জাপান, প্রযুক্তি, শৃঙ্খলা এবং কর্মসংস্থানের দিক থেকে বিশ্বের অন্যতম উন্নত দেশ। এই দেশে অভিবাসীদের জন্য রয়েছে প্রচুর কাজের সুযোগ, যা বহু মানুষের জীবনের গতিপথ বদলে দেয়। তবে একজন মুসলিম হিসেবে শুধু চাকরি বা আয়ের সুযোগ থাকলেই যথেষ্ট নয় – প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো, সেই উপার্জন ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী হালাল কি না। কেননা, ইসলামে জীবিকা শুধু পেট ভরানোর উপায় নয়; বরং এটি একটি ইবাদত, যা মানুষের আত্মিক উৎকর্ষতা ও আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির মাধ্যম হতে পারে।
এক হাদীছে বিষয়টা এভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে-
الحلال بَيْن والحَرامُ بَيْلُ، وَبَيْنَهُمَا أُمُورُ مُشتبِهَاتٌ لا يَعْلَمُهُنَّ كَثِير من الناس، فمن اللي الشبهات إستمرا لدينه و عرضه، وَ مَنْ وَقَعَ فِي الشُّبُهَاتِ وَقَعَ فِي الحَرَامِ، كالراعي يرعى حول الحمى يوشك أن يرتع فيه ، ألا وإن لكل ملك حتى أَلَا وَإِن حتى الله محارمة
নিশ্চয়ই হালাল সুস্পষ্ট এবং হারামও সুস্পষ্ট। উভয়ের মধ্যে আছে কিছু সন্দেহযুক্ত বিষয়। বহু মানুষ তা জানে না। সুতরাং যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয় পরিহার করল, সে তার দীন ও সম্মান রক্ষা করল। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি সন্দেহযুক্ত বিষয়ে লিপ্ত হল, সে হারামে লিপ্ত হয়ে গেল। ঠিক ওই রাখালের মত, যে সরকারি সংরক্ষিত ভূমির আশেপাশে পশু চড়ায়। অসতর্কতাবশত তার সংরক্ষিত ভূমিতে ঢুকে পড়ার আশু সম্ভাবনা রয়েছে। শোন হে! প্রত্যেক বাদশারই সংরক্ষিত এলাকা থাকে। শোন হে! আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা হল হারাম ও নিষিদ্ধ বিষয়সমূহ। (বুখারী ৫২ ও মুসলিম ১৫৯৯)
জাপানে কাজের বাস্তবতা
জাপানে অভিবাসী মুসলমানদের অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের চাকরির প্রস্তাব পেতে হয় – যেমন রেস্টুরেন্ট, কনভিনিয়েন্স স্টোর, হোটেল, নির্মাণ, নার্সিং, কারখানা ইত্যাদি। এইসব কাজের মাঝে অনেক ক্ষেত্রেই ইসলামসম্মত নয় এমন কার্যক্রম জড়িত থাকতে পারে – যেমন: অ্যালকোহল পরিবেশন বা বহন, হারাম খাদ্যসামগ্রী প্রস্তুত বা বিক্রয়, সুদভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করা ইত্যাদি। এসব ক্ষেত্রে মুসলমানদের উচিত নিজের ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধি করা এবং হালাল-হারাম সম্পর্কে সচেতন থেকে বিচক্ষণতার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা।
হারাম (নিষিদ্ধ) কাজসমূহ
