Monday, October 26, 2015

ফটো বা স্থীরচিত্র সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি :লেখকঃ মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান দা. বা.






ফটো বা স্থীরচিত্র সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি
লেখকঃ মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান দা. বা.
ভূমিকা

পরম করুণাময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার দয়ায় এবং মাসিক আল-জামিয়া ও মজলিসে ইলমী সংশ্লিষ্ট সকলের আন্তরিক মেহনতের ফলে সময়ের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মাসআলা সম্বলিত “ফটো সম্পর্কে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ” গ্রন্থটি প্রকাশ করা সম্ভব হলো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, পৌত্তলিকতার সূত্রপাত মূর্তি ও ফটোর মাধ্যমে ঘটেছে। এ কারণেই ইসলাম মূর্তি ও ফটোকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। যারা ফটো তোলে ও তোলায় তাদেরকে মালউন (অভিশপ্ত) এবং আল্লাহপাকের নিকট সর্বনিকৃষ্ট বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে হযরত আয়শা রা. বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু-শয্যায় শায়িতাবস্থায় তাঁর স্ত্রী উম্মে সালমা ও উম্মে হাবীবা মারিয়া নামক গির্জায় অংকিত ফটোর কথা বর্ণনা করলে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শীর মুবারক উঁচু করে বলেন- “খৃষ্টান-ইহুদীরা তাদের নেকলোক মৃত্যুবরণ করলে কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করে তাতে ফটো অংকিত করে। এরা আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট।” অন্য এক হাদীসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- “যারা ফটো তোলে, তারা কিয়ামতের দিন সর্বাধিক কঠোর আযাবে আক্রান্ত হবে।” এ সমস্ত হাদীসের কঠোর বাণীর কারণে মুসলিম উম্মাহর ফকীহ ও মুফতীগণ সর্বসম্মতভাবে সর্বপ্রকার ফটোকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। বক্ষমাণ পুস্তিকাটি মুহিউস সুন্নাহ আল্লামা মাহমূদুল হাসান সাহেবের লিখিত শরীয়তের মজবূত দলীল-সমৃদ্ধ একটি অভূতপূর্ব গবেষণা নিবন্ধ। এতে কুরআন-হাদীস ও শরীয়তের অন্যান্য দলিলের আলোকে সব ধরনের ও ছবি তথা প্রাণীর স্থির ছবি, ভিডিও ছবি, স্থির ও ভিডিও কার্টুন ছবি ইত্যাদির সর্বদিক নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইসলামী ব্যক্তিত্বদের চিন্তা ও উদ্ধৃতিও এতে সন্নিবেশিত হয়েছে। হযরত মুহিউস সুন্নাহ দা. বা. কেবল এদেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শীর্ষস্থানীয় একজন আলেমই নন; ইলমী গভীরতা, আমলী মাধুর্য আর যুগ সমস্যা সম্পর্কে সূক্ষ্মদৃষ্টি তার ব্যক্তিত্বের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তিনি হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী রহ.-এর সর্বশেষ খলীফা মুহিউস সুন্নাহ হযরত মাওলানা শাহ আবরারুল হক রহ. এর অতি নির্ভরযোগ্য স্নেহভাজন খলীফা। তার দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা রচনাটিকে সমৃদ্ধ ও উচ্চ মানে পৌছে দিয়েছে। আশা করি মানুষের বিভ্রান্তি ও চিন্তার অস্থিরতা দূরীকরণে এ পুস্তিকাটি বিরাট সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। -প্রকাশক
Jamia Islamia Darul Uloom Madania )Jatrabari Madrasa(

Established
1969
Type
Islamic university
Chancellor
Mawlana Mahmudul Hasan
Academic staff
73 (total)
Students
3500
Location
312 ,South Jatrabari, Dhaka 1204



সূচীপত্র
শিরোনাম
পৃষ্ঠা
পূর্বকথা ----------------------------------------------------------------------------
3
ফটো সম্পর্কে রাসূল সা. এর বাণী ----------------------------------------------------
3
ফটো সম্পর্কে মিশরী আলেমদের মতামত ----------------------------------------------
3
দেওবন্দের ওলামাদের মতামত -------------------------------------------------------
4
আবুল কালাম আজাদের অভিমত -----------------------------------------------------
4
সর্বসাধারণের প্রতি নমনীয়তার বিধান -------------------------------------------------
4
উমুমে বালওয়ার অর্থ ----------------------------------------------------------------
5
উপকার এবং অপকার----------------------------------------------------------------
5
উপকার হাসিলের শর্ত ---------------------------------------------------------------
6
ফটো চিত্রের অপকারিতা -------------------------------------------------------------
6
প্রয়োজনের মাপকাঠি ----------------------------------------------------------------
7
প্রয়োজনের প্রকারভেদ --------------------------------------------------------------
7
প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা ---------------------------------------------------------------
7
ফটোর প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা ---------------------------------------------------
8
ফটোর ধর্মীয় ক্ষতি ------------------------------------------------------------------
8
ফটোর চারিত্রিক প্রতিক্রিয়া -----------------------------------------------------------
9
কার্টুন ছবির হুকুম -------------------------------------------------------------------
9
বিধি-নিষেধের মানদণ্ড ---------------------------------------------------------------
9
কার্টুন ছবির ক্ষতির দিকসমূহ----------------------------------------------------------
10
ইল্লাত এবং মুসলিহাত ---------------------------------------------------------------
11
স্বভাবের গরমিল --------------------------------------------------------------------
12
খোদায়ী সাহায্যের পূর্বশর্ত -----------------------------------------------------------
12
দ্বীন-ধর্মের প্রতি অবহেলার পরিণাম ---------------------------------------------------
13
গোনাহের মজলিসে হাজিরী ----------------------------------------------------------
13
মসজিদে বিবাহ-শাদী ---------------------------------------------------------------
13
ঈদগাহের পবিত্রতা -----------------------------------------------------------------
13
জানাযার নামায --------------------------------------------------------------------
14
ফটোর প্রচার-প্রসার -----------------------------------------------------------------
14
ওলামাদের প্রতি কঠোর সতর্কবাণী-----------------------------------------------------
15
দ্বীনের বিকৃতির পথ -----------------------------------------------------------------
15
রাজনৈতিক নেতার প্রতি -------------------------------------------------------------
16
সফলতার পথ-----------------------------------------------------------------------
17
ফটো সম্পর্কে সতর্কবাণী-------------------------------------------------------------
18




পূর্বকথা
ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন-বিধান। কুফর,নেফাক, শিরক, বেদআত, মুনাফেকী, গুমরাহী, মুনকারাত ইত্যাদি গোনাহ ও অন্যায়কে ইসলাম সামান্যতম প্রশ্রয় দেয় না। একথা স্বতঃসিদ্ধ যে, একমাত্র ইসলামের অনুশীলনের মাধ্যমেই মানুষ ইহকাল ও পরকালের শান্তি এবং নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে পারে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে।  تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لَا يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا ۚ وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ "এই পরকাল আমি তাদের জন্য নির্ধারিত করি, যারা দুনিয়ার বুকে ঔদ্ধত্য প্রকাশ করতে ও অনর্থ সৃষ্টি করতে চায় না।" ( সূরা কাসাস: ৮৩) ইসলাম মানুষের আমল-আখলাকের প্রতি অধিক গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। একারণেই পাপাচার, অপরাধ প্রবণতা, ফিৎনা-ফাসাদ ইত্যাদি ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। শিরক ইসলামের দৃষ্টিতে সর্বাপেক্ষা গুরুতর ও অমার্জনীয় অপরাধ। আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُمْ بَيْنَ النَّاسِ أَنْ تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ ۚ إِنَّ اللَّهَ نِعِمَّا يَعِظُكُمْ بِهِ ۗ إِنَّ اللَّهَ كَانَ سَمِيعًا بَصِيرًا “নিশ্চয় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করেন না, যে তার সাথে কাউকে শরীক করে। এ ছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন।” (সূরা নিসা : ৫৮)


ফটো সম্পর্কে রাসূল সা. এর বাণী
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, পৌত্তলিকতার সূত্রপাত মূর্তি ও ফটোর মাধ্যমে ঘটেছে। এ কারণেই ইসলাম মূর্তি ও ফটোকে সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করেছে। যারা ফটো তোলে ও তোলায় তাদেরকে মালউন (অভিশপ্ত) এবং আল্লাহপাকের নিকট সর্বনিকৃষ্ট বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বুখারী ও মুসলিম শরীফে বর্ণিত হাদীসে হযরত আয়শা রা. বলেন, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যু-শয্যায় শায়িতাবস্থায় তাঁর স্ত্রী উম্মে সালমা ও উম্মে হাবীবা রা. মারিয়া নামক গির্জায় অংকিত ফটোর কথা বর্ণনা করলে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শীর মুবারক উঁচু করে বলেন- اولئك إذا مات فيهم الرجل الصالح “খৃষ্টান-ইহুদীরা তাদের নেকলোক মৃত্যুবরণ করলে কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ করে তাতে ফটো অংকিত করে। এরা আল্লাহর সৃষ্টিকুলের মধ্যে সর্বনিকৃষ্ট।” অন্য এক হাদীসে হযরত আয়শা রা. বলেন, হরত রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফরে ছিলেন, এই সময়ে আমি আমার দরজায় ফটোযুক্ত একটি পর্দা টানাই। তিনি সফর থেকে ফিরে রুমে লটকানো পর্দা দেখে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন এবং বলেন হে আয়শা! তোমার জানা থাকা উচিত যে, কিয়ামতের দিন সর্বাপেক্ষা অধিক আযাবে আক্রান্ত হবে তারা যারা আল্লাহর সৃষ্টজীবের ফটো অংকন করে নিজের প্রভুত্ব প্রকাশ করে। (বুখারী, মুসলিম) মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদের হাদীসে বলা হয়েছে- إن اشد الناس عذابا يوم القيامة المصورون “যারা ফটো তোলে, তারা কিয়ামতের দিন সর্বাধিক কঠোর আযাবে আক্রান্ত হবে।” এ সমস্ত হাদীসের কঠোর বাণীর কারণে মুসলিম উম্মাহর ফকীহ ও মুফতীগণ সর্বসম্মতভাবে সর্বপ্রকার ফটোকে হারাম বলে ঘোষণা করেছেন। 


ফটো সম্পর্কে মিশরী আলেমদের মতামত
ফটো তোলা মহাপাপ ও কবীরা গোনাহ। এ ব্যাপারে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে সর্বপ্রথম একটি কিতাব রচনা করেন মিশর আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শায়খ মুহাম্মাদ মুতীয়ী। তিনি “ইবাহাতুস সুওয়ার” নামক কিতাবে ক্যামেরার মাধ্যমে ফটো তোলাকে জায়েয বলে ফতওয়া দেন এবং এর পক্ষে যুক্তি পেশ করেন। কিন্তু সারা মুসলিম বিশ্বে এহেন মন্তব্যের কারণে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। মিশরের উলামা মাশায়েখগণ তার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেন এবং স্বয়ং তার একান্ত প্রিয় ছাত্র “আন্নাহযা আল ইসলামিয়া’ নামক কিতাবে স্বীয় শায়খ ও উস্তাদের ফটো বিষয়ক বক্তব্যের প্রতিবাদে কলম ধরেন। শেখ মুহাম্মাদ মুতীয়ীর ছাত্র শায়খ মুস্তফা এক পর্যায়ে লিখেছেন, “সমস্ত উম্মতের গোনাহর ভার একা শায়খ মুহাম্মাদ মুতীয়ীর কাঁধে পড়বে। কেননা তিনি একটি মারাত্মক গোনাহ্র দরজা উন্মুক্ত করেছেন।”

