যিলহজ্ব ১৪৩৬ . অক্টোবর ২০১৫
চলতি সংখ্যা . বর্ষ: ১১ . সংখ্যা: ০৯
একটি বানোয়াট কাহিনী : নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে উক্কাশা রা.-এর প্রতিশোধ গ্রহণের কাহিনী
এই কাহিনীটি সমাজে খুবই প্রসিদ্ধ-
একবার নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলাল রা.-কে বললেন, লোকদেরকে নামাযের জন্য জমা হতে বল। লোকেরা জমা হল। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে নিয়ে নামায আদায় করলেন। তারপর মেম্বারে উঠে ভাষণ দিলেন। তাঁর ভাষণ শুনে সাহাবীদের হৃদয় বিগলিত হল, চক্ষু অশ্রæসজল হল। এক পর্যায়ে নবীজী বললেন, তোমাদের কারো উপর যদি আমি কখনো যুলুম করে থাকি তাহলে আজই আমার থেকে প্রতিশোধ নিয়ে নাও। দু’বার এই ঘোষণা দেওয়ার পরও কেউ দাঁড়ালো না। তৃতীয়বার ঘোষণা দেওয়ার পর উক্কাশা নামক এক বৃদ্ধ সাহাবী ভিড় ঠেলে মেম্বারের দিকে এগিয়ে গেলেন। বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার উপর আমার মাতা-পিতা কোরবান হোক! আপনি বারবার না বললে আমি প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য দাঁড়াতাম না। এক গযওয়ায় আল্লাহ আমাদের বিজয় দান করার পর আমরা ফিরছিলাম। পথিমধ্যে আমার উট আপনার উটের বরাবর এলে আমি উট থেকে নেমে আপনার পায়ে চুমু দেওয়ার ইচ্ছা করলাম। তখন আপনি আপনার ছড়ি দিয়ে আমাকে আঘাত করেছিলেন। জানি না আমাকে স্বেচ্ছায় আঘাত করেছিলেন, নাকি উটকে আঘাত করতে গিয়ে আমার গায়ে আঘাত লেগেছিল?
নবীজী বললেন, আল্লাহর পানাহ! আমি স্বেচ্ছায় তোমাকে প্রহার করতে পারি না। তারপর বেলাল রা.-কে বললেন, ঘর থেকে একটি ছড়ি নিয়ে আসো। তিনি ছড়ি আনতে গেলে ফাতেমা রা. বললেন, ছড়ি দিয়ে কী হবে? জানতে পেরে তিনি হাসান-হুসাইনকে পাঠালেন নবীজীর পক্ষ হয়ে কিসাস গ্রহণ করতে। নবীজীর হাতে ছড়ি পৌঁছলে তিনি উক্কাশা রা.-এর হাতে দিয়ে বললেন, প্রতিশোধ গ্রহণ কর। তখন আবু বকর রা. দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, উক্কাশা! এই নাও আমার শরীর পেতে দিলাম, আমার থেকে নবীজীর কিসাস গ্রহণ কর; নবীজীর থেকে নয়। কিন্তু নবীজী তাকে বসিয়ে দিলেন। এমনিভাবে পর্যায়ক্রমে ওমর রা., আলী রা. দাঁড়িয়ে একই আবেদন করলেন। নবীজী তাদেরকেও বসিয়ে দিলেন। হাসান হুসাইন এগিয়ে গেলে নবীজী তাদেরকেও বসিয়ে দিলেন।
উক্কাশাকে বললেন, নাও, তোমার প্রতিশোধ গ্রহণ কর। উক্কাশা বললেন, আমাকে যখন আপনি আঘাত করেছিলেন তখন আমার গায়ে জামা ছিল না। তখন নবীজী জামা খুলে ফেললেন। এহেন পরিস্থিতি দেখে সাহাবাদের মাঝে কান্নার রোল পড়ে গেল।
নবীজী যখন জামা খুলে দিলেন তখন উক্কাশা রা. এই সুযোগে নবীজীর শরীরে চুমু খেয়ে বললেন, আপনার উপর আমার মাতা-পিতা কোরবান হোক! আপনার থেকে কি প্রতিশোধ গ্রহণ করা যায়! (কেউ কেউ এভাবেও বলেÑ যখন নবীজী জামা খুলে দিলেন আর ‘মোহরে নবুওত’-এর উপর উক্কাশা রা.-এর দৃষ্টি পড়ল তখন তিনি মোহরে নবুওতে চুমু খেয়ে বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমার প্রতিশোধ নেয়া হয়ে গেছে। এ উদ্দেশ্যেই নাকি তিনি এ বিষয়ের অবতারণা করেছিলেন।)
এটি একটি বানোয়াট কাহিনী, বাস্তবতার সাথে এর কোনোই সম্পর্ক নেই। এবং এর সাথে উক্কাশা রা.-এর মত মহান সাহাবীরও কোনো সম্পর্ক নেই। ইবনুল জাওযী রাহ. তার ‘মাওযূআত’ কিতাবে এ কিচ্ছাটি নকল করার পর বলেন-
هَذَا حَدِيث مَوْضُوع...، وَالْمُتَّهَم بِهِ عبد الْمُنعم بن إِدْرِيس.
এটি একটি জাল বর্ণনা।... আবদুল মুনঈম ইবনে ইদরীস নামক ব্যাক্তি এটি জাল করেছে। -কিতাবুল মাওযূআত, ইবনুল জাওযী, ১/৩০১
আরো দেখুন, লিসানুল মীযান, ৪/৭৩-৭৪; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ৯/২৭; আললাআলিল মাসনূআহ ফিল আহাদীসিল মাওযূআহ ১/২৫৭; তানযীহুশ শারীআহ ১/৩৩১; আলআসারুল মারফ‚আহ ফিল আহাদীসিল মাউযূআহ, পৃ. ৪০
একটি ভুল ধারণা : রুকু-সিজদার তাসবীহ কি তিনবারের বেশি পড়া নিষেধ?
কিছু মানুষ মনে করেন, রুকু বা সিজদার তাসবীহ তিনবারের বেশি পড়া যায় না। ফলে তারা যখন ইমামের পিছনে নামায পড়েন তখন সুযোগ থাকা সত্তে¡ও তিনবার তাসবীহ পড়েই চুপ করে থাকেন।
অনেক ইমাম সাহেবই রুকু সিজদার তাসবীহ বেশ ধীরে পড়েন। কোনো কোনো ইমাম সাহেবের ক্ষেত্রে মুসল্লিগণ তিনবারই তাসবীহ পড়ার সুযোগ পান। আবার কোনো কোনো ইমামের ক্ষেত্রে পঁচ থেকে সাতবার পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পাওয়া যায়। সুতরাং এক্ষেত্রে তিনবার পড়ে চুপ না থেকে ইমাম সাহেব রুকু বা সিজদা থেকে উঠা পর্যন্ত পড়তে থাকা।
একটি ভুল আমল : চলমান ‘ছুতরা’
কিছু মানুষকে দেখা যায়, তারা হাতে থাকা জায়নামায বা রুমালকে সুতরা হিসেবে ব্যবহার করেন। মুসল্লির সামনে দিয়ে যান আর হাতের রুমাল বা জায়নামাযকে সুতরা হিসেবে সামনে ধরে থাকেন আর চলতে থাকেন। এ ধরনের চলমান সুতরার মাধ্যমে সুতরা আদায় হবে না। সুতরাং এটা থেকে বিরত থাকতে হবে।
যিলকদ ১৪৩৬ . সেপ্টেম্বর ২০১৫
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১১ . সংখ্যা: ০৮
একটি বানোয়াট কিসসা : শাদ্দাদের বেহেশত
সমাজে ‘শাদ্দাদের বেহেশত’ শিরোনামে বিভিন্ন ধরনের কিস্সা প্রচলিত আছে। কেউ কিস্সাটি এভাবে বলেনÑ
শাদ্দাদ বিশাল রাজত্ব ও ধন-সম্পদের মালিক ছিল। তার কওমের নবী তাকে দাওয়াত দিলে সে বলে, ঈমানের বদলে কী মিলবে? নবী বললেন, জান্নাত। তখন সে ঔদ্ধত্য দেখিয়ে নিজেই জান্নাত বানাতে শুরু করে।
৩০০ বছর ধরে জান্নাত বানায়; তাতে বিভিন্ন ফলের গাছ লাগায়। প্রাসাদ বানায়, নহর খনন করে ইত্যাদি। এরপর সে যখন সৈন্য-সামন্ত নিয়ে তার বানানো বেহেশতের দিকে রওনা হয়। এক দিন এক রাতের রাস্তা বাকি থাকতেই আল্লাহ তাকে তার সৈন্য-সামন্তসহ ধ্বংস করে দেন।
কেউ বলে, তার বানানো জান্নাত দেখতে যাওয়ার পথে একটি সুন্দর হরিণ দেখতে পায়। হরিণটি শিকার করতে গিয়ে সে একটু দূরে চলে যায়। এ মুহূর্তে মালাকুল মাউত হাযির হয় এবং তার রূহ কবয করে। সে তার বানানো জান্নাত নিজেও দেখতে পারে না।
কেউ বলে, সে তার বানানো বেহেশতে প্রবেশ করার জন্য যখন এক পা দিল,তখন দ্বিতীয় পা রাখার আগেই মালাকুল মাউত তার রূহ কবয করে ফেলে ইত্যাদি ইত্যাদি।
কারো কারো মুখে এ-ও শোনা যায়, এরপর আল্লাহ তাআলা তার ঐ জান্নাত যমিনে ধ্বসিয়ে দেন; মাটির সাথে মিশিয়ে দেন। বালুর মধ্যে যে অংশ চিকচিক করে, তা শাদ্দাদের বানানো বেহেশতের ধ্বংসাবশেষ।
এ ছাড়াও শাদ্দাদের বেহেশত কেন্দ্রিক আরো অনেক কথা সমাজে প্রচলিত আছে। তার বেহেশত কীভাবে বানালো, কতজন শ্রমিক লেগেছে, এর দেয়াল কিসের ছিল,ফটক কিসের ছিল, মেঝে কিসের ছিল, ইত্যাদি।
শাদ্দাদের বেহেশত বানানোর কিসসা একেবারেই অবাস্তব ও কাল্পনিক; নির্ভরযোগ্য কোনো দলীল দ্বারা তা প্রমাণিত নয়। যারা এটি উল্লেখ করেছেন তারা ইসরাঈলী বর্ণনা থেকে তা এনেছেন। এজন্যই ইমাম ইবনে কাসীর ও আল্লামা ইবনে খালদুনসহ আরো অনেকেই এ কিসসাকে অবাস্তব ও কাল্পনিক বলে অভিহিত করেছেন। Ñতাফসীরে ইবনে কাসীর ৪/৮০২-৮০৩; মুকাদ্দামাতু ইবনে খালদূন ১/১৭; আলইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাওযূআত ফী কুতুবিত তাফসীর ২৮২-২৮৪
একটি ভুল উচ্চারণ : তাহাজ্জুতের নামায
রাতের শেষ প্রহরে বা গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে যে নামায পড়া হয় তাকে তাহাজ্জুদের নামায বলা হয়। এর আরবী পাঠ হল, تَهَجُّد (তাহাজ্জুদ)।
কিন্তু কিছু কিছু মানুষ এ শব্দটিকে ‘তাহাজ্জুত’ (تَهَجُت) উচ্চারণ করেন। এটি ভুল উচ্চারণ। সঠিক উচ্চারণ হল, তাহাজ্জুদ।
শাওয়াল ১৪৩৬ . আগস্ট ২০১৫
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১১ . সংখ্যা: ০৭
একটি ভিত্তিহীন কাহিনী : মূসা আ. ও আল্লাহর মাঝে কথোপকথন
আপনার কথা বললে মজলিসে লোক কম হয় কেন?...
কিছু কিছু মানুষকে দ্বীনী মজলিসে বসতে পারার ফযীলত হিসেবে নীচের কাহিনীটি বলতে শোনা যায়-
‘মূসা আ. একবার আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার আলোচনা করলে মানুষ কম হয় কেন?
আল্লাহ বললেন, এক তোড়া ফুল আনো। মূসা আ. বেছে বেছে সুন্দর সুন্দর ফুল দিয়ে একটি তোড়া বানিয়ে আনলেন।
আল্লাহ বললেন, এত ফুল থাকতে বেছে বেছে আনলে কেন?
মূসা আ. বললেন, বেছে বেছে সুন্দর দেখে পছন্দ করে এনেছি।
তখন আল্লাহ বললেন, আমিও আমার মজলিসে আমার বান্দাদের থেকে বেছে বেছে পছন্দনীয় বান্দাদের আনি।’
যে উদ্দেশ্যেই বলা হোক এটি একটি ভিত্তিহীন কাহিনী। কোনো নির্ভরযোগ্য বর্ণনার মাধ্যমে তা প্রমাণিতও নয়। সুতরাং এটি বর্ণনা না করা চাই। দ্বীনী মাহফিল বিষয়ে যে সহীহ হাদীস রয়েছে সেগুলোই বর্ণনা করা উচিত।
এটি হাদীস নয় : যে ব্যক্তি মসজিদ থেকে একটি চুল ফেলে দিল সে যেন একটি মৃত গাধা ফেলে দিল
কোথাও কোথাও এই কথাটি হাদীস হিসেবে প্রচলিত আছে-
‘যে ব্যক্তি মসজিদ থেকে একটি চুল ফেলে দিল সে যেন একটি মৃত গাধা ফেলে দিল বা সে একটি মরা গাধা সরানোর সওয়াব লাভ করল।’
মসজিদে কোনো ময়লা দেখলে তা পরিষ্কার করা অনেক সওয়াব ও ফযীলতের কাজ। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে কোনো ময়লা দেখলে নিজ হাতে তা পরিষ্কার করতেন। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের দেয়ালে ময়লা দেখতে পেলেন। তখন তিনি একটি পাথরের টুকরা নিলেন এবং নিজ হাতে তা পরিষ্কার করলেন। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪০৮
আরেক হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আমার সামনে আমার উম্মতের নেক আমলের প্রতিদান পেশ করা হল, এর মধ্যে ‘মসজিদ থেকে ময়লা দূর করার নেক আমলের প্রতিদানও দেখতে পেলাম...। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৬১; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৯১৬
সুতরাং মসজিদে কোনো ময়লা দেখলে তা পরিষ্কার করা অনেক সওয়াবের কাজ। কিন্তু মসজিদ থেকে একটি চুল ফেলে দিলে মরা গাধা ফেলার সওয়াব সম্বলিত কথাটি লোকমুখে হাদীস হিসেবে প্রসিদ্ধ হলেও এটি হাদীস নয়। কোনো নির্ভরযোগ্য কিতাবে তা পাওয়া যায় না। আমাদের জানামতে এর কোনো নির্ভরযোগ্য সনদ নেই।
একটি ভুল কথা : খাওয়ার মাঝে মাঝে কি পানি পান করা সুন্নত
কিছু কিছু মানুষকে বলতে শোনা যায়, খাওয়ার মাঝে মাঝে পানি পান করা সুন্নত।
এটি মনগড়া কথা, যার সাথে নবীজীর সুন্নতের কোনো সম্পর্ক নেই।
কোনো কাজকে -তা যত ভাল কাজই হোক নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে জানা ছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে সম্পৃক্ত করা বা সুন্নত বলা জায়েয নেই।
সুতরাং নিশ্চিতভাবে জানা ছাড়া কোনো কাজ বা পদ্ধতিকে সুন্নত বলা যাবে না। তাহলে এটা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেননি তা রাসূলের সাথে সম্পৃক্ত করা হবে। যা বড় ধরনের গুনাহের কাজ। আমরা এটা থেকে বিরত থাকব।
খানার মাঝে মাঝে পানি পান করা সুন্নত হওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অথবা সাহাবায়ে কেরামের ‘কওল’ বা ‘ফে‘ল’ (বক্তব্য বা কাজ) দ্বারা তা মাতলূব হওয়ার দলীল প্রয়োজন। আমাদের জানামতে এমন কোনো দলীল নেই।
একটি মারাত্মক ভ্রান্ত চিন্তা : কর্মই ধর্ম
সেদিন এক ভাইকে কথা প্রসঙ্গে বলতে শুনলাম- কর্মই ধর্ম; কে কোন ধর্মের তা কোনো বিষয় নয়, কে কেমন আমল করছে সেটাই আসল বিষয়। অর্থাৎ, ব্যক্তি যে ধর্মেরই হোক, ভালো কাজ করলে মুক্তি পাবে!
লোকটি শিক্ষিত এবং মসজিদের মুসল্লি। শুনে অবাক হলাম। অবাক হওয়ারই কথা। একজন শিক্ষিত মানুষ আবার মসজিদের মুসল্লি, তার মুখ থেকে এমন কথা!
আরো মানুষকে এমন কথা বলতে শুনেছি। আসলে প্রয়োজনীয় দ্বীনী ইলম না থাকায় মানুষ এ ধরনের কথা বলে থাকে।
হয়ত তাদের ধারণা, সব ধর্মের মানুষের সাথে যেহেতু ভালো আচরণ করতে হবে, তাই সকলের ধর্ম ও আদর্শের বিষয়েও উদার (?) হতে হবে। তার ধর্ম ও বিশ্বাসকেও সঠিক বলতে হবে।
একটু ভেবে দেখি, আদর্শের ক্ষেত্রে কি কোনো উদারতা চলে। শিরকের সাথে কি কোনো আপস চলে?
এটা কি সম্ভব, যে আল্লাহর সাথে কাউকে (বা হাজার দেবতাকে) শরীক করে তাকেও সঠিক বলব!!
আচ্ছা, বিষয়টি যদি এমনই হয় যে, কে কী আমল করছে সেটাই আসল বিষয়। তাহলেও একজন অমুসলিম কখনোই নাযাত পেতে পারে না। কারণ, সে সবচেয়ে বড় আমলেই তো ত্রæটি করছে। সে তো আল্লাহর সাথে শরীক করছে। আর আল্লাহ তাআলার স্পষ্ট ঘোষণা-
إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءوَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا بَعِيدًا.
“নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সঙ্গে শরীক করাকে ক্ষমা করবেন না। এর নিচের যে কোনোও গুনাহ যার ক্ষেত্রে চান ক্ষমা করে দেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরীক করে সে সঠিক পথ থেকে বহু দূরে সরে যায়। -সূরা নিসা ৪ : ১১৬
আচ্ছা, আল্লাহর সাথে শরীক করা, আল্লাহর দ্বীনকে প্রত্যাখ্যান করা, আল্লাহর কিতাবকে প্রত্যাখ্যান করা কি সবচেয়ে বড় অন্যায় নয়! আল্লাহর সৃষ্টি হয়ে, আল্লাহর যমিনে বসবাস করে, তার দেওয়া রিযিক ভক্ষণ করে যে আল্লাহকে অস্বীকার করে, সে কি সবচেয়ে বড় অপরাধী নয়! এত বড় বড় অন্যায় কাজ কেন আমাদের দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায়?
হাঁ, অমুসলিমের যত অধিকার আছে আমি তা আদায় করব। তার সাথে ভালো আচরণ করব। প্রতিবেশি হলে প্রতিবেশির হক আদায় করব। তার প্রতি জুলুম করব না। কিন্তু এর অর্থ তো এই নয় যে, তার শিরকি-কুফরিকেও সঠিক বলব। যে কোনো ধর্মের অনুসরণকে বৈধ বলব। তাদের শিরকি-কুফরি আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করব। তাদের বিশ্বাস ও দর্শনকে ভালো চোখে দেখব! (নাউযুবিল্লাহ)
আল্লাহ আমাদের সকল প্রকার ভ্রান্ত চিন্তা থেকে হেফাযত করুন। আল্লাহ তাআলার এ সুস্পষ্ট ঘোষণা স্মরণ রাখার তাওফিক দিন-
إِنَّ الدِّينَ عِنْدَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকট (গ্রহণযোগ্য) দ্বীন কেবল ইসলামই।... -সূরা আলে ইমরান ৩ : ১৯
স্মরণ রাখি এই আয়াতও-
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ
তরজমা : যে ব্যক্তি ইসলাম ছাড়া অন্য কোনোও দ্বীন অবলম্বন করতে চাবে, তার থেকে সে দ্বীন কবুল করা হবে না এবং আখেরাতে যারা মহাক্ষতিগ্রস্ত সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হবে। -সূরা আলে ইমরান ৩ : ৮৫
আরো স্মরণ রাখি রাসূলের এই বাণীও-
وَالَّذِي نَفْسُ مُحَمَّدٍ بِيَدِهِ، لَا يَسْمَعُ بِي أَحَدٌ مِنْ هَذِهِ الْأُمَّةِ يَهُودِيٌّ، وَلَا نَصْرَانِيٌّ، ثُمَّ يَمُوتُ وَلَمْ يُؤْمِنْ بِالَّذِي أُرْسِلْتُ بِهِ، إِلَّا كَانَ مِنْ أَصْحَابِ النَّارِ
ঐ সত্তার কসম যার হাতে মুহাম্মাদের প্রাণ। এই উম্মতের যে কেউ -সে ইহুদী হোক বা নাসার- আমার রিসালাতের সংবাদ পাওয়ার পরও আমার প্রতি ঈমান না এনে মৃত্যুবরণ করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৪০
পাঠকদের প্রতি দরখাস্ত, তারা যেন মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব রচিত “ঈমান সবার আগে’ কিতাবটি অবশ্যই অধ্যয়ন করেন। ইতিমধ্যে যার দ্বিতীয় সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে।
শাবান-রমযান ১৪৩৬ . জুন-জুলাই ২০১৫
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১১ . সংখ্যা: ০৬
একটি মারাত্মক ভুল চিন্তা : হারাম মাল ভক্ষণ বলতে কি শুধু হারাম মাল দ্বারা পানাহার বুঝায়
কিছু ভাইকে বলতে শোনা যায়, তার উপার্জনের মধ্যে হালাল-হারাম উভয় প্রকার উপার্জন আছে, কিন্তু সে নিজের ও পরিবারের খাওয়া-দাওয়ার খরচ কেবলমাত্র হালাল উপার্জন থেকে করে আর হারাম টাকা বাসা ভাড়া, পোশাক-পরিচ্ছদ ও অন্যান্য কাজে ব্যয় করে। এবং এতে সে সন্তুষ্ট। (নাউযু বিল্লাহি মিন যালিক)
তার ধারণা হল, হারাম মাল ভক্ষণ করা অর্থ শুধু হারাম মাল খাওয়া অর্থাৎ খাদ্যদ্রব্য হারাম মাল দ্বারা ক্রয় করা। বাসাভাড়া, বাহন, পরিধেয় বস্ত্র ইত্যাদি যদি হারাম মালের হয় তাতে সমস্যা নেই।
হারাম মাল ভক্ষণ বলতে যে শুধু হারাম-মাল দ্বারা পানাহার বুঝায় না, বরং সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত, একটি প্রসিদ্ধ হাদীস থেকে তা স্পষ্ট বুঝা যায়-
এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করেছে। চুল উষ্ক খুষ্ক। সে আসমানের দিকে হাত উঠিয়ে হে আমার রব!... হে আমার রব!!... বলে আল্লাহর কাছে দুআ করছে, (মুসাফিরের দুআ আল্লাহ কবুল করেন, সে হিসেবে তার দুআও কবুল হওয়ার কথা। কিন্তু তা হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে নবীজী বলেন,) কীভাবে তার দুআ কবুল হবে? অথচ তার খাদ্য হারাম, তার পানীয় হারাম, তার পোশাক হারাম অর্থের...। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১০১৫; জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯৮৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৮৩৪৮
এ হাদীসে তার দুআ কবুল না হওয়ার একটি কারণ বলা হচ্ছে, ‘তার পোশাক হারাম অর্থের’। এ থেকে বোঝা যায়, হারাম-ভক্ষণ শুধু হারাম মাল দ্বারা পানাহার বুঝায় না, বরং জীবন নির্বাহের সবকিছুকেই অন্তর্ভুক্ত করে। তাছাড়া শরীয়ত শুধু হারাম ভক্ষণকে নিষেধ করেননি বরং হারাম গ্রহণ করা এবং হারাম ব্যবহার করাকেও হারাম করেছে।
সুতরাং জীবন নির্বাহের যে কোনো অনুষঙ্গই হারাম থেকে মুক্ত হতে হবে। এমন নয় যে, পানাহার হবে হালাল মাল দ্বারা আর জীবনের অন্যান্য প্রয়োজন সারা হবে হারাম মাল দ্বারা। এটি চিন্তার একটি মারাত্মক ভুল। দ্বীনী সহীহ ইলমের অভাবে মানুষ হয়ত এমন মনে করে।
আল্লাহ সকলকে হারাম থেকে রক্ষা করুন, হালাল দ্বারা জীবন যাপনের তাওফীক দান করুন। দ্বীনী সহীহ ইলম হাসিল করার তাওফিক দিন। সকল প্রকার চিন্তার ভ্রান্তি থেকে রক্ষা করুন।
একটি ভুল ধারণা : ইস্তিঞ্জা করার পর অবশিষ্ট পানি দ্বারা ওযু না করা
কোনো কোনো মানুষকে দেখা যায়, ইস্তিঞ্জা করার পর পাত্রে যে অবশিষ্ট পানি রয়েছে সে পানি দ্বারা আর ওযু করে না। মনে করে যে, ইস্তিঞ্জার অবশিষ্ট পানি দ্বারা ওযু করা যাবে না। আবার কেউ কেউ মনে করে, সে পানি নাপাক। তাদের এ ধারণা ভুল।
ইস্তিঞ্জা করার কারণে পাত্রের পানি নাপাক হয় না। সুতরাং তা দ্বারা ওযু করতে কোনো সমস্যা নেই। হাঁ, যদি এ বিষয়ে নিশ্চিত হয় যে, কোনো কারণে পানি নাপাক হয়ে গেছে, তাহলে তা ভিন্ন কথা। কিন্তু শুধু ইস্তিঞ্জার অবশিষ্ট পানি হওয়ার কারণে তা দ্বারা ওযু করা যাবে না- এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা।
তবে, ইস্তিঞ্জার পর অবশিষ্ট পানি যদি অপচয় না করে তা ইস্তিঞ্জার কাজেই লাগানো হয়, আর ওযু নতুন পানি দিয়ে করা হয়, সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।
রজব ১৪৩৬ . মে ২০১৫
চলতি সংখ্যা . বর্ষ: ১১ . সংখ্যা: ০৫
একটি ভিত্তিহীন বর্ণনা : ওয়ায়েস করনীর জন্য কি নবীজী কোনো জুব্বা দিয়ে গিয়েছিলেন?
