Tuesday, July 30, 2019

'সফলতা সমাচার'

আরিফ আজাদ



[১]
আমি তখন হাইস্কুলে পড়ি। বিদ্যের জাহাজ হবার স্বপ্নে বিভোর। জগতের সবকিছু নিয়েই যেন আমার কৌতূহল। ক্লাশে সারাদিন এটা-ওটা নিয়ে স্যারদের প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতাম। আমার জিজ্ঞাসা যন্ত্রণায় স্যারেরা একরকম অতিষ্ট।
একদিন আমাদের ক্লাশে নতুন এক ছাত্র এলো। সে যে আস্ত একটা হাবাগোবা সেটা তার চেহারা দেখলেই বুঝে ফেলা যায়। ফ্যালফ্যাল চাহনি। শরীরের তুলনায় মাথাটা প্রকান্ড। ব্যাটা যে কেবল হাবাগোবা নয়, ভীষণরকম ভীতুও, সেটা বোঝা গেলো একটু পর। ইংরেজি ক্লাশের স্যার এসে যখন তাকে কমন নাউনের দুটো উদাহরণ দিতে বলেছিলো, তখন তার ভয়ে হাঁটু কাঁপাকাঁপি অবস্থা। নতুন মুখ দেখেই স্যার জিজ্ঞেস করলেন, ‘নাম কি?’
ছেলেটা মিনমিন করে বললো, ‘আলাদীন
ক্লাশের সবচাইতে ফাজিলটার নাম ছিলো শফিক। যেকোনো কিছু নিয়েই সে মুহূর্তে কৌতুক বানাতে পারতো। হাবাগোবাটার নাম আলাদীনশুনে সে ঘাঁড় ফিরিয়ে বললো, ‘বাবা আলাদীন, চেরাগটা কি পকেটে পুরেছো না ব্যাগে?’
শফিকের কথা যেন সবাইকে খুব মজা দিলো। তার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলাম আমরা সবাই। হাসলোনা কেবল ছেলেটা। একেবারে ফ্যালফ্যালিয়ে সে স্যারের দিকে তাকিয়ে রইলো। হাবাগোবা শব্দটার জন্মই হয়েছে বুঝি তার জন্যে।
এরপর ছিলো বাংলা ক্লাশ। দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে মজার ক্লাশ এইটাই। যে ম্যাডাম আমাদের বাংলা পড়াতেন, তিনি ছিলেন অসম্ভব রূপবতী। রূপের কারণেই হোক কিংবা শখের কারণে, বাংলা ক্লাশে বাংলা পড়ানোর চেয়ে তিনি গল্পই করতেন বেশি। সেই গল্পগুলোর সবটা জুড়ে আবার তিনি আর তিনি। সেদিনও তার ব্যক্তিক্রম হয়নি। বাংলা বইটা হাতে নিয়ে তিনি একটু চোখ বুলালেন তাতে। এরপর একটা মেয়েকে দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘এই সানজিদা, ওমন ঝিমুচ্ছিস কেনো? রাতে ঘুমোস নি? তোর মতোন বয়েসে আমরা কতো সিনসিয়ার ছিলাম পড়াশুনা নিয়ে জানিস?’