দেওবন্দের ওলামাদের মতামত
দেওবন্দী ওলামা-মাশায়েখ ও ফকীহগণও ফটোকে সম্পূর্ণ হারাম বলে সর্বসম্মত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। হযরত হাকীমুল উম্মত মুজাদ্দিদে মিল্লাত শাহ আশরাফ আলী থানভী রহ.-এর খলীফা বিশিষ্ট ঐতিহাসিক ও লেখক আল্লামা সুলাইমান নদভী মিশরী শায়খের বক্তব্যের প্রতিবাদে এক প্রবন্ধ লিখে ‘মাআরিফ’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এশিয়ার সুপ্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরীর নির্দেশে তাঁরই তত্ত্বাবধানে হযরত মুফতী শফী সাহেব মিশরী শায়খের প্রতিবাদে প্রবন্ধ লিখেন এবং দারুল উলূম দেওবন্দের “আল কাসিম’ পত্রিকায় সেটি ছাপা হয়। পরবর্তী সময় এই প্রবন্ধটি “আত তাছভীর লিআহকামিত তাছভীর” নামে পুস্তিকা আকারে প্রকাশ করা হয়। বলা হয় যে, তুমুল প্রতিবাদ এবং চাপের মুখে মিশরের শেখ মুহাম্মাদ মুতীয়ী শেষ পর্যন্ত নিজের ভুলের কথা স্বীকার করেন এবং মৃত্যুর আগে তার পূর্বের মত প্রত্যাহার করতঃ ফটোকে হারাম বলে সমস্ত ফকীহদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন।


আবুল কালাম আজাদের অভিমত
ফটো সম্পর্কে মুসলিম উম্মাহর নির্ভরযোগ্য ফকীহদের মতামতকে উপেক্ষা করে যারা এই না জায়েয কাজটাকে জায়েয করতে চান তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। তাদের বক্তব্য হলো, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ সাহেব একদিকে যেমন ছিলেন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ অপরদিকে তেমনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট গবেষক আলেমে দ্বীন। তিনি ফটোকে জায়েয মনে করতেন। তার ‘তরজুমানুল কুরআন’ এর উজ্জ্বল প্রমাণ। তরজুমানুল কুরআনে তিনি জুলকারনাইনের ইতিহাস ফটোসহ প্রকাশ করেছেন। মাওলানা আজাদের সূত্র ধরে তাদের এই উক্তি আমাকে অবাক করে তুলেছে। কারণ তারা সমস্ত ফকীহদের মতামতকে উপেক্ষ করে একজন রাজনীতিবিদের দৃষ্টিভঙ্গির আশ্রয় নিয়েছেন। যেখানে হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী রহ., শাহ আব্দুল আজীজ দেহলভী রহ., হযরত মুফতী রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ., হযরত আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী রহ., হযরত হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী রহ., হযরত শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ., হযরত মুফতী কেফায়েতুল্লাহ দেওবন্দী রহ., হযরত মুফতী মুহাম্মদ শফী সাহেব রহ.সহ দেওবন্দের ওলামা মাশায়েখদের সর্বসম্মত অভিমত হচ্ছে ফটো সম্পূর্ণ হারাম; সেখানে একটি ফেকহী মাসআলার ব্যাপারে তারা মাওলানা আজাদের শরণাপন্ন হলেন কেন? বড় মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ফটোর বৈধতা সম্পর্কে মাওলানা আজাদ সাহেবের কোন ফতওয়া আছে বলে কারো জানা নেই। তবে তিনি জুলকারনাইনের ফটো তার তরজুমানূল কুরআনে ছাপিয়ে প্রকাশ করেছেন, যা মূলত ফটো তোলাকে সমর্থনেরই নামান্তর। কিন্তু এতে তিনি কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েন। তাই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পরবর্তীতে তরজুমানুল কুরআন থেকে ছবি প্রত্যাহার করে নেন এবং ছবি হারাম বলে সুস্পস্ট মত প্রকাশ করেন।


সর্বসাধারণের প্রতি নমনীয়তার বিধান
সর্বসাধারণের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনে করণীয় বর্জনীয় হুকুম-আহকামের ক্ষেত্রে শরীয়তের পক্ষ থেকে শিথিলতা এবং নমনীয়তা অবলম্বনের একটি বিধান স্বীকৃত রয়েছে। এটাকে শরীয়তের পরিভাষায় উমুমে বালওয়া বলা হয়। এর সারমর্ম হচ্ছে, যে কাজ কর্ম সমাজের অধিকাংশ লোকেরা করে থাকে, সেই আমলকে হারাম অথবা নাজায়েয না বলা। কেননা এমতাবস্থায় অধিকাংশ মুসলমান অপরাধী এবং গোনাহগার সাব্যস্ত হয়ে যায়। তাই সমাজে ব্যাপক হারে প্রচলিত কাজকে হারাম অথবা নাজায়েয না বলা চাই। যাতে অধিকাংশ মুসলমান অন্যায়কারী ও গোনাহগার সাব্যস্ত না হয়। যারা ফটো তোলায় অভ্যস্ত এবং এটাকে জায়েয বলে, তারা উমুমে বালওয়ার দোহাই দিয়ে থাকে। তারা বলে থাকে যে, বর্তমান বিশ্বে ফটোর ছড়াছড়ি অত্যন্ত বেশি, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অধিকাংশ মুসলমান এই কাজে লিপ্ত। এমতাবস্থায় উমুমে বালওয়ার নিয়ম অনুযায়ী ফটো তোলা ও প্রচার করা জায়েয সাব্যস্ত হয়। কিন্তু তাদের এই উক্তি অনুসারে গীবতকে জায়েয বলা উচিত।

কেননা অসংখ্য মানুষ এমনকি ওলামা-মাশায়েখদের অনেকের দ্বারাও আজকাল গীবত, কুৎসা এবং দোষচর্চা হয়ে থাকে। এ ধরনের অনেক গোনাহর কাজ সমাজে ছড়িয়ে আছে। যেমনঃ মদ্যপান, সুদ-ঘুষ ইত্যাদি। তাহলে এসবও জায়েয হওয়া উচিত। কেননা এগুলোর ছড়াছড়িও যথেষ্ট রয়েছে এবং অসংখ্য মানুষ এহেন পাপ কাজে লিপ্ত রয়েছে। এটাই যদি উমুমে বালওয়ার অর্থ হয়, তাহলে খৃষ্টানদের মত ইসলাম ধর্মেও পাপ বলতে কোন কিছু থাকবে না। খৃষ্টানরা তাদের উম্মতের পাপের বিনিময়ে যিশুর শুলিবিদ্ধ হওয়ার বিশ্বাস আবিষ্কার করে খৃষ্টান ধর্মে সকল পাপাচারকে বৈধতা দিয়েছেন। অনুরূপ ইসলাম ধর্মে উমুমে বালওয়ার দোহাই দিয়ে পাপকাজকে বৈধতা দেয়ার অপচেষ্টা চালানো এবং যে গোনাহে সমাজের অধিক মানুষ লিপ্ত তাকে জায়েয বলার ফতওয়া আবিষ্কার করা বিভ্রান্তিকর যুক্তি ছাড়া আর কি।


উমুমে বালওয়ার অর্থ
যেখানে উমুমে বালওয়ার কারণে হুকুমের শৈথিল্য গ্রহণযোগ্য হয়, সেখানে শর্ত হচ্ছেঃ

ক. ঐ আমলটি শরীয়তের পক্ষ থেকে হালাল অথবা হারাম কোনটিই অকাট্য প্রমাণের দ্বারা সাব্যস্ত না থাকা। যে আমল হালাল অথবা হারাম হওয়া অকাট্য প্রমাণের মাধ্যমে সাব্যস্ত রয়েছে এবং উম্মতের ফকীহদের এ ব্যাপারে ঐকমত্য রয়েছে, সেই আমলের ক্ষেত্রে উমুমে বালওয়ার নিয়ম মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়।

খ. নাপাক এবং পবিত্রতার মাসআলা-মাসায়েলের মধ্যে যেখানে ফকীহদের ভিতর মতবিরোধ বিদ্যমান রয়েছে, সেখানে উমুমে বালওয়ার ভিত্তিতে হুকুমের শিথিলতা গ্রহণযোগ্য হতে পারে।

গ. যে সমস্ত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে শরীয়তে হালাল অথবা হারাম হওয়ার কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই, অর্থাৎ যা পালন করা অথবা না করার কারণে সওয়াব অথবা গোনাহ কোনটিরই বর্ণনা নেই- সে সমস্ত কর্মকাণ্ডে উমূমে বালওয়ার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের শরয়ী অধিকার রয়েছে। এ সমস্ত কর্মকাণ্ডকে শরীয়তের পরিভাষায় মুবাহাত বলা হয়। এ ধরনের আরো অনেক শর্তাবলী রয়েছে। যেহেতু ফটো সম্পর্কে সর্বসম্মতভাবে অকাট্য প্রমাণের মাধ্যমে হারাম ফতওয়া রয়েছে, সুতরাং উমুমে বালওয়ার দোহাই দিয়ে ফটোকে জায়েয বলার কোন অবকাশ নেই। কেননা এই মাসআলাটি মুবাহাতের অন্তর্ভুক্ত নয়।


উপকার এবং অপকার
অনেককে বলতে শোনা যায় যে, বর্তমান যুগ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগ। কম্পিউটার, টি.ভি. ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংবাদ মিডিয়া আজ শীর্ষস্থানে রয়েছে। কোন সংবাদ ও খবরকে সত্বর সারা বিশ্বে প্রচার করা এবং শ্রোতাদের অন্তরে বিশ্বাস সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে ফটো চিত্রের যে প্রভাব হতে পারে, তা ফটো ছাড়া কোনদিন হতে পারে না। আজ পাশ্চাত্য বিশ্ব এই সংবাদ মিডিয়ার মাধ্যমে সারা বিশ্বে স্বীয় আধিপত্য কায়েম করে চলেছে। তাই লাভ এবং উপকারের দিকে লক্ষ্য করে হুকুমের মধ্যে পরিবর্তন সাধন করাই যুক্তিযুক্ত। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে শরীয়তের সিদ্ধান্তের পরিবর্তন শরীয়তগতভাবেই স্বীকৃত রয়েছে।

এ সকল খোড়া যুক্তির উত্তরে বলা যায় যে-
ক. উপকার হাসিল করার শরীয়ত-নির্ধারিত বিধি-বিধান রয়েছে।


খ. প্রয়োজনের কারণে সিদ্ধান্তের মাঝে শিথিলতারও নীতিমালা রয়েছে। একজন অমুসলিমের জন্য এ সমস্ত বিধি-বিধান গ্রহণযোগ্য না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কোন মুসলমানের জন্য শরীয়তের বিধি-বিধান ও নীতিমালা অনুসরণের কোন বিকল্প নেই। তাদেরকে অবশ্যই এ ক্ষেত্রে শরীয়তে বিধি-বিধান মেনে চলতে হবে।

উপকার হাসিলের শর্ত

ক. প্রথম কথা হলো কোন উপকার হাসিলের জন্য অথবা লাভবান হওয়ার জন্য বিশেষ অপারগতা ব্যতীত কোন হারামকে হালাল অথবা হালালকে হারাম করার অধিকার কারো নেই। যারা শরীয়ত-নির্ধারিত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালাল সাব্যস্ত করে, তার প্রতি কাফের হয়ে যাওয়ার কঠোর হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। আর ফটো একটি মারাত্মক হারাম কাজ। সুতরাং উুপকারের স্বপ্ন দেখে এটাকে বৈধ এবং জায়েয বলার অধিকার কারো নেই।