ওয়ায়েস করনীর বিষয়ে আমাদের সমাজে একটি ঘটনা প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওমর ও আলী রা.-এর কাছে তাঁর একটি জুব্বা রেখে যান এবং তাদেরকে ওসীয়ত করে যান, তারা যেন এ জুব্বা ওয়ায়েস করনীকে দেন। পরবর্তীতে তাঁরা ওয়ায়েস করনীকে সেই জুব্বাটি দেন।
এটি একটি ভিত্তিহীন বর্ণনা। কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে এটি পাওয়া যায় না। আল্লামা আলী কারী আলহারাবী রাহ. বলেন-
وَكَذَا مَا اشْتهرَ بَيْنَهُمْ مِنْ أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَوْصَى عُمَرَ وَعَلِيًّا بِخِرْقَتِه لأُوَيْسٍ وَأَنَّهُمَا سَلَّمَاهَا إِلَيْهِ...، فَلا أَصْلَ لَهُ.
‘মানুষের মাঝে যে কথা প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়ায়েস করনীকে তাঁর জুব্বা মুবারক দেওয়ার জন্য ওমর ও আলী রা.-কে ওসীয়ত করে যান এবং তাঁরা সেটি তার হাতে পৌঁছান...- এ বর্ণনার কোনো ভিত্তি নেই। (দ্র. আলমাছনূ ফী মারিফাতিল হাদীসিল মাওযূ, বর্ণনা ৪৭৫; কাশফুল খাফা, বর্ণনা ২০৩৫; আলআসরারুল মারফ‚আ, বর্ণনা ৩৫৬)
সহীহ মুসলিমের বর্ণনায় ওমর রা.-এর সাথে ওয়ায়েস করনীর সাক্ষাতের ঘটনা এসেছে। কিন্তু উপরোক্ত কাহিনীর কথা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে পাওয়া যায় না।
http://www.alkawsar.com/article/1341
http://www.alkawsar.com/article/1341
একটি রসম : কালিমার মাধ্যমে দুআ শেষ করা
দুআর একটি আদব হল, আল্লাহর হামদ-ছানা (প্রশংসা) ও দরূদ শরীফ দ্বারা দুআ শুরু করা এবং শেষ করা। তাছাড়া হাদীস থেকে এ-ও বুঝা যায় যে,দুআ সমাপ্ত হবে ‘আমীন’-এর মাধ্যমে । কিন্তু অনেক মানুষকে দেখা যায়, তারা দুআ শেষ করেন কালিমার মাধ্যমে। এভাবে বলে থাকেন-
হে আল্লাহ! মৃত্যুর সময় যবানে জারি করে দিও- ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। অথবা বলেন,
اجعل آخر كلامنا عند الموت "لا إله إلا الله، محمد رسول الله".
অর্থাৎ কালিমার মাধ্যমে তারা দুআ শেষ করেন। এটি দুআর আদব নয়; বরং এর কারণে দুআ সমাপ্ত করার মাসনূন আমল ছুটে যায়।
হাঁ,দুআর মধ্যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থনা যে, হে আল্লাহ আমার শেষ কথা হোক তোমার কালিমা। হাদীস শরীফে এসেছে-
مَنْ كَانَ آخِر كَلَامِهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ.
যার শেষ কথা হবে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ সে জান্নাতে যাবে। -সুনানে আবূ দাউদ, হাদীস ৩১১৬
কিন্তু কালিমার মাধ্যমে দুআ শেষ করা একটি রসম মাত্র।
কয়েকটি অবহেলা : দস্তরখানে খাদ্য পড়লে তুলে না খাওয়া, দস্তরখানকে কাটা-হাড্ডি রাখার পাত্র বানানো এবং অপরিষ্কার রাখা
দস্তরখানের সবচেয়ে বড় ফায়দা হল, তাতে খাদ্য পড়লে তা থেকে তুলে খাওয়া হয়। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় যে, আমরা গুরুত্বের সাথে দস্তরখান বিছিয়ে খাচ্ছি ঠিকই কিন্তু খাদ্য পড়ে গেলে তুলে খাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি না। অথচ খাদ্য পড়ে গেলে তার ময়লা পরিষ্কার করে হলেও তুলে খাওয়ার প্রতি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেন-
إِذَا سَقَطَتْ لُقْمَةُ أَحَدِكُمْ فَلْيُمِطْ عَنْهَا الْأَذَى وَلْيَأْكُلْهَا، وَلَا يَدَعْهَا لِلشَّيْطَانِ.
যদি তোমাদের কারো খাদ্য-কণা পড়ে যায় তাহলে সে যেন এর ময়লা দূর করে খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য রেখে না দেয়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৩৪
তেমনি অনেক সময় আমরা দস্তরখান পরিষ্কার রাখি না, ফলে তাতে খাদ্য পড়লে তুলে খেতে রুচি হয় না। এটি কাম্য নয়; দস্তরখান সবসময় এমন পরিষ্কার রাখা চাই যে, তাতে খাদ্য পড়লে তুলে খেতে বা তা বিছিয়ে খানা খেতে রুচিতে না বাধে।
তেমনি অনেক সময় আমরা দস্তরখানকে কাটা,হাড্ডি ইত্যাদি রাখার পাত্র বানিয়ে ফেলি। ফলে একসময় তা এমন অপরিষ্কার হয়ে যায় যে, তাতে খাবার পড়ে গেলে তুলে খেতে আর রুচি হয় না। কাটা, হাড্ডি ইত্যাদি রাখার জন্য ভিন্ন পাত্র ব্যবহার করা চাই। দস্তরখানকে কাটা-হাড্ডির পাত্র বানানো ঠিক নয়।
জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৬ . এপ্রিল ২০১৫
চলতি সংখ্যা . বর্ষ: ১১ . সংখ্যা: ০৪
এটি হাদীস নয় : মুহূর্তকালের ধ্যানমগ্নতা বছরকালের/ ষাট বছর ইবাদত অপেক্ষা উত্তম।
تفكر ساعة خير من عبادة سنة/ ستين سنة
এটি হাদীস নয়। যে সনদে (বর্ণনাসূত্রে) হাদীস হিসেবে কথাটি বর্ণিত হয়েছে তা নির্ভরযোগ্য নয়। তাই কথাটি হাদীস নয় বলে মত প্রকাশ করেছেন শাস্ত্রের ইমামগণ। ইবনুল জাওযী রাহ. বলেন,
هذا حديث لا يصح ...
‘অর্থাৎ এটি সহীহ নয়।’ আহমদ গুমারীও অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন।
দ্রষ্টব্য : কিতাবুল মাওযূআত : ৩/৩৮৬ (টীকাসহ);আল মুগীর,পৃ.৭৬;আল ফাওয়ায়েদুল মাজমূআহ, পৃ.২৪২-২৪৩ (টীকাসহ)
তবে ব্যতিক্রম শব্দে কথাটি সাহাবী আবুদ দারদা রা. ও হাসান বসরী রাহ. থেকে প্রমাণিত। তাঁদের উক্তিটি নিম্নরূপ,
تفكر ساعة خير من قيام ليلة
অর্থাৎ ‘কিছু সময় চিন্তা-ভাবনা করা এক রাত নফল ইবাদত-বন্দেগী করার চেয়ে উত্তম।’
আবুদ দারদা রা.-এর উক্তির জন্য দেখুন: আত তবাকাতুল কুবরা:৭/১৮৭;মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা:১৯/১৭৯ (৩৫৭২৮);কিতাবুয যুহদ,ইমাম আহমদ,পৃ.১৭৩;কিতাবুয যুহদ,হান্নাদ ইবনুস সারী, বর্ণনা:৯৪৩;হিলয়াতুল আউলিয়া:১/২৬৮;শুআবুল ঈমান:১/১৩৫-১৩৬
হাসান বসরী রাহ.-এর উক্তির জন্য দেখুন:কিতাবুয যুহদ,ইমাম আহমদ,পৃ.৩৩২;মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা:১৯/৩৭৪
উল্লেখ্য, উক্তিটি সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকেও বর্ণিত হয়েছে। তবে তার সনদ কিছুটা দুর্বল। দেখুন: কিতাবুল আযামাহ,আবুশ্ শায়খ ইবনে হাইয়ান,বর্ণনা:৪২
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন,মোল্লা আলী কারী রাহ. উল্লেখ করেছেন,এটি সাররী সাকাতী রাহ.-এর উক্তি। কিন্তু এর কোনো সনদ (বর্ণনাসূত্র) আমরা খুঁজে পাইনি।
মোটকথা,কথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বাণী নয়। (ব্যতিক্রম শব্দে) আবুদ দারদা রা. ও হাসান বসরী রাহ.-এর উক্তি।
‘তাফাক্কুর’-এর অর্থ: ‘তাফাক্কুর’ অর্থ চিন্তা-ভাবনা করা। এই চিন্তা-ভাবনার ক্ষেত্র অনেক বিস্তৃত। আল্লাহর বড়ত্ব-মহত্ব ও অসীম কুদরত নিয়ে চিন্তা করা। মানুষের জীবনের সূচনা-সমাপ্তি,হাশর-নশর,জান্নাত-জাহান্নাম ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করা। নিজের ঈমান-আমলের উন্নতির ফিকির করা । আল্লাহর হক,মাখলুকের হক সম্পর্কে ফিকির করা। আত্মসমীক্ষা করা,আত্মসমালোচনা করা,আত্মসংশোধনের সম্ভাব্য পথ ও পন্থা সম্পর্কে চিন্তা-ফিকির করাও এর অন্তর্ভুক্ত। ‘ইলমী তাদাব্বুর’-ও (দ্বীনী ইলমের বিভিন্ন দিক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা) এই ‘তাফাক্কুর’-এর অন্তর্ভুক্ত। এমনিভাবে দ্বীনের হেফাযত ও দ্বীন প্রচারের জন্য চিন্তা-ভাবনা করাও এর অন্তর্ভুক্ত।
‘তাফাক্কুর’-এর অর্থ থেকে এর গুরুত্বের বিষয়টি স্পষ্ট। কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে মানবজাতিকে বিশেষ করে মুমিন বান্দাদেরকে ‘তাফাক্কুর’করতে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে। তাই ভালোভাবে বুঝে নেওয়া উচিত,উপরের আলোচনা দ্বারা ‘তাফাক্কুর’-এর গুরুত্ব অস্বীকার করা উদ্দেশ্য নয়,বরং শুধু এ-কথা বলা উদ্দেশ্য যে,‘তাফাক্কুরু সাআতিন খাইরুম মিন ইবাদাতি সানাতিন/সিত্তীনা সানাতিন’ শীর্ষক কথাটি হাদীস নয়।
উল্লেখ্য,যারা উপরোক্ত উক্তিটিকে হাদীস মনে করে তাদের অনেকে ‘তাফাক্কুর’ শব্দের অর্থ করে ‘ধ্যানমগ্নতা’,যেভাবে শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে। এটি ঠিক নয়। তাফাক্কুর অর্থ ‘ধ্যানমগ্নতা’ নয়। ‘ধ্যানমগ্নতা ইবাদত অপেক্ষা উত্তম’ বলে ইবাদত পালনের আবশ্যকতাও অস্বীকার করে তাদের অনেকে। ধ্যান-সাধনা করে ইবাদত রহিত হয়ে যাওয়ার ধারণা একটি সুস্পষ্ট কুফরী মতবাদ। এ ধরনের কথায় বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়।
http://www.alkawsar.com/article/1316
একটি ভুল কথা :শিক্ষক ছাত্রকে শরীরের যে স্থানে আঘাত করবে তা জান্নাতে যাবে!
কিছু মানুষকে বলতে শোনা যায়,পড়াতে গিয়ে বা তারবিয়াত করতে গিয়ে শিক্ষক যদি ছাত্রকে প্রহার করেন তাহলে শরীরের যে স্থানে প্রহার করা হয়েছে ঐ স্থান জান্নাতে যাবে বা জাহান্নামে যাবে না।
একথার কোনো ভিত্তি নেই। কাউকে শিক্ষক প্রহার করলে হয়ত সান্ত¦না দেওয়ার জন্য তার হিতাকাঙ্খী কেউ একথাটি বলে-শিক্ষক প্রহার করলে মন খারাপ করার কিছু নেই। কারণ,শিক্ষক ছাত্রকে শরীরের যে স্থানে আঘাত করবে তা জান্নাতে যাবে বা জাহান্নামে যাবে না।
উদ্দেশ্য ভালো হলেও এটি একটি ভিত্তিহীন কথা। তবে কোনো শিক্ষক যখন পড়ার কারণে বা আদব শিক্ষা দিতে গিয়ে ছাত্রকে প্রহার করেন এটা তিনি ছাত্রের ভালোর জন্যই করেন। সুতরাং ছাত্রের উচিত মাথা পেতে তা গ্রহণ করা। জিদ না করে যে কারণে তাকে প্রহার করা হয়েছে তা শুধরে নেওয়া।
তেমনি পিতা-মাতা, মুরব্বী যদি ছোটকে কখনো বিশেষ কারণে প্রহার করেন সেটাও তার ভালোর জন্যই করেন, নিজের ভালোর জন্যই তা মেনে নেওয়া উচিত।
এখন উস্তায বা পিতা-মাতা কতটুকু প্রহার করতে পারেন কিংবা কখন পারেন কখন পারেন না ইত্যাদি ভিন্ন আলোচনা। শরীয়তে এর মূলনীতি রয়েছে। ছাত্র বা সন্তানের এর পিছনে পড়া উচিত নয়। তার উচিত, মুরব্বীর সাথে বেআদবী না করা এবং যে কারণে তাকে প্রহার করা হয়েছে তা সংশোধন করা।
http://www.alkawsar.com/article/1317
এখন উস্তায বা পিতা-মাতা কতটুকু প্রহার করতে পারেন কিংবা কখন পারেন কখন পারেন না ইত্যাদি ভিন্ন আলোচনা। শরীয়তে এর মূলনীতি রয়েছে। ছাত্র বা সন্তানের এর পিছনে পড়া উচিত নয়। তার উচিত, মুরব্বীর সাথে বেআদবী না করা এবং যে কারণে তাকে প্রহার করা হয়েছে তা সংশোধন করা।
http://www.alkawsar.com/article/1317
জুমাদাল উলা ১৪৩৬ . মার্চ ২০১৫
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১১ . সংখ্যা: ০৩
একটি ভুল রসম : মায়ের মাথা ছুয়ে কসম করা
অনেক সময় কোনো বিষয় কাউকে বিশ্বাস করানোর উদ্দেশ্যে কেউ কেউ মায়ের মাথা ছুয়ে কসম করে। কখনো নিজের মাথা ছুয়ে কসম করে। এটি একটি কুসংস্কার, এটা থেকে বিরত থাকা জরুরি।
মায়ের মাথা হোক আর নিজের মাথা হোক এভাবে কসম করা ঠিক নয়।
একটি ভুল বিশ্বাস : কবরের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করলে কি আঙুল পচে যায়?
কারো কবর দেখাতে গিয়ে যদি কেউ আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখায় যে, ঐটা অমুকের কবর তাহলে কিছু মানুষকে বলতে শোনা যায়- কবরের দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করতে নেই, আঙুল পচে যাবে।
এটি একটি ভুল বিশ্বাস, যা অজ্ঞতাবশত মানুষ বলে থাকে। এর কোনো ভিত্তি নেই। এ ধারণা বর্জন করা উচিত।
একটি ভুল নাম : আম্বিয়া খাতুন
এভাবে কারো নাম রাখা ভুল। কারণ আম্বিয়া হল,নবী শব্দের বহুবচন। অর্থ নবীগণ। তাহলে এটা কি কারো নাম হতে পারে?
কুরআনে কারীমের একটি সূরার নাম ‘আম্বিয়া’ এবং কুরআনের বহু স্থানে আম্বিয়া শব্দটি এসেছে। সে কারণেই হয়ত শব্দটি কারো পছন্দ হয়েছে এবং তার কন্যার নাম রেখে দিয়েছে আম্বিয়া। কিন্তু নামটি রাখার পূর্বে যদি কোনো আলেমকে জিজ্ঞেস করে অর্থ জেনে নেয়া হত তাহলে হয়ত এ বিপত্তি ঘটত না। সুতরাং যে কোনো শব্দ পছন্দ হলেই সেটি নাম হিসেবে গ্রহণ করব না। বরং নাম রাখার পূর্বে জেনে নেব এ শব্দটি পুত্র বা কন্যার নাম রাখা যায় কি না। সাথে সাথে নামের বিষয়ে ইসলামের নির্দেশনা জেনে নিব; কোন নাম আল্লাহর কাছে বেশি পছন্দনীয়, কোন ধরনের নাম রাখা যাবে, কোনটা যাবে না ইত্যাদি।
এটি হাদীস নয় : দুনিয়া পচা মরদেহের মত, আর যে ব্যক্তি (আল্লাহর নাফরমানীর মাধ্যমে) এর পিছে ছুটে সে কুকুরের মত
الدنيا جيفة، وطلابها كلاب
এ দুনিয়া অতি ক্ষণস্থায়ী ও মূল্যহীন; যেমন পচা মরদেহ মূল্যহীন। দুনিয়া অর্জনের পিছে পড়ে আখেরাত বরবাদ করা; আল্লাহর নাফরমানী করা, হালাল-হারামের পরোয়া না করা ইত্যাদি ঠিক নয়- একথা বুঝাতে গিয়ে এ বাক্যটি বলা হয়।
একটি পচা মরদেহ বা পচা মৃতপ্রাণীর যেমন আমাদের কাছে কোনো মূল্য নেই। আমরা তা অর্জনের জন্য এর পিছনে ছুটি না। অথচ কুকুরের কাছে এর অনেক মূল্য। কাড়াকাড়ি-ছেঁড়াছিঁড়ি করে কুকুর তা অর্জন করতে চায়। তেমনি যারা আল্লাহর নাফরমানীর মাধ্যমে, আখেরাতকে বরবাদ করে দুনিয়া নিয়ে ছেঁড়াছিঁড়ি-মারামারি করে তারাও যেন ঐ কুকুরগুলোর মত মূল্যহীন বস্তু অর্জনের জন্য মারামারি-ছেঁড়াছিঁড়ি করছে। এ বাক্যটিতে একথাই তুলে ধরা হয়েছে।
তবে উল্লেখিত কথাটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস নয়। আযলূনী রাহ. বলেন, যদিও এর অর্থ সহীহ, কিন্তু এটি রাসূলের হাদীস নয়। ছগানী রাহ. বলেছেন, এটি একটি জাল বর্ণনা। -কাশফুল খাফা, বর্ণনা নং ১৩১৩
আল্লাহর কাছে এ দুনিয়ার মূল্য কতটুকু এ বিষয়ে জামে তিরমিযীর একটি হাদীসে (হাদীস নং ২৩২০) আছে, ‘দুনিয়া যদি আল্লাহ তাআলার কাছে মাছির ডানার বরাবর মূল্য রাখত তাহলে আল্লাহ তাআলা কোনো কাফেরকে (আল্লাহ-দ্রোহীকে) এক ঢোক পানি পান করতে দিতেন না।’
কিন্তু বৈধ পন্থায় দুনিয়া অর্জন এবং হালাল উপার্জন কখনোই দোষণীয় নয়। বরং সৎ ও সত্যবাদী ব্যবসায়ী আখেরাতে নবীদের সঙ্গী হবে। তেমনি দুনিয়া উপার্জন যাদেরকে আল্লাহর স্মরণ ও নামায থেকে বিমুখ করে না, কুরআনে কারীমে তাদের প্রশংসা করা হয়েছে।
আসলে দোষণীয় হল, আল্লাহর নাফরমানীর মাধ্যমে আল্লাহকে ভুলে শুধু দুনিয়ার পিছনে পড়ে থাকা। দুনিয়া উপার্জনে হালাল-হারামের তোয়াক্কা না করা।
একটি ভিত্তিহীন কাহিনী : ইদরীস আ. জান্নাত দেখতে গিয়ে আর বের না হওয়া
ইদরীস আ. সম্পর্কে একটি ঘটনা প্রচলিত আছে যে, তিনি জান্নাত দেখতে গিয়ে আর জান্নাত থেকে বের হননি। ঘটনাটি এরকম-
আল্লাহর নবী ইদরীস আ. ছিলেন মালাকুল মাউতের (রূহ কবযকারী ফিরিশতার) বন্ধু। ইদরীস আ. তার কাছে জান্নাত-জাহান্নাম দেখানোর আবদার জানালেন। তিনি তাঁকে জাহান্নাম দেখালেন। জাহান্নাম দেখে ইদরীস আ. এত বেশি ভয় পেলেন যে বেহুশ হওয়ার উপক্রম হলেন। তখন মালাকুল মাউত আপন ডানা দিয়ে তাঁকে আগলে নিলেন। তারপর তাঁকে জান্নাত দেখাতে নিয়ে গেলেন। জান্নাত দেখা শেষ হলে মালাকুল মাউত বললেন, দেখা হয়েছে, এবার চলুন। তিনি বললেন, কোথায় যাব। বললেন, যেখান থেকে এসেছেন। তখন ইদরীস আ. বললেন, না, জান্নাতে প্রবেশ যখন করেছি, এখান থেকে আর বের হব না। তখন মালাকুল মাউতকে বলা হল, তুমি কি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাওনি? জান্নাতে একবার যে প্রবেশ করে সে আর বের হয় না বা তাকে আর বের করা হয় না।
এ বর্ণনাটি ভিত্তিহীন।
এতে ইবরাহীম ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে খালেদ আলমিস্সীসী রয়েছে। ইমাম যাহাবী রাহ. এ রাবী সম্পর্কে বলেন, هذا رجل كذاب، قال الحاكم: أحاديثه موضوعة
এ ব্যক্তি একজন চরম মিথ্যাবাদী। হাকেম রাহ. বলেছেন, তার বর্ণনাগুলো মওযূ ও বানোয়াট। (মীযানুল ইতিদাল, তরজমা নং ১২৪; লীসানুল মীযান, তরজমা নং ১৭৮)
http://www.alkawsar.com/article/1294
http://www.alkawsar.com/article/1294
রবিউস সানি ১৪৩৬ . ফেব্রুয়ারি ২০১৫
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১১ . সংখ্যা: ০২
একটি ভিত্তিহীন বর্ণনা : মূসা আ.-এর পেটব্যথা ও গাছের পাতা খাওয়ার কাহিনী
মূসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে সমাজে বিভিন্ন বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী শোনা যায়। সে রকম একটি কিচ্ছা হল- একবার মূসা আলাইহিস সালাম-এর পেটব্যথা হল। মূসা আলাইহিস সালাম পেটব্যথার কথা আল্লাহকে বললে আল্লাহ বললেন, অমুক গাছের পাতা খাও। তিনি তা খেলেন এবং সুস্থ হয়ে গেলেন। পরবর্তীতে আবার মূসা আলাইহিস সালাম-এর পেটব্যাথা হলে তিনি আল্লাহ্র হুকুম ছাড়াই সেই গাছের পাতা খেলেন, কিন্তু এবার আর ব্যথা ভাল হল না। তখন আল্লাহ বললেন, গাছের পাতার কোনো ক্ষমতা নেই। (অর্থাৎ এ গাছের পাতা খেয়ে পূর্বে তুমি ভাল হয়েছ আমার হুকুমে। আর দ্বিতীয়বার যেহেতু আমার হুকুমে খাওনি; নিজে নিজে খেয়েছ, ফলে তা তোমাকে ভাল করতে পারেনি।)
এটি একটি ভিত্তিহীন ঘটনা, যার সাথে মূসা আলাইহিস সালাম-এর কোনো সম্পর্ক নেই। কোনো নির্ভরযোগ্য বর্ণনার মাধ্যমে তা প্রমাণিত নয়। তাছাড়া এ ঘটনাটি মিথ্যা হওয়ার সাথে সাথে একজন মহান নবীর সাথে বেআদবী এবং তাঁর উপর অপবাদও বটে। এ ধরনের ঘটনা বলা থেকে বিরত থাকা জরুরি।
বাস্তবে যদি তিনি প্রথমবার আল্লাহর হুকুমে গাছের পাতা খেয়ে ভালো হন, তাহলে তাঁর দ্বিতীয়বার খাওয়াটাও তো আল্লাহর পূর্বের হুকুমের অধীন। সেটা কীভাবে নিজে নিজে খাওয়া হল? আর গাছের পাতার রোগ ভালো করার নিজস্ব কোনো ক্ষমতা নেই, বরং তা আল্লাহর ইচ্ছায় ভালো করে- এ কথা কি আল্লাহর নবী মূসা আলাইহিস সালাম-এর অজানা ছিল। (নাউযুবিল্লাহ) একজন নবী সম্পর্কে এটা কত বড় অপবাদ!
একজন সাধারণ মানুষও তো একথা মনে করে না যে, অমুক গাছের পাতা খেলে অমুক রোগ ভালো হওয়ার অর্থ ঐ পাতার রোগ ভালো করার নিজস্ব ক্ষমতা রয়েছে। তাহলে একজন নবীর ব্যাপারে এরকম কথা কত বড় বেআদবী!
