামিল হওয়ার বরকত মসজিদে হারামের বাইরে কীভাবে পাওয়া যাবে? এজন্য মক্কায় থাকা অবস্থায় কোনো বাহানাতেই মসজিদে হারামের জামাত থেকে বঞ্চিত থাকা উচিত নয়। আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাযত করুন।

শাওয়াল ১৪৩০ . অক্টোবর ২০০৯

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৫ . সংখ্যা: ১০
একটি চিন্তাগত দুর্বলতা: রমযানুল মুবারকের সমাপ্তিতে আনন্দিত হওয়ার কারণ
রমযানুল মুবারক সমাপ্ত হলে এজন্য আনন্দিত হওয়া যায় যে, আল্লাহ তাআলা এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ মাস দান করেছিলেন, যা ছিল খায়র ও বরকতে পরিপূর্ণ। এ মাসের দিবসে সওম পালন এবং রজনীতে তারাবী ও তাহাজ্জুদের তাওফীকও আল্লাহ তাআলা দান করেছিলেন। এজন্য রমযানের শেষে মুমিনের অন্তর আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাতের আশায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। নিশ্চয়ই আল্লাহ নিজ মেহেরবানীতে আমাকে ক্ষমা করেছেন। রমযানুল মুবারকের খায়র ও বরকত নিশ্চয়ই আমাকে দান করেছেন। মুমিন তখন আল্লাহ তাআলার শোকরগোযারী করে, হামদ ও ছানা করে এবং তাকবীরের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার বড়ত্ব ও মহত্ব ঘোষণা করে। ঈদের দিন আল্লাহ তাআলার নির্দেশিত পন্থায় ঈদুল ফিতর এর আমলগুলো সম্পন্ন করে। এই লেখায় যে দুর্বলতাটি উল্লেখ করতে চাই তা এই যে, আমাদের মধ্যে অনেকের কথা ও আচরণে বোঝা যায় যে, মাহে রমযান যেন একটি বিপদ ছিল! শাওয়ালের চাঁদ দৃষ্টিগোচর হওয়ার দ্বারা এই বিপদ দূর হয়েছে! তাই আনন্দ!! বস্তুত এই দুর্বলতার শিকার তো তারাই হতে পারে যাদের রোযা রাখার তাওফীক হয়নি। তাদের জন্য তো প্রকৃতপক্ষেই রমযান ছিল ক্ষতির মাস। কিন্তু মুমিন এই মাসের আগমনে এজন্য আনন্দিত হয় যে, এটা তার দ্বীনী ও ঈমানী তরক্কীর মাস। এজন্য একে বিপদের পরিবর্তে মহা সৌভাগ্য মনে করে এবং আগ্রহের সঙ্গে তার প্রতীক্ষায় থাকে। আর এ মাস সমাপ্ত হলে সে এ আশায় আনন্দিত হয় যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির পরওয়ানা তার হাসিল হয়েছে!
হিসনে হাসীন, মুনাজাতে মকবুলের সাত মঞ্জিল
মনে পড়ে না, এই বিভাগে এই বিষয়ে ইতিপূর্বে লেখা হয়েছিল কি না। হিসনে হাসীনের বিষয়বস্তু হচ্ছে ওই দুআগুলো হাওয়ালাসহ একত্র করা, যা কুরআন-সুন্নাহ্য় উল্লেখিত হয়েছে। প্রথম চার অধ্যায়ে বিভিন্ন সময় ও পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন আমল ও ইবাদতের দুআ সন্নিবেশিত হয়েছে। পঞ্চম অধ্যায়ে সাধারণ দুআসমূহ রয়েছে, যা বিশেষ কোনো সময় বা পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত নয়। এই অধ্যায়ের দুআগুলো অযীফা আকারে পড়া যায়। তবে প্রথম চার অধ্যায়ের দুআ সেসব সময় ও পরিস্থিতিতেই পড়া উচিৎ যে সময় বা পরিসি'তিতে তা পড়ার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ সময়ের দুআগুলো দিন রাতের সব সময় অযীফা আকারে পাঠ করা যুক্তিযুক্ত নয়। যেমন ধরুন, কেউ যদি সকাল বেলা পাঠ করেন, (আরবী) (এই সন্ধ্যায় আমরা ও গোটা বিশ্ব জগত আল্লাহর, প্রশংসা আল্লাহর ...)