খ. দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, যদি কোন কর্মকাণ্ডে ভালো-মন্দ এবং লাভ ও ক্ষতি উভয় দিক বিদ্যমান থাকে, তাহলে মন্দ ও ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়ার খাতিরে ভালো ও লাভের দিকটি পরিহার করার সিদ্ধান্তই হচ্ছে শরীয়তের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। মুজতাহিদগণ এই সিদ্ধান্তের যুক্তি হিসেবেই এই মূলধারা নির্ধারণ করেছেন। دفع مضرة اولى من جلب منفعة অর্থাৎ ক্ষতি এবং উপকার একই স্থানে একত্রিত হলে ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার দিকটিকে প্রাধান্য দিতে হবে।পবিত্র কুরআনে মদ্যপানের অনেক বাহ্যিক উপকারিতার কথা স্বীকার করে ক্ষতির প্রবণতার কারণে তা পান করা, তৈরি করা এবং এর ব্যবসা বাণিজ্য করা সম্পূর্ণ হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। দুগ্ধ পানের মাধ্যমে মানুষের বিরাট উপকার হয়, মজা ও স্বাদ তো আছেই। কিন্তু বিষমিশ্রিত দুধ ক্ষতিকর বলে কেউ তা পান করে না, করার অনুমতিও নেই। অনেক সময় বিভিন্ন রোগের কারণেও দুধ পান করা নিষিদ্ধ হয়। যদি এই ক্ষতি কেবল বস্তু-জগতের সাথে সীমাবদ্ধ না হয়ে আখেরাতের জীবনেও ক্রিয়াশীল হয়, তাহলে এই ক্ষতি থেকে মুক্তির জন্য অবশ্যই সেই লাভের কাজটিকে উপেক্ষা করতে হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে ফটোর উপকারিতা ও লাভ মেনে নিলেও শরীয়তের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ও দুনিয়া আখেরাতের মারাত্মক ক্ষতি থেকে মুক্তির জন্যই এটি হারাম এবং সম্পূর্ণ বর্জনীয় হিসেবে গণ্য হয়।


ফটো চিত্রের অপকারিতা

১. একথা বলা হয় যে, ফটোর সাহায্যে ধর্মীয় খবরাখবর ও বিভিন্ন বিষয়াদি বিশ্বাস্য আকারে জানার সুযোগ হয়। কিন্তু এটা কেউ ভাবে না যে, এর দ্বারা ধর্মহীনতা, মিথ্যাচার, গান-বাদ্য ও ভিত্তিহীন প্রোপাগাণ্ডাকে সমগ্র বিশ্বে বিশ্বাস্য করে তোলা হয়। নগ্নতার প্রচার-প্রসার হয় এবং শ্রোতা ও দর্শকগণ এ কারণে চরম দৈহিক ও আত্মিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।


২. আরো বলা হয়ে থাকে যে, ফটো-চিত্রের দ্বারা ধর্মীয় ও জাতীয় ব্যক্তিত্বের প্রভাব প্রসারিত হয় এবং গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। মানুষের মধ্যে ঐক্যের অনুভূতি জাগ্রত হয়। কিন্তু সংবাদ পাঠক-পাঠিকা ও নায়ক-নায়িকাদের নির্লজ্জ ও মানবতা বিবর্জিত উলঙ্গ-অর্ধোলঙ্গ ফটো-চিত্র প্রদর্শনী ও প্রচারের মাধ্যমে কেবল ধর্মীয় নয়, মানব চরিত্রের কতটুকু অধঃপতন সাধিত হচ্ছে, সেদিকে চিন্তা বাবনার সুযোগ হয় না। মোটকতা ফটো চিত্রের প্রচার ও প্রদর্শনীর দ্বারা যদি কোন উপকার মনে হয়, তাহলে তার তুলনায় লক্ষ গুণ অধিক সমাজিক অধঃপতন, ব্যক্তি চরিত্রের অবক্ষয় এবং দুনিয়া ও আখেরাতের ধ্বংস সাধিত হয়। এই ক্ষতি ও ধ্বংস এতই বাস্তব যে, কারো অস্বীকার করার উপায় নেই। সিনেমা, থিয়েটার, টিভি, ভিসিআর, ও ডিশএন্টিনার ভয়াবহ তাণ্ডবে আক্রান্ত হয়ে আজ মানব জাতি চারিত্রিক অধপতনের চরমে পৌঁছেছে।

আজ নষ্ট যুবকদের যৌন উন্মাদনা থেকে মা, বোন, স্ত্রী বধুদের সম্ভ্রমও রক্ষা পাচ্ছে না। এরপরও যারা লাভের স্বপ্নপুরীতে বসবাস করে ফটো-চিত্রের পক্ষে কথা বলে, তাদের চিন্তা-চেতনার সাথে কোন সুস্থ লোকের পক্ষে ঐকমত্য পোষণ করা সম্ভব নয়।



প্রয়োজনের মাপকাঠি
আগেই বলা হয়েছে যে, একজন মুসলমানের জন্য সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে- স্বীয় শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী শরীয়ত-নির্ধারিত করণীয় ও বর্জনীয় বিধি-নিষেধ কঠোরভাবে মেনে চলা।
এর চেয়ে কোন বড় প্রয়োজন কোন মুসলমানের নেই। আল্লাহপাক এমন হুকুম-আহকাম মুসলমানের প্রতি ধার্য করেননি, যা মানুষের শক্তি-বহির্ভুত। কারণ কোন বিধান পালন করা শক্তি-বহির্ভূত হলে মানুষকে ভিন্ন পথে চলার প্রয়োজন দেখা দিবে। অস্বাভাবিক অবস্থা দেখা দিলে অথবা অসাধারণ প্রয়োজনের সম্মুখীন হলে সেখানেও শরীয়ত-নির্ধারিত বিধি-বিধান রয়েছে, যা অনুসরণের মাধ্যমে অনায়াসে প্রয়োজন মিটানো যায় এবং তা শরীয়ত অনুয়ায়ীই মিটানো যায়। শরীয়ত-বিবর্জিত উপায় অবলম্বনের প্রয়োজন হয় না মোটেই। পবিত্র কুরআন ও হাদীসে এ সম্পর্কে যথেষ্ট দিক-নির্দেশনা বিদ্যমান রয়েছে। এরূপ প্রয়োজনের খাতিরেই বলা হয়েছে, ক্ষুধার তাড়নায় মরণাপন্ন অবস্থায় হারামকৃত পশুর গোশত ভক্ষণ করে জীবন বাচানোর অনুমতি আছে। জিহাদের ময়দানে শত্র“র আঘাতে নাক কেটে যাওয়া সাহাবীকে স্বর্ণের নাক তৈরী করার এবং আর এক সাহাবীকে খুজলি পাচড়ায় ক্ষত বিক্ষত দেহে রেশমের কাপড় পরিধানের অনুমতি দানের পেছনে এই মূলধারারই প্রমাণ মিলে। উসূলের কিতাবে উম্মতের বিশেষজ্ঞ ফকীহগণ লিখেছেন- الضرورة تبيح المحظورات و تتقدر بقدرها অর্থাৎ বিশেষ প্রয়োজনে নিষিদ্ধ বিষয়ও সিদ্ধ হয়, তবে এই সিদ্ধতা শরীয়তসম্মত প্রয়োজনের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ।


প্রয়োজনের প্রকারভেদ

প্রয়োজন সাধারণত দুই ধরনের হয়ে থাকে:


ক. দুনিয়ার উপকারের জন্য প্রয়োজন হওয়া। এরূপ প্রয়োজন নিজের জন্য হতে পারে, অন্যের জন্য হতে পারে। কিন্তু এই প্রয়োজনে কোন কাজ করতে গেলে দুনিয়া ও আখেরাতের মারাত্মক ক্ষতি হয়, নিজের এবং অন্যান্য মানুষের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়। যেমন, দেহে শক্তি বৃদ্ধির জন্য হারাম ঔষধ সেবন করা অথবা আনন্দ উপভোগ করার জন্য বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে কাওয়ালী উপভোগ করা। এ ধরনের প্রয়োজনে হারাম ও নাজায়েয কর্মকাণ্ড করার মোটেই অনুমতি নেই।


খ. হ্যাঁ যদি শরীয়ত-কর্তৃক নির্ধারিত উসূল ভিত্তিক অকাট্য প্রমাণ দ্বারা শরীয়তসম্মত বিশেষ প্রয়োজন সাব্যস্ত হয়, তাহলে এরূপ জরুরত ও প্রয়োজনের কারণে হুকুমের মধ্যে শৈথিল্য গ্রহণীয় বলে বিবেচিত হবে। যেমন, রোগ মুক্তির জন্য এমন ঔষধ সেবনের প্রয়োজন দেখা দিল, যে ঔষধ মূলত হারাম; এ অবস্থায় যদি অভিজ্ঞ মুসলিম ডাক্তারের মতে ঐ ঔষধ ব্যতীত রোগ মুক্তির অন্য কোন উপায় না থাকে তাহলে এমন রোগীর জন্য এই হারাম ঔষধ ব্যবহার এবং সেবন করার অনুমতি রয়েছে।


প্রয়োজনীয়তার ব্যাখ্যা

যে বস্তু ব্যতীত মানুষের কষ্ট হয়, তাকেই প্রয়োজন বলা হয়। আর যদি কষ্ট না হয়, তাহলে সেটি প্রয়োজন-বহির্ভুত বলে বিবেচিত হয়। এ ক্ষেত্রে দেখার বিষয় হলো, প্রয়োজন এত অধিক হতে হবে যে, প্রয়োজন মিটানো ব্যতীত জীবন বাঁচানোই কঠিন, তাহলে এই প্রয়োজন শরীয়ত-সম্মত প্রয়োজন বলে সাব্যস্ত হবে এবং

তা পূরণ করা ওয়াজিব। আর যদি এরূপ না হয়, বরং কেবল আরামের জন্য হয়, জীবন-মরণের প্রশ্ন সেখানে না আসে, তাহলে শরীয়তে এই প্রয়োজন মিটানো জায়েয বলে বিবেচিত হয়। তৃতীয় প্রকার প্রয়োজন এমন যে, তা না হলেও কাজ বাধাগ্রস্ত হয় না, কষ্ট হয় না, তবে হলে আন্তরিক প্রশান্তি ও তৃপ্তির কারণ হয়।

এ ধরনের প্রয়োজন পূরণের দ্বারা আমিত্বভাব, গর্ব প্রকাশ এবং মানুষকে দেখানো উদ্দেশ্য হলে জায়েয নয়, অন্যথায় জায়েয। উপমাস্বরূপ পোষাক-পরিচ্ছদকে বিবেচনা করা যেতে পারে। নিন্মোক্ত চার কারণের যে কোনো এক কারণে পোশাক গ্রহণ করা হয়। ক. বিশেষ প্রয়োজনে পোশাক-পরিচ্ছদ গ্রহণ করা।
খ. আরাম ও শান্তির জন্য গ্রহণ করা।
গ. সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য গ্রহণ করা।
ঘ. সৌন্দর্য বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রদর্শনী ও মানুষকে দেখানো উদ্দেশ্য হওয়া। এর মধ্যে প্রথম বিশেষ প্রয়োজনে পোশাক গ্রহণ করা ওয়াজিব। যাতে সতর ঢাকা যায়। দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়েও শর্তের সাথে জায়েয। কিন্তু চতুর্থ পর্যায়টি হারাম এবং নাজায়েয।


ফটোর প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতা
উপরোক্ত আলোচনার দৃষ্টিকোণ থেকে ফটোর ব্যাপারটি বিবেচনা করা যায়-