এছাড়া কোনো বস্ত্তর মাঝে কোনো ভালো গুণ বা দোষ সেটা তো আল্লাহরই দেওয়া। কোনো ওষুধের মাঝে কোনো রোগ ভালো করার গুণ তো আল্লাহরই দেওয়া। সেটা অস্বীকারের কোনো কারণ নেই। ওষুধ খাওয়াও তো আল্লাহর আদেশের অধীন এবং উক্ত ওষুধের মাধ্যমে রোগ ভালো হওয়া না হওয়াও আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। মুমিন ওষুধ গ্রহণ করে আর আল্লাহর কাছে রোগমুক্তির প্রার্থনা করে। এর সাথে এ কথার কোনো বিরোধ নেই যে, ‘অমুক ওষুধ খেলে জ্বর ভালো হয়।’ কারণ ঐ ওষুধের মাঝে জ্বর ভালো করার গুণ আল্লাহরই দেওয়া । আর আল্লাহ চাইলে ঐ গুণ বা শক্তি কাজে লাগে, না চাইলে নয়।
http://www.alkawsar.com/article/1279
একটি অমূলক ধারণা :একটি দাড়িতে সত্তরটি ফিরিশতা থাকে
দাড়ির বিষয়ে কিছু মানুষকে বলতে শোনা যায় যে, একটি দাড়িতে সত্তরটি ফিরিশতা থাকে। কারো একটি দাড়ি ঝরে গেলে বা ছিড়ে গেলে বলে, আহা! তোমার সাথ থেকে সত্তরজন ফিরিশতা চলে গেল। তাদের ধারণা, একটি দাড়ির সাথে যেহেতু সত্তরটি ফিরিশতা থাকে সুতরাং একটি দাড়ি তোমার থেকে পৃথক হওয়া মানে সত্তরজন ফিরিশতা তোমার থেকে চলে যাওয়া। এটি একেবারেই অমূলক একটি ধারণা। এর কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু দাড়ির বিষয়ে সকলেরই সঠিক ধারণা থাকা উচিত।
দাড়ি ইসলামের শিআর ও পরিচয়-চিহ্ন হিসেবে গণ্য। দাড়ি লম্বা করা এবং মোচ খাটো করা দ্বীনে তাওহীদের শিক্ষা, যা সকল নবীর শরীয়তে ছিল। দাড়ি লম্বা রাখা ওয়াজিব এবং এক মুষ্ঠি থেকে খাটো করা নাজায়েয। এ বিষয়টি সকলে জানা এবং আমলে যত্নবান হওয়া জরুরি।
http://www.alkawsar.com/article/1280
একটি ভিত্তিহীন কথা :একটি ভাতের দানা বানাতে সত্তরজন ফিরিশতা লাগে
খাদ্য পড়ে গেলে তুলে খেতে হয়- এটা সকলেরই জানা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খাদ্য পড়ে গেলে তুলে খেতে বলেছেন। এমনকি খাদ্যে ময়লা লেগে গেলে তা পরিষ্কার করে খেতে বলেছেন। নিজেও এর উপর আমল করা উচিত এবং অন্যকেও উৎসাহ দেওয়া উচিত। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা ভাত পড়ে গেলে তুলে খাওয়ার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে বলে, ভাত নষ্ট করতে নেই; একটি ভাতের দানা বানাতে সত্তরজন ফিরিশতা লাগে।
একথার কোনো ভিত্তি নেই। একটি ভাত বা চাল তৈরি হতে কতজন ফিরিশতা লাগে তা একমাত্র আল্লাহই জানেন। এটি অদৃশ্য জগতের বিষয়। তবে একটি ভাতের দানা আমার পর্যন্ত আসতে যে অনেক মানুষের শ্রম আছে এবং মাটি, পানি, চন্দ্র-সূর্য ইত্যাদিকে আল্লাহ তাআলা এ উদ্দেশ্যে ও এমন অনেক উদ্দেশ্যে আমাদের খেদমতে নিয়োজিত করেছেন তা কারই বা অজানা। সুতরাং একটি ভাতের দানা হোক বা যে কোনো খাদ্যদ্রব্য হোক, নষ্ট বা অপচয় করার কোনো অবকাশ নেই। এর জন্য আল্লাহর কাছে হিসাব দিতে হবে।
খাদ্য আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। এর শুকরিয়া আদায় করা এবং অপচয় থেকে বিরত থাকা জরুরি। কখনো যেন এমন না হয় যে, আমি খাচ্ছি, কিন্তু না খাওয়ার শুরুতে আল্লাহর নাম নিলাম, না শেষে শুকরিয়া আদায় করলাম।
http://www.alkawsar.com/article/1281
রবিউল আউয়াল ১৪৩৬ . জানুয়ারি ২০১৫
চলতি সংখ্যা . বর্ষ: ১১ . সংখ্যা: ০১
একটি ভুল ধারণা : কলা কি হাত দিয়ে ভেঙে ভেঙে খাওয়া সুন্নত বা না খাওয়া কি আদব পরিপন্থী?
কিছু মানুষ মনে করে কলা সরাসরি মুখ দিয়ে কামড়ে খেতে হয় না; এটা আদবের খেলাফ। বরং হাত দিয়ে ভেঙে ভেঙে মুখে দিতে হয়। এবং এটাকে কেউ কেউ কলা খাওয়ার সুন্নত পদ্ধতিও মনে করে।
এটি মূলত একটি ভুল ধারণা। কলা খাওয়ার বিশেষ কোনো পদ্ধতির কথা হাদীসে পাওয়া যায় না। যার যেভাবে খাওয়া সুবিধা সেভাবেই খেতে পারে। কলা বড় হওয়ার কারণে অনেক সময় ভেঙে ভেঙে খেতে সুবিধা হয়, তখন ভেঙে ভেঙে খাবে। আর চাইলে স্বাভাবিকভাবেও খেতে পারবে এতে আদবের খেলাফ বা দোষের কিছু নেই।
একটি ভুল বিশ্বাস : চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণের সময় গর্ভবতী মহিলা কিছু কাটলে কি গর্ভের সন্তানের ক্ষতি হয়?
কিছু মানুষ মনে করেন, চন্দ্র বা সূর্য গ্রহণের সময় যদি গর্ভবতী মহিলা কিছু কাটাকাটি করেন, তাহলে গর্ভস্থ সন্তানের ক্ষতি হয়। কানকাটা বা ঠোটকাটা অবস্থায় জন্ম নেয়।
এটি একটি ভুল বিশ্বাস। বাস্তবতার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। শরীয়তে যেমন এর কোনো ভিত্তি নেই তেমনি বিবেক-বুদ্ধিও এ ধরনের অলীক ধারণা সমর্থন করে না। অতএব এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
একটি ভিত্তিহীন ঘটনা : নূহ আলাইহিস সালামের কিশতিতে মলত্যাগের ঘটনা
নূহ আ.-এর প্লাবন ও তাঁর কিশতির বিষয় কুরআন মাজীদের বিভিন্ন স্থানে বর্ণিত হয়েছে, যা কমবেশি সকলেরই জানা আছে। কিন্তু এর সাথে সাথে এ বিষয়ে সমাজে বিভিন্ন কল্পকাহিনীও প্রচলিত আছে।
এবিষয়ের একটি ঘটনা হল, আল্লাহ তাআলার আদেশে নূহ আ. যখন কিশতি বানালেন তখন তার কওম তা নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করতে লাগল। একপর্যায়ে তারা কিশতিতে মলত্যাগ করতে শুরু করল। একদিন এক কুষ্ঠরোগী তাতে মলত্যাগ করতে গিয়ে ময়লার মধ্যে পড়ে গেল এবং তার কুষ্ঠরোগ ভাল হয়ে গেল। এ ঘটনা যখন এলাকায় জানাজানি হয়ে গেল তখন লোকেরা এসে কিশতি থেকে ময়লা (মল) সংগ্রহ করে তাদের রুগিদের ভাল করতে লাগল, এমনকি তারা শেষপর্যায়ে গিয়ে কিশতি ধুয়ে ধুয়ে এর পানি সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে লাগল- এভাবে কিশতি পরিষ্কার হয়ে গেল।
আগেই বলা হয়েছে, এই ঘটনাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এর কোনো সহীহ সূত্র ও নির্ভরযোগ্য কোনো উদ্ধৃতিও নেই। এটি সম্পূর্ণ মনগড়া একটি কাহিনী। সুতরাং তা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকা জরুরি।
আরেকটি ভিত্তিহীন ঘটনা : নূহ আ.-এর প্লাবন ও বুড়ির ঘটনা
উপরের ঘটনার মত নূহ আ.-এর প্লাবন কেন্দ্রিক আরেকটি ঘটনাও সমাজে প্রচলিত আছে। নূহ আ.-এর প্লাবনের পূর্বক্ষণে এক বুড়ি নূহ আ.-কে বলল, নূহ! প্লাবনের পূর্বে আমাকে তোমার কিশতিতে নিয়ে যেও। কিন্তু নূহ আ. ঐ মুহূর্তে বুড়ির কথা ভুলে যান। আর আল্লাহর কুদরতে বুড়ি প্লাবন টেরই পায় না।
প্লাবন শেষে নূহ আ.-এর সাথে দেখা হলে বুড়ি বলল, নূহ! কী ব্যাপার তোমার প্লাবন কবে আসবে? এবার নূহ আ.-এর মনে পড়ে গেল, বুড়ি তো তাকে নিয়ে যেতে বলেছিল, কিন্তু সে সময় তো বুড়ির কথা তার মনেই ছিল না। তখন নূহ আ. তাকে বলেন, প্লাবন তো হয়ে গেছে। তখন বুড়ি বলল, কবে প্লাবন হল, আমি তো কিছু টেরই পেলাম না! নূহ আ. বললেন, আল্লাহ তাঁর কুদরতে আপনাকে বাঁচিয়েছেন।আগের ঘটনার মত এঘটনাটিও বানোয়াট ও ভিত্তিহীন।
সফর ১৪৩৬ . ডিসেম্বর ২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ১১
একটি ভুল উচ্চারণ : এস্তেমা বা ইস্তেমা
ইজতেমা। এটি আরবী اجتماع শব্দের বাংলা উচ্চারণ। অনেক মানুষকে দেখা যায় তারা ইজতেমা-কে এস্তেমা বা ইস্তেমা উচ্চারণ করেন বা লেখেন। এটি ভুল উচ্চারণ। সঠিক উচ্চারণ হল, ইজতেমা বা ইজতিমা।
ইজতেমা অর্থ সমবেত হওয়া। আর ইস্তেমা অর্থ হল, মনোযোগ সহকারে শোনা। http://www.alkawsar.com/article/1235
আরেকটি ভুল উচ্চারণ : মুআজ্জিম বা মুআজ্জেম
যিনি আযান দেন তাকে মুআয্যিন বলে। কিন্তু কিছু মানুষ এ শব্দটি উচ্চারণ করেন এভাবে -‘মুআজ্জিম’ শেষে ‘ম’ (আরবীতে ‘মীম’) দিয়ে। এটি এ শব্দের ভুল উচ্চারণ। সঠিক উচ্চারণ হল, ‘মুআয্যিন’।
আযান শব্দ থেকেই মুআয্যিন শব্দটি এসেছে। আযান শব্দটির শেষে যেমন ‘ন’ (আরবীতে ‘নূন’) তেমনি মুআয্যিন শব্দের শেষেও ‘ন’ (আরবীতে ‘নূন’) হবে। সুতরাং মুআজ্জিম না বলে বলতে হবে মুআয্যিন।
একটি ভিত্তিহীন ঘটনা : হাসান বসরীর পানির উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়া এবং রাবেয়া বসরীর শূন্যের উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়া।
রাবেয়া বসরী (হবে রাবেয়া বসরিয়্যাহ্) দ্বিতীয় হিজরী শতকের একজন প্রসিদ্ধ আবেদা নারী ছিলেন। ইমাম যাহাবী রাহ.-এর সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা, ইবনে খাল্লিকান রাহ.-এর অফাইয়াতুল আ‘ইয়ান, শা‘রানী রাহ.-এর আততাবাকাতুল কুবরাসহ আরো বিভিন্ন জীবনীগ্রন্থে তাঁর জীবনী সন্নিবেশিত হয়েছে। তাঁর বিষয়ে সমাজে বিভিন্ন বানোয়াট কিচ্ছা-কাহিনী প্রচলিত আছে।
তাঁর ও প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হাসান বসরী রাহ.-এর বিষয়ে একটি কাহিনী অনেককে বলতে শোনা যায়-
একবার হাসান বসরী রাহ. পানির উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়লেন। রাবেয়া বসরিয়্যাহ্ একথা জানতে পারলেন এবং তিনি শূন্যের উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়লেন। হাসান বসরী রাহ. যখন একথা জানতে পারলেন তখন বললেন, রাবেয়ার মাকাম আমার অনেক উপরে।
এ কিচ্ছার কোনোই ভিত্তি নেই। এটি একেবারেই কল্পনাপ্রসূত একটি কাহিনী, বাস্তবতার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। নির্ভরযোগ্য কোনো ইতিহাসগ্রন্থ বা রাবেয়া বসরিয়্যাহ-এর উপর রচিত কোনো নির্ভরযোগ্য জীবনীগ্রন্থে এ ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় না।
তাঁরা কত বড় বুযুর্গ ছিলেন একথা বুঝাতেই এজাতীয় কিচ্ছা-কাহিনীর অবতারণা করা হয়।
তাঁরা অনেক বড় মাপের বুযুর্গ ছিলেন, একথা স্বীকৃত। তাঁরা যুহ্দ ও তাকওয়ায়, দুনিয়াবিমুখতা ও খোদাভীতিতে অনেক অগ্রগামী ছিলেন। কিন্তু এধরনের কাহিনী দিয়ে তাদের বুযুর্গি প্রমাণ করার কী দরকার হয়ে পড়ল? আর এসবের সাথে বুযুর্গিরই বা কী সম্পর্ক?
আর আল্লাহর ওলীদের থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারামত প্রকাশিত হয় একথা স্বীকৃত। সাথে সাথে একথাও স্বীকৃত যে, কারামতের সাথে বুযুর্গির কোনো সম্পর্ক নেই। বুযুর্গি ও আল্লাহর প্রিয়পাত্র হওয়ার মাপকাঠি হল, তাকওয়া তথা আল্লাহর ভয় ও সুন্নত অনুযায়ী জীবন যাপন করা।
আর বানোয়াট এঘটনায় আরেকটি দিক দেখা যাচ্ছে। তা হল, একজন পানির উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়ছেন তা শুনে অপরজন শূন্যের উপর জায়নামায বিছিয়ে নামায পড়ছেন; যেন বুযুর্গির পাল্লা চলছে! আল্লাহওয়ালারা নিজেদেরকে আড়াল করতে চান। আর তাঁদের মত অনুসরণীয় বুযুর্গরা যেন নিজেদের বুযুর্গির প্রদর্শন করছেন। নাউযুবিল্লাহ। এটা তাদের ব্যাপারে মস্তবড় অপবাদও বটে!
আরেকটি বিষয় হল, হাসান বসরী রাহ. ইন্তেকাল করেছেন ১১০ হিজরীতে। আর রাবেয়া বসরীর জন্মই হয়েছে ৯৯ অথবা ১০০ হিজরীতে। অর্থাৎ হাসান বসরী রাহ.-এর ইন্তেকালের সময় রাবেয়া বসরিয়্যাহ রাহ.-এর বয়স ছিল সর্বোচ্চ ১১/১২ বছর। সিয়ারু আ‘লামিন নুবালায় (৮/২৪১) যাহাবী রাহ. বলেন, রাবেয়া বসরীয়্যাহ ১৮০ হিজরীতে ইন্তিকাল করেছেন। কথিত আছে, তিনি আশি বছর হায়াত পেয়েছেন। সুতরাং এ বিষয়টিও এঘটনার অসারতা প্রমাণ করে।
একটি ভুল মাসআলা : নাপাকি লাগলে কি কাপড়ের কোণা ধুলেই চলবে?
কোনো কোনো মানুষ মনে করেন, কাপড়ে নাপাকি লাগলে বা নাপাকির ছিটা লাগলে কাপড়ের এক কোণা ধুলেই পবিত্র হয়ে যাবে। তাদের এ ধারণা ঠিক নয়। বরং কাপড়ের যে অংশে নাপাকি লেগেছে সে অংশই ধুতে হবে। নইলে কাপড় পবিত্র হবে না।
http://www.alkawsar.com/article/1233
http://www.alkawsar.com/article/1233
একটি ভিত্তিহীন বর্ণনা : সিদরাতুল মুনতাহার পাতা ও মানুষের জন্ম-মৃত্যু
লোকমুখে প্রসিদ্ধ, মানুষ জন্ম নিলে নাকি সিদরাতুল মুনতাহা গাছটিতে একটি পাতা গজায়। আবার মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এলে ঐ পাতাটি ঝরে পড়ে। তা দেখে ফিরিশতা বুঝতে পারেন যে এই ব্যক্তির মৃত্যুর সময় ঘনিয়ে এসেছে।
এটি একটি ভিত্তিহীন বর্ণনা। হাদীসের নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থে এ বর্ণনা আমরা পাইনি।
http://www.alkawsar.com/article/1232
http://www.alkawsar.com/article/1232
মুহাররম ১৪৩৬ . নভেম্বর ২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ১০
একটি নামের ভুল : ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহ
অনেক দ্বীনদার মানুষই ইবনুল কায়্যিম রাহ.-এর নাম শুনেছেন। তাঁর নাম, মুহাম্মাদ ইবনে আবু বকর। উপাধী, শামসুদ্দীন। (সংক্ষেপে) ইবনুল কায়্যিম নামেই তিনি প্রসিদ্ধ। তিনি ৬৯১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন এবং তাঁর ইমেত্মকাল হয় ৭৫১ হিজরীতে। অনেকেই তাঁর প্রসিদ্ধ কিতাব যাদুল মাআদ-এর নাম শুনে থাকবেন। তাঁকে ‘ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহ’ও বলা হয়।
কিন্তু কিছু মানুষ তাঁকে ‘ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহ’-এর স্থলে ‘ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহ’ বলে বা লিখে থাকেন । এটা ভুল। হয়ত বলতে হবে, ‘ইবনুল কায়্যিম’ অথবা ‘ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহ’।
তাঁর পিতা দামেস্কের ‘আলমাদরাসাতুল জাওযিয়্যাহ’-এর কায়্যিম (তত্ত্বাবধায়ক, দায়িত্বশীল) ছিলেন। একারণে তাঁকে ‘কায়্যিমুল জাওযিয়্যাহ’ (জাওযিয়্যাহ মাদরাসার কায়্যিম বা তত্ত্বাবধায়ক) বলা হত। সে হিসেবে তাঁর সন্তানকে ‘ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহ’ (কায়্যিমুল জাওযিয়্যার ছেলে, জাওযিয়্যাহ মাদরাসার তত্ত্বাবধায়কের ছেলে) বলা হয়।
কিন্তু অনেকেই ‘জাওযিয়্যাহ’কে তার নিসবতি নাম (এলাকা, বংশ বা পেশা ইত্যাদীর সাথে সম্পর্কযুক্ত নাম) মনে করেন। তারা ভাবেন না যে, সে ক্ষেত্রে ‘জাওযিয়্যাহ’ (মুআন্নাছ) না হয়ে ‘জাওযী’ (মুযাক্কার) হওয়া দরকার ছিল। যেমন, আবুল ফারাজ ইবনুল জাওযী। সম্ভবত তারা ‘ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহ’-এর শেষ অংশ (জাওযিয়্যাহ)-কে ‘ইবনুল জাওযী‘ রাহ.-এর নামের ‘জাওযী’-এর মত নিসবতি নাম মনে করেন। যা নিতান্তই ভুল ধারণা।
যাহোক, হয়ত বলতে হবে, ‘ইবনুল কায়্যিম’ অথবা বলতে হবে ‘ইবনু কায়্যিমিল জাওযিয়্যাহ’। ‘ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যাহ’ ভুল।
http://www.alkawsar.com/article/1216
http://www.alkawsar.com/section/wrong-practice?page=1 (all above)
http://www.alkawsar.com/section/wrong-practice?page=1 (all above)
একটি ভুল ধারণা : শুকরের নাম মুখে নিলে কি চল্লিশদিন মুখ নাপাক থাকে?
অনেক মানুষকে বলতে শোনা যায়, ‘শুকর’-এর নাম উচ্চারণ করলে চল্লিশদিন মুখ নাপাক থাকে; শুকুর না বলে ‘খিনযীর’ বলতে হবে। একথাটি একেবারেই অমূলক।
শুকরকে আল্লাহ তাআলা হারাম করেছেন, আর হারাম বস্তুর প্রতি ঘৃণা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে শুকরের নাম মুখে উচ্চারণ করলেও মুখ নাপাক হয়ে যাবে -একথার কোনো ভিত্তি নেই।
এরপর শুকর বাংলা শব্দ, এর আরবী হল খিনযীর। একই প্রাণীর নাম বাংলায় উচ্চারণ করলে মুখ নাপাক হবে আর আরবীতে উচ্চারণ করলে নাপাক হবে না এরই বা কী অর্থ? আল্লাহ আমাদের অমূলক কথা বলা থেকে হেফাযত করুন।
একটি বাতিল বর্ণনা : আল্লাহ সুস্থতার নিআমত চাইতেন (নাউযুবিল্লাহ)
মূসা আ. ও আল্লাহর মাঝে কথোপকথন হয়েছে এটা কুরআন দ্বারা স্বীকৃত। এজন্য মূসা আ.-কে মূসা কালিমুল্লাহ বলা হয়। এটাকেই পুঁজি করে এক শ্রেণীর কাহিনীকার ‘মূসা আ. ও আল্লাহর মাঝে কথোপকথন’ শিরোনামে সমাজে বহু আজগুবি ঘটনা বলে থাকে, যা ওয়াজের মাঠ গরম করে ঠিকই কিন্তু সেগুলোর কোনো ভিত্তি নেই।
এগুলোর মধ্যে প্রসিদ্ধ একটি কথোপকথন হল সুস্থতার নিআমত বিষয়ে। ‘‘মূসা আ. আল্লাহকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহ! আপনি যদি মূসা হতেন আর আমি যদি আল্লাহ হতাম তাহলে আপনি কী চাইতেন? আল্লাহ বললেন, এটা আমার শান না। মূসা বললেন, তা তো জানি, কিন্তু হলে কী চাইতেন। তখন আল্লাহ বলেন, সুস্থতা চাইতাম।’’
সুস্থতা কত বড় নিআমত একথা বোঝাতে এই বানোয়াট কিচ্ছা বলা হয়, যার সাথে মূসা আ.-এর কোনোই সম্পর্ক নেই।
এমন কথোপকথনের অর্থ দাঁড়ায় মূসা আ. আল্লাহর সাথে মশকরা করছেন। (নাউযুবিল্লাহ) যা একজন নবীর জন্য কখনোই শোভন নয়। একজন নবীর শানে এধরনের কথা বলা বড়ই বেআদবী ও গর্হিত কাজ, যা থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
সুস্থতার নিআমতের ব্যাপারে তো হাদীস শরীফে কত সুন্দর সুন্দর কথা এসেছে সেগুলোই বলা উচিত।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,
نِعْمَتَانِ مَغْبُونٌ فِيهِمَا كَثِيرٌ مِنَ النَّاسِ: الصِّحَّةُ وَالْفَرَاغُ
‘‘দুটি নিআমতের ব্যাপারে মানুষ বড়ই ক্ষতির মধ্যে (লসের মধ্যে) রয়েছে। একটি হল, সুস্থতা, অপরটি হল, অবসর। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৪১২)
সুস্থতা ও অবসরকে মানুষ যথাযথ কাজে লাগায় না। যখন অসুস্থ হয় বা ব্যস্ততা বেড়ে যায় তখন বলে, এখন আমি সুস্থ থাকলে বা আমার অবসর থাকলে অমুক ভাল কাজ করতাম। অথবা বলে, সুস্থ হলে বা অবসর পেলে অমুক ভাল কাজ করব। অথচ আগের সুস্থতার সময় বা অবসর সময়কে সে হেলায় নষ্ট করেছে। এদিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে হাদীস শরীফে।
সুতরাং সহীহ বর্ণনা থাকতে ভিত্তিহীন কথা বলা মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। আমরা তা থেকে বিরত থাকব এবং যাচাই বাছাই ছাড়া কিছু বলব না এবং কোনো কিছু শোনামাত্রই বলে বেড়াব না।
http://www.alkawsar.com/article/1214
http://www.alkawsar.com/article/1214
যিলহজ্ব ১৪৩৫ . অক্টোবর ২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ০৯
একটি ভুল আমল : মাসবুক ব্যক্তি ভুলে দুই দিকে সালাম ফিরিয়ে ফেললে কি নামায বাতিল হয়ে যায়?
