অমুসলিম দেশে বসবাস : ইসলামী দৃষ্টিকোণ
Khairul Islam 6/03/2022
হানাফী ফিকহ-Hanafi Fiqh
অনেক মুসলিমই উচ্চতর ডিগ্রি এবং জীবনসামগ্রীর আরো উন্নতি,আরো স্বচ্ছলতা-স্বাচ্ছন্দ, দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতার উদ্দেশ্যে আমেরিকা /ইংল্যান্ড / অস্ট্রেলিয়া এর মত অমুসলিম দেশে যেতে চাই সম্ভব হলে একেবারে থেকে যেতে চাই।
উত্তর: এক্ষেত্রে শরয়ী দৃষ্টিকোণ হলো,অমুসলিম দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করা এবং সেখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করা,এটি এমন একটি মাসআলা,যার হুকুম স্থান কাল পাত্র ভেদে,প্রেক্ষাপট পরিস্থিতি এবং বসবাসকারী
ব্যক্তির উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন হওয়ার কারণে হুকুমও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
যার সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নরূপ:
১.কোনো ব্যক্তির যদি স্বীয় মুসলিম দেশে এতটুকু জীবিকা উপার্জনের ব্যবস্থা থাকে,যতটুকু দ্বারা সে নিজ শহরের স্টাটাস অনুযায়ী চলতে পারে। কিন্তু শুধুমাত্র জীবনসামগ্রীর আরো উন্নতি,আরো স্বচ্ছলতা-স্বাচ্ছন্দ, দুনিয়ার ভোগ-বিলাসিতার উদ্দেশ্যে কোনো অমুসলিম দেশে যেতে চায় এবং দারুল হারবের পরিচয় ও জাতীয়তাকে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং সেটাকে দারুল ইসলামের পরিচয় ও জাতীয়তার উপর প্রাধান্য দিয়ে কোনো অমুসলিম দেশের নাগরিকত্ব ও জাতীয়তা অর্জন করা জায়েয নয়। কেননা, এক্ষেত্রে ইহকালীন পরকালীন কোনো প্রয়োজন ছাড়া সেখানকার অশ্লীলতা বেহায়াপনায় নিজেকে নিজে ফেলে দেয়া হচ্ছে। আর বিনা প্রয়োজনে নিজের দ্বীন-ধর্ম, আখলাক-চরিত্র ইত্যাদিকে এক ঝুকির মধ্যে ফেলে দেয়া কোনো অবস্থাতেই বৈধ হতে পারে না।
এ ব্যাপারে অভিজ্ঞতা হলো, যারাই শুধুমাত্র সুখী, সমৃদ্ধি, ভোগ-বিলাসিতার উদ্দেশ্যে কোনো অমুসলিম দেশে বসবাস করছে, তাদের ধর্মীয় চেতনা একেবারে দুর্বল হয়ে যায়। এধরনের লোকেরা কুফরী পরিবেশে থেকে সেখানকার কালচারে উজ্জীবিত হয়ে যায়। আর ধীরে ধীরে তারা কেবল তাদের চেহারা (পোশাক, পোশাক, আকৃতি ও রূপ) এবং অবয়বে কাফেরদের সাদৃশ্যতাই গ্রহণ করে না, বরং কাফেরদের সাদৃশ্যতাকে
নিজেদের জন্য গর্বের কারণ মনে করে, যা স্পষ্টতই হারাম।
একারণে পবিত্র হাদীস শরীফে অত্যন্ত প্রয়োজন ব্যতীত, অমুসলিমদের সাথে বসবাস করাকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।
যেমন, আবু দাঊদ শরীফে হযরত সামুরা ইবনে জুনদুব (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন :
من جامع المشركين وسكن معه، فانه مثله –
“যে ব্যক্তি অমুলিমদের সাথে চলাফেরা করবে এবং তাদের সাথে বসবাস করবে, সেও তাদের অনুরূপ হবে”। (আবু দাঊদ,আবু দাঊদ ২/৩৮৫)
