গোস্ত বণ্টন নিয়ে প্রচলিত দুটি জিজ্ঞাসার জবাব
প্রশ্ন:
আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ মনে করে, কুরবানীর গোশত তিনভাগে বণ্টন করা জরুরি এবং এতে সামান্য ত্রুটি করলেও কুরবানী হবে না। অথচ অনেক সময় এমন হয়, বিশেষ করে পরিবারের লোকজন বেশি হলে এবং অভাবী হলে নিজের অংশ থেকে এক ভাগ রেখে দুই ভাগ দিয়ে দিলে সে তার পরিবার-পরিজন নিয়ে তৃপ্তির সাথে খেতেই পারে না। আবার দূরের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবকে দাওয়াত করে খাওয়াতে বা তাদের জন্য কিছু গোশত পাঠাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই প্রশ্ন হল, এভাবে প্রথমেই গোশত মেপে মেপে তিনভাগ করে এক ভাগ রেখে বাকি দুই ভাগ বিলিয়ে দেওয়া কতটুকু জরুরি? এতে কমবেশি করার হুকুম কী? বিস্তারিত দলিল-প্রমাণসহ জানতে চাই।
উত্তর:
কুরবানী করা এবং কুরবানীর গোশত দান করা ভিন্ন ভিন্ন দুটি আমল। আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইখলাসের সাথে পশু জবাই করার দ্বারাই কুরবানীর ওয়াজিব আদায় হয়ে যায়। আর কুরবানীকারীর জন্য তার কুরবানীর গোশতের ক্ষেত্রে শরীয়তের নির্দেশনা হল, সে নিজ পরিবার-পরিজনকে নিয়ে খাবে এবং পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, যারা কুরবানীর সামর্থ্য রাখে না তা দেরও দান করবে। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ... (কুরবানীর গোশত) তোমরা খাও, জমা করে রাখো এবং (গরীব-অসহায়দেরও) দান করো। হাদীস : ১৯৭১
অন্য বর্ণনায় আছে, তোমরা খাবে এবং অন্যদেরও খাওয়াবে। সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৯৭৩
তবে দানের ব্যাপারে কুরবানীকারীর উপর শরীয়ত কোনো বাধ্যবাধকতা আরোপ করেনি;বরং প্রত্যেককে তার অবস্থা অনুপাতে দান করতে বলা হয়েছে। অবশ্য সামর্থ্যবানদের জন্য স্বাভাবিক অবস্থায় উত্তম হল, মোটামুটি তিন ভাগ করে এক অংশ গরিব-মিসকিন ও অসহায়দেরকে দান করা, এক অংশ গরীব আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া। আর এক অংশ নিজের জন্য রাখা।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার কুরবানীর গোশতের তিন ভাগের এক ভাগ পরিবার-পরিজনকে দিতেন। আরেক ভাগ গরিব প্রতিবেশীদের দিতেন এবং এক ভাগ ভিক্ষুক ও অসহায়দের দান করতেন। আল মুগনী ১৩/৩৭৯
উল্লেখ্য, এ বণ্টন উত্তম জরুরি বা আবশ্যক নয়। তেমনি একেবারে ওজন করে তিন ভাগ করাও আবশ্যক নয়। বরং কুরবানীকারীর জন্য এতে তারতম্য করার অবকাশ আছে।
আরো উল্লেখ্য যে, এটি যেহেতু একটি মুস্তাহাব আমল তাই সামর্থ্যবানদের এর উপর আমল করা উচিত। আর কারো পরিবারের সদস্য বেশি হলে কিংবা নিজেদের প্রয়োজন বেশি থাকলে সেক্ষেত্রে তারা নিজেদের প্রয়োজন পরিমাণ গোশত রাখতে পারবে, এটা তাদের জন্য অনুত্তম হবে না।
ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪৩৭; বযলুল মাজহূদ ১৩/৪৩; রদ্দুল মুহতার ৬/৩২৮; তাবয়ীনুল হাকায়েক ৬/৪৮৬; ইলাউস সুনান ১৭/২৬২
*****
প্রশ্ন
আমি একজন আমেরিকা প্রবাসী। দীর্ঘদিন যাবত সপরিবারে এখানে আছি। কুরবানী দেশেই করে থাকি। এর একটা কারণ হল আমরা জানি যে, কুরবানীর গোশত তিন ভাগে ভাগ করতে হয়। এক ভাগ নিজের, এক ভাগ আত্মীয়স্বজনের আর এক ভাগ মিসকিনদের। আর মিসকিনদের অংশ কুরবানীদাতারা কেউ খেতে পারবে না। যদি খেতে হয় তাহলে ঐ পরিমাণ গোশতের মূল্য সদকা করে দিতে হবে।
উল্লেখ্য, আমাদের এখানে গরীবের অংশ গ্রহণ করার মতো কেউ নেই, তাই আমি এখানে কুরবানী না করে দেশে কুরবানী করে থাকি।
একজন আলেমের কাছে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের কুরবানী তিন ভাগে ভাগ করতেন। আবার আরেক হাদীসে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমরা যা ইচ্ছা দান কর, যা ইচ্ছা নিজেরা খাও। আমার জানার বিষয় হল-
ক) তিন ভাগ করাটা কি বাধ্যতামূলক?