ব্যস, এরপর ম্যাডাম ঢুকে পড়লেন নিজের গল্পে। স্কুল জীবনে তিনি কেমন দূরন্ত ছিলেন, কেমন করে ক্লাশের ছেলেমেয়েদের উপরে তিনি খবরদারি করতেন, ক্লাশে তার ভয়ে সবাই কিরকম তটস্থ থাকতো, উপস্থিত বক্তৃতা প্রতিযোগিতায় তার বক্তৃতা শুনে কিভাবে স্কুল শুদ্ধ লোকজন হাঁ হয়ে গিয়েছিলো- এসবই ছিলো গল্পের মূল বিষয়বস্তু। এমন ধারার গল্প শুনে হাঁই তুলতে তুলতে শফিক বললো, ‘ম্যাডাম, আপনার গল্প শুনে মনে হচ্ছে আপনি আসলে রাজনীতিবিদ হওয়ার জন্যেই জন্মেছিলেন। কিন্তু রাস্তা ভুল করে আপনি হয়ে গেছেন হাই স্কুলের টিচার
শফিকের কথা শুনে ক্লাশ শুদ্ধ ছেলেমেয়ে হো হো করে হাসিতে ফেঁটে পড়লো। এমনকি, একটু আগে টুলে বসে বসে ঝিমুতে থাকা সানজিদাও সেই অট্টহাসিতে লুটোপুটি খাওয়ার মতোন অবস্থা। হাসলোনা কেবল হাবাগোবা আলাদীন। হ্যাঁ, সেদিন থেকে আমরা তার নাম রেখেছিলাম হাবাগোবা আলাদীন।
টিফিন পিরিয়ডের পরেই ছিলো বিজ্ঞান ক্লাশ। বিজ্ঞান শব্দটা তখন যতোখানি না ভয়ঙ্কর, তার চাইতে বেশি ভয়ঙ্কর ছিলো আমাদের বিজ্ঞান টিচার। হাতির মতোন বিশাল দেহ। যেদিক দিয়ে হাঁটেন সেদিকটা মনে হয় গমগম করতে থাকে। তার ক্লাশ ফাঁকি দেওয়া তো দূর, কেউ হালকা টুঁ শব্দ করবে, এতোবড় বুকের পাঠা কারো ছিলোনা। যে শফিক হাসি-ঠাট্টা করে ক্লাশ মাতিয়ে রাখতো, সে পর্যন্ত বিজ্ঞান ক্লাশে কাঁকড়ার মতো হাত-পা গুটিয়ে ভালো ছেলের মতো বসে থাকতো।
কিন্তু, প্রথম দিনেই বিপত্তি বাঁধালো হাবাগোবা আলাদীন। টিফিন পিরিয়ড থেকেই সে একেবারে লাপাত্তা। আমরা তো ভাবলাম প্রথম দিনেই এই স্কুলে পড়ার তার সাধ মিটে গেছে। তাই হয়তো বই-টই রেখে পালিয়েছে। ওকে দিয়ে আর যা-ই হোক, পড়াশুনাটা যে হবেনা, সেটা সম্ভবত ও বুঝে গেছে।
বিজ্ঞান ক্লাশের তখন মাঝামাঝি সময়। আমাদের অবাক করে দিয়ে হাবাগোবা আলাদীন রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখে তো আমাদের মুখ একেবারে হাঁ হয়ে গেলো। নাহ। সে পুনঃরায় ফিরে আসাতে আমরা সেদিন অবাক হইনি। আমরা অবাক হচ্ছিলাম তার উপর দিয়ে বইতে যাওয়া আসন্ন ঝড়ের তান্ডলীলা কল্পনা করে। আমাদের চোখের সামনে তখন একটাই দৃশ্য। টেবিলের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে পিটখানা উপুড় করে রেখেছে হাবাগোবা আলাদীন। ম্যাড়ম্যাড়ে সেই পিটে বিজ্ঞান স্যারের সাড়ে ছকেজি ওজনের কিলগুলো পড়ছে আর তাতে পটাশ পটাশ শব্দ হচ্ছে। এই কিলগুলো হজম করার পর সে যে আর কোনোদিন এ স্কুল মুখী হবেনা, সে ব্যাপারে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত।
বিজ্ঞান স্যার কোণা চোখে ওর দিকে তাকালেন। তখনও সে বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলো। স্যার ইশারায় তাকে ভিতরে ডাকলেন। কাছে আসতেই তার পেটে চাপ দিয়ে বললেন, ‘নাম কি?’
সে আবার মিনমিন করে বললো, ‘আলাদীন
আজকেই প্রথম এসেছিস ক্লাশে?’
সে ভয়ে ভয়ে বললো, ‘জ্বি
তুই কি জানিস ক্লাশ অর্ধেক শেষ হয়ে গেছে?’
সে মাথা নিঁচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। স্যার তার পেটে আরেকটু জোরে চাপ দেওয়াতে সে একবার কোৎ করে উঠলো। স্যার বললেন, ‘এতো দেরি হওয়ার কারণ কি? কোথায় আড্ডা দিচ্ছিলি?’