ইসলামে যেসব কাজে সরাসরি হারাম উপাদান জড়িত, সেগুলো মুসলিমদের জন্য সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এই ধরনের কাজ থেকে উপার্জিত অর্থ কোনোভাবেই হালাল হিসেবে গণ্য হয় না:উদাহরণ স্বরূপ কিছু কাজের উল্লেখ করা হল:
রেস্টুরেন্ট বা বারে কাজ: যেসব স্থানে মদ, শুকরের মাংস বা অন্যান্য হারাম খাবার প্রস্তুত, পরিবেশন বা বিক্রি করা হয়, সেখানে কাজ করা মুসলিমদের জন্য হারাম। কারণ এতে সরাসরি হারাম পণ্যের প্রচার ও প্রসারে সহায়তা করা হয়।
দোকানে কাজ: যেসব দোকানে হারাম দ্রব্য (যেমন: মদ, শুকরের মাংস, মূর্তিপূজার সামগ্রী বা জুয়ার সরঞ্জাম) বিক্রি হয়, সেখানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করা নিষিদ্ধ।
রান্নার কাজ: যদি কোনো প্রতিষ্ঠানে হারাম উপাদান ব্যবহার করে রান্না করা হয়, তবে সেখানে রান্নার কাজ করা এড়িয়ে চলা উচিত। কারণ, এতে নিজের অজান্তেই হারাম খাদ্যের প্রস্তুতিতে সহায়তা করা হতে পারে।
ইসলামে অর্থ থাকা মানেই সব কিছু বৈধ নয়; হারাম উপাদানের সাথে জড়িত যেকোনো কাজ শরিয়াহ পরিপন্থী এবং এর দ্বারা অর্জিত সম্পদ বরকতহীন।
হারাম উপার্জনের উৎস ও বাস্তবতা
জাপানে অনেক কাজের মধ্যে এমন কিছু কাজ রয়েছে যেগুলো শরিয়াহ অনুযায়ী হারাম:
১. মদ বা অ্যালকোহল সম্পর্কিত কাজ: যেমন রেস্টুরেন্টে মদ পরিবেশন করা, বিক্রি করা বা ডেলিভারি করা।
২. শুকরের মাংস প্রস্তুত বা পরিবেশন: এমন খাবার পরিবেশনের সঙ্গে জড়িত কাজ করা শরিয়াহ অনুযায়ী নিষিদ্ধ।
৩. জুয়া, মূর্তি ও ভাস্কর্য তৈরি বা বিক্রি করা: যেমন স্যুভেনির দোকান বা ক্যাসিনোতে কাজ।
৪. সুদভিত্তিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান: ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স বা ঋণভিত্তিক সংস্থায় কাজ করা।
৫. হারাম পণ্যের দোকান: যেমন: কনভিনিয়েন্স স্টোরে কাজ যেখানে সিগারেট, মদ, জুয়ার সামগ্রী ইত্যাদি বিক্রি হয়।
এই কাজগুলোতে জড়িত থাকা মানে সরাসরি হারাম আয়ের অংশীদার হওয়া, যা ঈমানের জন্য হুমকিস্বরূপ।
সন্দেহজনক কাজ
কিছু কাজ সরাসরি হারাম না হলেও সেগুলোর পরিবেশ বা উপাদান এমন হয়, যা সন্দেহজনক। এই ধরনের কাজগুলোকে ইসলামে ‘শুবহাত’ বা সন্দেহজনক বিষয় বলা হয়। এ ধরনের কাজ থেকে বিরত থাকা একজন ঈমানদারের জন্য উত্তম।উদাহরণ স্বরূপ :
সুশি রেস্টুরেন্টে প্লেট ধোয়া: যদিও সরাসরি হারাম খাবার স্পর্শ করা হচ্ছে না, তবে হারাম খাবারের প্লেট ধোয়ার মাধ্যমে অজান্তেই হারাম খাবারে পরোক্ষ সহায়তা করা হতে পারে।
কুরিয়ার সার্ভিসে অজানা পণ্য পরিবহন: ইয়ামামোতো (Yamamoto) বা অন্যান্য কুরিয়ার সার্ভিসের ট্রাকে শুধু হালাল খাবার নয়, বরং বিভিন্ন ধরনের হালাল ও হারাম পণ্য থাকতে পারে। যেহেতু ডেলিভারির আগে প্রতিটি পণ্যের হালাল-হারাম যাচাই করা কঠিন, তাই এ ধরনের কাজ “শুকূহে” বা সন্দেহজনক।