। তদ্রূপ কেউ যদি সন্ধ্যায় পাঠ করেন, (আরবী) (এই ভোরে আমরা ও গোটা বিশ্বজগত আল্লাহর, সকল প্রশংসা আল্লাহর ...)। তাহলে বিষয়টি কেমন হবে? তদ্রূপ সর্বদা অযীফা আকারে কি এই দুআ পাঠ করা যাবে- আরবী ===== (সকল প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমাদেরকে আহার দিলেন, পানীয় দিলেন এবং যিনি আমাদেরকে মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন।) তদ্রূপ আরবী ========== অথচ এখন তার নিদ্রার সময় নয়। কিংবা আরবী ====== অথচ এখন সে ইস্তিঞ্জা থেকে আসেনি। মোটকথা, ‘হিসনে হাসীন’ কিতাবকে বিভিন্ন মঞ্জিলে ভাগ করে অযীফার কিতাব বানানো যুক্তিযুক্ত নয়। ‘মুনাজাতে মাকবূল’ কিতাবের অধিকাংশ দুআ হচ্ছে ব্যাপক অর্থবোধক দুআ, যা বিশেষ সময় বা পরিস্থিতির সঙ্গে যুক্ত নয়। এই দুআগুলো মিনতি ও মনোযোগের সঙ্গে যেকোনো সময় পাঠ করা যায়। সহজতার উদ্দেশ্যে ‘আলহিযবুল আ’যম’-এর মতো এই দুআগুলিকেও সাত মঞ্জিলে ভাগ করা হয়েছে। যেন প্রতিদিন এক মনযিল করে পাঠ করা যায় এবং কিতাব ও সুন্নাহ্য় শেখানো অধিকাংশ জামে দুআ প্রার্থনায় এসে যায়। সাত মনযিলে বিভক্ত করার বিষয়টি মাসআলাগতভাবে মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এটি পাঠ সহজ হওয়ার জন্য একটি বিন্যাসমাত্র। যে মনযিলে যে বারের নাম দেওয়া আছে সেদিনই তা পড়তে হবে তা-ও অপরিহার্য নয়। তদ্রূপ এটাও জরুরি নয় যে, একদিনে এক মনযিল পরিমাণই পড়তে হবে। সাত মনযিলে ভাগ করা এবং সপ্তাহের এক এক দিন এক এক মনযিল পাঠ করার কথা উল্লেখিত হওয়া এজন্য নয় যে, হাদীস শরীফে এই দুআগুলি এভাবে পাঠ করতে বলা হয়েছে। অতএব এই ধারণা করা যে, এই নিয়মের ব্যতিক্রম করার দ্বারা শরীয়তের কোনো হুকুম লঙ্ঘন হবে বা এই দুআগুলির বরকত ও ফযীলত হৃাস পাবে, ঠিক নয়। তবে একে নিছক একটি বিন্যাস মনে করে নিজের সুবিধার জন্য তা অনুসরণ করলে দোষের কিছু নেই। এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দেওয়ার প্রয়োজন এজন্য হয়েছে যে, কারো কারো প্রশ্ন থেকে অনুমিত হয়, তারা এই বিন্যাসের অনুসরণকেও সম্ভবত একটি শরয়ী হুকুম মনে করেন এবং মাসআলার দিক থেকেও এর অন্যথা অনুচিত বলে মনে করেন। অথচ প্রকৃত বিষয় তা-ই যা উপরে লেখা হয়েছে। আবু আবদুর রশীদ

শাবান-রমজান ১৪৩০ . আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ২০০৯

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৫ . সংখ্যা: ০৮-০৯
একটি ভুল কাজঃ জানাযার প্রতি তাকবীরে আকাশের দিকে চোখ ওঠানো
ভুলের কোনো শেষ নেই। কোনো কোনো ভুল এতই আজব হয় যে, যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তা থেকে নিরাপদ রেখেছেন তারা তা চিন-াও করতে পারেন না এবং এমন ভুল হতে পারে বলে বিশ্বাসও করতে পারেন না। সম্ভবত এ ধরনের একটি ভুল, যা কারো কারো মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে এই যে, তারা জানাযার নামাযের প্রতি তাকবীরের সময় আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকায়। তাদের ধারণা, জানাযার নামাযে এরূপ করা চাই! এই ধারণা ভুল। নামাযের অন্যান্য সময়ের মতো তাকবীর বলার সময়ও দৃষ্টি যমীনের দিকে থাকবে। এ সময় দৃষ্টিকে ওপরের দিকে ওঠানো যেমন খেলাফে সুন্নত তেমনি অযৌক্তিকও বটে। আর যদি এর পিছনে কোনো ভিত্তিহীন বিশ্বাস থাকে তবে তো বিষয়টা আরো মারাত্মক।