ক. ফটো ও চিত্র প্রদর্শনীর কারণে ধর্মীয়, সামাজিক এবং দুনিয়া ও আখেরাতের ক্ষতির দিক বিবেচনা করলে তা হারাম ও নাজায়েয হিসেবে সাব্যস্ত হয়। কারণ উপকার ও লাভের দিকটি ক্ষতির মোকাবেলায় গ্রহণযোগ্য হয় না। বল্গাহীনভাবে ফটো ও চিত্র প্রদর্শনীর কারণে আজ মুসলমানদের মধ্যে যে পরিমাণ অপরাধ প্রবণতা ও নির্লজ্জতা বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।


খ. তবে বিশেষ প্রয়োজনে স্থান-কাল-পাত্রভেদে ফটোর অনুমতি রয়েছে। যথা রোগীর এক্সরে। সাধারণত এক্সরে-র জন্য সমস্ত শরীরের প্রয়োজন হয় না, বরং দেহের বিশেষ বিশেষ অংশের ফটো নেয়া হয়। এরূপ ফটো তোলা হারাম নয়। কেননা হারাম হচ্ছে প্রাণী দেহের পূর্ণ ফটো অথবা উপরের অর্ধভাগের ফটো তোলা। এমনিভাবে মাথাবিহীন ফটোরও প্রয়োজনে অনুমতি রয়েছে। তাই এরূপ ফটো তোলা হারামের অন্তর্ভুক্ত নয়।


গ. আর যদি সমস্ত দেহের ফটোর প্রয়োজন অত্যাবশ্যকীয় হয়ে পড়ে, তাহলে এ ক্ষেত্রেও শরীয়ত অনুমতি প্রদান করেছে। হারানো বিজ্ঞপ্তি, অপরাধীকে গ্রেফতার করার ব্যাপারটিও এভাবে বিবেচনা করতে হবে। যদি আর কোন উপায়ে উদ্দেশ্য সাধন করা সম্ভব না হয়, তাহলে এই বিশেষ ক্ষেত্রে অনুমতি প্রদান করা হয়েছে, কিন্তু এটাকে স্থান-কাল পাত্র নির্বিশেষে ব্যাপকভাবে ফটো তোলার পক্ষে যুক্তি এবং উদাহরণ হিসেবে পেশ করা যাবে না।


ফটোর ধর্মীয় ক্ষতি
ফটো হারাম ও নাজায়েয হওয়ার ব্যাপারে আরো একটি দিক বিবেচনা করা যেতে পারে, তা হচ্ছে- যারা জাতীয় নেতৃত্বের অধিকারী- চাই ধর্মীয় ক্ষেত্রে হোক অথবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে- তাদের অনুসারী ও ভক্তগণ ভক্তি ও মুহব্বতের আবেগে তাদের সম্মুখে আপ্লুত হয়ে বিভিন্ন ধরনের শরীয়ত বিবর্জিত কর্মকাণ্ড করে, এমনকি নতশীর হয়ে সম্মান প্রদর্শন বরং সেজদা করা শুরু করে দেয়। এই সমস্ত শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিদের ফটো বা মূর্তি তৈরি করে বিশেষ বিশেষ স্থানে, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে, অফিসে ও জাদুঘরে রাখা হয়। মানুষ ঐ সমস্ত স্থানে প্রবেশ করে এই ফটোকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করে। এতে হিন্দু, খৃস্টান, ইয়াহুদীসহ বিধর্মীদের সংস্কৃতির অনুসরণ হয়।হাদীসে বলা হয়েছে- من تشبه بقوم فهو منهم অর্থাৎ যে অন্য কোন সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য অবলম্বন করবে সে ঐ সম্প্রদায়েরই অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ সমগ্র বিশ্বে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ব্যক্তিদের সাথে ভক্তি ও মুহাব্বতের এ ধরনের শিরকী কর্মকাণ্ডের উদাহরণ বিরল নয়। এভাবেই সমাজে শিরক, বিদআত ও গোমরাহীর প্রচার ও প্রসার হয়ে থাকে।



ফটোর চারিত্রিক প্রতিক্রিয়া
ফটো চিত্রে সুশ্রী বালক এবং রূপসী যুবতীদের উলঙ্গ অর্ধোলঙ্গ ছবি ছাপানো, প্রকাশ, প্রচার ও প্রদর্শনী হয়ে থাকে, যার কারণে মানুষের মনে প্রাণে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, চিন্তাশক্তির বিকৃতি ঘটে। অগোচরে অবৈধ প্রেম ও ভালোবাসার অনুভূতি জন্ম নেয়। অন্তর ও চিন্তাশক্তির ভিতর এক প্রেমচিত্র স্থায়ীভাবে অংকিত হয়ে পড়ে। অগণিত যুবক-যুবতী অপদৃষ্টির স্বাদ আস্বাদনে পাগলপারা হয়ে সর্বস্ব ধ্বংস করে দেয়। অনেক সময় বিবাহ-শাদীর পূর্বে ফটো আদান-প্রদানের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে, এই সিদ্ধান্ত অনেক সময় ধ্বংসের কারণ হয়। আমাদের বর্তমান যুগের যুবক-যুবতীদের মধ্যে নির্লজ্জ ফিল্ম দেখা এবং নভেল পড়ার আগ্রহ অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আজ যাবতীয় অপরাধের মধ্যে শতকরা সত্তর ভাগ এ সমস্ত যুবক যুবতীদের দ্বারা সংঘটিত হয়। এমতাবস্থায় জাতির কল্যাণ এবং নিরাপত্তার প্রয়োজনেই অবাধে অপ্রয়োজনে ফটোর ছড়াছড়ি হারাম এবং বন্ধ ঘোষণা করা আবশ্যক।


কার্টুন ছবির হুকুম
অনেককেই বলতে শোনা যায় যে, ভক্তি ও প্রেমপ্রীতির অবকাশ কার্টুন ছবিতে নেই। উপরন্তু এর উপকারিতা অনেক বেশি। বর্তমানে কার্টুন ছবির মাধ্যমে ঘটনার বিশ্লেষণের বিষয়টি সারা বিশ্বে সমাদৃত। এর মাধ্যমে অতি সহজে মানুষের মনে বাস্তব অবস্থার প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব হয় এবং আইনগতভাবেও কোন গ্রেফতার বা শাস্তির আশংকা থাকে না। কার্টুনের ফটো দেখে না ভক্তি সৃষ্টি হয়, না অন্তরে প্রেম-ভালবাসার আবেগ সৃষ্টি হয়। সুতরাং এক্সরে এবং অন্যান্য শরীয়ত সম্মত প্রয়োজনে যেমন ফটো তোলার অনুমতি রয়েছে তেমনিভাবে কার্টুন ছবিরও অনুমতি হওয়া উচিত।কিন্তু বাস্তব কথা হলো ফটো হারাম হওয়ার যে কারণ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে এবং শরীয়ত যে কারণে ফটোকে হারাম করেছে, সেই কারণ শুধু ভক্তি আর প্রেমই নয় বরং আরো কারণ রয়েছে, যে কারণসমূহের অনেকগুলো কার্টুন ছবিতে বিদ্যমান বিধায় কার্টুন ছবিও হারামের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে। প্রাসঙ্গিক উপকারিতার দিকে তাকিয়ে অন্যান্য পাপাচার এবং ক্ষতির দিক থেকে অন্ধ হলে চলবে না। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, কেবল উপকার বিবেচনা করে হালাল ও জায়েয বলা সঠিক হলে মদ্যপান ও জুয়া খেলাও হালাল হত। কিন্তু পবিত্র কুরআনে এই দুয়ের উপকারিতার প্রতি ইঙ্গিত করার পর ভয়াবহ ক্ষতির দিক বিবেচনা করে উভয়টিকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। এখান থেকে বুঝা যায়, কোন বস্তুর হারাম হওয়ার কারণ পাওয়া গেলে উপকারিতা ও লাভের দিক বিবেচনা করে সেই বস্তুকে হালাল বা বৈধ বলার অবকাশ নেই।


বিধি-নিষেধের মানদণ্ড
১. মনে রাখতে হবে যে, শরীয়তের যে কোন সিদ্ধান্ত এবং হুকুমের পেছনে অবশ্যই কারণ থাকে। এই কারণকে ইসলামী ফেকাহের পরিভাষায় ‘ইল্লত’ বলা হয়। যে কোন হুকুম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই ইল্লতই হচ্ছে মূল ভিত্তি। হয়তো ইল্লতের কারণে একটি বস্তুকে হারাম অথবা হালাল বলার পর হারামকে হালাল আর হালালকে হারাম বলার দ্বারা লাভ এবং উপকার হতে পারে অথবা কোন বিশেষ অবস্থায় তা বিশেষ সুবিধার কারণও হতে পারে- শরীয়তের পরিভাষায় এটাকে মুসলিহাত বলা হয়। ‘ইল্লত’ এবং ‘মুসলিাহত’ এক বস্তু নয়। উভয়টি ভিন্ন ভিন্ন জিনিস। উভয়ের মধ্যে মৌলিকভাবে পার্থক্য রয়েছে। শরীয়তের হুকুমসমূহ ‘ইল্লতের’র উপর নিভরশীল হয়; ‘মুসলিহাতের’ উপর নয়। বলা যায় যে, ‘ইল্লত’ হলো প্রতিটি হুকুমের জন্য মূল এবং ভিত্তি স্বরূপ। আর ‘মুসলিহাত’ হচ্ছে, তা থেকে উদগত পরিণাম এবং ফলাফল। এ বিষয়টি আরো পরিষ্কারভাবে এভাবে বলা যায় যে, ‘ইল্লত’ থেকে হুকুম নির্গত হয় আর হুকুম থেকে ‘মুসলিহাত’ বের হয়। সুতরাং বুঝা গেল উভয়ের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তাই কোন হুকুমের হালাল এবং হারাম হওয়া নির্ভর করে ইল্লতের উপর; মুসলিহাতের উপর নয়। অতএব যেহেতু ফটো হারাম হওয়ার কার্যকর ইল্লত বিদ্যমান রয়েছে, এমতাবস্থায় মুসলিহাতের অজুহাতে শরীয়ত কর্তৃক হারামকৃত কোন ধরনের ফটো তোলাই হালাল বা জায়েয হতে পারে না।

নসব-নামা দাদার স্থানে নাতিকে উল্লেখ করলে যেমন নসব-নামায় ও বংশসূত্রে বিকৃতির সৃষ্টি হয়, তেমনিভাবে ইল্লতের স্থলে মুসলিহাতকে প্রাধান্য দিয়ে হুকুম পরিবর্তনে প্রয়াসী হলে ইজতেহাদের ধারাবাহিকতায় বিকৃতি সাধিত হয়।


২. যে সমস্ত অপরাধের ব্যাপারে শরীয়ত কর্তৃক অভিশাপ ও কঠোর আযাবের ভয় প্রদর্শন করা হয়েছে, সে সমস্ত গোনাহকে কবীরা গোনাহ বলা হয়, অকাট্য প্রমাণ ব্যতীত মুসলিহাতের দোহাই দিয়ে এগুলোকে হালাল অথবা জায়েয বলার কোন সুযোগ নেই।


৩. কোন জিনিসের মধ্যে একটি অথবা একাধিক উপকার লাভের সম্ভাবনা ঐ জিনিস জায়েয হওয়ার পক্ষে কখনো দলীল হতে পারে না। হ্যাঁ শরীয়তগত উপকারিতার বিষয়টি ভিন্ন; সে সম্পর্কে পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহ পাকের সৃষ্টি সবকিছুই মূলত উপকারী। মদ্যপান ও জুয়া ইত্যাদির মধ্যেও উপকারিতা রয়েছে; কিন্তু তাই বলে এগুলোকে জায়েয বলা হয়নি।