সে মাথা নিঁচু রেখেই বললো, ‘স্যার, যোহরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে গিয়েছিলাম। মসজিদটা খানিকটা দূরে। এজন্যেই দেরি হয়ে গেছে
নতুন বলে দয়া করে হোক, কিংবা নামাজের কথা শুনে সমীহ করেই হোক, সেদিন হাবাগোবা আলাদীনের পিটের উপর দিয়ে যে টর্নেডো বয়ে যাওয়ার দৃশ্য আমরা কল্পনা করেছিলাম, সেটা আর বাস্তব রূপ পেলো না। স্যার তাকে বললেন, ‘ঠিক আছে। যা, নিজের জায়গায় গিয়ে বোস
আমাদের ম্যাথ ক্লাশের স্যার তাকে ডাকতো আদু ভাইবলে। স্যারের ধারণা ছিলো সে কোনোদিনও পরের ক্লাশ টপকাতে পারবেনা। একদিন ম্যাথের স্যার তার কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই বড় হয়ে কি হবি রে আদু ভাই?’
সে কিছু না বলে মাথা নিঁচু করে থাকলো। স্যার বললেন, ‘আমি বলি তুই কি হবি? তুই হবি মুদি দোকানদার! হা হা হা! বসে বসে মুড়ি বেচবি
স্যার এভাবেই তাকে পঁচাতেন আর হাসতেন। স্যারের সাথে হাসতাম আমরাও। ও-ই কেবল মাথা নিঁচু করে থাকতো। লজ্জায় হোক বা অপমানে।
চুপচাপ স্বভাবের সেই হাবাগোবা আলাদীন টিফিন পিরিয়ডের পর নিয়ম করেই দেরি করে আসতো। এবং অদ্ভুত হলেও সত্য, বিজ্ঞান স্যার কেবল তার জন্য নিজের চিরাচরিত নিয়ম থেকে সরে আসতেন। হাবাগোবাটার জন্যে যেন সাতখুন মাফ!
অন্য আরেকদিনের ঘটনা। বন্ধুদের নিয়ে আয়েশ করে টিফিন খাচ্ছিলাম। আমাদের পাশ দিয়ে হাবাগোবা আলাদীন হেঁটে যাওয়ার সময় মুনতাসির চেঁচিয়ে বললো, ‘কি রে মুদি দোকানদার! খাচ্ছিস না যে বরং?’
সে কিছুই বললো না। খানিক আমাদের দিকে তাকিয়ে আবার হাঁটা ধরলো। ব্যাপারটা গায়ে লাগলো মুনতাসিরের। বলাই বাহুল্য, শক্তি, তেজ আর শরীরের সাইজে মুনতাসির ছিলো আস্ত একটা পালোয়ানের সমান। আমরা তো বটেই, আমাদের উঁচু ক্লাশের ছাত্ররাও তার সাথে উল্টাপাল্টা করার সাহস পায়না। যাকে-তাকে ধরে টেঙিয়ে দেয়ার ব্যাপারে মুনতাসিরের স্কুলজোড়া খ্যাতি। সেই মুনতাসিরের কথাকে অগ্রাহ্য করে চলে যায় কিনা আলাদীনের মতোন তালপাতার সেঁপাই!
স্কুল ছুটির পর মুনতাসির গেটের বাইরে তার বিশালকার শরীর নিয়ে পায়চারি করছিলো। বুঝতেই পারছি আলাদীনের উপরে সে বেজায় চটেছে। হাতির পাড়া আর মুনতাসিরের থাবা, দুটোই আমাদের কাছে সমান। আলাদীনের জন্য যে এক মহা দূর্যোগ বাইরে ঘুরপাক খাচ্ছে, সেই আভাস আলাদীনের কাছে পৌঁছেছে কিনা কি জানি!
নাহ, পৌঁছেনি। হাবাগোবা আলাদীন নরম নরম পা ফেলে স্কুল থেকে বের হচ্ছিলো। যে-ই সে গেটের মুখে আসলো, ওমনি ছোঁ মেরে তাকে একপাশে নিয়ে গেলো মুনতাসির। যেন বাঘের থাবায় বন্দী হরিণ! বেচারা ঘটনার আকস্মিকতায় পুরোই জব্দ! মুখ দিয়ে কোন শব্দ ছাড়াই ভ্যাবাচ্যাকা চেহারা নিয়ে অপলক তাকিয়ে রইলো মুনতাসিরের চেহারার দিকে।
অন্যদিন হলে জবাবদিহির আগেই হয়তো মুনতাসির দু-চারটে লাগিয়ে দিতো। কিন্তু আজ তার ব্যতিক্রম হলো। এই হাবাগোবাটার বেলাতেই সবাই কেনো নিজেদের সত্ত্বা বিসর্জন দিয়ে দেয় সে এক রহস্য! যাহোক, আলাদীনের কলার টেনে ধরে, তার সুপারির সমান ছোট মুখটাকে নিজের মুখের কাছে এনে মুনতাসির জানতে চাইলো, ‘এতো ভাব কিসের তোর? তখন যে জানতে চাইলাম খাচ্ছিস না কেনো, ভাব দেখিয়ে চলে গেলি কেনো? তুই আমাকে চিনিস?’