একটি কাহিনীঃ ‘দুআয়ে কদ্হ’ সম্পর্কিত বর্ণনার কোনো ভিত্তি নেই
কোনো কোনো অযীফার কিতাবে ‘দুআয়ে কদ্হ’ নামে একটি দীর্ঘ দুআ পাওয়া যায়, যার সম্পর্কে দাবি করা হয়েছে যে, মি’রাজের রাতে হযরত জিব্রীল আ. তা নবীজীকে দান করেছেন এবং তার বহু ফযীলত উল্লেখ করেছেন! প্রকৃত বিষয় এই যে, এটা মাছূর দুআ নয়, কেউ তা তৈরি করেছে। আর এর যে ইতিহাস বর্ণনা করা হয়েছে তা একটি অলিক কাহিনী। বাস-বতার সঙ্গে এর দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই। মোল্লা আলী ক্বারী রাহ. ‘আলহিযবুল আ’যম’ কিতাবের শুরুতে এই ‘মওযূ’ বর্ণনাগুলির দিকে ইঙ্গিত করে কঠোর সমালোচনা করেছেন। শরহে নুখবার ভাষ্যগ্রনে'ও ‘মওযূ’ অধ্যায়ে এর সমালোচনা করেছেন।
একটি অন্যায় কাজঃ ‘বিসমিল্লাহ ‘ ও ‘দরূদ’ অশুদ্ধ বা অসম্পূর্ণ বলা ও লেখা
প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের শুরুতে ‘আল্লাহর যিকর’ মাসনূন। যে কাজের সূচনায় শরীয়ত যে যিকর নির্দেশ করেছে সে কাজের জন্য ঐ যিকরই মাসনূন। অনেক কাজে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ বলা বা লেখার নির্দেশনা রয়েছে। শরীয়তে তা মাসনূন। বিধানগত বিচারে এটা মাসনূন বা মুস-াহাব হলেও এর তাৎপর্য অত্যন- গভীর। সংক্ষেপে বলা যায় যে, এর দ্বারা বান্দা নতুন করে এর অঙ্গিকার। আল্লাহ তাআলার নেয়াতমসমূস স্মরণ করে এবং আল্লাহর দিকে রুজূ করে কাজের মধ্যে দুরুস-ী ও খায়র ও বরকতের দরখাস- করে। এজন্য এই আমল গুরুত্বের সঙ্গে করা চাই। আর যেহেতু এতে মাহবূবে হাকীকী আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের পবিত্র নাম রয়েছে তাই গভীর শ্রদ্ধা ও মহাব্বতের সঙ্গে তা আদায় করা চাই। পূর্ণ বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম তাজবীদ ও ইখলাসের সঙ্গে পাঠ করা চাই, শুধু রসম পুরা করার জন্য না হওয়া চাই। পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের মধ্যে অনেককে অনেক সময় দেখা যায়, যারা বিসমিল্লাহ এমনভাবে পাঠ করে থাকেন, যেন তা একটি অতিরিক্ত কাজ। মূল কাজ হল যা শুরু করা হচ্ছে। বলাবাহুল্য, যারা এমন মনে করেন তারা এই সুন্নতের তাৎপর্য সম্পর্কে সচেতন নন। বিসমিল্লাহকে মূল কাজের মতো গুরুত্ব দিয়ে পাঠ করা উচিত; বরং কোনো দুনিয়াবী কাজের শুরুতে যদি ‘বিসমিল্লাহ’ পড়া হয় তাহলে তা ওই কাজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। ‘আররহীম’ শব্দে ওয়াকফের কারণে দীর্ঘ মদ করতে হবে। কিন' যদি এক আলিফ মদও না করা হয় তবে তা হবে ‘লাহনে জলী’। তদ্রূপ ‘আররাহমান’-এর মীমে এক আলিফ ‘মদ’ করা জরুরি। অক্ষরগুলো মাখরাজ থেকে আদায় করা, বিশেষত ও সঠিক মাখরাজ থেকে আদায় করাও জরুরি। দরূদ শরীফও অত্যন- বরকতপূর্ণ আমল। দুআর বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে দরূদ শরীফ অত্যন- গুরুত্বপূর্ণ। এদিক থেকে তা আল্লাহ তাআলার ইবাদত। দ্বিতীয়ত এর সম্পর্ক রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে, যাঁর হক মুসলমানদের উপর তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি এবং যিনি আল্লাহ তাআলার পরে আল্লাহর বান্দাদের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহকারী। দরূদের মাধ্যমে তাঁর জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করা হয়। তাই এই আমল অত্যন- ভক্তি ও অনুরাগের সঙ্গে আদায় করা উচিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উল্লেখ এক মজলিসে বারবার হলে মাসআলাগত দিক থেকে যদিও প্রতিবার দরূদ পড়া জরুরি নয়, মুস-াহাব, কিন' এখানে বিষয়টি মহব্বতের। এজন্য-মাশাআল্লাহ-মুসলিম উম্মাহ এই মুস-াহাব আমলের বিষয়ে যত্নবান, কিন' এরপরও আমাদের মধ্যে কেউ কেউ কখনো কখনো উদাসীনতার শিকার হয়ে যায়। কেউ ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ এমনভাবে পাঠ করে, যেন তা একটি অতিরিক্ত বিষয়, এজন্য এত দ্রূত ও অস্পষ্টভাবে তা পাঠ করা হয় যে, কিছু অক্ষর সঠিকভাবে উচ্চারিতই হয় না। এটা ঠিক নয়। দরূদকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল মনে করে আদায় করা উচিত। লেখার মধ্যে তো দরূদ শরীফকে খুবই মাজলূম বানানো হয়। কেউ শুধু (স.) লেখেন, কেউ লেখেন (দ.)। যেন এটা শুধু ‘অতিরিক্ত’ বিষয়ই নয়, একটি ‘বিপদ’ও বটে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন!! প্রশ্ন এই যে, সম্পূর্ণ দরূদ লেখা হলে কতটুকু কালি বা কাগজ ব্যয় হবে? আহা! আমরা যদি উপলব্ধি করতে পারতাম যে, এই ব্যয়টুকুই হতে পারে আমাদের সঞ্চয়। আমাদের দেশের এমন একজন আলেমে দ্বীনের নাম আমার জানা আছে, যিনি শুধু এজন্য কোনো প্রকাশককে তার কিতাব ছাপতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন যে, তারা পূর্ণ দরূদের পরিবর্তে শুধু (দ:) ব্যবহার করতে চেয়েছিল। বলাবাহুল্য যে, এমন ব্যক্তিরাই হলেন আমাদের জন্য অনুসরণীয়।

রজব ১৪৩০ . জুলাই ২০০৯

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ৫ . সংখ্যা: ০৭
মিরাজ বিষয়ক আলোচনা : কিছু অসতর্কতা
১. যেহেতু কোনো কোনো অবিশ্বাসী মিরাজের ঘটনাকে অসম্ভব মনে করে তাই অনেকে তাদেরকে বোঝানোর জন্য বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্যের অবতারণা করেন এবং মিরাজের সম্ভাব্যতা প্রমাণের প্রয়াস পান। আসলে এটা মৌলিক কাজ নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেহেতু নিজ শক্তিতে আসমান ও জমিনের এই আশ্চর্য ভ্রমণ সম্পন্ন করেননি। তাঁকে ভ্রমণ করানো হয়েছে এবং করিয়েছেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা, যিনি আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা এবং সকল ত্রুটি ও অক্ষমতা থেকে পবিত্র এজন্য কোনো মুমিন কুরআন-হাদীসের বিবরণের উপর সামান্যতম দ্বিধাও করতে পারে না। এ কথাটিই হচ্ছে এ প্রসঙ্গে মূল কথা।
২. মিরাজের ঘটনা বলার সময় বর্ণনার শুদ্ধা-শুদ্ধির প্রতি দৃষ্টি না রাখাও একটি ব্যাপক ভুল। একশ্রেণীর মানুষ যে কোনো চটি পুস্তিকায় কিছু পেলে বা কোনো কাহিনীকারের নিকট কিছু শুনলে তা-ই বিশ্বাস করে বসে এবং এত দৃঢ়তার সাথে তা বর্ণনা করতে থাকে যেন সহীহ বুখারী বা সহীহ মুসলিমের হাদীস। এমন কাজ শরীয়তের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েয।