৪. প্রয়োজনে এবং বিশেষ বিশেষ অবস্থায় মস্তকবিহীন দেহের বা ছিন্ন অংশের ফটো তোলার অনুমতি রয়েছে।


৫. এমনকি বিশেষ প্রয়োজনে (যার বিস্তারিত আলোচনা পূর্বে করা হয়েছে এবং যে সম্পর্কে শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত শর্তাবলী ফেকাহের কিতাবসমূহে বিদ্যমান রয়েছে) প্রয়োজানীয় শর্তাবলী সাপেক্ষে পুরো দেহের ফটো তোলারও অনুমতি রয়েছে।


৬. রূপচর্চা করা, প্রদর্শনী করা আর বিশেষ প্রয়োজন ও অপরাগতা এক জিনিস নয়; সুতরাং উভয়টিকে এক মানদণ্ডে বিচার করা যুক্তিযুক্ত হবে না।


৭. শরীয়তের হুকুম-আহকাম ও সিদ্ধান্তাবলী একান্ত বাস্তববিমুখী হয়ে থাকে। অবাস্তব বা নিছক ধারণার উপর ভিত্তি করে শরীয়তের হুকুম-আহকাম নির্ধারিত হয়না। কার্টুন ছবি জায়েয হওয়ার যে সমস্ত উপকারিতার কথা বলা হয়, এগুলো কোন হুকুমের ইল্লত হতে পারে না। হয়তো এগুলোকে মুসলিহাত বলা যেতে পারে। আর হালাল-হারামের হুকুম মুসলিহাতের উপর নয়; বরং ইল্লতের উপর নির্ভরশীল।


কার্টুন ছবির ক্ষতির দিকসমূহ

তাছাড়া কার্টুন ছবির উপকারিতার কথা যারা বলে থাকে, তাদেরকে এর অপকারিতা ও ক্ষতির দিকগুলোও বিবেচনা করা প্রয়োজন। যেমন-


১. কার্টুন ছবির কারণে মানুষ প্রকৃত তত্ত্ব-তালাশের আগ্রহ হারায়, বাস্তবমুখী অনুসন্ধানের স্থলে অবাস্তব অনুভূতিই তার মধ্যে প্রবল হয়ে ওঠে।গবেষণা শক্তি হারিয়ে অপ্রকৃত বস্তুর প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে ওঠে। বস্তুকেই স্বীয় বিশ্বাসের মূল হিসেবে গ্রহণ করে ‘ঈমান বিল গাইব’র মন-মানসিকতা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়ে। এ ধরণের মন-মানসিকতার অধিকারীরা দুরবীনের সাহায্যে অদৃশ্য কীট-পতঙ্গ ও তার প্রতিক্রিয়া দেখতে পায়, কিন্তু তাদের জ্ঞান-শক্তি আল্লাহর প্রতি ঈমান, তার রাসূলের প্রতি বিশ্বাস, মৃত্যুর পর পুনর্জীবন এবং আখেরাতের বিষয়বস্তু উপলবিদ্ধ করতে অক্ষম। তাই বস্তু-পরায়ণ ফটোচিত্রকে হারাম করে শরীয়ত বস্তু পূজার ভূতকে ধ্বংস করেছে। যাতে মানুষ অদৃশ্য জগত ও আখেরাতের প্রকৃত অবস্থাকে বুঝতে সক্ষম হয়।



২. কার্টুন ছবি কেবল নিজ সীমায় সীমাবদ্ধ থকে না, এই মন-মানসিকতা শেষ পর্যন্ত সর্বপ্রকার ফটোচিত্রের রূপ ধারণ করে। ফিল্ম, সিনেমা ও ক্লাবসহ সর্বস্তরে ফটো-মূর্তির ছড়াছড়ি চলছে। এর অর্থ যোগানের জন্য সুদ-ঘুষ, ডাকাতি, জুয়া, লুটপাট ও মারামারি কাটাকাটির ভয়ানক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণেই শরীয়ত সর্বপ্রকার ফটো ও মূর্তিকে হারাম ঘোষণা করে মুসলিম পরিবেশকে এই ভয়াবহ অবস্থা থেকে রক্ষা করেছে।


৩. যেখানে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে মারা যাচ্ছে, লজ্জাস্থান ঢাকার মত অবস্থা ব্যবস্থাও নেই। সেখানে এক শ্রেণীর অর্থশালীরা বিলাসিতার চরমে পৌঁছে কোটি কোটি টাকা খরচ করে বিদেশী ফিল্ম আমদানী করত: আত্মবিনোদনে লিপ্ত হয়। দেশের প্রায় এক তৃতীয়াংশ মানুষ অন্ন, বস্ত্র ও বাসস্থানের অভাবে মরণাপন্ন হয়ে আছে। আর এক শ্রেণীর পাষণ্ড কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সিনেমা হল ও ক্লাব ঘর নির্মাণ করে চিত্র প্রদর্শনীতে মত্ত হয়ে রয়েছে। সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রাত দিন ক্ষেত মজুরী দিয়ে যৎসামান্য অর্থ উপার্জন করে, এই শ্রেণীটি টিভি আর সিনেমার তামাশার বাহানায় তাদের কাছ থেকে সেটাও নিয়ে যায়। একে তো অভাবী, উপার্জনের কোন ব্যবস্থা নেই, এরপর যারা অল্প-স্বল্প উপার্জন করে, তা দিয়ে নিজের জরুরী প্রয়োজনা না মিটিয়ে ফূর্তিবিনোদনে ব্যয় করে ফেলে। ফলে তারা দেশের বেকারত্ব সমস্যা বৃদ্ধির কারণ হয়। অবশেষে নিমজ্জিত হয় চরিত্রগত অধ:পতনের অতলগহবরে। এ কারণেই শরীয়ত এই ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে হারাম ঘোষণা করেছে।


৪. কার্টুনের সর্বাধিক লক্ষণীয় ও আপত্তিকর দিক হচ্ছে দেহের বিকৃতি সাধন। শরীয়ত দেহ বিকৃতিকে হারাম করেছে। আল্লাহর সৃষ্টির বিকৃতি সাধনের অধিকার কারো নেই। পবিত্র কুরআন-হাদীসে এর প্রতি কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। মোটকথা হলো কার্টুন ছবির ভাল দিকসমূহ বিচেনার সময় তার অপকারিতা ও ক্ষতির দিকসমূহ বিবেচনায় রাখলে তা হারাম হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত মনে হবে। কিন্তু এ সমস্ত ব্যাপারে এক শ্রেণীর মানুষ বুঝে শুনে অথবা আবেগের বশীভূত হয়ে উপকারিতার কথা বলে। আর হারামের দিকসমূহ এবং নাজায়েযের কারণ ও ইল্লতসমূহ থেকে একেবারেই অন্ধ হয়ে যায় অথবা উভয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে ব্যর্থ হয়।


ইল্লাত এবং মুসলিহাত
মানুষের এই স্বভাবজাত অবস্থার প্রতি আলোকপাত করে হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ. লিখেছেন যে, সাধারণত লোকেরা ইল্লত ও মুসলিহাতের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে না। তারা মুসলিহাতকেই ইল্লত মনে করে বসে। এর কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, لأنها ربما تشتبه المصلحة بالعلة অর্থাৎ অনেক সময় মুসলিহাতকে ইল্লতের মত মনে হয়। তাই বিভিন্ন উপকারিতা ও লাভ দেখে ফটো ও কার্টুন ইত্যাদি জায়েয বলে মনে হয়; অথচ অসংখ্য হাদীসে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফটো অংকনকারীকে অভিশপ্ত, জালেম ও নিকৃষ্টতম বলে কঠোর বাণী উচ্চারণ করেছেন। মোল্লা আলী ক্বারী রহ. লিখেছেন- قال اصحابنا و غيرهم تصوير صورة الحيوان حرام اشد التحريم অর্থাৎ আমাদের সমসাময়িক ও পূর্বের অনেক আলেমের মত হলো- প্রাণসম্পন্ন বস্তুর ফটো তৈরি করা মারাত্মক গোনাহ ও হারাম।

এটা কবীরা গোনাহের অন্তর্ভূক্ত। কেননা পবিত্র হাদীসসমূহে এ ব্যাপারে কঠোর শাস্তির হুশিয়ারী উচ্চারিত হয়েছে। কাপড়, কার্পেট ও দেরহাম-দীনারসহ কোথাও প্রাণীর ফটো অংকন করা জায়েয নেই। কার্টুন ছবিও এর অন্তর্ভুক্ত। ভিন্ন হুকুমের কোন প্রমাণ নেই। কার্টুনের মাধ্যমে ব্যঙ্গ চিত্র প্রদর্শন করা হয়, মানুষের দোষ চর্চা করা হয়, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সমাজে হেয়-অপদস্থ করা হয়, তার প্রতি বিদ্রুপ প্রদর্শন করা হয়; শরীয়ত উল্লেখিত প্রত্যেকটি কাজকেই গোনাহে কবীরা বলে থাকে। এ কারণেও কার্টুন ছবি হারামের অন্তর্ভুক্ত।



স্বভাবের গরমিল

ফটো ও কার্টুনের যত উপকারিতাই বলা হোক না কেন, এবং বর্তমান অত্যাধুনিক প্রগতির যুগে এর যতই মূল্য দেয়া হোক না কেন আসলে এটা এমন একটি পাপ কাজ, যার সাথে নবুওয়াতী স্বভাবের কোন মিল নেই। পবিত্রতার সাথেও এর কোন সংশ্রব নেই। যারা পৃথিবীর সর্বাপেক্ষা অভিশপ্ত ও নিকৃষ্ট, পূতপবিত্র ফেরেশতা স্বভাবের সাথে তাদের অপবিত্র ও অভিশপ্ত স্বভাবের মিল না হওয়াই স্বভাবিক। হযরত আয়শা সিদ্দীকা রা. বলেন, إن النبى صلى الله عليه و سلم لم يكن يترك فى بيته شيئا الخ
“রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ গৃহে কোন জিনিসের মধ্যে ফটো দেখার সাথে সাথে তা মিটিয়ে ফেলতেন অথবা চুর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলতেন।” বুখারী মুসলিমসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে হযরত আবু হুরাইরা ও হযরত আলী রা.-এর সূত্রে বর্ণিত আছে যে, রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ان النبی صلی اللہ علیہ وسلم لم یکن یترک فی بیتہ شیئا الخ যে ঘরে কুকুর ও ফটো থাকে, সেই ঘরে রহমতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. তার রচিত ‘হুজ্জাতিল্লাহিল বালিগাহ’ কিতাবে উপরোক্ত হাদীসের ব্যাখ্যা করে বলেন- لما کانت التصاویر فیہا معنی الاصنام অর্থাৎ যেহেতু ফটোর মধ্যে মূর্তির প্রকৃতি বিদ্যমান রয়েছে আর পবিত্র জগত থেকে মূর্তি ও মূর্তিপুঁজারীদের উপর অভিশাপ বর্ষিত হয়, এই কারণেই ফটোর প্রতি ফেরেশতাদের অত্যন্ত ঘৃণা রয়েছে। সুতরাং যে নাপাক ও হারাম বস্তুর প্রতি রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এত অধিক ঘৃণা ও ক্ষোভ রয়েছে এবং যে ফটোর প্রতি সর্বদা অভিশাপ ও আযাব নাযিল হয়, যা থেকে সতর্ক ও বেঁচে থাকার জন্য বার বার হুাঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছে, সেই হারাম ফটোর ব্যাপারে মুসলমানদের ঈমানের দাবী কী হওয়া উচিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নাপাক পায়খানার মধ্যে উপকারের দিক বিবেচনা করা যায়; কিন্তু কোন পবিত্র স্বভাবের অধিকারী ব্যক্তির পক্ষে পায়খানাকে উপকারী বলে হালাল বলা কি সম্ভব? নাপাক বস্তুকে যতই সুন্দর আবরণে আবৃত করা হোক না কেন, তার উপকারিতা, মহত্ত্ব্ ও প্রয়োজনীয়তার উপর যতই কবিতা, প্রবন্ধ ও বইপুস্তক রচনা করা হোক না কেন, নাপাক নাপাকই থেকে যায়। আগুন ব্যতীত অন্য কোন বস্তুই তাকে পাক করতে পারে না। যদি আমাদের অন্তর্দৃষ্টি উদাসীনতার আবরণে আচ্ছাদিত না হতো, তাহলে আমাদের নাকে ফটোর দুর্গন্ধ অবশ্যই অনুভূত হত।