মুনতাসিরকে চিনেনা এমন পোড়ামুখো স্কুলে নেই। যারা চিনেনা তারাও তার গল্প শুনতে শুনতে তাকে চিনে ফেলে। সম্ভবত হাবাগোবা আলাদীনও চিনে। সে মুখ নিঁচু করে বললো, ‘আমি রোজা রেখেছি। আমি যে রোজা রেখেছি সেটা কাউকে জানাতে চাচ্ছিলাম না। তাই তোমার প্রশ্নের উত্তর দিইনি
এমন দিনে কেউ রোজা রাখে বলে জানা নেই আমাদের। রোজার মাস তো কবেই গত হয়েছে। ব্যাটা নিশ্চয় ঢপ দিচ্ছে! পাশ থেকে আমিনুল বলে উঠলো, ‘ব্যাটা তো সাংঘাতিক মিথ্যুক! এখন কি রোজার মাস নাকি যে রোজা রেখেছিস?’
-‘রোজার মাস ছাড়াও রোজা রাখা যায়। এগুলোকে বলে নফল রোজা। প্রতি সোমবার এবং বৃহঃস্পতিবার রোজা রাখতেন আমাদের রাসূল
আমিনুল পাল্টা জিজ্ঞেস করলো, ‘কে শিখিয়েছে তোকে এই নতুন জিনিস?’
আলাদীন বললো, ‘আমার বাবা। বাবাকে দেখে দেখে আমরাও শিখেছি। সপ্তাহের সোম এবং বৃহঃস্পতিবার আমাদের বাসার সবাই রোজা রাখে
ধপ করে তার কলার ছেড়ে দিলো মুনতাসির। কিছু না বলেই হনহন করে সে হাঁটা ধরলো বাড়ির পথে। সেদিনও আসন্ন ঝড়ের তান্ডবলীলা আসি আসি করে আর আসলো না। নিত্যকার মতো, সেদিনও বেঁচে গেলো হাবাগোবাটা।
ইতোপূর্বে যা কোনোদিন হয়নি একদিন তা-ই হলো। যে আলাদীন কখনো নিজ থেকে একটা শব্দও করেনা, সে এসে সেদিন আমাদের উদ্দেশ্য করে বলতে লাগলো, ‘আযান হচ্ছে মসজিদে। তোমরা কি নামাজে যাবে?’
তার কথা শুনে আমরা একে-অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলাম। ভূত দেখলে মানুষ যেরকম চমকে উঠে, সেরকম চমকে উঠেছিলাম হয়তো। নিজেদের একটু স্বাভাবিক করে বললাম, ‘কি বললি?’
-‘যোহরের আযান হচ্ছে। আমার সাথে মসজিদে যাবে? এই যে দেখো, মুয়াজ্জিন বলছে, ‘হাইয়্যাল আল-ফালাহ। মানে, সফলতার পথে এসো। জীবনে সফল হতে চাইলে চলো আমরা নামাজে যাই
এতোদিন শুনেছি জীবনে সফল হতে হলে ভালোমতো পড়াশুনা করতে হয়। আজ এই হাবাগোবাটার কাছে নতুন কথা শুনলাম বৈকি! নামাজে গেলে নাকি মানুষ সফল হয়। সেদিন ওর কথায় আমরা কেউ কর্ণপাত করিনি। প্রতিদিনকার মতো ও একাই সেদিন নামাজে গিয়েছিলো।
এরপর? একদিন হুট করে বাবার বদলি হয়ে যায়। আমরা চলে যাই অন্য শহরে...