৩. কোনো কোনো জাহেল ব্যক্তি মিরাজের ঘটনা এমনভাবে বর্ণনা করে, যেন আরশ আল্লাহ তাআলার থাকার জায়গা  এবং তিনি নবীজীকে নিজের ঘরে দাওয়াত করেছেন। নাউযুবিল্লাহ।
এই উপস্থাপনা খুবই মারাত্মক। আল্লাহ তাআলা সকল কিছুর সৃষ্টিকর্তা, আরশ তাঁর মাখলুক, স্থান ও কাল তিনি সৃষ্টি করেছেন, তাঁর সত্ত্বা স্থান-কালের সকল বন্ধনের উর্ধ্বে। এটাই আহলে সুন্নত ওয়াল জামাতের আকীদা।
মিরাজের ঘটনাকে ঠিক সেভাবেই বুঝতে হবে যেভাবে সূরা ইসরা ও সূরা নাজমের আয়াতসমূহে ইরশাদ হয়েছে এবং সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে। #
এটা হাদীসের দুআ নয়
‘মুনাজাতে মকবুল’ (হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. কর্তৃক সংকলিত)-এর কোনো কোনো সংস্করণের শেষে একটি দুআ ছাপা আছে। যার শিরোনাম হচ্ছে, ‘দুআয়ে ইব্রাহীম’ এবং এটি প্রত্যেক জুমায় সকাল-সন্ধ্যা পড়তে বলা হয়েছে।
অনেকেই ‘মুনাজাতে মকবুল’-এর দুআগুলির ন্যায় এটাকেও হাদীসে উল্লেখিত দুআ মনে করেন। কিন্তু প্রকৃত বিষয় তা নয়। না এটা কোনো মা’ছূর দুআ, আর না হযরত ইব্রাহীম আ.-এর সাথে এই দুআর কোনো সম্পর্ক আছে। আর এটা ‘মুনাজাতে মকবুল’-এর অংশও নয়। কোনো প্রকাশক এটাকে কিতাবের সাথে ছেপে দিয়েছে। কেন, কীভাবে এটা ইব্রাহীম আ.-এর নামে নামকরণ করা হল তারও কোনো সূত্র নেই। 
একটি ভুল মাসআলা : বিধবার অন্যত্র বিবাহ হলে সে কি পূর্বের স্বামীর মীরাস থেকে বঞ্চিত হয়?
কারো কারো ধারণা যে, স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রী স্বামীর যে মীরাস পায় তার জন্য শর্ত হল, অন্য কোথাও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ না হওয়া। যদি কোথাও বিয়ে করে তাহলে সে পূর্বের স্বামীর মীরাস পাবে না। নাউযুবিল্লাহ!
মনে রাখবেন, এটা সম্পূর্ণ জাহেলী চিন্তা! স্বামীর মৃত্যুর সময় স্ত্রী জীবিত থাকলেই সে মীরাসের হকদার হয়ে যায়। তার অন্যত্র বিবাহ হোক বা না হোক তাতে তার মীরাস প্রাপ্তির ক্ষেত্রে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করে না। এ কারণে কোনো মহিলাকে মীরাস থেকে বঞ্চিত করা হলে তা হবে বড় ধরনের কবীরা গুনাহ। এটা একদিকে তার পাওনা আত্মসাৎ করা অপরদিকে শরীয়তের বিকৃতি সাধন।
আমাদের দেশে স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবাদের সঙ্গে বিবাহের ব্যবস্থা না করা একটি জাহেলী নিয়ম। এর এখন আরো বড় যুলুম যোগ হয়েছে যে, অন্যত্র  বিবাহের কারণে তাকে মীরাস থেকে বঞ্চিত করা হয়।
لا حول ولا قوة إلا بالله العظيم
স্মরণ রাখবেন, যাদের তত্ত্বাবধানে কোনো বিধবা রয়েছে তাদের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হল, বাস্তব কোনো ওযর না থাকলে (সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কখনোই কোনো ওযর নয়) তার বিয়ের ব্যবস্থা করা। এতে বিভিন্ন উপকারিতার পাশাপাশি মৃত সুন্নত যিন্দা করার ছওয়াবও হাসিল হবে। 
একটি ভুল প্রচলন : বিবাহের ইজাব-কবুলের পর সালাম-মুসাফাহা কি সুন্নত?