অনেক মানুষকে দেখা যায়, মাসবুক অবস্থায় যদি ইমামের সাথে দুই দিকে সালাম ফিরিয়ে ফেলে তাহলে মনে করে যে তার নামায বাতিল হয়ে গিয়েছে। ফলে আবার নতুন করে শুরু থেকে নামায পড়ে।
এ আমলটি ভুল। মাসআলা না জানার কারণেই হয়তো তারা এমনটি করেন। এক্ষেত্রে নিয়ম হল, দুই দিকে সালাম ফিরিয়ে ফেললেও, যদি নামায ভেঙে যায় এমন কোনো কাজ না করা হয় তাহলে উঠে যাবে এবং বাকী রাকাত আদায় করবে। শেষে সাহু সিজদা আদায় করবে।
আর একথা তো সবারই জানা যে, মাসবুক ব্যক্তি ইমামের সাথে সালাম ফেরাবে না। বরং ইমামের দুই দিকে সালাম ফেরানো হলে উঠে বাকী রাকাত আদায় করবে।
আল্লাহ আমাদের সঠিকভাবে মাসআলা জেনে আমল করার তাওফীক দান করুন। -আবু আহমাদ
একটি ভিত্তিহীন ঘটনা : ওয়ায়েস করনীর দাঁত ভাঙার গল্প
ওয়ায়েস করনীর দাঁত ভাঙার গল্প লোকমুখে খুবই প্রসিদ্ধ। ঘটনাটি নিমণরূপ- ওহুদ যুদ্ধে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানদান মোবারক শহীদ হল তখন ওয়ায়েস করনী বিষয়টি জানতে পারলেন এবং যারপরনাই ব্যাথিত হলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা ছিল। এ ঘটনা শুনে তিনি স্থির থাকতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাঁত মোবারক যখন শহীদ হয়েছে তো আমার এ দাঁতের কী অর্থ! তিনি নিজের একটি দাঁত ভেঙে ফেললেন। পরক্ষণে চিন্তা করলেন, আমি যে দাঁত ভেঙেছি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হয়ত এ দাঁত ভাঙেনি অন্য দাঁত। তাই ভেবে তিনি নিজের আরেকটি দাঁত ভেঙে ফেললেন। এভাবে তিনি নিজের সবগুলো দাঁত ভেঙে ফেললেন।
নবীজীর প্রতি উম্মতের ভালবাসা প্রকাশের চূড়ান্ত নযীর হিসেবে বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে এ ঘটনা বলে থাকেন। কিন্তু এ ঘটনার কোনোই ভিত্তি নেই। মোল্লা আলী কারী রাহ. বলেন, এ ঘটনা প্রমাণিত নয়। (দ্র. আলমা‘দিনুল আদানী, আলবুরহানুল জালি ফী তাহকীকি ইনতিসাবিস সুফিয়্যাতি ইলা আলী, পৃ. ১৬৪-১৬৫) ওয়ায়েস করনী (উয়াইস আলকারানী) একজন বড় মাপের তাবেয়ী ও বুযুর্গ ছিলেন। ইয়ামানের অধিবাসী ছিলেন। তিনি ৩৭ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যুগের হওয়া সত্ত্বেও তাঁর সাথে সাক্ষাতের সুযোগ তার হয়নি। কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা ছিল। তার বৃদ্ধা মা ছিলেন। মায়ের সাথে তিনি সদাচরণ করতেন। মায়ের সেবাযত্ন করতেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে চিনতেন। হাদীস শরীফে এসেছে, ওমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ইয়ামান থেকে উয়াইস নামে এক ব্যক্তি তোমাদের কাছে আসবে। ইয়ামানে মা ছাড়া তার আর কেউ নেই। তার শ্বেত রোগ ছিল । সে আল্লাহর কাছে দুআ করলে আল্লাহ তার রোগ ভাল করে দেন, কিন্তু তার শরীরের একটি স্থানে এক দিনার অথবা এক দিরহাম পরিমাণ স্থান সাদাই থেকে যায়। তোমাদের কেউ যদি তার সাক্ষাৎ পায় সে যেন তাকে নিজের জন্য ইস্তেগফার করতে বলে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৪২
ওয়ায়েস করনীর সাথে সাহাবীদের সাক্ষাতের ঘটনাও হাদীস শরীফে এসেছে। কিন্তু কোথাও এমন কিচ্ছার কথা নেই। সহীহ মুসলিমে এসেছে, ওমর রা.-এর সাথে ওয়ায়েস করনীর সাক্ষাত হলে তাকে সনাক্ত করার জন্য তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বলে দেয়া সব আলামত জিজ্ঞাসা করেন। এ বর্ণনায় আছে ওমর রা. নবীজীর কথা অনুযায়ী তাকে নিজের জন্য ইস্তিগফার করতে বলেন, তিনি ওমর রা.-এর জন্য ইস্তিগফার করেন। পরবর্তী বছর হজ্বের মৌসুমে ওয়ায়েস করনী যে এলাকায় বসবাস করছিলেন সেখান থেকে এক ব্যক্তি এলে ওমর রা. তার (ওয়ায়েস করনীর) খোঁজ খবর নেন। (দ্র. সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৪২)
যিলক্বদ ১৪৩৫ . সেপ্টেম্বর ২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ০৮
একটি ভুল চিন্তা : আমরা ইবাদত করলে কি আল্লাহর লাভ?!
এক ভাইয়ের আববা খুব অসুস্থ। তাকে আইসিইউ-তে ভর্তি করা হয়েছে। অক্সিজেনের সাহায্যে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে হচ্ছে। তো তার আববাকে দেখতে গিয়ে তার সাথে কথা চলছিল যে, সুস্থতা আল্লাহ তাআলার অনেক বড় নিআমত। এ নিআমতের উপর বেশি বেশি শুকরিয়া আদায় করা দরকার। তখন সে এক পর্যায়ে বলে বসল, আমরা সুস্থ থাকলে তো আল্লাহরই লাভ; তখন আমরা আল্লাহর ইবাদত করতে পারব।
(আরো কোনো কোনো মানুষকে এজাতীয় বাক্য বলতে শুনেছি।) এটি একটি ভুল চিন্তা, যা ব্যক্তির অজ্ঞতার কারণেই মনে এসে থাকে। আমাদের ইবাদতের সাথে আল্লাহর লাভ ক্ষতির কী সম্পর্ক? আমরা কোনো নেক আমল করলে তার কল্যাণ ও সওয়াব আমরাই লাভ করব। আর আমাদের নাফরমানীর অকল্যাণ ও আপদ আমাদের উপরেই বর্তাবে। আমাদের ইবাদত করা না করা আল্লাহর রাজত্বে সামান্য হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটাবে না। আল্লাহ আমাদের ইবাদতের মুখাপেক্ষী নন। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,‘‘...তোমাদের শুরু থেকে শেষ সকলেই যদি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী (পরহেযগার) ব্যক্তির মত হয়ে যায় তাহলে তা আমার রাজত্বে সামান্য বৃদ্ধিও ঘটাবে না। তেমনিভাবে তোমাদের শুরু থেকে শেষ সকলেই যদি তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে পাপিষ্ঠ ব্যক্তির মত হয়ে যায় তাহলে তা আমার রাজত্বে সামান্য হ্রাস ঘটাবে না।...’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৫৭৭)
কিছু মরুবাসী মনে করছিল, ইসলাম গ্রহণ করে তারা (আল্লাহর উপর) আল্লাহর নবীর উপর অনুগ্রহ করে ফেলেছে। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের উদ্দেশে বললেন, (তরজমা) ‘‘তারা ইসলাম গ্রহণ করে তোমাকে ধন্য করেছে মনে করে। আপনি বলুন, তোমাদের ইসলাম গ্রহণ আমাকে ধন্য করেছে মনে করো না; বরং আল্লাহই ঈমানের দিকে পরিচালিত করে তোমাদের ধন্য করেছেন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও।’’ (সূরা হুজুরাত ৪৯: ১৭)
সুতরাং আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক থাকব, যেন এজাতীয় কথা বা চিন্তা থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি। আল্লাহই তাওফীক দাতা।
একটি ভুল ভাবনা : বাসন চেটে খেলে কি কন্যা সন্তান হয়?
এক ভাইকে বাসন চেটে খাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হলে সে বলল, ‘প্লেট চেটে খেলে তো কন্যা সন্তান হয়’। আরেকজন মন্তব্য করলেন, চেটে খাওয়া তো অভদ্রতা ও দারিদ্রে্যর আলামত। (নাউযুবিল্লাহ)
ধারণা দুটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, অর্থহীন ও নিতামত্মই মূর্খতা। দ্বীনী বিষয়ে গাফলত ও অজ্ঞতার কারণেই যে এ ধরনের কথাবার্তা মানুষ বলে থাকে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা সন্তান দেওয়া না দেওয়া বা কাউকে ছেলে সন্তান দেয়া, কাউকে মেয়ে সন্তান দেয়া তো সম্পূর্ণ আল্লাহ তাআলার ইচ্ছাধীন। বাসন চেটে খাওয়ার সাথে এর কী সম্পর্ক? আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) ‘‘আসমান যমীনের রাজত্ব আল্লাহ্রই; তিনি যা চান সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র দেন। অথবা তাদেরকে পুত্র-কন্যা উভয়ই দান করেন। আবার যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। তিনি সবকিছুই জানেন, সব কিছুই করতে পারেন।’’ -সূরা শুরা ৪২ : ৪৯-৫০ এ ধরনের ধারণার আরেকটি বাজে দিক হলো, তাতে জাহেলী যুগের দুর্গন্ধ প্রকাশ পাচ্ছে। জাহেলী যুগে কন্যা সন্তানের কথা শুনলেই মানুষের মুখ কালো হয়ে যেত। (সূরা নহল ১৬ : ৫৮) আল্লাহ তো কন্যা সন্তানের সংবাদকে ‘সুসংবাদ’ বলে ব্যক্ত করেছেন।
আর সম্ভবত দ্বিতীয় মন্তব্যটি ঐ ভদ্রলোক এজন্য করেছেন যে, তার জানা নেই; বাসন চেটে খাওয়া রাসূলের সুন্নত। কারণ যার হৃদয়ে তিল পরিমাণ ঈমান আছে, বিষয়টি সুন্নত জানার পরও সে ব্যক্তি এ ধরনের মন্তব্য করতে পারে না। কোন্টা ভদ্রতা ও আদব-কায়দা আর কোন্টা অভদ্রতা ও বেআদবী তা তো রাসূলের কাছ থেকেই শিখতে হবে।
হযরত আনাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, যখন তোমাদের কেউ খানা খাবে সে যেন তার আঙ্গুল চেটে খায়। আর লোকমা (খাদ্যদ্রব্য) পড়ে গেলে সে যেন ময়লা দূর করে খেয়ে নেয় এবং শয়তানের জন্য তা রেখে না দেয়। সাথে সাথে তিনি আমাদেরকে পাত্র চেটে খাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, কারণ, তোমাদের জানা নেই খাদ্যের কোন্ অংশে বরকত রয়েছে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৩৬; জামে তিরমিযী, হাদীস ১৮০৩
আল্লাহ আমাদের সকলকে সহীহ ইলম ও সমঝ দান করুন। আমীন
একটি ভুল ধারণা : পাত্রে দু’বার খানা তুলে না দিলে কি আহারগ্রহণকারী ব্যক্তি পানিতে পড়ে মারা যায়?
কোথাও দেখা যায়, আহারগ্রহণকারীর পাত্রে এক চামচ খাবার তুলে দেয়ার পর তিনি যদি আর নিতে নাও চান তবুও জোর করে অল্প হলেও আরেক চামচ দেয়া হয় এবং সাথে এ কথাও বলা হয়, ‘একবার দিতে নাই, অন্যথায় তুমি পানিতে পড়ে মারা যাবে।’
প্রশ্ন হলো, পাত্রে একবার বা দুইবার খানা তুলে দেয়ার সাথে মৃত্যুর স্থানের কি সম্পর্ক? কে কোথায় মারা যাবে তার প্রকৃত জ্ঞান তো একমাত্র আলিমুল গায়ব আল্লাহর কাছে-ই আছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আর কোনো প্রাণ জানে না যে, সে কোথায় মারা যাবে।’ -সূরা লুকমান ৩১ : ৩৪
অবশ্য পাত্রে দু’বার না দিলে পানিতে পড়ে যাবে এ ধরনের ভ্রান্ত চিন্তা বাদ দিয়ে কেউ যদি মেহমানদারির খাতিরে একাধিকবার খাবার তুলে দিতে চায় তাতে কোনো সমস্যা নেই। তবে এ ক্ষেত্রেও কৃত্রিমতা পরিহার করে আহার গ্রহণকারী ব্যক্তির রুচি ও চাহিদার প্রতি খেয়াল রাখা উচিত।
শাওয়াল ১৪৩৫ . আগস্ট ২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ০৭
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ০৭
এটি হাদীস নয় : শবে বরাতে হালুয়া-রুটি বানালে আরশের নিচে ছায়া পাবে
একটি গ্রামের মহিলাদের প্রায় সকলকেই বলতে শোনা গেছে, ‘শবে বরাতে হালুয়া-রুটি বানালে আরশের নিচে ছায়া পাওয়া যাবে।’ এটিকে রাসূলের হাদীস হিসেবেই বলা হয়েছে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীসের সাথে এর দূরতম সম্পর্কও নেই।
এটি এমন একটি ভিত্তিহীন কথা যার জাল হওয়ার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি জাল হাদীসের উপর লেখা কিতাবাদিতেও এর কোনো খোঁজ পাওয়া যায় না।
কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, ওহুদ যুদ্ধে যখন নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দানদান মোবরক শহীদ হয়েছিল, তখন কিছুদিন কোনো প্রকার শক্ত খাবার খেতে পারতেন না। সেই ঘটনার প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এই দিনে ঘটা করে হালুয়া রুটি খাওয়া হয়। কিন্তু ওহুদ যুদ্ধ তো শাবান মাসের ১৫ তারিখে হয়নি তা হয়েছে শাওয়ালের ৭ তারিখে। সুতরাং যদি সে কেন্দ্রিক কোনো বিষয় থাকত তাহলে তা শাওয়াল মাসের ৭ তারিখে থাকত শাবানের ১৫ তারিখে নয়।
শাবানের পনের তারিখের রাতের ফযীলত সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। (এ রাতের ফযীলত বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন, আলকাউসারের সেপ্টেম্বর ২০০৫ সংখ্যায় ‘‘বাড়াবাড়ি ও ছাড়াছাড়ির কবলে শাবান শবে বরাত’’ শিরোনামে) হাদীস শরীফে এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে (শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন। (সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫৬৬৫; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ৩৮৩৩) কিন্তু এই রাতের সাথে হালুয়া-রুটির কী সম্পর্ক?
এ রাতের যতটুকু ফযীলত প্রমাণিত আছে শুধু ততটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। রসম-রেওয়াযের পিছে পড়ে এর মূল ফযীলত থেকে বঞ্চিত হওয়া ঠিক নয়।
আর আলোচ্য বিষয়টি মূলত এই রাতের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন রসমের অন্যতম, যার কোনো ভিত্তি নেই। এ ধরণের কাজ এবং এ রাত কেন্দ্রিক আরো যত রসম-রেওয়ায আছে এগুলে থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
আর এ ধরনের ভিত্তিহীন কথাকে রাসূলের হাদীস হিসেবে বলা অনেক মারাত্নক গুনাহের কাজ। আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন। দ্বীনের সকল বিষয়ে সহীহ কথা ও সহীহ কাজ করার তাওফিক দিন।
আরেকটি ভিত্তিহীন রেওয়ায়েত : শবে বরাতের রাতের গোসল
শাবানের ১৫ তারিখের রাতের বিষয়ে আরেকটি ভিত্তিহীন বর্ণনা সমাজে প্রচলিত আছে। সেটি শবে বরাতের রাতের গোসল কেন্দ্রিক। এই রাতে ইবাদতের উদ্দেশে যদি কেউ গোসল করে তাহলে তার গোসলের প্রতি ফোটার বিনিময়ে গুনাহ মাফ হবে। আবার কেউ কেউ বর্ণনাটি এভাবে বলে যে, প্রতি ফোটায় ৭০ রাকাত নফল নামাযের সওয়াব হবে।
তো যে যেভাবেই বলুক, এটি যে একটি জাল বর্ণনা বা ভিত্তিহীন কথা তা বলাই বাহুল্য। আল্লাহ আমাদের এ ধরনের জাল বর্ণনা ও ভিত্তিহীন কথা থেকে হেফাজত করুন এবং ফযীলতের প্রতিটি বিষয়কে তার গরি মধ্যে রেখে তাকে কাজে লাগানোর তাওফিক দিন। আমীন
একটি ভুল উচ্চারণ : সালামের জবাবে ‘অলাইকুম সালাম’
আমাদের অনেকেরই সালাম দিতে গিয়ে বা সালামের উত্তর দিতে গিয়ে অজান্তেই ভুল হয়ে যায়। ইতিপূর্বে (এপ্রিল ২০০৫) সালামের বিভিন্ন ভুল নিয়ে লেখা হয়েছিল। সেখানে সালাম দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের অনেকের উচ্চারণে যে বিভিন্ন ভুল হয়ে থাকে সে বিষয়ে লেখা হয়েছিল। আজ সালামের জবাব দেয়ার ক্ষেত্রে উচ্চারণে যে ভুল লক্ষ্য করা যায় সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সালাম একটি দুআ। ইসলামের শেআর ও প্রতিক পর্যায়ের একটি আমল। এর সহীহ উচ্চারণের প্রতি গুরুত্ব দেয়া জরুরি। কমপক্ষে এতটুকু বিশুদ্ধ উচ্চারণ অবশ্যই জরুরি, যার দ্বারা অর্থ ঠিক থাকে।
وَعَلَيْكُمُ السَّلَامُ وَرَحْمَةُ اللهِ وَبَرَكَاتُهُ
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম, ওয়া রাহমাতুল্লাহি, ওয়া বারাকাতুহু’
আরবী দেখে এর সহীহ উচ্চারণ শিখে নেয়া উচিত অন্যথায় ন্ঠ বাদ পড়ে যায়- ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম’-এর স্থলে ‘অলাইকুম...’ হয়ে যায়, যা স্পষ্ট ভুল। (দ্র. বাংলায় আরবীর পুরোপুরি সহীহ উচ্চারণ ব্যক্ত করা সম্ভব নয়)।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়- আমরা অনেক সময়ই সালামের পূর্ণ জবাব দিতে কার্পণ্য করে থাকি। পুরো উত্তর বলি না,
দায়সারাভাবে উত্তর দিই। অথচ আল্লাহ তাআলা কুরআনেই শিখিয়েছেন; কেউ সালাম দিলে তার চেয়ে উত্তম শব্দে উত্তর দেয়া চায়। সূরা নিসার ৮৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) ‘‘যখন কেউ তোমাদের সালাম করে, তখন তোমরা তাকে তদপেক্ষাও উত্তম পন্থায় সালাম (জবাব) দিও কিংবা (অন্ততপক্ষে) সেই শব্দেই তার জবাব দিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর হিসাব রাখেন।’’
http://www.alkawsar.com/article/1165
http://www.alkawsar.com/section/wrong-practice?page=2 (all above)
http://www.alkawsar.com/section/wrong-practice?page=2 (all above)
শাবান-রমযান ১৪৩৫ . জুন-জুলাই ২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ০৬
একটি ভুল কথা : রোযাদারের খাবারের হিসাব হবে না
কোনো কোনো মানুষকে বলতে শোনা যায়, রোযাদারের খাবারের কোনো হিসাব হবে না। এটি একটি ভুল কথা।
খাবারের হিসাব বলতে সাধারণত খাবারের অপচয় বোঝায়। আর কুরআন হাদীসে এমন কোনো কথা নেই যে, রোযাদার যদি খাবারের অপচয় করে তাহলে তার কোনো হিসাব হবে না। যে ব্যক্তিই খাবার বা যেকোনো বস্ত্তই অপচয় করুক আল্লাহর দরবারে তাকে এর হিসাব দিতে হবে। সুতরাং রোযাদার হোক বা যেই হোক খাবার বা যেকোনো বস্ত্তর অপচয় থেকে বেঁচে থাকা জরুরি।
আর পানাহারের ক্ষেত্রে হারাম থেকে বেঁচে থাকা ফরয- তা তো সব সময় এবং সর্বাবস্থারই বিধান। হিসাবের প্রশ্ন আসে হালালের ক্ষেত্রে; নিয়ামতের যথাযথ ব্যবহার হল কি না এবং তার শোকর আদায় করা হল কি না। হারামের উপর তো সরাসরি শাস্তি হয়। তাই প্রচলিত এ বাক্য শুনে এরূপ মনে করা যে, হারাম খেলেও কোনো হিসাব নেই তা আরো ভয়াবহ।
এটি হাদীস নয় : তালিবুল ইলমের জন্য সত্তর হাজার ফিরিশতা ডানা বিছিয়ে দেন
জনৈক ওয়ায়েয তালিবুল ইলমের ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘যে ব্যক্তি ইলম অন্বেষণের জন্য পথ চলে তার পায়ের নিচে সত্তর হাজার ফিরিশতা ডানা বিছিয়ে দেন।’’
এটি হাদীস নয়। আমাদের জানামতে এমন কথা হাদীসের প্রসিদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থসমূহে নেই। বরং এ ব্যাপারে সহীহ ও প্রসিদ্ধ হাদীস হল, (যেখানে ফিরিশতার ডানা রাখার কথা আছে কিন্তু ফিরিশতার কোনো সংখ্যার কথা উল্লেখ নেই।) ‘‘ যে ব্যক্তি ইলমের জন্য পথ চলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের পথ সহজ করে দেন। আর ফিরিশতারা তালিবুল ইলমের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ডানা রেখে দেন। আর আলেমের জন্য আসমান ও যমিনের অধিবাসিরা ইসতিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করতে থাকে। এমনকি সমুদ্রের মাছ পর্যন্ত তাঁদের জন্য ইসতিগফার করতে থাকে।...’’
(জামে তিরমিযী, হাদীস ২৬৮২; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৬৪১; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ২২৩; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস ১৫৭৩; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৮৮)
হাদীসের আরবী পাঠ নিম্নরূপ-
"...من سلك طريقا يبتغي فيه علما، سلك الله به طريقا إلى الجنة، و إن الملائكة لتضع أجنحتها رضى لطالب العلم، و إن العالم ليستغفر له من في السموات و من في الأرض حتى الحيتان في الماء..."