[২]
লন্ডন থেকে পিএইচডি শেষ করে যখন আসি, তখন চারদিক থেকে কেবল চাকরির আবেদন এসে জমা হতে থাকে। কোনটা রেখে কোনটা করি সে ব্যাপারে অনেকটা দিশেহারাই হয়ে যাচ্ছিলাম। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম যে শিক্ষক হবো। জয়েন করলাম দেশের নামকরা একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। একটা ডিপার্টমেন্টের হেড হিশেবে।
আমি তখন মোটামুটি সাংসারিক হয়ে উঠেছি। স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ভালোমতোই জীবন পার হচ্ছিলো আমার। দশ বছর একই পোস্টে থাকার পরে আমার ভালোরকমের প্রমোশান হয়ে গেলো। ভাগ্যগুণেই হোক বা কর্মগুণেই, আমি তখন ডিপার্টমেন্ট হেড থেকে একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির চেয়ারে!
সময় বয়ে যাচ্ছিলো তার নিজস্ব গতিতে। সময়ের সেই গতিতে কোন হেরফের নেই। সে না দ্রুত না মন্থর। দিন যায়, মাস পেরোয়, বছর ঘুরে আসে, আর জীবনের ঝুলিতে জমা হতে থাকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতা। তবে, একদিন এমন এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম, যে অভিজ্ঞতা আমাকে একেবারে ভিতর থেকে ভেঙে দিয়ে যায়। যে অভিজ্ঞতা ভেঙে চুরমার করে দেয় আমার সকল অহঙ্কার, সকল অহমিকাবোধ।
জীবনের কাছে আমি যেন নিতান্তই শিশু হয়ে পড়ি। আমার ইচ্ছে করে হাউমাউ করে কাঁদতে। কিংবা, যদি জীবন থেকেই পালিয়ে যেতে পারতাম, যদি হারিয়ে যেতে পারতাম সময়ের অজানা কোন স্রোতে, তাহলে সম্ভবত মুক্তি মিলতো। কিন্তু, জীবন কি আর পুতুল খেলার মতো? মন চাইলো খেললাম আর মন না চাইলেই ভন্ডুল করে দিয়ে উঠে যাবো? জীবন এক কঠিন সত্য। জীবন এমন এক বাঁধন যা মৃত্যুর আগে খুলেনা। অথবা, আমরা হয়তোবা কারো খেলার পুতুল। আমাদের নিয়ে তিনি দিব্যি খেলে চলেছেন রাতদিন। তিনি যেভাবে নাচান, আমরা হয়তো সেভাবেই নাচি। তিনি চাইলেই কাঁদি, তিনি চাইলেই হাসি। হাসি-কান্নার এই সময়টুকুর যে সমষ্টি, তার নামই সম্ভবত জীবন...
কাজ শেষ করে একদিন বাসায় এসে দেখি আমার স্ত্রী মলিন চেহারা নিয়ে সোফায় বসে আছে। দীর্ঘ ত্রিশ বছরের সংসার জীবনে এই মহিলাকে সেদিনের চেয়ে বিমর্ষ আমি আর কখনোই দেখিনি। মুখে সর্বদা হাসি জিইয়ে রাখার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিলো তার। আমি যতোখানি রাশভারি, সে ঠিক ততোখানিই হাসিখুশি। তার অকারণ হাসির চোটে আমার মাঝে মাঝে রাগ উঠে যেতো। সেই মহিলাকে এমন বিমর্ষ, বিহ্বল চেহারায় দেখে আমার বুকের ভেতরটা কোন এক অজানা আশংকায় কেঁপে উঠলো। আমার অন্তরাত্মার কোথায় যেন বিপদের বীণ বেজে বেজে আমাকে একটি সমূহ দূর্যোগের আভাস দিচ্ছিলো। আমি খুব দূর্বল চিত্তের মানুষ। যেকোন কিছুতেই অস্থির হয়ে পড়ার বাতিক রয়েছে। তবুও, নিজেকে একটু শক্ত করে আমার স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘রেবেকা, ওমন মলিন মুখে বসে আছো যে? কোন সমস্যা?’
সমস্যা যে হয়েছে সে ব্যাপারে আমি ঘোর নিশ্চিত। তাও প্রশ্ন করার জন্যই প্রশ্ন করা। সে আমার দিকে তাকাতেই হুড়মুড় করে তার চোখ ভেঙে যেন শ্রাবণের বারিধারা নেমে এলো। সারাটা জীবনের সবটুকু মেঘ সম্ভবত তার চোখে আজকের জন্যই জমা হয়ে ছিলো। সুযোগ আসাতেই বাঁধ ভাঙা ঢেউয়ের মতোন বুকে আছড়ে পড়লো সেই মেঘ ভাঙা বৃষ্টির দল। তাকে কোনোরকমে শান্ত করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কি হয়েছে তা তো বলবে, তাইনা?’