খোদায়ী সাহায্যের পূর্বশর্ত
আমি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে শপথ করে বলতে পারি যে, পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক অন্যান্য পাপাচারের মত ফটোর পাপাচার থেকে মুসলমানদের পরিবেশ পাক-পবিত্র না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোন কালেই আল্লাহপাকের রহমত ও সাহায্য লাভে ধন্য হতে পারবো না। আমাদের আল্লাহ প্রদত্ত নিরাপত্তা কখনো প্রতিষ্ঠিত হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত মুসলমানগণ অন্যান্য গোনাহের মত ফটো বর্জন এবং তা নিশ্চিহ্ন করার সুন্নতকে জিন্দা না করবে, ততদিন তারা অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন এবং শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় মোটেই সক্ষম হবে না। শুধু ২০ বছর কেন, ২০ হাজার বছর ধরেও যদি কাশ্মীর, ফিলিস্তীন ও ইরাকসহ পৃথিবীর মজলুম মুসলমানদের আর্তনাদ জাতিসংঘ তথা সমগ্র পৃথিবীর দরবারে বার বার পেশ করা হয়, তবু তার ন্যূনতম মূল্যায়ন হবে না অর্থাৎ মুসলিম নির্যাতনের কোন বিচার পাওয়া যাবে না।

যে সমস্ত মুসলমানদের দ্বারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক আনিত শরীয়ত ও সুন্নাত অবহেলিত ও উপেক্ষিত হবে, তারা পৃথিবীর কোন আদলতে বিচার পাবে না এবং কোন পরাশক্তি থেকেই তারা সাহায্যের ভিক্ষা লাভ করতে সক্ষম হবে না। পবিত্র কুরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে- ان ینصر کم اللہ فلا غالب لکم وان یخذلکم فمن ذا الذی ینصرکم من بعدہ “যদি আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেন, তাহলে কেউ তোমাদের পরাভূত করতে পারবে না, আর (তোমাদের পাপাচারের কারণে) তিনিই যদি তোমাদের অপদস্থ করেন, তাহলে কে সে, যে তোমাদের সাহায্য করবে?” (সূরা আলে ইমরান : ১৬০)


দ্বীন-ধর্মের প্রতি অবহেলার পরিণাম
আমাদের দেশে বিভিন্ন মাদরাসা ও সংস্থা থেকে মাসিক ধর্মীয় পত্র-পত্রিকা প্রকাশ পাচ্ছে। ওলামা-মাশায়েখগণ বিভিন্ন ধরনের ওয়াজ-নসীহত ও ইসলাহী মজলিস করে থাকেন, ফটোর ব্যাপারেও এসব ওয়ায়েজীন ওলামা-মাশায়েখ ও পত্রিকার সম্পাদকবৃন্দের বিশেষ ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, বর্তমান যুগে এই গোনাহের এতো অধিক ছড়াছড়ির একটি বড় কারণ হচ্ছে, এ ব্যাপারে এক শ্রেণীর ওলামা মাশায়েখদের দুর্বলতা, উদাসীনতা ও নীরব ভূমিকা। গোনাহের ছড়াছড়ি দেখে শক্তি অনুযায়ী ইসলাহের চেষ্টা ও প্রতিবাদ না করা ‘মুদাহানাত’ তথা শরীয়তের প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করার শামিল। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে যে, অভিশপ্ত ফটো এখন ক্লাব, সিনেমা যাত্রা প্রভৃতি স্থান দখল সম্পন্ন করে উলামা-মাশায়েখদের ইসলাহী মজলিসে ওয়াজ নসীহতের মাহফিলে অনুপ্রবেশ করেছে। এমনকি দ্বীনী মারকায মাদরাসা, মসজিদ, খানকাহ এবং ঈদগাহেও এই গোনাহ অনায়াসে ঢুকে পড়েছে। দেশের প্রসিদ্ধ মাদরাসাসমূহে মাহফিলের বক্তাদের ফটো তোলা হচ্ছে এবং অনুষ্ঠানে ভিডিও করা হচ্ছে। অথচ সেখানে অসংখ্য ওলামা-মাশায়েখ, বিভিন্ন মাদরাসার মুহতামিম ও ছাত্ররাও উপস্থিত রয়েছেন। কিন্তু কেউই এই পাপাচারের প্রতিবাদ করার সাহস দেখায় না। সাম্প্রতিককালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওলামা-মাশায়েখ ও শিক্ষক ছাত্রদের এক বিরাট সমাবেশ ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ফটো ধারণ ও ভিডিও রেকর্ডিংয়ের পাপ করা হয়েছে। আর তা হয়েছে অত্যন্ত আগ্রহ ও উদ্দীপনার সাথে। তখন কারো পক্ষে এহেন হারাম কাজের প্রতিবাদ করাও সম্ভব হয়নি। বড়ই পরিতাপের বিষয়! বড়ই আশ্চর্যের বিষয়!!


গোনাহের মজলিসে হাজিরী
অনেকে বলে থাকেন যে, ফটো তোলার সময় আমি অন্যদিকে ফিরে থাকি, অথবা কাপড় মুড়িয়ে থাকি। মনে রাখতে হবে যে, এটুকু বাহানা করা মোটেই যথেষ্ট নয়। শরীয়তের হুকুম হলো- যে অনুষ্ঠানে গোনাহ হয়, সেখানে বসাই জায়েয নেই। যদি পূর্ব থেকে ফটো তোলার বিষয়টি জানা থাকে, তাহলে সেই অনুষ্ঠানে শরীক হওয়াই জায়েয নেই। অধিকন্তু ওলামা-মাশায়েখদের জন্য আরো অধিক কঠোর হওয়া জরুরী। যিনি আলেমেরদকে দাওয়াত করে আনেন, তিনি যদি মজলিসে গোনাহ ও হারাম কাজে লিপ্ত হন, তাহলে সেই মজলিস থেকেও আলেমদের ফেরত চলে আসা জরুরী। এ ধরনের দাওয়াত ও মজলিসে শরীক হওয়া ঠিক নয়। অতএব যে মজলিসে ফটো উঠানো হয়, কোনভাবে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও এরূপ মজলিসে শরীক হওয়ার গোনাহ থেকে মোটেই রক্ষা পাওয়া যাবে না। মাদরাসাসমূহ হচ্ছে সুন্নতের মারকায এবং দুর্গ; কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, আজ সেখান থেকেই শরীয়ত ও সুন্নতের খেলাফ কাজ প্রকাশ পাচ্ছে। সীরাতের নামে মজলিস করে সেখানে সীরাতের সাথে মূলত ঠাট্টা করা হয় এবং আল্লাহর মাহবুব ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর প্রাণে কঠোর আঘাত হানা হয়।

মসজিদে বিবাহ-শাদী
একথা সত্য যে, বিবাহ-শাদী মসজিদে হওয়া অত্যন্ত বরকতময়। এ কারণে আমরা মুনকারাত ও প্রচলিত গোনাহ থেকে মুক্তির জন্য উপযুক্ত উপায় মনে করে বিবাহ-শাদী মসজিদে অনুষ্ঠানের জন্য মানুষকে উপদেশ দেই এবং এ ব্যাপারে তাদেরক উদ্বুদ্ধ করি। কিন্তু মসজিদে অনুষ্ঠেয় বিবাহানুষ্ঠানে ফটো তোলার কারণে সেখানে আল্লাহর লা’নত নেমে আসে কি না এব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। সুন্নতের উপর আমলের সময় যাতে গোনাহে কবীরার সূত্রপাত না ঘটে।


ঈদগাহের পবিত্রতা
দুঃখের সাথে বলতে হয় যে, বৎসরে দুইবার মুসলমানগণ ঈদের মাঠে নামাযের জন্য একত্রিত হয়। বর্তমানে সেখানেও ফটোর অভিশাপ অনুপ্রবেশ করেছে। এ অন্যায় কাজের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের মতে ইসলামের নিদর্শন স্থাপন এবং সংরক্ষণের খাতিরেই ফটো গ্রহণ করা হয়ে থাকে।

অথচ ঈদের নামাযের এ বরকতময় অনুষ্ঠানে শয়তানী প্রভাব বিস্তার করে ঈদগাহকে সিনেমা হল ও ক্লাবে পরিণত করে যে তার পবিত্রতা ধ্বংস করা হচ্ছে সেদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ নেই। কায় ছাপা হয়। এলবাম করে রাখা হয়। অথচ এসব হচ্ছে কবীরা গোনাহ। এই সমস্ত অনুষ্ঠানে শয়তানবাহিনী উপস্থিত হয়ে অত্যস্ত সহজেই স্বীয় কাজ সম্পাদন করে থাকে। কিন্তু কারো বাধা প্রদান ও প্রতিবাদ করার হিম্মত হয় না। মুসলমানদের ঈমানী শক্তি কোথায় হারিয়ে গেল। নিজের হাতে মসজিদ মাদরাসা, খানকাহ ও ঈদগাহ তৈরি করে সেখানে র্শিক্, বিদআত এবং গোনাহের প্রয়াস চালানো হচ্ছে এর চেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আর কি হতে পারে!


জানাযার নামায
মানুষ মৃত্যুর পর দুনিয়ার জীবন পাড়ি দিয়ে আখেরাতের জীবনে কদম রাখে। দুনিয়াতে তার কোন কিছু করার থাকে না, সে কেবল আত্মীয় স্বজন ও হিতাকাংক্ষীদের প্রতি তাকিয়ে থাকে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, মৃতদেহকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক টানাহেঁচড়া তো আছেই, উপরন্তু ধর্মের নামে বেদআত, কুসংস্কার ইত্যাদি গোনাহের কাজ অনায়াসে করা হয়। নামাযের জানাযার দৃশ্য ভিডিও করা হয়। তার ফটো পত্রিকায় ছাপা হয়। এলবাম করে রাখা হয়। অথচ এসব হচ্ছে কবীরা গোনাহ। এই সমস্ত অনুষ্ঠানে শয়তানবাহিনী উপস্থিত হয়ে অত্যস্ত সহজেই স্বীয় কাজ সম্পাদন করে থাকে। কিন্তু কারো বাধা প্রদান ও প্রতিবাদ করার হিম্মত হয় না। মুসলমানদের ঈমানী শক্তি কোথায় হারিয়ে গেল। নিজের হাতে মসজিদ মাদরাসা, খানকাহ ও ঈদগাহ তৈরি করে সেখানে র্শিক্, বিদআত এবং গোনাহের প্রয়াস চালানো হচ্ছে এর চেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার আর কি হতে পারে!