কারো সঙ্গে দেখা হলে সর্বপ্রথম আমল হচ্ছে সালাম।
السلام قبل الكلام
সালামের স্থান কুশল বিনিময়েরও পূর্বে। এ বিষয়টি সকলেরই জানা আছে। মুসাফাহাও সাক্ষাতের শুরুতেই করতে হয়। এখন এ কথা সুষ্পষ্ট যে, বিবাহের অনুষ্ঠান চলাকালে বর তো মজলিসের শুরুতেই উপস্থিত হয়। আর আসার পর সালাম-মুসাফাহাও অবশ্যই করে থাকে। কিন্তু অনেক জায়গায় এই প্রচলন দেখা যায় যে, বিবাহের খুতবা ও ইজাব-কবুল হওয়ার পর বর দাঁড়িয়ে উপস্থিত সবাইকে সালাম দেয় এবং বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির সঙ্গে মুসাফাহা-মুআনাকা করে। যদি সে নিজে না করে তবে কোনো মুরববী তাকে ইশারা করে বলে, সবাইকে সালাম দাও। এটি অন্যান্য রসম-রেওয়াজের মতো একটি রসম। এটি সুন্নত নয়, আবার যুক্তিযুক্ত কোনো কাজও নয়। ইজাব-কবুলের পর সুন্নত আমল হচ্ছে, নব দম্পতির জন্য বরকতের দুআ করা। যে দুআর বাক্য হাদীসে এভাবে এসেছে,
بارك الله لك وبارك عليك وجمع بينكما في الخير
(জামে তিরমিযী, হাদীস : ১০৯১)

জুমাদাল উখরা ১৪৩০ . জুন ২০০৯

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৫ . সংখ্যা: ০৬
তরজমার ভুল : إن أولياءه إلا المتقون এর অর্থ কী?
পূর্ণ আয়াত সামনে না রাখার কারণে অনেককে দেখা যায় তারা উপরোক্ত আয়াতের তরজমা এভাবে করেন, ‘শুধু মুত্তাকীরাই হল আল্লাহর ওলী।’ এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, তাকওয়া ও পরহেযগারী ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা যায় না। কুরআন মজীদে আল্লাহর ওলীদের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে-
الذين آمنوا وكانوا يتقون
অর্থাৎ ‘যারা ঈমান এনেছে ও তাকওয়া অবলম্বন করেছে।’
অতএব ঈমান ও তাকওয়ায় যে যত উঁচু মাকাম অর্জন করবে সে তত বড় ওলী। কিন্তু উপরোক্ত আয়াতাংশে এই বিষয়ে বলা হয়নি। পূর্ণ আয়াত তেলাওয়াত করলে পরিষ্কার দেখা যাবে, এর অর্থ হচ্ছে-‘‘একমাত্র মুত্তাকীরাই মসজিদে হারামের অভিভাবক।’’ অর্থাৎ মুশরিকদের কোনো অধিকার নেই মসজিদে হারামের কর্তৃত্বগ্রহণ করার এবং মুমিনদেরকে প্রবেশে বাধা প্রদান করার। এই মসজিদের উপর তো তাদের কোনো অধিকার নেই। একমাত্র মুত্তাকীরাই অর্থাৎ তাওহীদে বিশ্বাসী তাকওয়ার অনুসারী লোকেরাই এই মসজিদের অভিভাবক।
আয়াতের পূর্বাপর লক্ষ না করে মধ্য থেকে একটি অংশ তুলে নিয়ে তরজমা ও তাফসীর করতে থাকলে এ ধরনের ভুল হয়। কুরআন মজীদের বিষয়ে এটা খুবই অসতর্কতা, যা পরিহার করা উচিত।
অবচেতনে ভুল চিন্তা : দেশের রাজনৈতিক পরিচিতির কারণে আপনজনকে পর মনে করা
মুসলিম উম্মাহ তাওহীদ ও মিল্লাতে হানীফিয়্যাহর মেলবন্ধনে আবদ্ধ। তাঁরা দ্বীনে তাওহীদ ও শরীয়তে মুহাম্মদীর অনুসারী, যা আল্লাহ তাআলা আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর নাযিল করেছেন। এই উম্মতের একতার মূল সূত্র হচ্ছে লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। এই কালেমায় বিশ্বাসীরা যে ভূখন্ডেরই অধিবাসী হোক, যে ভাষা ও বর্ণেরই হোক, যে গোত্র ও সম্প্রদায়েরই হোক পরস্পর ভাই ভাই। তাদের বৈশিষ্ট্য তা-ই যা রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মুসলিম জাতি প্রীতি ও ভালবাসায় এক দেহের ন্যায়। দেহের এক অঙ্গে কষ্ট হলে গোটা দেহ জ্বর ও অনিদ্রায় ভুগতে থাকে।’-সহীহ মুসলিম ২/৩২১