সুতরাং তালিবুল ইলমের ফযীলত বিষয়ে উল্লিখিত হাদীসসহ আরো যেসব সহীহ হাদীস রয়েছে সেগুলোই বলা উচিত।
দ্রষ্টব্য: কেউ কেউ এই হাদীসের لتضع أجنحتها এই বাক্যের ব্যাখ্যা করেছেন -‘‘ডানা বিছিয়ে দেয়া।’’ আবার কেউ বলেছেন এর অর্থ হল ‘‘ তালিবুল ইলমের সম্মানে বিনয়াবনত হওয়া’’। কেউ বলেছেন, ‘‘ উড্ডয়ন বন্ধ করে থেমে যাওয়া ও যিকিরের জন্য অবতরণ করা।’’ মূলত এ বাক্যের মাঝে এ সবকটি অর্থেরই অবকাশ রয়েছে।
রজব ১৪৩৫ . মে-২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ০৫
একটি নাজায়েয প্রচলন : চুল বিক্রি করা
অনেক এলাকায় দেখা যায় ফেরীওয়ালারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে মহিলাদের জমানো চুল ক্রয় করে। আর মহিলারাও অজ্ঞতাবশত চুল বিক্রি করেন। এটি একটি নাজায়েয কাজ, এ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক।
মানুষের কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, কোনো অংশ বিক্রি করা জায়েয নয়। মানুষকে যেমন আল্লাহ তাআলা সম্মানিত বানিয়েছেন তেমনিভাবে মানুষের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি চুল, নখ ইত্যাদি কর্তিত অংশও সম্মানিত এবং এগুলো বিক্রয়যোগ্য কোনো বস্ত্ত নয়। সুতরাং এগুলো বিক্রি করা যাবে না। সম্ভব হলে দাফন করে দেয়া উত্তম।
একটি গর্হিত রসম : বিয়েতে রং মাখা-মাখি করা
অনেক এলাকায় দেখা যায়, বিশেষ করে গ্রামে বিয়ে বাড়িতে রং মাখা-মাখি করা হয়। এটা অত্যন্ত গর্হিত একটি রসম, যা হিন্দুদের থেকে আমাদের মাঝে প্রবেশ করেছে। রং মাখামাখি হিন্দুদের একটি বিশেষ উৎসব যাকে হোলি উৎসব বলে। সুতরাং কোনো মুসলিম এ কাজ করতে পারে না। শুধু বিজাতীয় সংস্কৃতি ও একটি অনর্থক কাজ হওয়াই এটি বর্জনের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু বিজাতীয় সংস্কৃতি হওয়ার সাথে সাথে এক্ষেত্রে যে চরম অশ্লীলতা পরিলক্ষিত হয় তাতে কোনো মুসলিমের দ্বারা এমন কাজ হওয়ার কল্পনাও করা যায় না। বিবাহ একটি আল্লাহর নেআমত। আল্লাহর নাফরমানির মাধ্যমে এ নেআমতের নাশোকরি হয় এবং তা বরকত ও কল্যাণ থেকে মাহরূমীর কারণ হয়।
আল্লাহ আমাদের সকল প্রকার অশ্লীলতা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি থেকে হেফাজত করুন।
একটি ভুল প্রথা : দোকান ঝাড়ু দেয়ার আগে ভিক্ষা না দেয়া বা বেচা-কেনা না করা
অনেক দোকানদারকে দেখা যায়, দোকান খোলার পর ঝাড়ু দেয়ার আগে কোনো ভিক্ষুক আসলে ভিক্ষা দেয় না বা কেউ কিছু কিনতে আসলে বিক্রি করে না। এটাকে অলক্ষুণে মনে করে। মনে করে, ঝাড়ু দেয়ার আগে এগুলো করলে সারাদিন বেচা-কেনা ভালো হবে না।
এটি একটি অমূলক ধারণা ও ভিত্তিহীন বিশ্বাস। ঝাড়ু দেয়া যেমন ভালো কাজ, দোকান খোলার পর ভিক্ষুককে দান করা তো আরো ভালো কাজ। দোকান খোলার পর একটি ভালো কাজের মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করা হল; এতে আরো বরকত বেশি হওয়ার কথা। তেমনিভাবে পণ্য বিক্রি করা-এটি ব্যবসার সাথে সাথে একটি সেবাও বটে। সুতরাং এটিও একটি ভালো কাজ। শুধু ঝাড়ু দেয়ার ওসিলায় এ ভাল কাজগুলো থেকে বিরত থাকার কোনোই অর্থ হয় না। সুতরাং ঝাড়ু দেয়ার আগে ভিক্ষা দেয়া যাবে না বা বিক্রি করা যাবে না মনে করা ঠিক নয়।
একটি ভুল ধারণা : দুপুরে নামাযের নিষিদ্ধ সময় কি ঠিক ১২টা
দুপুর বেলা সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে থাকে তখন নামায পড়া নিষেধ। অনেকে মনে করে এ সময়টা ঠিক দুপুর ১২টা। এ ধারণা ঠিক নয়।
এ সময়টা হল সূর্য ঢলার সময়ের পূর্বে আনুমানিক ৫ মিনিট। মৌসুম ভেদে সূর্য ঢলার সময়ের তারতম্যের কারণে এ সময়টিও পরিবর্তিত হতে থাকে। মৌসুম ভেদে সূর্য ঢলার সময়ের মাঝে প্রায় আধ ঘণ্টার ব্যবধান হয়ে থাকে। এক মৌসুমে (ঢাকার সময় অনুযায়ী) সূর্য ঢলার সর্বনিম্ন সময় ১১:৪২ তো আরেক মৌসুমে সর্বোচ্চ ১২:১৩।
এ সময় থেকে পাঁচ মিনিট বিয়োগ করলে দুপুরের নামাযের নিষিদ্ধ সময় হয় এক মৌসুমে সর্বনিম্ন ১১:৩৭ আরেক মৌসুমে সর্বোচ্চ ১২:০৮। সুতরাং নির্দিষ্ট করে ঠিক ১২টাকে দুপুরে নামাযের নিষিদ্ধ সময় মনে করা ঠিক নয়।
মোটকথা, সূর্য ঢলার সময় যখনই হবে তার পূর্বের পাঁচ মিনিটই হলো দুপুরে নামাযের নিষিদ্ধ সময়।
http://www.alkawsar.com/article/1131
জুমাদাল উখরা ১৪৩৫ . এপ্রিল ২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ০৪
একটি বলার ভুল
...ইন্নি কুনতুম মিনায যলিমীন
দুআ ইউনুসের সহীহ পাঠ হল, ‘লা ইলা-হা ইলা আনতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতু মিনায যলিমীন।’ (আপনি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই, আপনার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। নিশ্চয় আমি অপরাধী।) কিন্তু কিছু কিছু মানুষকে বলতে শোনা যায় বা বিভিন্ন গাড়িতে লেখা দেখা যায়, তারা এ বাক্যের ‘ইন্নি কুনতু মিনায যলিমীন’-এর স্থলে ‘ইন্নি কুনতুম মিনায যলিমীন’ বলে বা লেখে, যা ভাষাগতভাবে ভুল। আর দুআটি যেহেতু কুরআন মাজিদের অংশ তাই এ ভুল আরো মারাত্নক। ‘ইন্নি কুনতু মিনায যলিমীন’ অর্থ হল, নিশ্চয় আমি অপরাধী। আর ‘ইন্নি কুনতুম মিনায যলিমীন’-এর অর্থই মেলে না, এর এক রকম অর্থ দাঁড়ায়- নিশ্চয় আমি তোমরা অপরাধী। সুতরাং এ বাক্যটি সহীহভাবে বলা জরুরি।
http://www.alkawsar.com/article/1115
এটি হাদীস নয়
এটি হাদীস নয়
এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা গেল, কেউ ফজরের দুই রাকাত (ফরয) নামায আদায় করলে আলাহ তার সারা দিনের জামিন হয়ে যান। যোহরের চার রাকাত (ফরয) ও আসরের চার রাকাত (ফরয) -এই আট রাকাত আদায় করলে সে আট জান্নাতের মালিক হয়ে গেল। মাগরিবের তিন রাকাত (ফরয) ও ইশার চার রাকাত (ফরয) -এই সাত রাকাত আদায় করলে সাত জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেয়ে গেল।
এই বক্তব্যের প্রথম অংশ (ফজরের নামায আদায় করলে আলাহ সারা দিনের জামিন হয়ে যান।) সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুলাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালাম ইরশাদ করেন, ‘‘যে ব্যক্তি ফযরের নামায আদায় করল সে আলাহর জিম্মায় চলে গেল...।’’ (সহীহ মুসলিম, হাদীস ৬৫৭) কিন্তু বাকি অংশ কোনো হাদীসে পাওয়া যায় না। সুতরাং এ অংশ হাদীস নয়।
এর পরিবর্তে নামাযের ফযীলত বিষয়ে নিম্নোক্ত সহীহ হাদীসগুলো বলা যেতে পারে।
রাসূলুলাহ সালালাহু আলাইহ ওয়াসালাম বলেন, আলাহ পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। যে ব্যক্তি সুন্দর করে ওযু করবে এবং সময় মত তা (পাঁচ ওয়াক্ত নামায) আদায় করবে, পূর্ণরূপে রুকু, (সিজদা) করবে, খুশু খুযু সহকারে তা আদায় করবে, তার ব্যাপারে আলাহর প্রতিশ্রুতি রয়েছে যে, তিনি তাকে ক্ষমা করবেন। আর যে তা করবে না তার ব্যাপারে আলাহর কোনো প্রতিশ্রুতি নেই; তাকে ক্ষমাও করতে পারেন আবার আযাবে গ্রেফতার করতে পারেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪২৫)
হাদীসে কুদসীতে আলাহ তাআলা বলেন, (হে নবী!) আমি আপনার উম্মতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছি এবং এই প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে, যে ব্যক্তি সময়মত যত্নসহকারে তা আদায় করবে আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। আর যে তা করবে না তার ব্যাপারে আমার কোনো প্রতিশ্রুতি নেই। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৪৩০)
আর পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের মাধ্যমে বান্দার গুনাহ মাফ হওয়ার নিম্নোক্ত হাদীস তো সবারই জানা।
রাসূলুলাহ সালালাহু আলাইহ ওয়াসালাম বলেন, তোমাদের কারো বাড়ির দরজায় যদি একটি নহর থাকে আর সে তাতে প্রতিদিন পাঁচবার গোসল করে, তার শরীরে কি কোনো ময়লা বাকি থাকতে পারে? সাহাবার বললেন, কখনোই না। তখন রাসূলুলাহ সালালাহু আলাইহ ওয়াসালাম বললেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাযও তেমন; এর মাধ্যমে আলাহ বান্দার গুনাহ মিটিয়ে দেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৫২৮; সহীহ মুসলিম ১৫৫৪)
এছাড়া এধরনের আরো অনেক সহীহ হাদীস রয়েছে।
আর আলকুরআনুল কারীমে তো জান্নাতুল ফিরদাউসের আধিকারীদের গুণ বলা হয়েছে -‘তারা নামাযের প্রতি যত্নবান হবে, খুশু খুযু সহকারে নামায আদায়কারী হবে।’ সুতরাং নামাযের সাথে জান্নাতের ওয়াদা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির বিষয়টি ওতপ্রত জড়িত। তাই নামাযের ফযীলত হিসেবে এ বিষয়ক কুরআনের আয়াত ও সহীহ হাদীস বলা উচিত। কিন্তু নিজ থেকে কোনো ফযীলত বানিয়ে বলা বা ভিত্তিহীন কোনো কিছু ফযীলত হিসেবে বলা ঠিক নয়।
আলাহ আমাদের ভিত্তিহীন কথা বলা থেকে হেফাযত করুন।
জুমাদাল উলা ১৪৩৫ . মার্চ ২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ০৩
বলার ভুল : লাল বাতি জ্বালিলে নামায পড়া নিষেধ
অনেক মসজিদে দেখা যায়, মেহরাবের একপাশে একটা লাল বাতি থাকে, তার নিচে লেখা থাকে, ‘‘লাল বাতি জ্বালিলে নামায পড়া নিষেধ’’। যে কোনো ফরয নামাযের ২/৩ মিনিট পূর্বে বাতিটি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এখন কথা হল, বাস্তবেই কি ফরয নামাযের ২/৩ মিনিট পূর্বে কোনো ধরনের নামায পড়া নিষেধ! দুই তিন মিনিটে তো অন্তত দুই রাকাত ‘তাহিয়্যাতুল মসজিদ’ আদায় করা যায়। আর ফজরের সময় দুই রাকাত ফজরের সুন্নত আদায় করা যায়। আর নিষেধ’ শব্দ দ্বারা তো না-জায়েয বা হারাম বোঝানো হয়। এখানে তো বিষয়টি এমন নয়; বরং এটি ইনতিযাম বা শৃঙ্খলা রক্ষার্থে করা হয়। অর্থাৎ এর দ্বারা মুসল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় যে, এখনই জামাত দাঁড়াবে, এখন যদি নফল বা সুন্নত শুরু করা হয় তাহলে জামাত দাঁড়াতে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে বা আপনি মাসবুক হবেন। সুতরাং এখন মসজিদের ভিতরে নফল বা সুন্নতের নিয়ত না করা উচিত।
এ উদ্দেশ্যে তো শুধু ‘‘জামাতের সময় নিকটে’’ বা এ ধরনের অন্য কোনো বাক্য লেখাই যথেষ্ট।
উল্লেখ্য, অনেক সময় কোনো কোনো মুসল্লি পর্যাপ্ত সময় না থাকা সত্ত্বেও সামনের কাতারে বা অন্য কোনো কাতারের এমন স্থানে নামাযে দাঁড়িয়ে যান যার ফলে জামাত দাঁড়াতে বিঘ্ন ঘটে বা তার কারণে কাতারের মাঝে ফাঁকা থেকে যায়। সুতরাং এ ব্যাপারে নিজ থেকেই সতর্ক হওয়া কাম্য।
http://www.alkawsar.com/article/1097
http://www.alkawsar.com/article/1097
এটি হাদীস নয়
‘‘মসজিদে কেউ প্রথমবার দুনিয়াবী কথা বললে ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর বন্ধু ‘আপনি’ চুপ করুন। আবার দুনিয়াবী কথা বললে ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর বান্দা ‘তুমি’ চুপ কর। তৃতীয়বার কথা বললে ফিরিশতারা বলেন, হে আল্লাহর দুশমন ‘তুই’ চুপ কর।’’
এক ভাই প্রশ্ন পাঠিয়েছেন, এটি হাদীস কি না। কাউকে তিনি এটিকে হাদীস হিসেবে বলতে শুনেছেন।
এটি হাদীস নয়; হাদীসের কিতাবসমূহে এটা পাওয়া যায় না।
ইতিপূর্বে (অক্টোবর-নভেম্বর ২০০৫) এ বিভাগে এ বিষয়ক একটি জাল বর্ণনা আলোচনা করা হয়েছে। সেটি ছিল- ‘‘মসজিদে (দুনিয়াবী) কথাবার্তা নেকিকে এমনভাবে খতম করে, যেমন আগুন কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে।’’
মনে রাখতে হবে, মসজিদ নামায ও আল্লাহ তাআলার যিকিরের জন্যই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মসজিদকে দুনিয়াবী কথাবার্তা ও কাজকর্মের স্থান বানানো অথবা এ উদ্দেশ্যে মসজিদে জমায়েত হওয়া নাজায়েয।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে বেচা-কেনা বা হারানো বস্ত্ত খুঁজে পাওয়ার এলান করতে নিষেধ করেছেন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১০৭৯)।
আরেক হাদীসে এ বিষয়ে কঠিন ধমকি এসেছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, কাউকে মসজিদে বেচা-কেনা করতে দেখলে বল, তোমার বেচা-কেনা লাভজনক না হোক। তেমনিভাবে কাউকে যদি মসজিদে হারানো বস্ত্তর এলান করতে দেখ তাহলে বল, আল্লাহ তোমার হারানো বস্ত্ত ফিরিয়ে না দিন (অর্থাৎ এ কাজটি খুবই নিন্দনীয়)। (জামে তিরমিযী, হাদীস ১৩৩৬; সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস ১৩০৫)। তবে কোনো দ্বীনী কাজের জন্য মসজিদে যাওয়ার পর প্রসঙ্গক্রমে দুনিয়াবী কোনো বৈধ কথাবার্তা বলা জায়েয। এর বৈধতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরামের আমল দ্বারা প্রমাণিত। (দ্রষ্টব্য সহীহ বুখারী ১/৬৩,৬৪, ও ৬৫; রদ্দুল মুহতার (শামী) ১/৬৬২; আললু’লুউল মারসূ ৭৮)
http://www.alkawsar.com/article/1096
http://www.alkawsar.com/section/wrong-practice?page=3 (all above)
রবিউস সানি ১৪৩৫ . ফেব্রুয়ারি ২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ০২
একটি ভুল ধারণা : পায়ে মেহেদী দেওয়া কি নিষেধ?
অনেকে মনে করেন মেয়েদের জন্যও পায়ে মেহেদী দেওয়া নিষেধ। এ ধারণা ঠিক নয়।
প্রথম কথা হল, পুরুষদের জন্য সাজ-সজ্জার উদ্দেশ্যে মেহেদী লাগানো নিষেধ। তবে চুল-দাড়ি পেকে গেলে তাতে মেহেদী লাগানোর অনুমতি আছে। আর মেয়েদের জন্য হাতে পায়ে মেহেদী লাগানোতে দোষের কিছু নেই।
একটি ভুল মাসআলা : মহিলাদের জবাইকৃত পশু কি হালাল নয়?
সাধারণত পুরুষরাই হাঁস মুরগি ইত্যাদি জবাই করে থাকেন। মহিলাদের জবাই করার তেমন প্রয়োজন হয় না। ফলে কোনো কোনো মানুষ মনে করেন, কোনো মহিলা মুরগি বা কোনো পশু জবাই করলে তা খাওয়া হালাল নয়। তাদের এই ধারণা ঠিক নয়। পুরুষের জবাইকৃত পশু যেমন হালাল তেমনি মহিলার জবাইকৃত পশুও হালাল।
বাড়িতে পুরুষ মানুষ না থাকলে অনেক সময়ই মহিলাদের হাঁস-মুরগি জবাই করতে হয়। এতে কোনো অসুবিধা নেই।
এটি হাদীস নয় : জ্ঞান-সাধকের দোয়াতের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে মূল্যবান
‘‘জ্ঞান-সাধকের দোয়াতের কালি শহীদের রক্তের চেয়ে মূল্যবান’’ এ কথাটি হাদীস হিসেবে জনশ্রুতি থাকলেও হাদীস বিশারদগণের নির্ভরযোগ্য মতানুসারে এটি হাদীস নয়; বরং পরবর্তী কারো বাণী। ইমাম সাখাবী রাহ. ‘আল মাকাসিদুল হাসানাতে’ ( পৃ. ৪৪২, বর্ণনা: ১০০৫ ) এটিকে হাসান বসরী রাহ.-এর বাণী বলে উল্লেখ করেছেন।
শাওকানী রাহ.,যারকাশী রাহ.,তাহের পাটনী রাহ.-সহ আরো অনেক হাদীস বিশারদ এ বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন।
(দেখুন: আল ফাওয়াইদুল মাজমূআ, খ. ১ পৃ. ২৮৭, বর্ণনা: ৫৩; আললাআলিল মানছূরাহ, পৃ. ১০১, বর্ণনা: ১০; আল আসারুল মারফূআ ২০৭; কাশফুল খাফা, খ.২ পৃ.২০০; তাযকিরাতুল মাওযূআত খ. ২ পৃ. ৩৬৯; মিযানুল ইতিদাল খ.৩ পৃ. ৪৯৮।)
সুতরাং এটিকে হাদীস হিসেবে বলা উচিত নয়।
http://www.alkawsar.com/article/1072
একটি ভুল আমল : নামাযে পায়ের আঙ্গুল কেবলামুখী না রাখা
নামাযে দাঁড়ানো অবস্থায় পায়ের আঙ্গুল কেবলামুখি করে রাখতে হয়। কিন্তু অনেক মানুষকেই দেখা যায় নামাযে দাঁড়ানোর সময় পায়ের পাতা (আঙ্গুলগুলো) ডানে বামে ঘুরিয়ে রাখেন। এটা ঠিক নয়। দুই পায়ের পাতার মাঝে সামনে পিছনে সমান ফাঁকা রেখে পায়ের আঙ্গুল সোজা কিবলামুখী করে দাঁড়াতে হয়।
অবশ্য কারো যদি ওযর থাকে তাহলে ভিন্ন কথা।
তেমনিভাবে অনেক মানুষকে দেখা যায় তাকবীর বলে হাত ওঠানোর সময় হাতের তালু নিজের কানের দিকে বা আকাশের দিকে করে রাখেন এটিও ঠিক নয়। নিয়ম হল এ সময় হাতের তালু কেবলামুখী করে রাখা।
http://www.alkawsar.com/article/1076
আরেকটি ভুল মাসআলা : যে ঘরে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় সে ঘর কি চল্লিশ দিন নাপাক থাকে?
কোনো কোনো এলাকায় মনে করা হয়, যে ঘরে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয় বা ভূমিষ্ঠ শিশুর মা যে ঘরে অবস্থান করেন সে ঘর চল্লিশ দিন পর্যন্ত নাপাক থাকে, এখানে নামায পড়া যাবে না। এটি একেবারেই অমূলক ধারণা, যা মূর্খতা বৈ কিছুই নয়। পাক নাপাকের সম্পর্ক তো নাপাকি লেগে থাকা না থাকার সাথে, সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া বা ভূমিষ্ঠ সন্তানের মায়ের অবস্থানের সাথে এর কোনোই সম্পর্ক নেই।
http://www.alkawsar.com/article/1075
http://www.alkawsar.com/article/1075
রবিউল আউয়াল ১৪৩৫ . জানুয়ারি ২০১৪
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ১০ . সংখ্যা: ০১
একটি ভুল ঘটনা : হযরত আবু বকর রা.-এর চট পরিধান করা
অনেক বক্তাকেই এই চটকদার কাহিনী বলতে শোনা যায়। ‘একবার হযরত আবু বকর রা. আল্লাহর রাস্তায় দান করতে করতে সবকিছু দান করে দিলেন। এমনকি তিনি নিজের গায়ের পোশাকও দান করে দিলেন। এখন তিনি সতর ঢাকার জন্য ছালার চট পরিধান করলেন। হযরত আবু বকরের এই কাজ আল্লাহ এত পছন্দ করলেন যে, সমস্ত ফেরেশতাকে ডেকে বললেন, আমার হাবীবের দোস্ত আবু বকর নিজের সবকিছু দান করে চট পরিধান করেছে। সুতরাং তোমরাও তার অনুসরণে চট পরিধান কর। সমস্ত ফেরেশতা তখন দীর্ঘ তিনদিন পর্যন্ত চট পরিধান করে ছিলেন।’’
আল্লাহর রাস্তায় দান করার ফযীলত বা আবু বকর রা.-এর ফযীলত হিসেবে অনেকে ঘটনাটি বলে থাকেন। কিন্তু আসলে এটি একটি জাল বর্ণনা যা উশনানী নামক জনৈক মিথ্যাবাদী কর্তৃক জালকৃত।
ইবনুল জাওযী রাহ. তাঁর আলমাউযুআত কিতাবে (খ. ১ পৃ.৩১৪) বলেন, ‘এটা উশনানীর জালকৃত বর্ণনা।’
সুয়ূতী রাহ. আললাআলিল মাছনূআ-তে (১ : ২৬৯) বলেন, ‘এটি একটি জাল বর্ণনা যা উশনানী কর্তৃক জালকৃত।’
এছাড়া দেখুন, আলফাওয়াইদুল মাজমূআ ১:৩৩২; তানযীহুশ শারীআহ ১:৩৯১
তার জালকৃত বর্ননা নিম্নরূপ :
‘জিবরীল আ. একবার চট পরিহিত অবস্থায় নবীজীর কাছে আগমন করলেন। নবীজী বললেন, হে জিবরীল! আপনাকে তো এমন পোশাকে কখনো দেখিনি? উত্তরে জিবরীল আ. বললেন, আল্লাহ তাআলা আসমানে সকল ফেরেশতাকে এই পোশাক পরতে নির্দেশ করেছেন। কারণ আবু বকর যমীনে এই পোশাক পরেছে।’’ এই হল তার জালকৃত বর্ণনা। কিন্তু কাহিনীকাররা এর সাথে আগে পরে আরো কথা যোগ করে আরো চটকদাররূপে বর্ণনা করে। আর আবু বকর রা.-এর ফযীলত বা তাঁর দান করার ঘটনা তো সহীহ হাদীসেই বর্ণিত হয়েছে। সেগুলো বলা উচিত।
হাদীস শরীফে এসেছে, ওমর রা. বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে দান করার নির্দেশ দিলেন। তখন আমার হাতে বেশ সম্পদও ছিল। আমি মনে মনে বললাম, আজ আমি আবু বকরের চেয়ে অগ্রগামী হব। আমি আমার অর্ধেক সম্পদ নবীজীর দরবারে পেশ করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, তোমার পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ (হে ওমর!)? আমি বললাম, অনুরূপ অর্ধেক রেখে এসেছি।
তারপর আবু বকর তাঁর সমস্ত সম্পদ নিয়ে হাজির হলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু বকর! পরিবারের জন্য কী রেখে এসেছ? তিনি উত্তরে বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি। তখন আমি বললাম, আল্লাহর কসম, আমি কখনোই তাঁর চেয়ে অগ্রগামী হতে পারব না। (জামে তিরমিযী, হাদীস:৩৬৭৫; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস:১৬৮০; মুসতাদরাকে হাকিম, হাদীস:১৫১০)
এটি হাদীস নয় : আশুরার রোযা: ষাট বছর ইবাদতের সওয়াব
গত ১৪ নভেম্বর (২০১৩) দৈনিক ইনকিলাবে ধর্ম-দর্শন পাতায় ‘পথ নির্দেশ: মুহররম ও শহীদানে কারবালা’ শিরোনামে একটি লেখা পড়লাম। সেখানে আশুরার রোযার ফযীলত বর্ণনা করতে গিয়ে লেখা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি আশুরার রোযা রাখে সে ষাট বছর দিনে রোযা রাতে ইবাদত করার সওয়াব লাভ করে।’ হাদীস হিসেবে লেখা হলেও এটি হাদীস নয়। এটি একটি জাল বর্ণনা যা হাবীব ইবনে আবী হাবীব নামক এক হাদীস জালকারী থেকে বর্ণিত। ইবনুল জাওযী রাহ. বলেন, ‘এটা নিঃসন্দেহে মওযূ বর্ণনা।’ (আলমাউযূআত ২:২০৩) আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রাহ. বলেন, এটি একটি বাতিল ও ভিত্তিহীন বর্ণনা। এটা হাবীব ইবনে আবী হাবীব বর্ণনা করে। আর সে হাদীস জাল করত। (আলমানারুল মুনীফ ১:৪৭, বর্ণনা নং ৪৪) হাফেয সুয়ূতী রাহ. ও আল্লামা ইবনু আররাক রাহ. এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়েছেন। আল্লামা আবদুল হাই লখনবী রাহ. আশুরার রোযার ফযীলত বিষয়ে জাল বর্ণনার আলোচনা করতে গিয়ে শুরুতেই এই বর্ণনাটি এনেছেন। (আললাআলিল মাসনূআ ১:১৩৫; তানযীহুশ শরীআহ ২:১৪৮; আলআসারুল মারফূআ ১:৯৪)
আশুরার রোযার ফযীলত তো সহীহ হাদীসেই বর্ণিত হয়েছে। হযরত আবু কাতাদা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তাআলা অতীতের এক বছরের (সগীরাহ) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন। (সহীহ মুসলিম ১:৩৬৭; জামে তিরমিযী ১:১৫৮) সুতরাং সহীহ হাদীসে যে ফযীলত বর্ণিত হয়েছে শুধু তা-ই বলা উচিত।
আর আশুরা-কেন্দ্রিক বিভিন্ন ভিত্তিহীন বর্ণনা ও ঘটনা আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে। এ বিষয়ে ইতিপূর্বে মাসিক আল কাউসারে (মুহাররম-ফেব্রুয়ারি ২০০৫) বিস্তারিত লেখা হয়েছে।
সফর ১৪৩৫ . ডিসেম্বর ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ১১
আরেকটি ভুল ধারণা : আগের উম্মত কি নবীর মাধ্যম ছাড়া দুআ করতে পারত না?
কিছু মানুষের ধারণা আগের উম্মতগণ নবীর মাধ্যম ছাড়া সরাসরি আল্লাহর কাছে দুআ করতে পারত না। এটি একটি অমূলক ধারণা। কুরআন হাদীসে এর কোন ভিত্তি পাওয়া যায় না। বরং এর উল্টোটা পাওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) আমার বান্দাগণ যখন আপনার কাছে আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন (আপনি তাদেরকে বলুন যে,) আমি এত নিকটবর্তী যে, কেউ যখন আমাকে ডাকে আমি তার ডাক শুনি (তার ডাকে সাড়া দিই)- সূরা বাকারা ২:১৮৬
এ আয়াতে বর্তমান উম্মত ও পূর্ববর্তী উম্মতের মাঝে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। এছাড়া পূর্ববর্তী উম্মতের সরাসরি দুআ করার নযীর কুরআনেই বিদ্যমান। এখানে কয়েকটি পেশ করা হল-
১. মূসা আলাইহিস সালাম-এর উম্মত ফিরাউনের স্ত্রীর দুআ:
(তরজমা) আল্লাহ মুমিনদের জন্য ফিরাউনের স্ত্রীর দৃষ্টান্ত পেশ করেছেন, যে দুআ করেছিল: ‘হে আমার প্রতিপালক! তোমার সন্নিধানে জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ কর এবং আমাকে উদ্ধার কর ফিরাউন ও তার দুষ্কৃতি থেকে এবং আমাকে উদ্ধার কর জালিম সম্প্রদায় হতে।’-সূরা তাহরীম ৬৬ : ১১
২. আসহাবে কাহফ তথা তৎকালীন নবীর উম্মতের দুআ :
(তরজমা) যখন যুবক দলটি (আসহাবে কাহ্ফ) গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল এবং (আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করে) বলেছিল, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের প্রতি আপনার নিকট থেকে বিশেষ রহমত নাযিল করুন এবং এ পরিস্থিতিতে আমাদের জন্য কল্যাণকর পথের ব্যবস্থা করে দিন।’-সূরা কাহ্ফ ১৮ : ১০
৩. ইমরানের স্ত্রীর দুআ :
(তরজমা) যখন ইমরানের স্ত্রী (আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করে) বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার গর্ভে যা আছে তা একান্ত তোমার জন্য উৎসর্গ করলাম। সুতরাং তুমি আমার পক্ষ থেকে তা কবুল কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’-সূরা আলে ইমরান ৩ : ৩৫
http://www.alkawsar.com/article/1042
http://www.alkawsar.com/section/wrong-practice?page=4 ( all above)
http://www.alkawsar.com/section/wrong-practice?page=4 ( all above)
একটি ভুল ধারণা : মুহাররম মাসে বিবাহ করা কি অশুভ
এতে কোনোই সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ তাআলা কতক মাস, দিন ও রাতকে অন্যান্য মাস, দিন ও রাতের চেয়ে বেশি মর্যাদাপূর্ণ বানিয়েছেন এবং তাতে ভাল কাজের অধিক বরকত রেখেছেন। কিন্তু কোনো মাস, দিন ও রাত বা কোনো সময়কে অকল্যাণকর বা অশুভ বানাননি। সময় মাত্রই আল্লাহ তাআলার নেয়ামত ও করুণা। উত্তম ও সঠিক কাজের মাধ্যমে মানুষ যে কোনো সময়কেই ফলপ্রসূ ও বরকতময় করতে সক্ষম।
কোনো মাস, দিন বা রাতকে অশুভ মনে করা বিশেষ কোনো সময়কে বিশেষ কাজের জন্য অশুভ ও অলক্ষুণে মনে করা-সবই জাহেলিয়াতের কুসংস্কার। যেমন ইসলামপূর্ব যুগের কোনো কোনো লোকের এই ধারণা ছিল যে, শাওয়াল মাসে বিবাহ-শাদির অনুষ্ঠান অশুভ ও অকল্যাণকর। উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. এই ভিত্তিহীন ধারণাকে এই বলে খন্ডন করেছেন যে- ‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে শাওয়াল মাসেই বিবাহ করেছেন এবং শাওয়াল মাসেই বিবাহ-রজনী উদযাপন করেছেন। অথচ তাঁর অনুগ্রহ লাভে আমার চেয়ে অধিক সৌভাগ্যবতী স্ত্রী আর কে আছে? - সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৪২৩
বর্তমানে কিছু লোক মুহাররম মাসের ব্যাপারে এজাতীয় ধারণা পোষণ করে। সম্ভবত তাদের এই ভ্রান্ত ধারণার পেছনে এ মাসে হযরত হোসাইন রা.-এর শাহাদাত বরণের ঘটনা কার্যকর। অথচ সময় কখনো অশুভ হয় না। বিশেষ করে মুহাররম মাস তো ‘আশহুরে হুরুম’ তথা মর্যাদাপূর্ণ মাস-চারটির অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস। রমযান মাসের পর এ মাসের গুরুত্ব ও ফযীলতই সবচেয়ে বেশি। হযরত হোসাইন রা.-এর শাহাদাত বরণের মাধ্যমে এ মাস কীভাবে অশুভ হতে পারে? অশুভ ও অকল্যাণ তো ওই সব লোকের বদআমলের মধ্যে নিহিত, যারা তাঁকে অন্যায়ভাবে শহীদ করেছে। বছরের কোন্ মাসটি এমন আছে, যাতে কোনো মহান ব্যক্তির শাহাদাতের ঘটনা ঘটেনি? তবে কি বছরের সকল মাসই অশুভ ও অকল্যাণকর হয়ে যাবে?