খ) যদি বাধ্যতামূলক হয় তাহলে মিসকিনদের অংশের হুকুম কী?
গ) যদি বাধ্যতামূলক না হয় তাহলে কুরবানীদাতা কি মিসকীনদের অংশ খেতে পারবেন?
ঘ) আর উপরে উল্লেখিত উভয় হাদীসই কি সহীহ? সহীহ হলে দুই হাদীসের মাঝে সমন্বয় হবে কীভাবে?
আমার মতো এখানের অনেকেরই একই প্রশ্ন। দলীলসহ জানালে কৃতজ্ঞ থাকব।
উত্তর
কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজের জন্য রাখা, এক ভাগ আত্মীয়-স্বজনকে আর এক ভাগ ফকীর মিসকীনকে দেওয়া মুস্তাহাব। তবে এভাবে তিন ভাগে বণ্টন করা জরুরি নয়। কেউ পুরো গোশত নিজের জন্য রেখে দিলেও তার কুরবানী আদায় হয়ে যাবে। তাই আপনি চাইলে যেখানে আছেন সেখানেই কুরবানী করতে পারেন। সেখানে গোশত দেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া না গেলেও কোনো অসুবিধা হবে না।
আর প্রশ্নে যে দুটি হাদীসের কথা উল্লেখ করা হয়েছে উভয় হাদীসই নির্ভরযোগ্য সূত্রে বর্ণিত আছে। প্রথম হাদীসটি হল : হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কুরবানীর গোশত বণ্টন সম্পর্কে বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরবানীর গোশত তিন ভাগ করে একভাগ নিজ পরিবারের জন্য রাখতেন, এক ভাগ গরীব প্রতিবেশীকে দিতেন আর এক ভাগ অন্যান্য গরীব-মিসকীনকে দান করতেন।-আল ওযায়েফ, আবু মুসা আলআসবাহানী, মুগনী ইবনে কুদামা ১৩/৩৭৯-৩৮০
দ্বিতীয় হাদীসটি হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা কুরবানীর গোশত যে পরিমাণ ইচ্ছা খাও, অন্যদেরকে খাওয়াও এবং যতটুকু ইচ্ছা জমা করে রাখ।-সুনানে তিরমিযী, হাদীস : ১৫১০
দ্বিতীয় হাদীস দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, কুরবানীর গোশত বণ্টনের বিষয়টি কুরবানীদাতার ইচ্ছাধীন। অন্যকে না দিলেও গুনাহ হবে না। আর প্রথম হাদীসে কুরবানীর গোশত বণ্টনের উত্তম পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়েছে। তাই উভয় হাদীসের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।
-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৯৭২; মুয়াত্তা, ইমাম মুহাম্মাদ পৃ. ২৮১-২৮২; হিদায়া ৪/৪৫০; উমদাতুল কারী ১০/৫৭-৫৮; বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪; আলবাহরুর রায়েক ৮/১৭৮; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০০; আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৭-৩২