হালাল ও নিরাপদ কাজসমূহ
জাপানে এমন অনেক পরিশ্রমী কাজ রয়েছে যেগুলো সম্পূর্ণরূপে শরিয়তসম্মত এবং তাতে কোনো হারাম বা সন্দেহজনক উপাদান নেই। এই কাজগুলো শারীরিক পরিশ্রমের হলেও মানসিক শান্তি নিশ্চিত করে:উদাহরণ স্বরূপ কিছু কাজের উল্লেখ করা হল:
গৃহ নির্মাণ বা ভাঙার কাজ: কনস্ট্রাকশন সাইটে বাড়ি নির্মাণ, সংস্কার বা ভাঙার কাজ।
রাস্তা নির্মাণ ও মেরামত: রাস্তাঘাট তৈরি বা মেরামতের কাজে যুক্ত থাকা।
বিল্ডিং বা হোটেল পরিষ্কার: অফিস, অ্যাপার্টমেন্ট বা অন্যান্য বিল্ডিংয়ের পরিচ্ছন্নতার কাজ।
টয়লেট পরিষ্কার: এই কাজটি যদিও কঠোর এবং অনেকের কাছে অনাকর্ষণীয় মনে হতে পারে, তবে এটি সম্পূর্ণ হালাল।
কৃষিকাজ ও খামার কাজ: ফসল ফলানো, ফল সংগ্রহ, পশু পালন বা খামারের অন্যান্য কাজ।
বৃক্ষচর্চা: বাগান পরিচর্যা, গাছে পানি দেওয়া বা গাছের যত্ন নেওয়া।
পশুখাদ্য প্রস্তুতি ও মজুদ কারখানা: যেসব কারখানায় পশুখাদ্য উৎপাদন বা সংরক্ষণ করা হয়, সেখানে কাজ করা।
ভাষাজ্ঞানের গুরুত্ব ও কাজের উন্নয়ন
জাপানে একজন মুসলিমের জন্য কাজের ক্ষেত্র নির্বাচন এবং উন্নত ক্যারিয়ারের জন্য জাপানি ভাষা শেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষাজ্ঞান যত বেশি হবে, হালাল ও আরামদায়ক কাজের সুযোগ তত বাড়বে।
মুসলিমদের করণীয়
জাপানে অবস্থানরত মুসলিমদের উচিত:
ইসলামী জ্ঞান অর্জন করা: শরিয়াহর আলোকে কোন পেশা বৈধ বা অবৈধ, তা জানতে স্থানীয় ইমাম বা ইসলামিক স্কলারদের সঙ্গে পরামর্শ করা।
নিয়ত শুদ্ধ রাখা: উপার্জনের মূল উদ্দেশ্য যেন আল্লাহর সন্তুষ্টি হয়, শুধুমাত্র দুনিয়াবি লাভ নয়।
সম্ভব হলে বিকল্প খোঁজা: যদি কোনো চাকরিতে হারাম উপাদান থাকে, তবে ধৈর্য ধারণ করে হালাল বিকল্প খোঁজার চেষ্টা করা।
পরিবার ও সমাজে সচেতনতা ছড়ানো: হালাল উপার্জনের গুরুত্ব নিয়ে পরিবার ও মুসলিম কমিউনিটিতে আলোচনা করা এবং অন্যদের উৎসাহিত করা।
উপসংহার
জীবিকার পেছনে ছুটতে গিয়ে যদি আমরা হালাল-হারামের সীমারেখা ভুলে যাই, তবে আমরা কেবল দুনিয়ার ক্ষতিই নয়, আখিরাতের চিরস্থায়ী ক্ষতির পথেও পা রাখি। একজন সচেতন মুসলিম হিসেবে জাপানে কর্মজীবন গড়ে তুলতে হলে আমাদের অবশ্যই হালাল উপার্জনের প্রতি যত্নবান হতে হবে। কারণ হালাল জীবিকা শুধু আমাদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নয়, বরং আত্মিক প্রশান্তি ও আল্লাহর সন্তুষ্টির একটি প্রধান মাধ্যম। এটি আমাদের দুনিয়া ও আখিরাত – উভয় জীবনের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।