সফর মাসের ব্যাপারেও জাহেলি যুগে এই ভ্রান্ত বিশ্বাস ছিল যে, এ মাসটি অশুভ। নাউযুবিল্লাহ! এজাতীয় শুভাশুভের ধারণা একটি কুসংস্কার, যাকে ইসলাম বাতিল সাব্যস্ত করেছে এবং এভাবে বান্দাদেরকে এক বিরাট মুসীবত থেকে মুক্তি দিয়ে আরাম ও স্বস্তির জীবন-যাপনের পথ সুগম করেছে।
এটি হাদীস নয় : ফিরিশতারা গুনাহ মাথায় নিয়ে মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন
কোনো ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশের সময় ফিরিশতারা তার গুনাহ মাথায় করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন, যাতে গুনাহসহ কোনো ব্যক্তিকে পবিত্র মসজিদে প্রবেশ করতে না হয়। ওই ব্যক্তি বেশি দেরি করলে একসময় ফিরিশতারা বলেন, আল্লাহ! তার গুনাহ বহন করতে আমাদের তো খুব কষ্ট হচ্ছে। তখন আল্লাহ বলেন, গুনাহগুলো সমুদ্রে ফেলে দাও।
মসজিদে যত বেশি সময় কাটানো যায় ততই ভালো। কিন্তু মসজিদে বেশি সময় অবস্থান করার প্রতি উদ্বুদ্ধকারী উপরোক্ত বর্ণনার কোনো ভিত্তি নেই। নামাযের পর পবিত্র অবস্থায় নামাযের স্থানে বসে থাকলে ফিরিশতা মাগফিরাতের দুআ করে - হে আল্লাহ তাকে মাফ করে দিন, তার প্রতি রহম করুন। (সহীহ বুখারী, হাদীস:৬৫৯) এক নামাযের পর আরেক নামাযের অপেক্ষায় থাকলে গুনাহ মাফ হয়। (সহীহ মুসলিম, হাদীস:২৫১) কিন্তু ফিরিশতারা গুনাহ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আর দেরি করে বের হলে কষ্টের কারণে তা সমুদ্রে ফেলে দেন- গুনাহ মাফ হওয়ার এই আজগুবি কাহিনীর কোনোই ভিত্তি নেই। এ ধরনের কল্পিত বিষয় বলা আবার হাদীস হিসেবে বলা অনেক বড় অন্যায়।
মুহাররম ১৪৩৫ . নভেম্বর ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ১০
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ১০
একটি বলার ভুল : সন্তানকে বলা : তুমি আমার লক্ষ্মী!
অনেক বাবা-মা সন্তানকে আদর করে বলেন, তুমি আমার লক্ষ্মী! এটি একটি মারাত্মক ভুল কথা যা আকীদা-বিশ্বাসকে কলুষিত করে। এ ধরনের কথা মূলত হিন্দুদের থেকে মুসলমানদের মাঝে সংক্রমিত হয়েছে। লক্ষ্মী হল হিন্দুদের দেবী যাকে হিন্দুরা ধন-ঐশ্বর্য ও সৌভাগ্যের দেবী মনে করে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে ভাষার শব্দ-চয়নের সুন্দর-অসুন্দরও শিখিয়েছেন। সেখানে কোনো শব্দের সাথে যদি শিরকের সম্পৃক্ততা থাকে তাহলে তা যে বর্জনীয় একথা বলারই অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং এ ধরনের হিন্দুয়ানী কথা বলা থেকে বিরত থাকা জরুরী।
একটি বানোয়াট কিসসা : কোহে কাফের মোরগ
কোহ ফার্সী শব্দ, অর্থ পাহাড় আর কাফ হল আরবী হরফ-দুই নোকতা ওয়ালা ক্বফ। আর কোহে কাফ বলতে বুঝায় একটি পাহাড়, যা কি না আরবী ক্বফের মত বৃত্তাকার হয়ে পুরো পৃথিবীকে বেষ্টন করে রেখেছে আর তার উপর বিশালাকার একটি মোরগ রয়েছে যার এক পা পাহাড়ের এক প্রান্তে আর অন্য পা অপর প্রান্তে। একেই বলে কোহে কাফের মোরগ।
আল্লাহ কত বড় রায্যাক (রিযিকদাতা)-তা বোঝাতে গিয়ে কিছু কাহিনীকার এই কিস্সার অবতারণা করে বলেন, আল্লাহ এত বড় রিযিকদাতা যে, এই বিশালাকার মোরগকে নিয়মিত রিযিক দিচ্ছেন।
আসলে এটি একটি বানোয়াট কিস্সা যার কোনো ভিত্তি নেই। কোহে কাফের মোরগ তো দূরের কথা কোহে কাফেরই কোনো অস্তিত্ব নেই।
তাফসীরে ইবনে কাছীরে সূরা ক্বফ এর তাফসীরের শুরুতে ইবনে কাছীর রাহ. বলেন, ‘‘আমার কাছে মনে হয়, এটা এবং এজাতীয় বিষয়গুলো যিন্দীকদের বানানো।’’ ইমাম আলূসী রাহ. তাফসীরে রূহুল মাআনীতে ইমাম ক্বারাফী রাহ. এর বক্তব্য উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘‘কোহে কাফের (জাবালে কাফ) কোনো অস্তিত্ব নেই।’’ এ কথা নকল করার পর আলূসী রাহ. বলেন, আমার মতও এমনই। (তাফসীরে রূহুল মাআনী খ. ২৩ পৃ. ১৯২ [শামেলা]) আরো বিস্তারিত দেখুন : ‘‘আল ইসরাঈলিয়্যাত ওয়াল মাওযূআত ফী কুতুবিত তাফাসীর, মুহাম্মাদ ইবনে মুহাম্মাদ আবু শাহবা পৃ. ৩০২-৩০৪’’।
আর আল্লাহ যে মহান রিযিকদাতা এ কথা বোঝানোর জন্য জাতীয় ভিত্তিহীন কিসসার অবতারণা করার কোনো প্রয়োজন নেই। আলকুরআনে এ বিষয়ক প্রচুর আয়াত রয়েছে।
আল্লাহ আমাদের যাচাই বাছাই ছাড়া ভিত্তিহীন কথা বলা থেকে হেফাজত করুন। আমীন।
ভুল উচ্চারণে কালিমা পাঠ : লা-ইলাহা ইল্লেল্লাহ
যে কালেমার মাধ্যমে আমরা ঈমানের স্বীকৃতি দিই তাওহীদের সাক্ষ্য দিই সে কালেমার উচ্চারণেও দেখা যায় কিছু মানুষ ভুল করে থাকেন। দ্বীনী শিক্ষার বিষয়ে শিথিলতা অনেক বড় অন্যায়। কিন্তু এ পর্যায়ের শিথিলতাকে আমরা কী বলতে পারি জানি না।
দ্বীনী বিষয়ে মক্তব স্তরের শিক্ষা যে লাভ করেছে তারও তো এ ধরনের ভুল হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আফসোস! কিছু মানুষের এ স্তরের দ্বীনী শিক্ষারও সুযোগ হয় না বা প্রয়োজন মনে করে না। ফলে দ্বীনী সাধারণ সাধারণ বিষয়েও ভুলের শিকার হন।
‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ এখানে ‘ইল্লাল্লাহ’ শব্দের প্রথম ল্ল-তে আ-কার দিয়ে অর্থাৎ যবর দিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু কিছু মানুষ এ ক্ষেত্রে আ-কার অর্থাৎ যবর-এর পরিবর্তে এ-কার অর্থাৎ যের দিয়ে ‘ইল্লেল্লাহ’ পড়েন যা সম্পূর্ণ ভুল। এ শব্দের সঠিক উচ্চারণ হল, ‘ইল্লাল্লাহ’ (দ্বিতীয় ল্ল-তে পোড় করে অর্থাৎ স্বর মোটা করে উচ্চারণ করতে হবে)
উল্লেখ্য, আরবী শব্দের সঠিক উচ্চারণ বাংলায় প্রকাশ করা কঠিন। এ কারণে কর্তব্য হচ্ছে, এজাতীয় উচ্চারণগত বিষয়গুলো কোনো অভিজ্ঞ ক্বারী ছাহেবের কাছে মশক করে শুদ্ধ করে নেওয়া।
একটি ভুল প্রচলন : কবরের চার কোণে চার কুল
অনেক এলাকায় প্রচলন আছে, মায়্যেতকে দাফন করার পর চার ব্যক্তি কবরের চার কোণে দাঁড়িয়ে চার কুল (অর্থাৎ সূরা কাফিরুন, ইখলাস, ফালাক, নাস) পড়ে। তারপর তারা কবরের চার কোণে চারটি তাজা ডাল পুঁতে দেয়।
কোথাও আবার চার কোণের চারটি খুঁটি হাতে চার কুল পড়ে খুঁটিগুলো গেড়ে দেয়। কোথাও চার খুঁটিতে সুতা পেঁচায়। আবার কেউ বলল, তাদের এলাকায় চারটি কঞ্চি হাতে চার কুল পড়ে কঞ্চি চারটি কবরের উপর রাখে।
এটি একটি মনগড়া রসম যার কোনো ভিত্তি নেই। কোনো হাদীসে বা সাহাবা-তাবেয়ীন থেকে এ আমলের কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সুতরাং তা বর্জনীয়। এজাতীয় মনগড়া কোনো রসমের পিছে না পড়ে প্রমাণিত কোনো আমল করা উচিৎ। যেমন দাফন শেষে মায়্যেতের জন্য মাগফিরাতের দুআ করা এবং কবরের সুওয়াল জওয়াব সহজ হওয়ার জন্য দুআ করা। সূরা বাকারার শুরু থেকে মুফলিহুন (১-৫ আয়াত) পর্যন্ত এবং শেষে আমানার রাসূলু থেকে শেষ পর্যন্ত (২৮৫-২৮৬ আয়াত) তিলাওয়াত করে ইসালে সওয়াব করা ইত্যাদি।
যিলহজ্ব ১৪৩৪ . অক্টোবর ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ০৯
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ০৯
একটি ভুল ধারণা : ভাত পড়লে তুলে না খেলে কি তা কবরে বিচ্ছু হয়ে কামড়াবে?
ছোট শিশু নিজ হাতে খেতে গেলে অনেক ভাত পড়ে। তখন সে ভাতগুলো তুলে খাওয়ার জন্য অনেকেই বলে থাকেন-‘পড়ে যাওয়া ভাতগুলো তুলে খাও নইলে কিন্তু এগুলো কবরে বিচ্ছু হয়ে কামড়াবে।
ছোটদেরকে এজাতীয় বিষয়ে সতর্ক করা ও উৎসাহ দেওয়া প্রসংশনীয়। কিন্তু তা করতে গিয়ে অমূলক কথা বলা কখনোই সমিচীন নয়।
হাদীসে এ বিষয়ে যে নির্দেশনা এসেছে সেটাই ছোটদের সামনে পেশ করা উচিত।
হাদীসে এ বিষয়ে যে নির্দেশনা এসেছে সেটাই ছোটদের সামনে পেশ করা উচিত।
হযরত আনাস ইবনে মালেক রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন খানা খেতেন তখন আঙ্গুল চেটে খেতেন এবং বলতেন, খাদ্য পড়ে গেলে তা থেকে ময়লা দূর করে খেয়ে নাও এবং তা শয়তানের জন্য রেখে দিও না।
তিনি আমাদের পাত্র চেটে খাওয়ার আদেশ করতেন এবং বলতেন, তোমাদের তো জানা নেই খাদ্যের কোন্ অংশে বরকত রয়েছে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৩৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৪৭; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫২৪৯)
তিনি আমাদের পাত্র চেটে খাওয়ার আদেশ করতেন এবং বলতেন, তোমাদের তো জানা নেই খাদ্যের কোন্ অংশে বরকত রয়েছে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস ২০৩৪; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৩৮৪৭; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫২৪৯)
একটি ভুল ধারণা : জুমার আগের বাংলা বয়ানকে খুতবা মনে করা
জুমআর নামাযের আগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুটি খুতবা দিতেন। দুই খুতবার মধ্যে অল্প সময় বসতেন এবং উভয় খুতবা হত আরবী ভাষায়। দুই খুতবা আরবী ভাষায় হওয়া সুন্নত (মুয়াক্কাদাহ)। হাদীস শরীফ দ্বারা তা-ই প্রমাণিত। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন, তাবে তাবেয়ীন এবং গোটা মুসলিম উম্মাহ সর্বযুগে এ অনুযায়ী আমল করেছেন। এজন্য এ নিয়মের খুতবাকে ‘খুতবায়ে মাসনূনাহ’ বলে।
আর জুমার দিন যেহতেু মসজিদে অনেক মানুষের সমাগম হয় তাই এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় ভাষায় কিছু দ্বীনী আলোচনা করা হয়। এটা ‘খুতবায়ে মাসনূনাহ’ বলে গণ্য নয়।
কিন্তু কিছু মানুষ খুতবার আগের এই দ্বীনী আলোচনাকেও জুমার খুতবা মনে করেন। তাদের এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ জুমার খুতবার কিছু স্বতন্ত্র্য আহকাম রয়েছে, যা এই খুতবারই বৈশিষ্ট্য। যেমন, খুতবা আরবী ভাষায় হওয়া, খুতবা চলাকালে কোনো প্রকার কথা বা কাজ নিষিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। সুতরাং জুমার খুতবার আগের বাংলা বয়ানকে যারা খুতবা মনে করেন তাদের ধারণা ঠিক নয়।
ভুল উচ্চারণে দরূদ পাঠ : সাল্লেল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
সালামু দুলাই আলাইকা
দরূদ শরীফ অত্যন্ত বরকতপূর্ণ আমল। দুআর বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে দরূদ শরীফ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ হিসেবে তা আল্লাহ তাআলার ইবাদত। দ্বিতীয়ত এর সম্পর্ক রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে, যাঁর হক মুসলমানদের উপর তাদের প্রাণের চেয়েও বেশি এবং যিনি আল্লাহ তাআলার পরে আল্লাহর বান্দাদের প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহকারী। দরূদের মাধ্যমে তাঁর জন্য আল্লাহর দরবারে দুআ করা হয়। তাই এই আমল অত্যন্ত ভক্তি ও অনুরাগের সাথে আদায় করা উচিত। সহীহ-শুদ্ধভাবে আদায় করা উচিত।
নামাযে পঠিত দরূদে ইবরাহীমীর পর ছোট দরূদ হিসেবে ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ দরূদটিই সবচেয়ে বেশি লেখা ও পাঠ করা হয়। কিন্তু অনেক মানুষকেই দেখা যায়, এই ছোট্ট দরূদটির প্রথম অংশ
صلى الله সাল্লাল্লাহু (প্রথম লাম-এ যবর) কে সাল্লেল্লাহু (প্রথম ল্ল- তে এ-কার দিয়ে অর্থাৎ প্রথম লামে যের দিয়ে) পড়ে থাকেন, যা সম্পূর্ণ ভুল।
আর আমাদের দেশের প্রচলিত মীলাদ মাহফিলে সুর করে সম্মিলিতভাবে যে দরূদ ও সালাম পাঠ করা হয় সে ক্ষেত্রে তো দরূদ শরীফকে বড়ই মাজলুম বানানো হয়।
এভাবে সুর করে সম্মিলিতভাবে দরূদ পাঠ করা কী তা এখনকার আলোচনার বিষয় নয়। এখনকার আলোচ্য বিষয় হল, সেক্ষেত্রে দরূদ ও সালামের শব্দাবলির উচ্চারণের যে বেহাল দশা হয় সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
সেখানে জনসাধারণ
يا نبي سلام عليك ‘ইয়া নাবী সালামুন আলাইকা’
এই বাক্য উচ্চারণ করে এভাবে-ইয়া নাবী সালাই মালাইকা। তারপর
يا نبي سلام عليك ‘ইয়া নাবী সালামুন আলাইকা’
এই বাক্য উচ্চারণ করে এভাবে-ইয়া নাবী সালাই মালাইকা। তারপর
صلوات الله عليكসালাওয়া-তুল্লাহি আলাইকা
এই বাক্য উচ্চারণ করে এভাবে-‘সালামু দুলাই আলাইকা’। তারপর
এই বাক্য উচ্চারণ করে এভাবে-‘সালামু দুলাই আলাইকা’। তারপর
وعلى آل سيدنا
(ওয়া আলা আলি সাইয়্যিদিনা) এই বাক্য উচ্চারণ করে এভাবে-অলাই আলে সায়্যেদিনা’ ইত্যাদি। এগুলো নিছক উচ্চারণের ভুল নয়; বরং অমার্জনীয় বিকৃতি, যা থেকে বেঁচে থাকা ফরয। দরূদের মতো বরকত ও ফযীলতপূর্ণ আমলের ক্ষেত্রে আল্লাহ আমাদের আরো সচেতন হওয়ার এবং সহীহ-শুদ্ধভাবে সঠিক পন্থায় বেশি বেশি দরূদ পাঠ করার তাওফীক দিন। আমীন।
একটি বলার ভুল : আলাইহিস সাল্লাম
আমাদের নবীজীর নাম উচ্চারণ করলে আমরা বলি ‘সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’। অন্যান্য নবীগণের নাম উচ্চারণ করলে বলি, ‘আলাইহিস সালাম’। কয়েকজন নবীর নাম উচ্চারণ করলে ‘আলাইহিমুস সালাম’। কিন্তু কিছু মানুষ সাল্লাম ও সালাম-এর মাঝে পার্থক্য করতে পারেন না। ফলে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে আলাইহিস সালাম-এর স্থলে আলাইহিস সাল্লাম বলেন, যা সম্পূর্ণ ভুল।
সঠিক উচ্চারণ হল, প্রথমটির শেষ শব্দ হল ‘সাল্লাম’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম), আর দ্বিতীয়টির শেষ শব্দ হল ‘সালাম’ (আলাইহিস সালাম)।
যিলক্বদ ১৪৩৪ . সেপ্টেম্বর ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ০৮
একটি ভুল প্রচলন
চেয়ারে বসে নামায আদায় করা কি ইচ্ছাধীন বিষয়?
কিছুদিন যাবৎ মহল্লার মসজিদের এক মুসল্লীকে দেখছি যখন তিনি সহজে চেয়ার পান তখন চেয়ারে বসে নামায আদায় করেন। আর পরে আসলে বা চেয়ার না পেলে দাঁড়িয়েই নামায আদায় করেন।
মসজিদগুলোতে চেয়ারের প্রচলন বেড়ে যাওয়ায় কিছু মানুষ হয়ত মনে করেন যে, চেয়ারে বসে নামায আদায় করাটা ইচ্ছাধীন। কোন্ ধরণের ওযর হলে চেয়ারে বসে নামায আদায় করা জায়েয, কোন্ ক্ষেত্রে নামায সহীহ হয় না বা মাকরূহ হয়। কোন্ ক্ষেত্রে চেয়ারে না বসে যমীনে বসে নামায আদায় করতে হয়-এসব বিষয়ে যে শরীয়তের সতন্ত্র বিধান রয়েছে তা মনে হয় এদের জানাই নেই ।
যাদের এ ধরণের ওযর আছে তাদের উচিত নিজ নিজ অবস্থা কোন বিজ্ঞ আলেমের কাছে পেশ করা এবং সঠিকভাবে মাসআলা জেনে আমল করা। সামান্য ব্যাথা হল বা একটু কষ্ট অনুভব হল অমনি নিজ থেকে চেয়ারে বসে নামায আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম আর আমার খবরও নেই যে আমার নামায হচ্ছে না।
এ বিষয়ে মৌলিক কথা হল, যে ব্যক্তি দাঁড়িয়ে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পদ্ধতি হল, জমিনে বসে তা আদায় করা। আর যে রুকু সিজদা করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প পন্থা হল, ইশারায় তা আদায় করা। আর যে ব্যক্তি যমিনে বসে নামায আদায় করতে অক্ষম তার জন্য বিকল্প হল, চেয়ারে বসে নামায আদায় করা। কেবলমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় ওযরের কারণে চেয়ারে বসে নামায আদায় করা ঠিক নয়।
সুতরাং আমাদের উচিত এ বিষয় এবং এজাতীয় যে কোন বিষয়ে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিজ্ঞ আলেমের শরণাপন্ন হওয়া।
একটি ভুল ধারণা
দুআয়ে মা’ছূরা কি শুধু ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী যালামতু নাফসী ...’
নামাযের শেষ বৈঠকে দরূদ শরীফের পর দুআয়ে মা’ছূরা পড়তে হয়। এখানে কোন একটি মাসনূন দুআ পড়লেই হয়। একাধিক দুআও পড়া যায়। হাদীস শরীফে এসেছে-
ثم يتخير من المسألة ما شاء
(অর্থ) অতঃপর (দরূদ পাঠের পর) যে দুআ ইচ্ছা পড়বে। (সহীহ মুসলিম,হাদীস : ৪০২)
এক্ষেত্রে বেশি প্রসিদ্ধ হল, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী যালামতু নাফসী...’ এই দুআটি। ফলে অনেকেই মনে করেন দুআ মা’ছূরা শুধু এটিই। এটি ছাড়া এক্ষেত্রে অন্য কোন দুআ পড়লে হবে না। আসলে বিষয়টি তা নয়। বরং এক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসের যে কোন দুআই পড়া যায় এবং কুরআন-হাদীসের যে কোন দুআর মাধ্যমেই এ সুন্নত আদায় হয়ে যায়।
উল্লেখ্য, দুআয়ে মা’ছূর (বহুবচনে আদইয়ায়ে মা’ছূরা) শব্দের অর্থ বর্ণিত দুআ। অর্থাৎ আলকুরআনুল কারীম ও হাদীস শরীফে যেসব দুআর তালীম দেয়া হয়েছে।
হাদীস শরীফে এক্ষেত্রে পড়ার আরো দুআ বর্ণিত হয়েছে। তার মধ্য থেকে একটি হল,
اللهم إني أعوذ بك من عذاب القبر وأعوذ بك من فتنة المسيح الدجال وأعوذ بك من فتنة المحيا والممات، اللهم إني أعوذ بك من المأثم والمغرم
অর্থ: হে আল্লাহ! আমি তোমার আশ্রয় প্রার্থনা করছি কবরের আযাব থেকে, দাজ্জালের ফিৎনা থেকে। আশ্রয় প্রার্থনা করছি জীবন ও মৃত্যুর ফিৎন থেকে। হে আল্লাহ ! আমি আশ্রয় চাচ্ছি গুনাহ ও ঋণ থেকে। (সহীহ বুখারী,হাদীস: ৮৩২; সহীহ মুসলিম,হাদীস: ৫৮৯)
আর আমাদের মাঝে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ যে দুআ তা আবু বকর রা.-এর আবেদনের প্রেক্ষিতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে শিখিয়েছেন।
হাদীস শরীফে এসেছে, হযরত আবু বকর রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে আবেদন করলেন-আমাকে একটি দুআ শিখিয়ে দিন, যা আমি নামাযে পড়ব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এই দুআ কর-
اللهم إني ظلمت نفسي ظلما كثيرا ولا يغفر الذنوب إلا أنت فاغفرلي مغفرة من عندك وارحمني إنك أنت الغفور الرحيم
অর্থ: ইয়া আল্লাহ! আমি নিজের উপর অনেক জুলুম করেছি। আর আপনি ছাড়া গুনাহ মাফকারী আর কেউ নেই। আপনি নিজ অনুগ্রহে আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার প্রতি রহম করুন। নিঃসন্দেহে আপনিই ক্ষমাকারী, করুণাময়।
(সহীহ বুখারী,হাদীস: ৮৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস: ২৭০৫)
একটি ভুল প্রচলন
ডানে শুভলক্ষণ বামে কুলক্ষণ
অনেকে সকালবেলা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পাখি দেখলে ঢিল মারে। এখন পাখিটি যদি ডানে যায় তাহলে মনে করে যাত্রা শুভ। আর যদি পাখিটি বামে যায় তাহলে কুলক্ষণ; যাত্রা আশুভ।
এটি একটি অমূলক ধারণা, যার কোন ভিত্তি নেই। কল্যাণ অকল্যাণ, লাভ ক্ষতি সব আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। এর সাথে পাখির কী সম্পর্ক?! আল্লাহ চাইলে আমার কল্যাণ হবে নইলে নয়।
আর কুলক্ষণের এ মানসিকতাকে ইসলাম কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ঘেষিত হয়েছে
لا عدو ولا طيرة ولا هامة ولا صفر
অর্থাৎ রোগ লেগে যাওয়া, কুলক্ষণ, পেঁচা ও সফর-এর কোন বাস্তবতা নেই। (সহীহ বুখারী, হাদীস : ৫৭০৭)
এছাড়া অমূলক ধারণার ভিত্তিতে সকাল বেলা খামোখা নিজের কাজের মনোবল নষ্ট করা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
সুতরাং এমন অমূলক ধারণা পরিত্যাগ করা প্রতিটি মুমিনের অবশ্যকর্তব্য। আল্লাহ আমাদেরকে হেফাযত করুন।
শাওয়াল ১৪৩৪ . আগস্ট ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ০৭
একটি ভুল ধারণা : সন্ধ্যার বাতি
অনেকের ধারণা, মাগরীবের আযান দিলে দোকান পাট বা গাড়িতে বাতি জ্বালাতে হয় নইলে ব্যবসায় ক্ষতি হয়। এটাকে ‘সন্ধ্যার বাতি’ বলে। এ ধরণা ঠিক নয়। সন্ধ্যা হলে প্রয়োজনের খাতিরে এমনিতেই দোকান পাট বা গাড়িতে বাতি জ্বালাতে হয় এর সাথে লাভ ক্ষতির কী সম্পর্ক? লাভ ক্ষতি তো হয় আল্লাহর পক্ষ হতে বাতি; জ্বালা না জ্বালার এখানে কোনো দখল নেই। প্রয়োজন হলে বাতি জ্বালাবে না হলে জ্বালাবে না।
নামের বিকৃত উচ্চারণ : মেহবুব, রেহমান, মেহমুদ
অনেকেই এ নামগুলোকে এভাবে উচ্চারণ করে বা লেখে। এভাবে বলা বা লেখা দুটোই ভুল। এগুলোর সঠিক উচ্চারণ যথাক্রমে ‘মাহবুব’, ‘রহমান’, ‘মাহমুদ’। এগুলো আরবী নাম। প্রতিটি নামের প্রথম অক্ষরে যবর। ওভাবে উচ্চারণ করলে যবরের স্থলে যের হয়ে যায় যা সম্পূর্ণ ভুল। আর ‘রহমান’ নামটি আল্লাহর নাম। এটি নামের দ্বিতীয় অংশ হিসেবে ব্যবহার হয় যেমন মাহবুবুর রহমান। বিশেষত এটা আল্লাহর নাম হওয়ার কারণে এ নামটির বিকৃত উচ্চারণ বড় ধরনের অন্যায়।
একটি ভুল আমল : কুনুতের জন্য তাকবীর বলার সময় কি প্রথমে হাত ছেড়ে তারপর বাঁধতে হয়?