[৩]
আমি ভাবতেই পারছিনা যে আমার একমাত্র ছেলেটা মাদকাসক্ত। মাদকের মাঝে এভাবে সে হারিয়ে যাবে তা ছিলো আমার স্বপ্নাতীত। ওর জন্যই তো সবকিছু। নিজের সন্তানকে নেশাগ্রস্ত, উদভ্রান্ত আর মাতাল অবস্থায় দেখার চেয়ে মৃত্যু ঢের ভালো নয় কি?
অথচ, ওকে ঘিরে কতো স্বপ্নের জাল বুনেছিলাম এতোদিন। ভেবেছিলাম বিদেশে পড়াশুনা করে বাবার যোগ্য সন্তান হবে। মানুষের মতোন মানুষ হবে। কখনো ভাবতেই পারিনি যে সে এমন উচ্ছ্বনে যাবে। জীবনের যা কিছু ত্যাগ, যা কিছু বিসর্জন- সব ছিলো ওর জন্যই। দেশে থাকলে ও ভালো শিক্ষা-দীক্ষা পাবেনা, বেড়ে উঠার ভালো পরিবেশ পাবেনা সেই ভয়ে ওকে আমি বিদেশে নিয়ে যাই।
ওকে বড় করতে গিয়ে আমি আমার বাবা-মার কাছ থেকেও ছিটকে পড়ি। বাবা-মা কারো মৃত্যুতেই আমি তাদের পাশে থাকতে পারিনি। তাদের কি মনে হয়নি মৃত্যুকালে একটু আমাকে ছুঁয়ে দেখতে? আমার হাতের একটু স্পর্শ পেতে? অথচ, দুজনের কারো কবরে মাটি দেওয়ার সুযোগটা পর্যন্ত আমি পাইনি। বিদেশ-বিভূঁইয়ে নিজের জীবন আর ছেলের জীবনের কথা ভেবে এতোটাই থিতু হয়েছিলাম যে, বাবা-মার সংস্পর্শের বাইরে থাকাটাকে কখনো ওভাবে অনুভব করিনি। আজ খুব অনুশোচনা হচ্ছে। মনে হচ্ছে একবার অতীতে ফিরে যাই। ফিরে যাই আমার শৈশবে। মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদি। আজ মনে হচ্ছে আমি ব্যর্থ। এই জীবন, এই পড়াশুনা, এই যশ-খ্যাতি আমাকে কিচ্ছু দেয়নি। কিচ্ছুনা। একরাশ হতাশা, গ্লানি আর দুঃখ ছাড়া জীবন থেকে আমি আর কিছুই পাইনি।

[৪]
বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে খুব হৈচৈ শোনা গেলো। খুব সম্ভবত কোন এক ছাত্রীকে নিয়েই। যে ডিপার্টমেন্টের ঘটনা সেই ডিপার্টমেন্টেই ব্যাপারটার সুরাহা হতে পারতো। হয়নি। সেটা নিষ্পত্তির ভার গড়িয়েছে আমার টেবিল পর্যন্তই। দেখলাম আমার টেবিলে রঙিন খামে মোড়ানো একটা চিঠি রাখা। চিঠি না বলে দরখাস্ত বলাটাই শ্রেয়। একবার ইচ্ছে হলো জিনিসটাকে আবর্জনার বিনে ছুঁড়ে ফেলে দিই। পরক্ষণে মনে হলো- যে গাধাটা এই জিনিসটা আমার টেবিল পর্যন্ত পৌঁছিয়েছে তাকে ডেকে আচ্ছামতো ঝেড়ে দিই। কোনোটাই করা হলো না। নিতান্ত অনিচ্ছাকৃতভাবে রঙিন খামে মোড়ানো সেই দরখাস্তটা আমি ধীর হস্তে খুলে পড়তে লাগলাম...
পিয়নকে ডেকে বললাম, ‘এই দরখাস্তটা যার, তাকে বলো আমার রুমে আসতে
পিয়ন জি স্যারবলে ছুটে গেলো। বেশ খানিকক্ষণ পর আগাগোড়া বোরকায় ঢাকা একটি মেয়ে, তার সাথে একজন মধ্যবয়েসী লোক আমার রুমে এসে ঢুকলো। তাদেরকে বসতে বলে আমি মেয়েটাকে বললাম, ‘এই দরখাস্ত তুমিই লিখেছো?’