হযরত জারীর ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন :
انا بريئ من كل مسلم يقيم بين اظهر المشركين، قالوا يا رسول الله! لم؟ قال لا ترئ اي نارهما-
“সেসব মুসলমানদের ব্যাপারে আমার কোন দায়-দায়িত্ব নেই, যারা অমুসলিমদের সাথে বসবাস করে। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এর কারণ কি? তিনি উত্তরে বললেন, ইসলামের অগ্নি এবং কুফরীর অগ্নি উভয়টি এক সাথে থাকতে পারেনা। কোনটি মুসলমানের আগুন, কোনটি অমুসলিমের আগুন তোমরা তা পার্থক্য করতে পারবেনা”। আবু দাঊদ ৩/৪৫
আবু দাঊদ শরীফে মাকহূল (রহ.) থেকে মুরসাল রিওয়ায়াত, রাসূলুল্লাহ স. ইরশাদ করেন : “নিজেদের সন্তান-সন্তুতিদেরকে অমুসলিমদের মাঝে ছেড়ে দিওনা”। (তাহযীবুস সুনান লি ইব্ন কায়্যিম ৩/৪৩৭)
একারণে ফুকাহায়ে কিরাম বলেন, শুধুমাত্র চাকরির উদ্দেশ্যে কোনো মুসলিম ব্যক্তির জন্য অমুসলিম দেশে বসবাস করা এবং তাদের সংখ্যায় বৃদ্ধি করা, এটি এমনি একটি কাজ, যার দ্বারা তার ন্যায়পরায়নতা
চরিত্র প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়। (তাকমিলায়ে রাদ্দুল মুখতার ১/১০১)
২.যদি কোনো মুসলমান কোনো কঠিন অজুহাত ও বাধ্যবাধকতার কারণে অমুসলিম দেশে চলে গিয়ে বসবাস শুরু করে,যেমন,কোনো অপরাধ ছাড়াই তারা নিজ দেশে নৃশংসতা ও কারাবরণ করছে এবং এসব জুলুম থেকে বাঁচার অন্য কোনো উপায় না থাকে বা কোনো ব্যক্তি চরম অর্থনৈতিক সংকটের শিকার হয় এবং চেষ্টা সত্ত্বেও ইসলামী দেশে অর্থনৈতিক সম্পদ না পাওয়া যায় এবং তার নিজের ব্যাপারে পূর্ণ আস্থা থাকে যে,সে একটি অমুসলিম দেশে শরিয়া নিয়ম মেনে তার ধর্ম ও ঈমান রক্ষা করতে পারবেন এবং সে দেশে বিদ্যমান মুনকারাত ও অশ্লীলতার সাগরে ডুবে যাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবেন। এমনিভাবে যদি স্ত্রী-সন্তানাদি সাথে থাকে তাহলে তাদের সম্পর্কেও এই আস্থা থাকা শর্ত। তাহলে এ পরিস্থিতিতে তার জন্য অমুসলিম দেশে বসবাস এবং সেখানকার নাগরিকত্ব অর্জন জায়েয। যেমনটা সাহাবায়ে কেরাম রাযি. তাদের স্বদেশে ধর্মের উপর ভিত্তি করে প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড ও পরিস্থিতিতে বিরক্ত হয়ে একটি অমুসলিম দেশে (আবিসিনিয়া) তাদের জীবন রক্ষার জন্য তাদের আশ্রয় নিয়েছিলেন।
৩.এমনিভাবে কোনো ব্যক্তি যদি মুসলিম দেশে হন্যে হয়ে খোঁজাখোঁজি করা সত্ত্বেও জীবিকা উপার্জনের কোন সোর্স ব্যবস্থা করতে না পারে এবং অমুসলিম দেশে বৈধ চাকরি করার উদ্দেশ্যে সেখানে যায় তাহলে সেটাও বৈধ হবে। তবে শর্ত হলো, সেখানে ধর্ম পালনে বাধাপ্রাপ্ত না হতে হবে।কেননা, হালাল জীবিকা অন্বেষণ করাও ফরজ ইবাদতসমূহের পর একটি অন্যতম ফরজ কাজ। আর জীবিকা উপার্জনের জন্য ইসলাম কোনো জায়গাকে নির্দিষ্ট করে দেয়নি।বরং জীবিকা উপার্জনের ব্যাপারে ইসলামের ব্যাপক অনুমতি রয়েছে যে,যেখান থেকে ইচ্ছা করবে সেখান থেকে জীবিকা উপার্জন করতে পারবে।