ফটোর প্রচার-প্রসার
ফটোর মত গোনাহ উপভোগের স্বাদ আস্বাদনের জন্য বহু পথ খোলা রয়েছে। কিন্তু কতিপয় অদূরদর্শী স্বার্থপর লোকদের কারণে পবিত্র স্থান, মসজিদ, মাদরাসা, ইসলামী সভা-সমিতি ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি স্থানসমূহেও এই অভিশাপ নেমে এসেছে এবং সেখান থেকে অব্যাহতভবে এর আমলী প্রচার চলছে। যদি এক শ্রেণীর ওলামাদের নীরব ভূমিকা ও স্বার্থপরতার কারণে এ অভিশাপ চালু থাকে এবং পরিণামে তা যদি সর্ব সাধারণের মাঝে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে, তাহলে হয়তো এমন এক সময় আসতে পারে, যখন এই সমস্ত পবিত্র স্থানসমূহে প্রকাশ্যে মদ্যপান থেকে শুরু করে গান-বাদ্যসহ সর্বপ্রকার গোনাহের আসর-অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা কার্যকর হয়ে উঠবে।

পবিত্র হাদীসে বলা হয়েছে, কিয়ামতের নিকটতম সময়ে প্রকাশ্যে জনসমাবেশে যিনা শুরু হবে। কেউ বাধা দেয়ার সাহস পাবে না। তখন হয়তো বেশির চেয়ে বেশি এতটুকু বলা হবে যে, কাজটা আড়ালে গিয়ে করলে ভালো হতো। শুধু এতটুকু সাহস করে যে বলবে, সে হযরত আবু বকর রা. এর মত মর্যাদাবান হবে। প্রথম প্রথম আমার ধারণা ছিল, হয়তো এমন সময় আসবে যখন হক কথা বলার শক্তি থাকবে না। কিন্তু অবস্থা পর্যবেক্ষণের পর বুঝে আসে যে, হাদীসের অর্থ হলো শক্তি এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও প্রতিবাদ করা হবে না, হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য চুপশাহের ভূমিকা পালন করা হবে। এখন এই অবস্থাই দেখা যাচ্ছে। আমাদের দেশে এখনো কোথাও এমন পরিবেশ হয়নি, যেখানে গোনাহের প্রতিবাদ করা যায় না। ফটোর ব্যাপারে এক শ্রেণীর মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও আলেম-ওলামাদের আত্মবিলাসিতা ও নীরবতা সাধারণ মানুষের জন্য চরম উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আলেমদের এসব কর্মকাণ্ড দেখে তারা হতবাক। এই শ্রেণীর আলেমদের এমন নীরব ভূমিকার কারণে আজ অধিকাংশ মুসলিম জনসাধারণ ফটোর মত একটি মারাত্মক কবীরা গোনাহকে (যে গোনাহটি শিরকের সূত্রপাত ঘটায়) গোনাহই মনে করে না। যাদের মনে ফটো তোলা কিঞ্চিত গোনাহ বলে ধারণা ছিলো, এই শ্রেণীর আলেমদের উদাসীনতার কারণে গোনাহের ঐ অনুভূতিটুকুও আজ খতম হয়ে যাচ্ছে।



ওলামাদের প্রতি কঠোর সতর্কবাণী
যে সমস্ত আলেমগণ ফটো তোলেন অথবা এই মহাপাপটিকে দেখেও নীরব ভূমিকা পালন করেন তাদেরকে একটি হাদীসের প্রতি দৃষ্টি দানের দাওয়াত দিচ্ছি।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সূত্রে রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- لما وقعت بنوا اسرائیل فی المعاصی نہتہم علمائہم فلم ینتہوا فجالسوہم .... الخ অর্থাৎ যখন বনী ইসরাঈলের লোকেরা গোনাহে লিপ্ত হয়, তখন তাদের ওলামাগণ তাদেরকে নিষেধ করে, কিন্তু এতে তারা বিরত হয়নি। পরবর্তী সময়ে তাদের ওলামাগণ ঐ গোনাহগারদের সভা-সমাবেশে যাতায়াত ও উঠা-বসা শুরু করে, তাদের সাথে মিলে-মিশে পানাহার করে। পরিণামে আল্লাহপাক তাদের সকলের অন্তর (থেকে ঈমানের নূর দূরীভূত করে) সমান করে দেন। অতঃপর হযরত দাউদ আ. ও হযরত ঈসা আ. এর ভাষায় তাদেরকে ‘মালউন’ অভিশপ্ত অভিহিত করেন। কেননা তারা সকলেই গোনাহগার হয়েছিল এবং সীমালংঘন করেছিল। হযরত ইবনে মাসউদ বলেন, এই ঘটনা বলার সময় রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেলান দিয়ে বসা ছিলেন। অতঃপর সোজা হয়ে বসে কঠোর স্বরে ইরশাদ করেন, ঐ সত্তার কসম! যার মুঠোয় আমার আত্মা, তোমরা মোটেই অপারগ বলে গণ্য হবে না এবং আল্লাহর কঠোর আযাব থেকে রক্ষা পেতে পারো না, যতক্ষণ তোমরা ঐ সমস্ত পাপাচারীদেরকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে যে কোন উপায়ে বিরত না কর।


অন্য এক রেওয়ায়েতে ইরশাদ করেন, বনী ইসরাঈলের ওলামাদের মত তোমাদের জন্য নীরব ভূমিকা পালনের মোটেই অনুমতি নেই। বরং সর্বাবস্থায় অবশ্যই তোমাদেরকে ভালো কাজের নির্দেশ দিতেই হবে এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখতেই হবে। অত্যাচারীর হাতকে অবশ্যই স্তব্ধ করতে হবে। হকের প্রয়োজনেই তাদেরকে রুখতে হবে; যে কোনভাবে তাদেরকে হকের উপর সুদৃঢ় রাখতে হবে। অন্যথায় বনী ইসরাঈলের ন্যায় আল্লাহপাক তোমাদের অন্তর থেকেও ঈমানের নূর ছিন্ন করে ওদের সমপর্যায়ভুক্ত করে দিবেন। অতঃপর বনী ইসরাঈলের মত তোমাদের প্রতি অভিশাপ ও লানত বর্ষিত হবে। উপদেশ ও শিক্ষা গ্রহণের জন্য এই একটি হাদীসই যথেষ্ট। আর যাদের সংশোধন ও শিক্ষা গ্রহণের ইচ্ছা নেই, তাদেরকে শত শত হাদীস শোনালেও কোন লাভ হবে না। এ জাতীয় লোকদের সম্পর্কে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- فما تغنی الایات والنذر عن قوم لایؤمنون “নিদর্শনাবলী ও সতর্কবাণী অবিশ্বাসী সম্প্রদায়ের কোন কাজে আসে না।” (সূরা ইউনুস : ১০১)

দ্বীনের বিকৃতির পথ
অত্যন্ত পরিতাপের সাথে বলতে হয় যে, অতীতে যে সমস্ত পথে দ্বীনের বিকৃতি সূচিত হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম পথই ছিল ওলামাদের অবহেলা ও নীরব ভূমিকা। এটা বর্তমান যুগেও পরিলক্ষিত হচ্ছে। ওলামা-মাশায়েখদের নীরবতার কারণে কেবল ফটো আর মূর্তিই নয়, সর্বক্ষেত্রেই ধর্মের বিৃকতি পরিদৃষ্ট হচ্ছে। অথচ এ ব্যাপারে আমাদের কোন অনুভূতিই নেই। হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ রহ. তার প্রসিদ্ধ কিতাব ‘হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগায়’ কোন্ কোন্ পথে দ্বীনের তাহরীফ ও বিকৃতি সাধিত হয় এবং অতীতে হয়েছে তা এক-একটি করে বর্ণনা করেছেন। তিনি এ ক্ষেত্রে ওলামাদের নীরব ভূমিকা পালণ করাকে পথম এবং অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, দ্বীন বিকৃতির অন্যতম কারণ হচ্ছে, গোনাহ দেখেও নীরব ভূমিকা পালন করা। (১২০/১) এই বিকৃতির সূচনা হয় এভাবেঃ নবী-রাসূলদের মুখলিস-খাঁটি অনুসারীদের পর এমন অযোগ্য ব্যক্তি তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়, যারা নামাযকে গুরুত্বহীন করে তোলে এবং প্রবৃত্তির গোলামী করতে থাকে। তারা জ্ঞান চর্চা, আমল এবং শিক্ষা গ্রহণ ও শিক্ষাদানের মাধ্যমে দ্বীন প্রচারের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি। মানুষকে ভাল কাজের উপদেশ দেয়নি এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখেনি। যে কারণে দ্বীনের বিরুদ্ধে অগণিত প্রথা সমাজে চালু হয়ে পড়ে এবং পর্যায়ক্রমে শরীয়তের বিরোধিতা মানুষের স্বভাবে মজ্জাগত হয়ে যায়। এরপর যারা তাদের স্থলাভিষিক্ত হয়, তারা গোনাহের প্রতিবাদ না করা এবং নীরব ভূমিকা পালনে তাদের পূর্বসূরীদের তুলনায় আরো চার কদম সামনে অগ্রসর হয়।

শেষ পর্যন্ত ঐশী জ্ঞানের এক বিরাট অংশ নিরুদ্দেশ হয়ে পড়ে। ফলে মানুষ স্বীয় জীবনে কোন বিষয়েই শরীয়ত-কর্তৃক হালাল-হারামের বিধি-বিধান মেনে চলার প্রয়োজন মনে করে না। যারা জাতির কর্ণধার এবং পৃষ্ঠপোষক, তাদের এই নীরব ভূমিকাই জাতি ধ্বংসের সবচেয়ে বড় কারণ হয়। তাদের নীরব ভূমিকার কারণে সমাজে মুনকারাত ও অপসংস্কৃতির প্রচার-প্রসার ঘটে। এদিকে অপসংস্কৃতি দূরীকরণের দায়িত্ব পালনে ওলামাদের চরম উদাসীনতা মজ্জাগত হয়ে যায়।


এই দিকে আলোকপাত করেই আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, “তোমাদের পূর্বসূরীদের মধ্যে এমন অভিজ্ঞ লোক কেন জন্মায়নি, যারা ভূখণ্ডে ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারীদেরকে বিরত রাখবে? হ্যাঁ যৎসামান্য লোক ভাল বটে; তাই তাদেরকে আমি আযাব থেকে রক্ষা করেছি। যারা অত্যাচারে অভ্যস্ত, তারা আত্মবিলাসী; তারা মারাত্মক অপরাধী।” হযরত শাহ সাহেব এরপর উপরে উল্লেখিত হযরত ইবনে মাসউদ রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদসিটিও বর্ণনা করেছেন। বস্তুত ওলামায়ে কেরাম গোনাহর প্রতিরোধে নীরব ভূমিকা পরিহার করে সঠিক পন্থা অনুসরণ করতঃ ঐক্যবদ্ধভাবে সর্বশক্তি প্রয়োগ করলে সমাজ থেকে সর্বপ্রকার পাপাচার অবশ্যই দূর করা যেতে পারে। দূর করা যেতে পারে আল্লাহপাকের আযাব গজব। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! আমাদের অযোগ্যতা, আমাদের নীরবতা এবং আমাদের দায়িত্বহীনতার কারণে কবীরা গোনাহসমূহ বর্জন তো দূরের কথা, গোনাহের কাজ করা গৌরব ও সম্মানের বিশেষ নিদর্শনে পরিণত হয়ে চলেছে। ওলামা-মাশায়েখগণ হচ্ছেন খোদায়ী দ্বীন-ভাণ্ডারের প্রহরী।