যতদিন ইসলামী খিলাফত অটুট ছিল ততদিন সকল মুসলিম জনপদ একই কেন্দ্রের অধীন ছিল কিন্তু ইসলামী খিলাফত দুর্বল হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার পর মুসলিম জনপদগুলোকে বিভক্ত করা হল। সুবিশাল মুসলিম সাম্রাজ্যকে টুকরা টুকরা করে ফেলা হল। এখন যদি এই ভূখন্ডগত বিভক্তির দ্বারা মুসলিম উম্মাহকেও বিভক্ত করে ফেলা যায় তবেই মুসলিম উম্মাহর সর্বনাশের ষোলকলা পূর্ণ হয়। ইসলামের দুশমনরা এই চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বর্তমান অবস্থায় যদিও প্রত্যেক দেশের সীমান্ত রক্ষাও অপরিহার্য কিন্তু এই রাজনৈতিক বিভক্তি যে আমাদের অনেকের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, আমরা অন্যান্য মুসলিম দেশের সমস্যাকে নিজেদের সমস্যা মনে করি না, অন্যান্য মুসলিম দেশের বিপদ আপদে আমাদের মনে সামান্য অস্থিরতাও সৃষ্টি হয় না-এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।
মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য দ্বীনের মৌলিক চিন্তাধারাকে লালন করা। চিন্তায় ও আলোচনায় তা এ পরিমাণ চর্চা করা প্রয়োজন যাতে পরিস্থিতির কারণে আমরা দ্বীনের মৌলিক চেতনা বিস্মৃত না হই।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, কালেমায় বিশ্বাসী মুসলিম যেখানেই বাস করুক, আমারই মতো সে আল্লাহর বান্দা,  সে আল্লাহর যমীনেই বাস করছে। তাওহীদের বন্ধনই মুসলমানদের প্রীতি ও একতার সবচেয়ে বড় বন্ধন, সবচেয়ে দৃঢ় ও স্থায়ী বন্ধন। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এর হক আদায় করার তাওফীক দান করুন। আমীন। #
একটি ভিত্তিহীন রসম বা ভিত্তিহীন বর্ণনা : আসরের পর কিছু খাওয়া কি অনুত্তম
একজন বুদ্ধিমান শিক্ষিত মানুষের নিকট থেকে একথাটা শুনে খুবই আশ্চর্যান্বিত হয়েছি যে, তিনি আসর থেকে মাগরিবের মধ্যে কিছু খান না। পূর্ব থেকেই তার ধারণা যে, এই সময় খাওয়া-দাওয়া করা ভালো না বা নিষেধ আছে।
এই ধারণা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। শরীয়তে শুধু রোযার হালতে খাওয়া-দাওয়া নিষেধ। অন্য সময় নিষেধ নয়। তবে কেউ যদি বিশেষ কোনো সমস্যার কারণে বা চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষ কোনো সময় খাওয়া থেকে বিরত থাকে তবে সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়। কিন্তু মনগড়াভাবে দিনে রাতের কোনো অংশের ব্যাপারে একথা বলা যে, এ সময় খানাপিনা থেকে বিরত থাকা উত্তম বা ছওয়াবের কাজ, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ ধরনের রসম-রেওয়াজ মেনে চলা শরীয়তে নিষেধ। কারো প্রয়োজন না হলে খাবে না কিন্তু একে একটি বিধান বানিয়ে দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। #

জুমাদাল উলা ১৪৩০ . মে ২০০৯

পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৫ . সংখ্যা: ০৫
এটি হাদীস নয়, কোনো হাদীসের বক্তব্যও নয় : হাদীসে কি ফুল কেনার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে?
এটি হাদীস নয়, কোনো হাদীসের বক্তব্যও নয় : হাদীসে কি ফুল কেনার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে?
জোটে যদি মোটে একটি পয়সা
খাদ্য কিনিও ক্ষুধার লাগি
দুটি যদি জোটে তবে
অর্ধেকে ফুল কিনে নিও
হে অনুরাগী! 
-মহানবীর হাদীস অবলম্বনে 
গুলশানের এক চৌরাস্তার মোড়ে একটি বিলবোর্ডে  এই পংক্তিগুলো দেখলাম।
‘মহানবীর হাদীস অবলম্বনে’ একথাটি যদি সেখানে না থাকত তাহলে এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু ছিল না।
আমাদের জানামতে এটা না কোনো হাদীস, না কোনো সহীহ হাদীস থেকে একথা বুঝা যায়।
এ জাতীয় বক্তব্যের কোনো হাদীস প্রচলিত ও নির্ভরযোগ্য কোনো হাদীসের কিতাবে আমরা পাইনি। 
নামের ভুল উচ্চারণ : চন্দ্র পঞ্চম মাসের নামের সঠিক উচ্চারণ কী?