অনেককে দেখা যায় বেতের নামাযে দুআয়ে কুনুতের জন্য তাকবীর বলার সময় প্রথমে নিচের দিকে হাত ছেড়ে দেয় তারপর হাত উঠিয়ে বাঁধে। এটি ঠিক নয়। তাকবীর বলে হাত বাঁধার জন্য নিচের দিকে হাত ছেড়ে দেয়ার প্রয়োজন নেই।
ঈদের নামাযের অতিরিক্ত তাকবীরের ক্ষেত্রেও অনেককে এমনটি করতে দেখা যায়।
একটি ভুল মাসআলা : যে মহিলাকে দিনে চল্লিশ জন বেগানা পুরুষ দেখল সে পুরুষের হুকুমে
কাউকে কাউকে বলতে শোনা যায়, ‘যে মহিলাকে দিনে চল্লিশজন বেগানা পুরুষ দেখল সে পুরুষের হুকুমে’। কথাটি হয়তো এ দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয় যে এ ধরণের ফাসেক নারীদের থেকে অন্য নারীদের দূরে থাকা উচিত-এ ধারণা ঠিক। তাই বলে ঢালাওভাবে এ কথা বলে দেয়া যে এ ধরণের নারী পুরুষের হুকুমে- তা ঠিক নয়। নারী তো নারীই, তার বেলায় নারীর সকল বিধানই প্রযোজ্য। তবে অসৎ সঙ্গ থেকে বেঁচে থাকার জন্য কাফের, ফাসেক ও বেদ্বীন নারীদের থেকে দূরে থাকবে।
তাছাড়া এক্ষেত্রে চল্লিশ সংখ্যারই বা যৌক্তিকতা কোথায়?
উল্লেখ্য, পর্দা লঙ্ঘন করা কবীরা গুনাহ। আর অবিরত এ গুনাহ করতে থাকা অনেক বড় অন্যায়। এ পাপ শুধু নিজের মাঝে সীমাবদ্ধ নয় বরং অন্যকেও পাপ করতে সহায়তা করা হয়, ফলে তার পাপের দায়ও নিজের কাঁধে চলে আসে। পাপের বোঝা ভারী হয়। সুতরাং প্রতিটি নারী পুরুষেরই এ পাপ থেকে বেঁচে থাকা ফরয।
নামের ভুল উচ্চারণ : প্রসিদ্ধ কয়েকজন মুহাদ্দীসের নামের ভুল উচ্চারণ
হাদীসের প্রসিদ্ধ কয়েকজন ইমামের নাম উচ্চারণ করতে বা লিখতে অনেকেই ভুল করেন, এর মধ্যে কয়েকটি গত সংখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে এ সংখ্যায়ও অনুরূপ আরো কয়েকটি উল্লেখ করা হলো।
১. ইমাম দারিমী রাহ.
তাঁর পূর্ণ নাম আব্দুল্লাহ ইবনে আব্দুর রহমান ইবনে ফযল ইবনে বাহরাম ইবনে আব্দুস সামাদ আদ দারিমী (১৮১-২৫৫হি.)। তিনি হাদীসের একজন বড় ইমাম ছিলেন। তাঁর সংকলিত হাদীসের কিতাব ‘সুনানে দারিমী’র নাম আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। তিনি সমরকন্দের অধিবাসী ছিলেন ফলে তাঁকে সমরকান্দীও বলা হয়। আর বনু দারিম-এর দিকে সম্পৃক্ত করে তাঁকে দারিমী বলা হয়। কিন্তু অনেকেই তাঁর নাম বলতে গিয়ে দারিমী (রা-এর মধ্যে যের) এর পরিবর্তে দারামী (রা-এর মধ্যে যবর দিয়ে) বলেন বা লিখে থাকেন যা একেবারেই ভুল। সঠিক উচ্চারণ ‘দারিমী’। বাংলায় সর্বোচ্চ দারেমী (র-তে এ-কার দিয়ে) বলা যায়।
তিনি ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন মুহাদ্দীসের নাম রয়েছে ‘দারিমী’ তাঁদের নামের ক্ষেত্রেও একই কথা।-আল আনসাব, সামআনী ২/৪৪০, তাহযীবুল কামাল ১০/২৮৩-২৮৭
২. ইকরিমা
এ নামে বেশ কয়েকজন সাহাবী ও মুহাদ্দীস রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে প্রসিদ্ধ হলেন, ইকরিমা ইবনে আবু জাহল রা. এবং ইকরিমা মাওলা ইবনে আববাস রাহ.। তাঁদের নাম বলতে বা লিখতে গিয়েও কেউ কেউ ‘ইকরিমা’ (রা-এর মধ্যে যের) এর স্থলে ‘ইকরামা’ (রা-এর মধ্যে যবর দিয়ে) বলে থাকেন যা সম্পূর্ণ ভুল। সঠিক হল, ইকরিমা (রা-এর মধ্যে যের)
৩. ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন রহ.
তাঁর পূর্ণ নাম ইয়াহইয়া ইবনে মায়ীন ইবনে আওন ইবনে যিয়াদ ইবনে বিসতাম ইবনে আব্দুর রহমান (১৫৮-২৩৩ হি.)। তিনি হাদীস শাস্ত্রের একজন বড় ইমাম ছিলেন। হাদীস অধ্যয়নকারী তালিবুল ইলম মাত্রই তাঁর নাম জানেন। কিন্তু অনেকেই তাঁর নাম বলতে গিয়ে নামের দ্বিতীয় অংশ অর্থাৎ পিতার নামের ক্ষেত্রে ভুল করে থাকেন। তাঁর পিতার নাম হলো ‘মায়ীন’ অর্থাৎ মী- মে যবর। কিন্তু অনেকেই বলে থাকেন ‘মুয়ীন’ (মী- মে পেশ দিয়ে) যা সম্পূর্ণ ভুল।
শাবান-রমযান ১৪৩৪ . জুন-জুলাই ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ০৬
নামের ভুল উচ্চারণ : প্রসিদ্ধ দুইজন মুহাদ্দীসের নামের ভুল উচ্চারণ
হাদীসের প্রসিদ্ধ কয়েকজন ইমামের নাম উচ্চারণ করতে বা লিখতে অনেকেই ভুল করেন। তার মধ্য থেকে দুইটি নিম্নে তুলে ধরা হল-
১. ইমাম তবারানী রহ.
তাঁর পূর্ণ নাম সুলাইমান ইবনে আহমাদ ইবনে আইয়ূব আবুল কাসেম আত্তবারানী (২৬০-৩৬০ হি.) তিনি হাদীসের একজন বড় ইমাম ছিলেন। তাঁর সংকলিত কয়েকটি হাদীসের কিতাবের নাম আমরা সচারাচর শুনে থাকি। যেমন মুজামে কাবীর, মুজামে আওসাত, মুজামে ছগীর। কোন কোন সময় সরাসরি মুজামে তবারানী বা তবারানী শরীফ-ও বলা হয়। এক্ষেত্রে যে ভুলটা লক্ষ করা যায় তা হল, ইমাম তবারানী রহ. -এর নাম বলতে গিয়ে অনেকে ‘তিব্রানী’ বলে থাকে যা সম্পূর্ণ ভুল। শামের ‘তবারিয়্যাহ্’-এর দিকে সম্পৃক্ত করে তাঁকে ‘তবারানী’ বলা হয়। সুতরাং তিব্রানী বলা একেবারেই ভুল।-মুজামুল বুলদান, খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ২৪৮ (তবারিয়্যাহ); আলআ’লা, যিরিকলী, খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১৮১
২. ইমাম দারাকুত্নী রহ.
তাঁর পূর্ণ নাম আলী ইবনে ওমর ইবনে আহমাদ ইবনে মাহদী আবুল হাসান আদ্দারাকুতনী (৩০৬-৩৮৫ হি.)। তিনি হাদীসের একজন বড় ইমাম ছিলেন। তাঁর সংকলিত হাদীসের কিতাব ‘সুনানে দারাকুতনী’-এর নাম আমরা প্রায়ই শুনে থাকি। তিনি বাগদাদের ‘দারুল কুত্ন’ নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। এদিকে সম্পৃক্ত করেই তাঁকে ‘দারাকুত্নী’ বলা হয়। কিন্তু অনেকেই তাঁর নাম বলা বা লেখার ক্ষেত্রে ‘দারাকুত্নী’ -এর স্থলে ‘দার্কুতনী বা দারেকুত্নী’ বলে বা লিখে থাকেন যা একেবারেই ভুল। তাঁর নামের সঠিক উচ্চারণ হল, ‘দারাকুত্নী’।-মুজামুল বুলদান, খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২৭৬ (দারুল কুত্ন); আলআ’লাম, যিরিকলী, খন্ড : ৫, পৃষ্ঠা : ১৩০
একটি ভুল মাসআলা : রোযার নিয়ত কি মুখে করা জরুরী?
রোযার নিয়ত নিয়ে অনেকের মধ্যে একটা ভুল ধারণা কাজ করে। অনেকেই মনে করেন, রোযার নিয়ত মুখে করতে হয়। সমাজে যে আরবী নিয়ত প্রচলিত আছে তা বলতে হয়, নইলে কমপক্ষে মুখে এতটুকু বলতে হয় যে, আমি আগামীকাল রোজা রাখার নিয়ত করছি। অন্যথায় নাকি রোযা সহীহ হবে না।
তাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। রোযার জন্য মৌখিক নিয়ত জরুরি নয়; বরং অন্তরে রোযার সংকল্প করাই যথেষ্ট। এমনকি রোযার উদ্দেশ্যে সাহরী খেলেই রোযার নিয়ত হয়ে যায়। সুতরাং এ কথা ভাবার কোন সুযোগ নেই যে, মুখে রোযার নিয়ত না করলে রোযা হবে না।
একটি ভুল প্রচলন : সালামের জবাব না দিয়ে ‘কেমন আছেন’ বলা
অনেক মানুষকেই দেখা যায় সালামের জবাব না দিয়ে বলে, ‘কেমন আছেন?’ বা সালামের উত্তর কোন রকম দিয়ে কেমন আছেন বলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। এ কাজটি ঠিক নয়। কেউ সালাম দিলে তার জবাব দেয়া ওয়াজিব। তাই আগে স্পষ্টভাবে শুনিয়ে সালামের জবাব দিতে হবে, তারপর কুশল বিনিময়ের সময় থাকলে তা করবে।
কিন্তু সালামের জবাব না দিয়ে বা কোন রকম সালামের উত্তর দিয়ে কেমন আছেন বলাটা একেবারেই অনুচিৎ।
রজব ১৪৩৪ . মে ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ০৫
একটি ভুল আমল : বরকতের জন্য সকালে গোলাপজল সন্ধ্যায় আগরবাতি
বিভিন্ন দোকানে বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় বরকতের জন্য সকালে গোলাপজল ছিটায় আর সন্ধ্যা হলে আগরবাতি জালায়।
গোলাপজল একটি সুগন্ধি পানি আর আগরবাতি একটি সুগন্ধি ধূপ। এর সাথে বরকতের কী সম্পর্ক? বরকত তো আসে আল্লাহর পক্ষ থেকে, তাঁর দেওয়া নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে এবং তাঁর কাছে বরকতের দুআর মাধ্যমে। শুকরিয়া আদায় (যবানের মাধ্যমে ও আমলের মাধ্যমে) বরকত লাভের সবচেয়ে বড় উপায়।
আল্লাহ তাআলা আলকুরআনুল কারীমে বলেছেন (অর্থ) তোমাদের প্রতিপালক ঘোষণা করেছেন, যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় কর তাহলে অবশ্যই আমি বাড়িয়ে দিব। ... (ইব্রাহীম ১৪: ৭)
মুমিন বরকত কামনা করবে নেক আমলের মাধ্যমে ও সকাল সন্ধ্যা আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া শিখিয়েছেন-
اللهم ما أصبح بي من نعمة أو بأحد من خلقك، فمنك وحدك لا شريك لك، فلك الحمد ولك الشكر.
সন্ধ্যায় বলবে ما أمسى بي اللهم
অর্থ : হে আল্লাহ এই সকালে (বা এই সন্ধ্যায়) আমি অথবা আপনার যে কোন মাখলুক যত নেয়ামত ভোগ করছে সকল নেয়ামত কেবল আপনারই দান। আপনার কোন শরীক নেই। সুতরাং আপনারই প্রশংসা এবং আপনারই জন্য শোকরগোজারী।
সুতরাং আমরা দ্বীন অনুযায়ী চলার মাধ্যমে ও নেয়ামতের শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে বরকত কামনা করব। কোন রসম-সর্বস্ব বিষয়ের মাধ্যমে নয়।
আরেকটি ভিত্তিহীন কথা : কিয়ামতের দিন কি নবীজী তিন স্থানে বেহুশ হবেন? (নাউযুবিল্লাহ)
মীযান, আমলনামা ও পুলসিরাতের ভয়াবহতা বর্ণনা করতে গিয়ে কাউকে বলতে শোনা গেছে, এই তিন স্থানে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত এই তিন স্থানে বেহুশ হয়ে যাবেন (নাউযুবিল্লাহ)।
এ কথার কোনোই ভিত্তি নেই। এ ধরণের কথা বলা মারাত্নক গুনাহের কাজ। বরং হাদীস শরীফে তো এসেছে, হযরত আনাস রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে কিয়ামতের দিন আমার জন্য সুপারিশের আবেদন জানালাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, (হ্যাঁ) আমি তোমার জন্য সুপারিশ করব। আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল! আমি (সেদিন) আপনাকে কোথায় খুঁজব। নবীজী বললেন, প্রথমে (পুল)সিরাতের কাছে খুঁজবে। বললাম, সেখানে যদি আপনার সাথে আমার সাক্ষাৎ না হয় তাহলে কোথায় খুঁজব? তিনি বললেন, তাহলে আমাকে মীযানের কাছে খুঁজবে। আমি বললাম, সেখানেও যদি আপনাকে না পাই? নবীজী বললেন, তাহলে হাউজের (হাউজে কাউসার) কাছে খুঁজবে। কারণ আমি সেদিন এই তিন স্থানের কোনো না কোনো স্থানে থাকবই।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪৩৩; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১২৮২৫
এর চেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতেও তো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেহুশ হবেন না। হাশরের ময়দানে যখন আল্লাহ তাআলা কঠিন ক্রোধের অবস্থায় থাকবেন। মানুষ সুপারিশের জন্য বড় বড় নবীগণের কাছে যাবে, সকলে অপারগতা প্রকাশ করবেন। অবশেষে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসলে তিনি সুপারিশ করবেন (বিস্তারিত: জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৪৩৪; সহীহ বুখারী, হাদীস : ৩৩৪০)
হ্যাঁ, একথা ঠিক যে, এ সকল স্থানে বান্দাদের অবস্থা অনেক নাজুক ও ভয়াবহ হবে। কিন্তু এ তিন স্থানে নবীজী বেহুশ হয়ে যাবেন এ কথা একেবারেই অবাস্তব।
আল্লাহ তাআলা আমাদের মনগড়া কথা বলা থেকে হেফাজত করুন।
একটি ভিত্তিহীন কথা : আলমে আরওয়াহের সিজদা
জনৈক ব্যক্তিকে বলতে শুনলাম আলমে আরওয়াহে (রূহের জগতে) নাকি আল্লাহ বান্দাদেরকে সিজদার নির্দেশ দেন। তখন যারা প্রথমে সিজদা করেছিল তারা দুনিয়াতে কাফের হবে। আর যারা মাঝখানে সিজদা করেছে তারা দুনিয়াতে মাঝামাঝি বা মধ্যপন্থী আর যারা শেষে সিজদা করেছে তারা প্রথমে কাফের হবে পরে ঈমানদার হয়ে জান্নাতী হবে।
এটি একেবারেই অলীক ও ভিত্তিহীন একটি কথা। কোন বিবেকবান মানুষ তা বলতে পারে না, বিশ্বাস করা তো দূরের কথা। আলমে আরওয়াহে আল্লাহ বান্দাদের সিজদা করতে বলেছেন এমন কথা কুরআন হাদীসের কোথাও নেই। সুতরাং এমনটি বলা বা বিশ্বাস করা কোনটিই ঠিক নয়।
হাঁ, আলমে আরওয়াহে আল্লাহ বান্দাদের থেকে স্বীকারোক্তি নিয়েছেন যার বর্ণনা কুরআন হাদীসে স্পষ্টভাবে এসেছে। সূরা আরাফের ১৭২ নং আয়াতে তা এসেছে-(অর্থ) স্মরণ কর, তোমার প্রতিপালক আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ হতে তার বংশধরকে বের করেন এবং তাদের নিজেদের সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন এবং বলেন, ‘আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই?’ তারা বলে, ‘হাঁ অবশ্যই; আমরা সাক্ষী রইলাম’ ...।
আর হাদীস শরীফেও এর বিস্তারিত বিবরণ এসেছে।
আল্লাহ আমাদের অবাস্তব কথা বলা ও তা বিশ্বাস করা থেকে হেফাজত করুন।
এটি হাদীস নয় : শয়তান ঈদের দিন রোজা রাখে
কিছু মানুষের মুখে এটিকে হাদীস হিসেবে বলতে শোনা যায়। কিন্তু এটা কোনো হাদীসও নয়, কোনো হাদীসের ভাষ্যও নয়। ঈদের দিন রোযা রাখা নিষিদ্ধ সুতরাং ঈদের দিন রোজা রাখা একটি শয়তানী কাজ। সম্ভবত এখান থেকেই কেউ কেউ বলেছে, ঈদের দিন শয়তান রোজা রাখে। আর পরবর্তীতে কেউ সেটাকে হাদীস হিসেবে বর্ণনা করেছে।
জুমাদাল উখরা ১৪৩৪ . এপ্রিল ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ০৪
একটি ভুল ধারণা : গোঁফ স্পর্শ করা পানি পান করা কি হারাম?
অনেক মানুষের ধারণা, পান করার সময় যদি পানি গোঁফ স্পর্শ করে তাহলে সেই পানি পান করা হারাম হয়ে যায়। এ ধারণা ঠিক নয়। হাঁ, হাদীস শরীফে দাড়ি লম্বা করতে বলা হয়েছে আর গোঁফ খাটো করতে বলা হয়েছে। তাই দাড়ি মুন্ডানো বা খাটো করা গুনাহ এবং মোচ বড় করে রাখা না-জায়েয।
একটি ভুল কথা : খোদার পর বাবা-মা তারপর নবীজী!
এ কথাটি লোকমুখে আগেও শুনেছি। কিন্তু কদিন আগে যখন দেশের বড় একজন লেখকের লেখায় কথাটি দেখলাম তখন ভাবলাম এটা আলকাউসারের ‘প্রচলিত ভুল’ বিভাগে আসা দরকার।
এ কথা সত্য যে আল্লাহ তায়ালা মা-বাবার হককে অনেক গুরুত্ব দিয়েছেন এবং মা বাবার সাথে সদাচরণ সন্তানের উপর আবশ্যক করে দিয়েছেন। এমনকি মা-বাবা যদি সন্তানকে কুফ্রী করতে বলে তবুও। কুফরীর ক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করবে না কিন্তু এর পরও তাদের সাথে সদাচরণ করবে।
আলকুরআনুল কারীমে আল্লাহর সাথে শিরক না করার আদেশের সাথে সাথেই মাতা পিতার সাথে সদাচরণের কথা এসেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, (অর্থ) তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ছাড়া অন্য কারো ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে ...। সূরা বনী ইসরাঈল : ২৩
কিন্তু ‘খোদার পরে বাবা মা তারপর নবীজী’ এ জাতীয় কথা কুরআন হাদীসের কোথাও নেই। হাদীস শরীফে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্ট বলেছেন, তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হবে না যতক্ষণ আমি তার কাছে তার পিতা (মাতা) সন্তান এবং সকল মানুষের চেয়ে অধিক প্রিয় না হব। (সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪৪)
বরং নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিজের প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসতে হবে। হাদীস শরীফে এসেছে, তোমরা কেউ ঐ পর্যন্ত মুমিন হবে না, যে পর্যন্ত আমি তার কাছে তার প্রাণের চেয়েও বেশি প্রিয় না হই। (মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৮০৪৭;সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৬৩২)
আলকুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (অর্থ) নবী মুমিনদের কাছে তাদের প্রাণ অপেক্ষা বেশি প্রিয়...। (সূরা আল আহযাব, (৩৩):৬) আল্লাহ আমাদের দ্বীনের সহীহ সমঝ নসীব করুন এবং দ্বীনের মেজায বোঝার তাওফীক দান করুন। আমীন।
এটি হাদীস নয় : আপনার জুতায় আরশ ধন্য হয়েছে
লোকমুখে মেরাজ সম্পর্কে একটি কথা প্রসিদ্ধ আছে যে, মেরাজ রজনীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরশে মুআল্লায় প্রবেশের পূর্বে জুতা খুলতে চাইলে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,
يا محمد! لا تخلع نعليك، فإن العرش يتشرف بقدومك متنعلا ويفتخر على غيره متبركا.
হে মুহাম্মাদ! আপনি জুতা খুলবেন না। (জুতা নিয়েই আরোহন করুন) কেননা, আপনার জুতা নিয়ে আগমনে আরশ ধন্য হবে। এটি বরকত লাভের কারণে অন্যের উপর গর্ববোধ করবে।
কথাগুলো সাধারণ মানুষের মাঝে প্রসিদ্ধ তো আছেই, কোন কোন বক্তার মুখেও শোনা যায়। কিন্তু তা প্রমাণিত নয়। সবগুলোই মনগড়া ও বানানো কথা।
ইমাম রযীউদ্দীন আল-কায্ভীনী (রহ.)কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জুতা নিয়ে আরশ গমন এবং আল্লাহ তাআলার সম্বোধন (হে মুহাম্মাদ! আপনার জুতায় আরশ ধন্য হয়েছে) ইত্যাদি প্রমাণিত কি না। তিনি উত্তরে বলেছিলেন-
أما حديث وطئ النبي صلى الله عليه وسلم العرش بنعله فليس بصحيح ولا ثابت، بل وصوله إلى ذروة العرش لم يثبت في خبر صحيح ولا حسن ولا ثابت أصلا، إنما صح في الأخبار انتهاؤه إلى سدرة المنتهى فحسب.