আর যারা শরীয়তের সীমালঙ্ঘন করে তারা হচ্ছে চোর-ডাকাত। সুতরাং প্রহরীগণ চোর-ডাকাতের সাথে আতাত করলে তারাই যে সর্বপ্রথম কঠোর শাস্তির উপযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হবেন তাতে কোন ধরনের সন্দেহের অবকাশ আছে কি? ওলামা-মাশায়েখদের প্রধান কাজ হচ্ছে তালীম-তরবিয়াত এবং দাওয়াত ও তাবলীগ। তাদেরকে অবশ্যই সৎ কাজের উপদেশ দিতে হবে এবং অসৎ কাজ থেকে জনগণকে বিরত রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। এ ব্যাপারে তাদেরকে হতে হবে নম্রভদ্র, শিষ্টাচারী, সুকৌশলী, দূরদর্শী, দরদী ও ধৈর্যশীল। কাউকে হেয়প্রতিপন্ন করা যাবে না, কটাক্ষ করা যাবে না এবং তিরষ্কার করা যাবে না; বরং দাওয়াত ও তাবলীগের নির্ধারিত নিয়মাবলির অনুসরণ করতে হবে। তবে তাদের মধ্যে এই দৃঢ়তা অবশ্যই থাকতে হবে যে, গোনাহকে মোটেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। কাউকে খুশী করার জন্য অথবা ভয়ে ভীত হয়ে কিংবা হীন স্বার্থ চরিতার্থের জন্য মোটেই নমনীয়তা অবলম্বন করা যাবে না। এই কঠোর ভূমিকার কারণে ভর্ৎসনার সম্মুখীন হলে বা বিপদের আশংকা দেখা দিলে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হবে।

বড়দের প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে গোনাহের কাজে শরীক হওয়া যাবে না মোটেই। কারণ হাদীসে এসেছে- لاطاعۃ لمخلوق فی معصیۃ الخالق অর্থাৎ সৃষ্টিকর্তার নাফরমানী করে কোন সৃষ্টির প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা বৈধ নয়। ভর্ৎসনাকারীর ভর্ৎসনায় ভীতসন্ত্রস্ত হওয়া যাবে না। ওলামাদেরকে নিম্নোক্ত সতর্কবাণী অবশ্যই স্মরণ রাখতে হবে- الا ان الخیر خیار العلمائ وان الشر شرار العلمائ অর্থাৎ শুনে রাখো, ওলামায়ে কেরামই সর্বপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, আবার তারাই সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট।


রাজনৈতিক নেতার প্রতি
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এবং আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আমাদের প্রশাসনের কর্তৃত্ব ও চাবিকাঠি বহুদিন যাবত এমন লোকদের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আছে যাদের অধিকাংশই হচ্ছে তথাকথিত প্রগতিবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী। তারা আল্লাহর দেয়া জীবন-বিধানের স্থলে ধর্মনিরপেক্ষতা তথা ধর্মহীনতার অনুরাগী ও অনুসারী। তাদের নিকট শরীয়ত ও সুন্নতের কোন মূল্য নেই। লজ্জা-শরম, পবিত্রতা, চারিত্রিক স্বচ্ছতা, আত্মমর্যাদা এবং ঈমান ও জাতীয়তাবোধ বলতে তাদের মধ্যে লেশ মাত্র নেই। ধোঁকাবাজী, মিথ্যা আর মুনাফেকী হচ্ছে তাদের রাজনীতির মূল পাথেয়।

মানুষ হত্যা, লুটতরাজ আর নারীভোগের স্বাধীনতা হচ্ছে তাদের তথাকথিত উন্নত সমাজের আসল রূপ! নির্লজ্জতা আর অপসংস্কৃতি হচ্ছে তাদের জীবনের শোভা; এ ছাড়া যুবক-যুবতীদের অবাধ মেলামেশা হচ্ছে তাদের আধুনিক সভ্যতা ও নারী স্বাধীনতার গৌরব। তারা ইউরোপীয় সভ্যতাকে মানব সভ্যতার গৌরব মনে করে থাকে। যার ফলশ্র“তিতে আজ সারা বিশ্ব অধঃপতনের চরম স্তরে উপনীত হয়েছে। আল্লাহপাকের ক্রমাগত আযাবের কারণে আজ জাতি দিশাহারা।


এমন শোচনীয় মুহূর্তেও যারা মুসলিম জাগরণ, ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রশাসন কায়েমের জন্য সাহসী ভূমিকা পালনে সক্রিয় রয়েছেন, দেশ ও জাতির মুক্তি ও ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাদের এ অবদান অবশ্যই প্রশংসনীয়। তাদের সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতায় সর্বশ্রেণীর মুসলমানদেরকে এগিয়ে আসা একান্ত আবশ্যক। সকলে মিলে এক বৃহত্তম ঐক্যশক্তি গড়ে তোলা এবং বাস্তবমুখী কর্মসূচী বাস্তবায়নে সর্বশক্তি প্রয়োগ করার এখনই উপযুক্ত সময়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, এই ঐক্যপ্রক্রিয়া এবং এর স্থায়িত্ব নির্ভর করে শরীয়ত ও সুন্নতের সঠিক অনুশীলনের উপর। যারা এর বিকল্প পথের সন্ধান করে তারা কোনদিন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না; তাদের মধ্যে কোনদিন সামগ্রিক ঐক্য স্থায়ী হবে না। একথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, অতীতে কোন কালেই মুসলমানগণ বস্তু শক্তির মাধ্যমে বিজয়ী হতে পারেনি। বদর, ওহুদ, খন্দক ও হুনাইনসহ কোন যুদ্ধেই মুসলমানগণ বস্তু শক্তির মাধ্যমে বিজয় লাভ করেনি; বরং তাদের বিজয় অর্জিত হয়েছে মহান আল্লাহপাকের অসীম শক্তি তাদের অনুকূলে থাকার কারণে এবং তাঁরই পরম সাহায্য-সহযোগিতায়। আর খোদায়ী শক্তি ও সাহায্য লাভের প্রধান দুটি শর্ত হচ্ছে নেক আমল এবং গোনাহ বর্জন।


সফলতার পথ

ক. নেক আমলের দ্বারা ঈমানী শক্তি বৃদ্ধি পায় ও সুসংহত হয়। নেক আমলের মধ্যে রয়েছে- আকীদার পরিশুদ্ধি, দৃঢ়তা, ইখলাসের সাথে সুন্নত মোতাবেক সমস্ত ইবাদত করা, ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নতে মুয়াক্বাদা বাধ্যতামূলকভাবে আদায় করা, শক্তি সামর্থ্য অনুযায়ী নফল ইবাদতের পাবন্দী করা, নিজ নফসের ইসলাহের প্রতি গুরুত্ববান হওয়া, তেলাওয়াত ও মুনাজাতের প্রতি অধিক মনোযোগী হওয়া, এস্তেগফার, তওবা এবং তাহাজ্জুদ ও ইশরাকের পাবন্দী করা, সদকা খয়রাত করা, বান্দার হক সমূহ আদায় করে দেয়া ইত্যাদি।

খ. নিজের ইসলাহ ও আমলের পাবন্দীর সাথে সাথে পর্যায়ক্রমে নিজের পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, অধীনস্ত লোকজন ও সাধারণ মানুষদের মধ্যে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ করা এবং অত্যন্ত নিষ্ঠা ও দরদের
সাথে এই কাজ সম্পাদন করা। কোন দুনিয়াবী স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়: বরং একমাত্র আল্লাহপাকের রিজা এবং সন্তুষ্টির জন্য করা।


গ. মনে রাখতে হবে যে, অনেক আমল অবশ্যই কাম্য এবং তা নেহায়েত উপকারী, কিন্তু অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য এতটুকুই যথেষ্ট নয়। সেই সাথে ছোট বড় সর্বপ্রকার গেনাহকে সম্পূর্ণ বর্জন করা একান্ত জরুরী। বরং নেক আমলের তুলনায়ও অনেক ক্ষেত্রে এটা অধিক জরুরী। এই গোনাহ অন্তরগত, বুদ্ধিগত এবং দেহগত হতে পারে, আকীদা, ইবাদত, মুআমালাত, মুআশারাত, আখলাক, রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, ব্যক্তিগত এবং সমাজগতও হতে পারে। মোটকথা সর্বপ্রকার গোনাহ থেকে মুক্ত থাকা অত্যাবশ্যক।


ঘ. ব্যক্তিগতভাবে গোনাহ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকার সাথে সাথে নিজ পরিবার, পরিজন, আত্মীয়-স্বজন, অধীনস্থ লোকজন এবং সাধারণ মানুষদেরকে গোনাহ থেকে মুক্ত রাখার জন্য স্বীয় শক্তি-সামর্থ্য অনুপাতে দরদ ও হেকমতের সাথে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা চাই। নেকীর পরিবেশে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সব রকম ভূমিকা পালন করা জরুরী।


ফটো সম্পর্কে সতর্কবাণী

মনে রাখতে হবে যে, মানুষ যে সকল গোনাহ করে থাকে তন্মধ্যে অনেক গোনাহ এমন রয়েছে যা গোপনে করা হয়। হয়তো ভয়-ভীতির কারণে অথবা শরম-লজ্জার কারণে গোপনে করা হয়ে থাকে। আর এমন অনেক গোনাহ রয়েছে, যা একে তো কবীরা গোনাহ, তাও আবার প্রকাশ্যে করা হয়। যাতে বুঝা যায় যে, অন্তরে না আছে ভয় ভীতি, না আছে লজ্জা শরম। এমনই একটি মারাত্মক গোনাহ হচ্ছে ফটো তোলা এবং কাউকে দিয়ে ফটো উঠানো। যারা এই ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করেছেন এবং নিজেদেরকে এতে জড়িয়ে রেখেছেন, তাদেরকে অবশ্যই জাগ্রত হওয়া উচিত এবং এর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন।
কেননা এতে কেবল তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না বরং-

ক. শরীয়তের একটি হারামকৃত কাজের ব্যাপক প্রচার-প্রসারের পথ সুগম হচ্ছে।
খ. জনসাধারণের অন্তর থেকে এই পাপাচারের ঘৃণা দূরীভূত হয়ে তা কাম্য বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফটো-চিত্র দৈনিক সংবাদপত্রে ছাপানো এবং টিভি ইত্যাদিতে প্রদর্শনের কারণে প্রকারান্তরে এর বৈধতা ও জায়েয হওয়ার মনোভাব সৃষ্টি করা হচ্ছে।


গ. যারা এ কাজটিকে পাপ বলে জানেন তাদের প্রতি আমার আহবান হলো- (হক্কানী আলেম মাত্রই এটাকে পাপ বলে জানেন) যদি আপনাদের অগোচরে বা অজ্ঞাতে কেউ ফটো তুলে নেয়, তাহলে অবগত হওয়ার পর যথাযথভাবে এর প্রতিবাদ করুন! সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রতিবাদলিপি ছাপিয়ে অপরাধীদেরকে সতর্ক করুন!

অন্যথায় এ ধরনের পাপাচারের পরেও নীরব ও নমনীয় ভূমিকা আপনাদের নিজেদের মধ্যে আস্থাহীনতা, মতবিরোধ ও অনৈক্যর কারণ হয়ে দাঁড়াবে এবং খোদায়ী শক্তি ও সাহায্য-সহযোগিতার অভাবে অভিষ্ট লক্ষ্য অর্জন হবে সুদূরপরাহত।


মুদ্রণ ব্যবস্থাপনায়ঃ মোঃ ইমরান নূর মানিক

Available at: Essential Pharma Documents (www. pharmacydocs.blogspot.com)

No comments:

Post a Comment