যেমন কুরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে :
هو الذي جعل لكم الارض ذلولا فامشوا في مناكبها وكلوا من رزقه واليه النشور-
“আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জন্য পৃথিবীকে করেছেন সুগম, সুতরাং তোমরা তাতে ভ্রমণ কর এবং তার দেয়া জীবিকা থেকে আহার কর, তোমাদেরকে তার দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে”। (সূরা মুলক, আয়াত, ১৫)
৪.এমনিভাবে কাফেরদের কাছে দ্বীনের দাওয়াত দিবে, কিংবা সেখানে বসবাসরত মুসলিমদেরকে ইসলামী হুকুম আহকাম শিক্ষা দিবে, কিংবা দ্বীনের উপর অটল অবিচল থেকে শরীয়তের বিধি-বিধান পালনের ব্যাপারে উদ্ধুদ্ধ করবে, এসব উদ্দেশ্যে সেখানে বসবাস করা শুধু কেবল জায়েযই নয়, বরং ছাওয়াবের অধিকারীও হবে। যেমন বহু সাহাবায়ে কিরাম এবং তাবেঈনগণ এধরনের নেক নিয়তে অমুসলিম দেশে বসবাস করছেন। যা পরবর্তীতে তাদের সুমহান জীবন চরিতের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গিয়েছে।
৬.মুসলমানদের উপর গর্ব করার জন্য দারুল ইসলামের উপর দারুল কুফরকে প্রাধান্য দেওয়া, যেন কাফেরদের জীবন ব্যবস্থার ন্যায় তাদের জীবন ব্যবস্থা হয়ে যায় কিংবা তাদের কালচার গ্রহণের জন্য অমুসলিম দেশে বসবাস করে, এসব উদ্দেশ্যে অমুসলিম দেশে বসবাস করা শরী‘আত অনুযায়ী সম্পূর্ণ হারাম।
যেমন হাদিসে এসেছে,
من تشبه بقوم فهو منهم. الحدیث.
(مشکاة المصابیح، کتاب اللباس، الفصل الثاني، ۲/۳۷۵، ط: قدیمی کراچی)
যে ব্যক্তি কোনো জাতির অনুকরণ করে সে তাদেরই একজন। মিশকাতুল মাসাবিহ 2/375
৭. অমুসলিম দেশে প্রথম থেকেই বসবাসরত একজন নওমুসলিম যার জন্য অন্য দেশে বসবাস করা কঠিন এবং সেই দেশে বসবাস করে ইসলাম পালনে বাধাপ্রাপ্ত না হয় তাহলে তার জন্যও সেখানে বসবাসের অনুমতি রয়েছে।
৮.চিকিৎসার জন্য অমুসলিম দেশে যাওয়া,প্রকাশ থাকে যে,এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন,যদি স্বদেশে এটি অসম্ভব হয় তবে অমুসলিম রাষ্ট্রে যাওয়া জায়েয।
৯.যতদূর শিক্ষার ক্ষেত্রে,এটি একটি অত্যন্ত গুরুতর এবং গুরুতর বিষয়।স্পষ্টতই এর জন্য বাসস্থান প্রয়োজন। যে সকল অবস্থায় অমুসলিম দেশে আবাস গ্রহণ করা মাকরূহ বা হারাম সেসব ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য যাওয়া এবং সেখানে বসবাস করা মাকরূহ বা হারাম হবে।
আর যে সকল অবস্থায় অমুসলিম দেশে আবাস গ্রহণ করা জায়েয সেসব ক্ষেত্রে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য যাওয়াও জায়েয হবে।
তবে এক্ষেত্রে বিশেষভাবে মনোযোগ দিতে হবে যে,যদি নিজ দেশে ধর্মীয়,জাগতিক শিক্ষাগত চাহিদা পূরণ করা যায়, তাহলে অবশ্যই এই নোংরা পরিবেশ থেকে দূরে থাকা উচিত। ফাতাওয়ায়ে বাইয়্যিনাত 3/372