মেয়েটা আস্তে করে বললো, ‘জি
-‘হিজাব পরে ক্লাশ করা যাবেনা- এটা তোমাকে কে বলেছে?’
-‘আমাদের একজন ম্যাডাম
-‘উনি কি বলেছেন?’
-‘বলেছেন হিজাব পরে ক্লাশে আসা যাবেনা। ক্লাশ করতে হলে এরকম বোরকা-হিজাব ছাড়াই করতে হবে
-‘তো, তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো?’
-‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, হিজাব পরে ক্লাশ করতে না দিলে আমি আর এখানে পড়াশুনা করবো না
-‘তুমি কি ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছো?’
-‘জি
-‘তোমার ক্যারিয়ারের কথা একবার ভেবেছো? তোমার জন্য সামনে যে অবাধ সাফল্য অপেক্ষা করছে, তা তুমি বুঝতে পারছো?’
মেয়েটা বললো, ‘স্যরি স্যার। আমার ধর্মকে পাশ কাটিয়ে আমি জীবনে সফল হতে চাইনা
-‘এটাই তোমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত?’
-‘জি’- মেয়েটা একবাক্যে উত্তর দিলো।
আমি মেয়েটার বাবার দিকে ফিরলাম। বললাম, ‘আপনি কি ওর বাবা?’
-‘জি
-‘আপনার মেয়ের এই সিদ্ধান্তকে আপনি সমর্থন করেন?’
লোকটা বেশ হাসিখুশি চেহারায় বললো, ‘অবশ্যই করি। কেবল সমর্থন নয়, এপ্রিশিয়েট করি
আমি একটু ঘাবড়ে গেলাম। এরকম ভালো একটা ডিপার্টমেন্টে পড়ে মেয়েটা। আর কটা বছর গেলেই গ্র্যাজুয়েশান শেষ করে চাইলেই ভালো ক্যারিয়ার করতে পারবে। এমন অবস্থায় কেবল খুব সামান্য একটা ইস্যুতে পড়াশুনাই ছেড়ে দিতে চাচ্ছে, আর তার বাবা নাকি সেটা বসে বসে এপ্রিশিয়েট করছে। এমন পাগলও হয় দুনিয়ায়?
আমি বললাম, ‘এটা কি এপ্রিশিয়েট করার মতোন কোন ব্যাপার?’
লোকটা আরো হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললো, ‘অবশ্যই। আমার মেয়ে দুনিয়ার জীবনের প্রাপ্তির বদলে আখিরাতের প্রাপ্তিকে বড় করে দেখতে শিখেছে। অর্থনীতির ভাষায়, ‘অপরচুনিটি কস্টবলে একটা ব্যাপার আছে। বিশাল কিছুর আশায় ক্ষুদ্র কিছু ত্যাগ করার নামই হলো অপরচুনিটি কস্ট। আমার মেয়ে অনন্ত জীবনের সফলতার জন্য দুনিয়ার ক্ষণিক সফলতাকে জলাঞ্জলি দিতে চাইছে, মুসলিম বাবা হিশেবে এর চেয়ে বড় পাওনা আমার জন্য আর কিছুই হতে পারেনা
আমি মুহূর্তের জন্য যেন কোথাও হারিয়ে গেলাম। জীবন নিয়ে এভাবেও ভাবা যায়? এরকম জীবনদর্শনও মানুষ অন্তরে লালন করতে পারে? স্বার্থপরতার এই দুনিয়ায় এরকম মানুষও আছে? জীবনের গোলকধাঁধায় যারা ভড়কে যায়না। হারিয়ে যায়না। যারা অনুপম আদর্শকে বুকে ধারণ করে তার জন্য জীবনের সবটুকু সুখ, সবটুকু আহ্লাদকে ছেড়ে দিতে পারে? আমি ভাবলাম- আমার ছেলেটাকেও যদি আমি এরকম দীক্ষা দিতে পারতাম! যদি বলতে পারতাম- এটাই তোমার শেষ গন্তব্য নয়। এরপরে অনন্ত এক গন্তব্যে তোমাকে পাড়ি জমাতে হবে। সেই গন্তব্যের পথকে মসৃণ রাখতে দুনিয়ার সমস্ত মোহকে ত্যাগ করতে হবে। ইশ! যদি সত্যিই তাকে এভাবে মানুষ করতে পারতাম, আজ আমিও কি বাবা হিশেবে গর্ববোধ করতে পারতাম না? ছেলে মাদকাসক্ত, মাতাল আর নষ্ট হয়ে গেছে বলে কি বুকে পাথর নিয়ে আমাকে চলতে হতো?