জুতা পায়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আরশ গমনের হাদীস প্রমাণিত নয়। এমনকিক তিনি (খালি পায়ে) আরশে পৌঁছেছেন এমন কথাও কোন নির্ভরযোগ্যসূত্রে বর্ণিত নেই। সহীহ বর্ণনা মতে তিনি শুধু সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত গমন করেছেন।-সুবুলুল হুদা ওয়ার রাশাদ-শরহুল মাওয়াহেব ৮/২২৩
অপর এক মুহাদ্দিসের ভাষ্য-
আল্লাহ তাআলা তাকে ধ্বংস করুন, যে বলে তিনি জুতা নিয়ে আরশে আরোহণ করেছেন। কত ঔদ্ধত্য! কত বড় স্পর্ধা!! যিনি শিষ্টাচারীদের সরদার, যিনি আরেফবিল্লাহগণের মধ্যমণি, তাঁর ব্যাপারে এমন কথা! তিনি আরো বলেন যে, রযীউদ্দীন আল-কাযভীনীর উত্তরই সঠিক। প্রায় চল্লিশজন সাহাবী থেকে সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মেরাজ তথা উর্ধ্ব জগতে গমনের ঘটনা বর্ণিত আছে। এঁদের কারো হাদীসে এ কথা উল্লেখ নেই যে, সে রাতে তাঁর পায়ে জুতা ছিল। এ কথা কতক গন্ডমূর্খ কিসসা-কাহিনীকারদের কাব্যে এসেছে। ... কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত হাদীসে বা দুর্বলসূত্রে বর্ণিত হাদীসেও এ কথা নেই যে, তিনি আরশে আরোহন করেছেন। এটি কারো বানানো কথা, এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা যায় না।-শরহুল মাওয়াহেব ৮/২২৩
আহমদ ইবনে মুহাম্মাদ মাক্কারী (রহ.) স্বরচিত গ্রন্থ ফাতহুল মুতাআল ফী মাদহি খাইরিন নিআল-এ উপরোক্ত কথাটিকে জাল বলে জানিয়েছেন।-আল আসারুল মারফুআ ৩৭
আরো দ্রষ্টব্য : গায়াতুল মাকাল ফীমা ইয়াতাআল্লাকু বিন্নিআল : আল্লামা লাখনোভী (রহ.)
জুমাদাল উলা ১৪৩৪ . মার্চ ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ০৯
একটি ভুল ধারণা : মায়্যেতের রূহ চল্লিশ দিন বাড়িতে আসা যাওয়া করা
অনেক এলাকায় প্রচলন আছে, কেউ মারা গেলে চল্লিশ দিন বাড়িতে বা যে ঘরে মারা গিয়েছে সে ঘরে আগরবাতি জ্বালিয়ে রাখে । এর কারণ হিসেবে বলে থাকে মায়্যেতের রূহ চল্লিশ দিন পর্যন্ত আসা যাওয়া করে সুতরাং চল্লিশদিন পর্যন্ত আগরবাতি জ্বালাতে হবে ।
এ আমলটি একেবারেই ভিত্তিহীন। যেমন ভিত্তিহীন উপরোক্ত ধারণা।
মৃতের রূহ বাড়িতে আসার বিষয়টি ঠিক নয়। জুমার রাতে বা বিশেষ বিশেষ রাতে মায়্যেতের রূহ বাড়ির দরজায় আসে এ ধরণের কিছু রেওয়ায়াত সমাজে প্রচলিত আছে কিন্তু তা সহীহ নয়।
হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.কে জিজ্ঞেস করা হল, প্রতি জুমার রাতে মুমিনদের রূহ তাদের পরিবারের কাছে আসে-এটা কি ঠিক?
তিনি উত্তরে বলেন, জুমার রাত ও অন্যান্য সময় মৃতের রূহ রাড়িতে আসা প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ের রেওয়ায়াত ছহী নয়। সুতরাং এ বিশ্বাস রাখা ঠিক নয়।-তালিফাতে রশিদিয়্যাহ, পৃ. ২৩৩
একটি অবহেলা : উদাসীনতার সাথে দুআ করা
আমরা অনেক সময় দুআর জন্য হাত তোলার পরও উদাসীন থাকি। বিশেষ করে জুমার দিন বিষয়টি বেশি চোখে পড়ে। মসজিদ থেকে বের হচ্ছে আর হাঁটতে হাঁটতে হাত তুলে দুআ করছে। অর্থাৎ নিছক হাত তুলে আছে। এমনও দেখা যায় যে, হাত তুলে আছে আবার আরেকজনের সাথে গল্পও চলছে বা হাতের আঙ্গুল ফোটাচ্ছে ইত্যাদি। এ সবই উদাসীনতার সাথে দুআ করার শামিল, যা কখনোই উচিত নয়।
হাদীস শরীফে আছে, উদাসীনতার সাথে দুআ করলে আল্লাহ সে দুআ কবুল করেন না। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, দুআ কবুল করা হবে এই বিশ্বাস নিয়ে তোমরা দুআ কর। এবং জেনে রাখ, আল্লাহ তাআলা উদাসীন হৃদয়ের দুআ কবুল করেন না। (দ্র. জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৭৯; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৬৬৫৫; মাজমাউয যাওয়ায়েদ ১০/২২২)
আমাকে দুআয় শরীক হতেই হবে তা তো জরুরী নয়। আমার যদি দুআয় শরীক হওয়ার সময় না থাকে তাহলে শরীক হব না। কিন্তু আল্লাহর সামনে হাত তুলে আমার মনোযোগ থাকবে অন্যদিকে তা কখোনোই সমীচীন নয়।
এটি হাদীস নয় : যারা শিক্ষা লাভ করে ...
যারা শিক্ষা লাভ করে এবং তদনুযায়ী কাজ করে তারাই প্রকৃত বিদ্বান।
একটি পাঠ্য বইয়ের কভার পেজের পিছনে উপরোক্ত কথাটি লেখার পর লেখা হয়েছে ‘-আলহাদীস’ অর্থাৎ এটি একটি হাদীসে নববী।
প্রথম কথা হল, এটি হাদীস নয়; বরং আলী রা.-এর উক্তি। সুতরাং এখানে আল হাদীস এর পরিবর্তে লেখা উচিত ‘-হযরত আলী রা.’।
সুনানে দারেমী (বর্ণনা নং ৩৯৪), ইকতিদাউল ইলমিল আমালা (পৃ.২২) আলজামে লিআখলাকির রাবী ওয়া আদাবিস সামে ( বর্ণনা নং ৩১) ইত্যাদি আরো কিছু কিতাবে এই বর্ণনাটি রয়েছে। সেখানে স্পষ্ট রয়েছে যে, এটা আলী রা. এর উক্তি।
ইলমের দাবীই হল সে অনুযায়ী আমল করা। কুরআন হাদীসে ইলম অনুযায়ী আমল করার প্রতি অনেক তাকিদ এসেছে। ‘ইকতিদাউল ইলমিল আমালা’ (ইলমের দাবী হল আমল) নামে এ বিষয়ে খতীব বাগদাদী রহ. এর স্বতন্ত্র কিতাব রয়েছে। তবে উপরোক্ত উক্তিটি আমাদের জানা মতে হাদীসে বর্ণিত হয়নি। তাই এটিকে হাদীস না বলে আলী রা.-এর উক্তি বলতে হবে।
রবিউল আওয়াল-রবিউস সানী ১৪৩৪ . ফেব্রুয়ারি ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ০২
একটি ভুল কাজ : কুরআন তিলাওয়াত চালু করে অন্য কাজ করা
অনেক মানুষকে দেখা যায় ক্যাসেট বা কম্পিউটারে কুরআন তিলাওয়াত চালু করে অন্য কাজ করতে থাকে। তিলাওয়াত একেবারেই শুনছে না বা কাজের কারণে তিলাওয়াতের প্রতি মনোযোগ দিতে পারছে না। বা একটা কিছু শুনতে শুনতে কাজ করার অভ্যাস তাই তিলাওয়াত ছেড়ে রেখেছে। শোনা উদ্দেশ্য নয়। এ কাজটি ঠিক নয়। কুরআন তিলাওয়াত শোনা একটি স্বতন্ত্র আমল। আল কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, (অর্থ) যখন কুরআন তিলাওয়াত হয় তখন তোমরা মনোযোগ সহকারে তা শ্রবণ কর এবং চুপ থাক। যাতে তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করা হয় (সূরা আরাফ, ২০৪) কিন্তু তিলাওয়াত ছেড়ে তা না শোনা এবং অন্য কাজে লিপ্ত থাকা কুরআনের এই হুকুমের খেলাফ।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেও অন্যের থেকে তিলাওয়াত শুনতে পছন্দ করতেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, আমাকে তিলাওয়াত করে শোনাও। বললাম, আপনাকে কুরআন তিলাওয়াত করে শোনাব, কুরআন তো আপনার উপরই নাযিল হয়েছে! রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, আমি অন্যের কাছ থেকে তিলাওয়াত শুনতে পছন্দ করি। আমি সূরা নিসা তিলাওয়াত করতে শুরু করলাম। যখন এই আয়াতে পৌছলাম-(অর্থ) ‘‘যখন আমি প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষী উপস্থিত করব এবং আপনাকে উপস্থিত করব তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষীরূপে, তখন কী অবস্থা হবে?’’ তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, থাম (হে আব্দুল্লাহ!)। আমি নবীজীর দিকে তাকিয়ে দেখি তার দুগন্ড বেয়ে অশ্রু ঝড়ছে। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৫৮২
আল্লাহর কালাম তিলাওয়াত হচ্ছে আর আমি অন্যদিকে মনোযোগ দিব তা হয় না। সুতরাং তিলাওয়াত যখন শুনব তো মনোযোগ দিয়ে তিলাওয়াতই শুনব। আর কাজ করার সময় যদি কিছু শুনতেই হয় তাহলে গুনাহের কিছু না শুনে শরীয়তসম্মত গযল সংগীত শোনা যেতে পারে।
একটি ভিত্তিহীন কাহিনী : সুলাইমান আ. এর যিয়াফত
লোকমুখে প্রসিদ্ধ, হযরত সুলাইমান আলাইহিস সালাম একবার আল্লাহকে বললেন, হে আল্লাহ আমি সকল সৃষ্টিজীবকে এক বছর খাওয়াতে চাই। আল্লাহ বললেন, হে সুলাইমান তুমি তা পারবে না। তখন সুলাইমান আলাইহিস সালাম বললেন, আল্লাহ! তাহলে এক সপ্তাহ। আল্লাহ বললেন, তুমি তাও পারবে না। সুলাইমান আলাইহিস সালাম বললেন, তাহলে একদিন। আল্লাহ বললেন, হে সুলাইমান তুমি তাও পারবে না। একপর্যায়ে আল্লাহ এক দিনের অনুমতি দিলেন। সুলাইমান আলাইহিস সালাম জিন ও মানুষকে হুকুম করলেন, পৃথিবীতে যত প্রকার খাদ্য শস্য আছে এবং হালাল যত প্রকার প্রাণী আছে সব হাযির কর। তারা তা করল। এরপর বিশাল বিশাল ডেগ তৈরী করা হল এবং রান্না করা হল। তারপর বাতাসকে আদেশ করা হল, সে যেন খাদ্যের উপর দিয়ে সদা প্রবাহিত হতে থাকে যাতে খাবার নষ্ট না হয়। তারপর খাবারগুলো সুবিস্তৃত যমিনে রাখা হল। যে যমিনে খাবার রাখা হল তার দৈর্ঘ্য ছিল দুই মাসের পথ। খাবার প্রস্ত্তত শেষ হলে আল্লাহ বললেন, হে সুলাইমান! কোন্ প্রাণী দিয়ে শুরু করবে? সুলাইমান আ. বললেন, সমুদ্রের প্রাণী দিয়ে। তখন আল্লাহ সাগরের একটি বড় মাছকে বললেন, যাও সুলাইমানের যিয়াফত খেয়ে এস। তখন মাছটি সমুদ্র থেকে মাথা উঠিয়ে বললো, হে (আল্লাহর নবী) সুলাইমান, আপনি নাকি যিয়াফতের ব্যবস্থা করেছেন? তিনি বললেন, হাঁ, এইতো খাবার প্রস্ত্তত, তুমি শুরু কর। তখন সে খাওয়া শুরু করল এবং খেতে খেতে খাবারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পৌছে গেল। সব খাবার শেষ করে ফেলল। তারপর বলল, আমাকে আরো খাবার দিন, আমি এখনও তৃপ্ত হইনি। তখন সুলাইমান আলাইহিস সালাম বললেন, তুমি সব খাবার খেয়ে ফেলেছ তাও তোমার পেট ভরেনি। তখন মাছ বলল, মেজবান কি মেহমানের সাথে এভাবে কথা বলে? হে (আল্লাহর নবী) সুলাইমান! শুনে রাখুন, আমার রব আমাকে প্রতিদিন এর তিন গুণ খাবার দেন। আজ আপনার কারণে আমাকে কম খেতে হল। এ কথা শুনে সুলাইমান আ. সিজদায় লুটিয়ে পড়লেন...।
এ ঘটনাটি একেবারেই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। হাদীস, তাফসীর বা ইতিহাসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থে এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাছাড়া এ ঘটনার মাঝে এমন কিছু বিষয় আছে যা নিজেই প্রমাণ করে যে, ঘটনাটি সত্য নয়।
১. একজন নবী এমন উদ্ভট ও অযৌক্তিক আবদার করবেন তা হতে পারে না। এর অর্থ দাড়ায় আল্লাহর মাখলুক সম্পর্কে তার ন্যূনতম ধারণা নেই। একজন নবীর শানে এ রকম ধারণা করা সমীচীন নয়। ২. আল্লাহ নিষেধ করার পরও একজন নবী এরকম আবদার করতে থাকবেন। আর আল্লাহও তাকে এমন অযৌক্তিক বিষয়ের অনুমতি দিয়ে দিবেন তা কীভাবে হয়?
৩. পৃথিবীর সকল প্রাণীই কি রান্না করা খাবার খায়? মাছ কি রান্না করা খাবার খায়? ৪. ঘটনায় বলা হয়েছে, খাবার যে যমীনে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে তার দৈর্ঘ্য দুই মাসের পথ। মাছটি কি দুই মাসের পথ মুহূর্তেই অতিক্রম করে ফেলল? বা এত দীর্ঘ পথ জলের প্রাণী স্থলে থাকল কীভাবে? ৪. যে মাছের পেটে এত খাবার সংকুলান হয় সে মাছটি কত বড়! ৫.শুধু বাতাস প্রবাহিত হওয়াই কি পাক করা খাদ্য নষ্ট না হওয়ার জন্য যথেষ্ট? এ ধরনের আরো অযৌক্তিক কথা এ কিচ্ছায় রয়েছে। যা এ ঘটনা মিথ্যা হওয়ার জন্য যথেষ্ট। এমন ঘটনা বর্ণনা করা যেমন বৈধ নয় তেমনি বিশ্বাস করাও মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়।
কোনো প্রকার যাচাই বাছাই ছাড়াই শোনা কথা বলা থেকে আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।
সফর ১৪৩৪ . জানুয়ারি ২০১৩
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৯ . সংখ্যা: ০১
একটি ভুল ধারণা : জায়নামায বিছিয়ে রাখলে কি শয়তান এসে তাতে নামায পড়ে নেয়?
অনেকের ধারণা, নামায পড়ার পর জায়নামায বিছিয়ে রাখলে শয়তান এসে তাতে নামায পড়ে নেয়। এটি একটি ভুল ধারণা। তবে নামায পড়া হয়ে গেলে জায়নামায বিছিয়ে না রাখাই ভাল। কারণ জায়নামায পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র রাখা জরুরী। বিছিয়ে রাখলে তার উপর দিয়ে চলাফেরা হবে। ফলে তা ময়লা হবে। কখনো নাপাকীও লেগে যেতে পারে।
উল্লেখ্য, কিতাব বা কুরআন শরীফের ব্যাপারেও অনেককে এমন ধারণা পোষণ করতে দেখা যায় যে, খুলে রাখলে শয়তান এসে পড়ে নিবে। এ ধারণাও ঠিক নয়। তবে পড়ার পর প্রয়োজন ছাড়া খুলে না রাখাই ভালো।
একটি অনুত্তম আমল : মাসবুক অবশিষ্ট নামাযের জন্য কখন দাঁড়াবে?
নিয়ম হলো, মাসবুক (যে ইমামের সাথে এক বা একাধিক রাকাত পায়নি ) ইমামের দুই দিকে সালাম ফিরানো শেষ হওয়ার পর ছুটে যাওয়া রাকাত আদায় করার জন্য দাঁড়াবে। কিন্তু অনেককে দেখা যায় ইমাম সালাম ফিরানো শুরু করার সাথে সাথে উঠে যায়। এটা অনুত্তম।
এতে আরেকটি সমস্যা এই যে, কখনো ইমাম একদিকে সালাম ফিরানোর পর বরং দুই দিকে সালাম ফিরানোর পরও সাহু সিজদা দেয়ার সম্ভাবনা থাকে। এমতাবস্থায় দাড়িয়ে গিয়ে থাকলে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
এটি হাদীস নয়
লোকমুখে প্রসিদ্ধ, ‘আল্লাহ কোনো বান্দার দিকে ১০ বার রহমতের নজরে তাকালে সে নিয়মিত জামাতে নামাজ পড়তে পারে। আর ৪০ বার তাকালে হজ্ব করতে পারে। আর ৭০ বার তাকালে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে পারে।’ এটি হাদীস নয়। আল্লাহর রহমত ও তাওফিক না হলে বান্দা কোনো ভালো কাজই করতে পারে না। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে আল্লাহ এতবার কারো প্রতি রহমতের দৃষ্টি দিলে সে অমুক আমল করতে পারে, এতবার হলে অমুক ... ইত্যাদি এ ধরনের কোনো রেওয়ায়েত পাওয়া যায় না। সুতরাং তা বর্ণনা করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
একটি অমার্জিত আচরণ : মাইক টেস্টের জন্য কুরআন তিলাওয়াত করা
অনেক সময় মাইক টেস্টের জন্য কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখা যায়। এটা ঠিক নয়। কুরআন তিলাওয়াত একটি ইবাদাতে মাকছুদাহ ও স্বতন্ত্র ইবাদাত। হাদীস শরীফে কুরআন তিলাওয়াতের বহু ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। আর কুরআন হল আল্লাহ্র কালাম, যা সর্বোচ্চ তাযীমের বিষয়। সুতরাং কুরআন তিলাওয়াতকে মাইক টেস্ট ইত্যাদি কাজের মাধ্যম বানানো কখনোই সমীচীন নয়। এটা কালামুল্লাহ্র তাযীমের খেলাফ। অনুরূপভাবে মোবাইলের রিংটোনের জন্যও কুরআন তিলাওয়াতের ব্যবহার অনুচিত। কারণ মোবাইল নিয়ে টয়লেটে প্রবেশের পর কল এলে অপবিত্র স্থানে আল্লাহ তাআলার পবিত্র কালামের ধ্বনি বেজে ওঠে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
আল্লাহ সকলকে দ্বীনের সহীহ সমঝ দান করুন।
একটি ভুল আমল : দোয়ার শেষে কি হাতে চুমু খেতে হয়?
অনেক মানুষকে দোয়া শেষে হাতে চুমু খেতে দেখা যায়। ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা বেশী দেখা যায়। এটা ঠিক নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে হাতে চুমু খাওয়ার কোনো প্রমাণ নেই। সুতরাং তা না করা চাই।
একটি অনর্থক কাজ : খুৎবা চলাকালীন দান বাক্স চালানো
অনেক মসজিদে দেখা যায়, খুৎবা চলা অবস্থায়ও দানবাক্স চলতে থাকে। হাদীস শরীফে খুৎবা চলা অবস্থায় অন্যকে চুপ করতে বলাকেও অনর্থক কাজ বলা হয়েছে। সেখানে খুৎবার সময় দানবাক্স চালানো তো আরো বড় অনর্থক কাজ। সুতরাং তা পরিহার করা জরুরী।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সুন্দরভাবে ওযু করে জুমার জন্য মসজিদে এল তারপর চুপ থেকে খুৎবা শুনল তার দশ দিনের গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। আর যে নুড়ি স্পর্শ করল সে ‘অনর্থক’ কাজ করল।
(দ্র. সহীহ মুসলিম, কিতাবুল জুমুআ, হাদীস : ৮৫৭)
আরেক হাদীসে এসেছে, জুমার দিন খুৎবা চলা অবস্থায় যদি তোমার পাশের সাথীকে বল, ‘চুপ কর’ তাহলে তুমিও একটি অনর্থক কাজ করলে। (দ্র. সহীহ বুখারী, হাদীস ৯৩৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ৯৩১
‘নাহি আনিল মুনকার’ বা গোনাহের কাজ থেকে নিষেধ করা তো ভালো। কিন্তু খুৎবা চলা অবস্থায় সেটাকেও অনর্থক ও গোনাহের কাজ বলা হয়েছে। মসজিদের জন্য দান করা বা দান সংগ্রহ করা নিঃসন্দেহে সওয়াবের কাজ। কিন্তু তা যদি খুৎবা চলা অবস্থায় করা হয় তাহলে তাও অনর্থক ও গোনাহের কাজ বলে গণ্য হবে। এজন্য এ বিষয়ে খুবই সতর্ক থাকা জরুরী।
এখানে এবিষয়টিও বলে দেওয়া সমীচীন মনে হয় যে, মসজিদফান্ডের জন্য দান সংগ্রহ করার এই পদ্ধতি (বাক্স চালনা) কি কোনো আদর্শ পদ্ধতি হতে পারে-এ বিষয়ে চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন। অনেকে এ পদ্ধতিকে পছন্দের দৃষ্টিতে দেখেন না। এজন্য এর উত্তম বিকল্প কী হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা ফিকির করা প্রয়োজন। আসলে তো উচিত ছিল, প্রত্যেক মুসল্লী নিজ নিজ জিম্মাদারিতে স্বীয় অনুদান মসজিদের জিম্মাদারগণের কাছে জমা করে আসবেন। কিন্তু না আমাদের ঈমান অত মজবুত না আমাদের সেই ফুরসত আছে।
মুহাররম-১৪৩৪ . ডিসেম্বর-২০১২
পুরোনো সংখ্যা . বর্ষ: ০৮ . সংখ্যা: ১১
একটি ভুল প্রচলন : বদ নযর থেকে হেফাযতের জন্য শিশুর কপালে টিপ দেওয়া
অনেকে বদ নযর থেকে হেফাযতের উদ্দেশ্যে শিশুর কপালে টিপ দেয়। এটা ঠিক নয়। এটি বদ নযর রোধ করে না। শিশুকে বদ নযর ইত্যাদি থেকে রক্ষা করার জন্য কী করতে হবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শিখিয়েছেন।
সহীহ বুখারীর এক হাদীসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাসান ও হুসাইন রা. এর জন্য এই দোয়া পড়ে আল্লাহর আশ্রয় চাইতেন-
أُعِيْذُكُمَا بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّةِ مِنْ كُلِّ شَيْطَانٍ وَّهَامَّةٍ وَّمِنْ كُلِّ عَيْنٍ لاَمَّةٍ.
অর্থ : সকল শয়তান, কীটপতঙ্গ ও বদনজর হতে তোমাদেরকে আল্লাহর পূর্ণাঙ্গ কালিমাসমূহের আশ্রয়ে দিচ্ছি।
দোয়াটি এক সন্তানের জন্য পড়লে ‘উয়ীযুকা’, দুইজনের জন্য ‘উয়ীযুকুমা’ আর দুইয়ের অধিক হলে ‘উয়ীযুকুম’ বলতে হবে। এর সাথে আয়াতুল কুরসী, তিন কুল ও হাদীসের অন্যান্য দোয়া তো আছেই।
একটি অবহেলা : মেয়ে সন্তান হলে কানে আযান না দেয়া
নিয়ম হলো সন্তান ছেলে হোক মেয়ে হোক ভূমিষ্ট হওয়ার পর ডান কানে আযান ও বাম কানে ইকামত দেওয়া।
কিন্তু দেখা যায়, অনেক মানুষ ছেলে হলে কানে আযান ইকামত দেয় কিন্তু মেয়ে হলে দেয় না বা শুধু আযান দেয় ইকামত দেয় না। এটা ঠিক নয়। এক্ষেত্রে ছেলে সন্তান বা মেয়ে সন্তানের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। এছাড়া অনেকে তো এ আমলটির ব্যাপারেই অবহেলা করেন, যা একেবারেই অনুচিত।
একটি ভুল মাসআলা : গায়রে মাহরামের সাথে কথা বললে কি অযু নষ্ট হয়ে যায়?
অনেকের ধারণা গায়রে মাহরামের (মাহরাম নয় এমন) সাথে কথা বললে অযু নষ্ট হয়ে যায়। এ ধারণা ঠিক নয়। তবে বিনা প্রয়োজনে গায়রে মাহরামের সাথে কথা বলাও জায়েয নয়। এমনকি প্রয়োজনে কথা বললেও তা যেন কোমল স্বরে না হয় সে ব্যাপারেও আলকুরআনুল কারীমে সতর্ক করা হয়েছে। (সূরা আহযাব : ৩২)
মোবাইলে কথা বলার ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি লক্ষ্যণীয়।
একটি ভুল ধারণা : যাকাত কি শুধু রমযান মাসে আদায় করতে হয়?
অনেক মানুষ মনে করে যে, যাকাত শুধু রমযান মাসে আদায়যোগ্য আমল। এ ধারণা ঠিক নয়। নিসাব পরিমাণ সম্পদের উপর এক চান্দ্র বছর অতিবাহিত হলেই সেই সম্পদের যাকাত দেওয়া ফরয। যাকাত ফরয হওয়ার পর দ্রুত আদায় করতে হবে। কিন্তু কোনো কোনো লোককে দেখা যায়, তাদের যাকাতবর্ষ রমযান মাসের আগে, এমনকি ৪/৫ মাস আগে হয়ে যায়। এরপরও তারা তখন যাকাত আদায় করে না; বরং রমযানের অপেক্ষা করতে থাকে। এমন করা আদৌ উচিত নয়। বরং গরীবের পাওনা যত দ্রুত আদায় করা যায় ততই শ্রেয়। হ্যাঁ, যাদের যাকাতবর্ষ রমযান মাসে পূর্ণ হয় তারা রমযানেই আদায় করবেন।
একটি ভুল আমল : ছেলের পিতাও কি পাত্রী দেখবে?
অনেক পরিবারে দেখা যায়, পাত্রী দেখতে গেলে ছেলের পিতাও পাত্রী দেখেন। তারা ভাবেন, ছেলের পিতা তার হবু বৌমা না দেখলে কি হয়? এ কাজটি ঠিক নয়। বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত এই মেয়েটি ছেলের পিতার জন্য দেখা জায়েয নেই। সুতরাং এ কাজটি বর্জন করা উচিত। সাথে সাথে ওলিমার অনুষ্ঠানে কনেকে স্টেজে বসিয়ে আগত নারী-পুরুষ সকল মেহমানকে দেখানো ইত্যাদী সব ধরনের বেপর্দা ও গর্হিত সকল হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা জরুরি।
No comments:
Post a Comment