চন্দ্র মাসের পঞ্চম মাসের নাম জুমাদাল উলা এবং ষষ্ঠ মাসের নাম জুমাদাল উখরা, এই দুই নামের উচ্চারণের ক্ষেত্রে কেউ কেউ ভুল করে থাকেন। ভুল উচ্চারণগুলো নিম্নে পেশ করা হল :
ক) জুমাদিউল আওয়াল খ) জুমাদিউল উলা গ) জুমাদাল আওয়াল ঘ) জুমাদিউস ছানী ঙ) জমাদিউস ছানিয়া চ) জুমাদাস ছানী।
আরবীতে এই দুই মাসের উচ্চারণ তা-ই, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ জুমাদাল উলা ও জুমাদাল উখরা।
তাফসীর বিষয়ক একটি ভুল
‘আবাবিল’ কি কোনো বিশেষ পাখির নাম? যে সমস্ত পাখির দ্বারা কংকর নিক্ষেপের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা আসহাবুল ফীলকে ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং কা’বাকে রক্ষা করেছেন তাদের কথা সূরা ফিল-এ এসেছে। উক্ত আয়াত হল,
وارسل عليهم طيرا ابابيل
এই আয়াতের অর্থ হল, এবং আল্লাহ তাদের উপর ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি পাঠিয়েছেন।
এখানে ‘আবাবীল’ শব্দটি ‘ইববালা’-এর বহুবচন, যার অর্থ ঝাঁকে ঝাঁকে, দলে দলে। উদ্দেশ্য হল, অনেক পাখি পাঠানো হয়েছিল।
সাধারণ মানুষ মনে করে যে, ‘আবাবিল’ বলে ঐ পাখিগুলোর নাম বুঝানো হয়েছে। এ ধারণা ঠিক নয়। আসলে আবাবিল অর্থ ঝাঁকে ঝাঁকে।
এখন কথা হল, যে পাখি দ্বারা আসহাবুল ফিলকে ধ্বংস করা হয়েছে তা কী পাখির নাম ছিল? এ বিষয়ে কুরআনে কিছু বলা হয়নি এবং এ বিষয়ে ইতিহাসের বক্তব্যও বিভিন্ন ধরনের। 
আরবী ব্যাকরণগত ভুল
কিছু সংক্ষিপ্ত হাদীস আছে, যার আরবী বক্তব্য সাধারণ মানুষেরও জানা। হাদীসগুলো সহীহ, কিন্তু সেগুলোর আরবী বলতে গিয়ে অনেকেই ভুল করে থাকেন কিছু দৃষ্টান্ত পোশ করছি।
أخلص دينك يكفك العمل القليل.
ইখলাসের সাথে ইবাদত কর, অল্প আমলই যথেষ্ট হবে।
কিছু মানুষ এই হাদীসের ‘ইয়াকফিকা’-এর স্থলে ‘ইয়াকফীকা’ (মদসহকারে) পড়ে। এটা আরবী ব্যাকরণ হিসেবেও ভুল এবং হাদীস বর্ণনার দিক থেকেও ভুল।
يا ايها الناس قولوا لا اله الله تفلحوا
‘হে লোকসকল, তোমরা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বল, সফলকাম হবে।’
এই হাদীসের ‘তুফলিহূ’-এর স্থলে কেউ কেউ ‘তুফলিহুন’ (নূনসহকারে) বলে থাকেন। এটা ভুল।
من قال لا اله الا الله دخل الجنة
‘যে বলবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’
এই হাদীসে ‘দাখালাল জান্নাহ’-এর সাথে ‘ফা’ যোগ করে ‘ফাদাখালাল জান্নাহ’ বলে। এটাও ভুল।
من شذ شذ في النار
এই হাদীসে দ্বিতীয় আরবী কে কেউ কেউ আরবী পড়ে এটা ঠিক নয়।
পুরোনো সংখ্যা
For COMPLETE PDF file:https://www.facebook.com/download/541971779301549/%E0%A6%AA_%E0%A6%B0%E0%A6%9A%E0%A6%B2_%E0%A6%A4%20%E0%A6%AD_%E0%A6%B2%20%20%20%20-%20Copy.pdf

No comments:

Post a Comment