দরখাস্তটার উপরে আমার আবার চোখ পড়লো। মেয়েটা একেবারে শেষে নিজের নাম লিখেছে এভাবে, ‘আয়েশা বিনতে আলাদীনআলাদীননামটা দেখেই আমার বুকের ভিতরে চ্যাৎ করে উঠলো। এ কোন আলাদীন? আমাদের শৈশবের সেই হাবাগোবা আলাদীন নয় তো? আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘স্যরি, কিছু মনে করবেন না। আপনার নাম?’
লোকটা বললো, ‘মোহাম্মদ আলাদীন
আমার আগ্রহ বেড়ে গেলো। বললাম, ‘আপনার বাসা?’
-‘চট্টগ্রাম
হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমার হাইস্কুল তো চট্টগ্রামেই ছিলো। আমি আরো দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, আপনার হাই স্কুলের নাম?’
-‘সাদনপুর আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়
আমার মনে পড়ে যায় সেই শৈশবের গল্প! সেই স্কুল, সেই ক্লাসরুম, সেই বন্ধুদের। হ্যাঁ, এ অবশ্যই আমাদের সেই হাবাগোবা আলাদীন। আমি তার হাত ধরে বললাম, ‘এই হাবাগোবা আলাদীন! আমাকে চিনতে পারছিস? আমি আর তুই একই স্কুলে পড়তাম
লোকটা বেশ চমকে উঠলো। বললো, ‘আপনার নাম?’
-‘আমি রূপম! তোকে যে আমরা হাবাগোবা আলাদীন ডাকতাম মনে আছে?’
আলাদীনের চোখেমুখে খুশির ঝলক। বললো, ‘হ্যাঁ
-‘এটা তোর মেয়ে?’
-‘হ্যাঁ
মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আমি বললাম্‌, ‘বাপকা বেটি হয়েছিস। বেঁচে থাক মা

[৫]
আলাদীনের সাথে আমার অনেক আলাপ হয়ে গেছে। আমাদের সেই বিজ্ঞান স্যারের গল্প, অঙ্ক স্যার যে তাকে মুদি দোকানদারবলে ডাকতো সেই গল্প, ডাকাবুকো মুনতাসিরের গল্প সহ আমার বিদেশ-বিভূইয়ের হরেক পদের গল্প। হ্যাঁ, বাদ যায়নি আমার উচ্ছ্বনে যাওয়া ছেলেটার গল্পও। সেই গল্পে আলাদীন আর আমি, দুজনেই খুব উদাস হয়ে গিয়েছিলাম।
যোহরের আযান হচ্ছে মসজিদে। আলাদীন বললো, ‘উঠি তাহলে? নামাজে যাওয়া লাগবে। আযান হচ্ছে
আমি তাকে বিদেয় দিলাম। সে আর তার মেয়ে আমার রুম থেকে প্রস্থান করলো। আমার মনে পড়ে গেলো আলাদীনের ছোটবেলাকার সেই কথাগুলো- যোহরের আযান হচ্ছে। আমার সাথে মসজিদে যাবে? এই যে দেখো, মুয়াজ্জিন বলছে, ‘হাইয়্যাল আল-ফালাহ। মানে, সফলতার পথে এসো। জীবনে সফল হতে চাইলে চলো আমরা নামাজে যাই
সেদিন বুঝিনি নামাজে গেলে কিভাবে সফল হওয়া যায়। বুঝতেও চায়নি। আচ্ছা, আলাদীন কি সত্যি সত্যিই সফল হতে পেরেছে? পেরেছেই তো! নিজের আদর্শে গড়ে তুলেছে সন্তানদের। সন্তানরা সেই আদর্শ ধরে রাখতে দুনিয়াটাকেই বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আচ্ছা, আমি কি সফল হতে পেরেছি? আমি জানিনা...


No comments:

Post a Comment